ঋদ্ধিমান কাণ্ডে মুখোশ ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে কুৎসিত মুখ

ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ শুরু হলেই বাঙালির জাত্যভিমান চড়চড়িয়ে বাড়তে থাকে। এমন একটা সময়ে সর্বশেষ বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার ঋদ্ধিমান সাহাকে (বাংলা থেকে নির্বাচিত সর্বশেষ টেস্ট ক্রিকেটার অবশ্য উত্তরপ্রদেশ থেকে এসে কলকাতার বাসিন্দা হয়ে যাওয়া মহম্মদ শামি) ভারতীয় দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সিরিজের জন্য দল ঘোষণা ১৯ ফেব্রুয়ারি হয়ে থাকলেও সংবাদমাধ্যমে আগেই প্রকাশিত হয়েছিল, ভারতীয় দলের কোচ রাহুল দ্রাবিড় নাকি ঋদ্ধিমানকে বলে দিয়েছেন, তাঁকে দলে নেওয়া হবে না। প্রধান নির্বাচক চেতন শর্মা দল ঘোষণা করার পর থেকে ঋদ্ধিমান বেশ কয়েকটা সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলেছেন। সর্বত্রই পরিষ্কার যে সত্যিই তাঁকে দ্রাবিড় সেরকমই বলেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, চেতনও ফোনে বলেছিলেন এরপর থেকে আর ঋদ্ধিমানের কথা ভাবা হবে না। একে ঋদ্ধিমান ধনী ক্রিকেট প্রশাসক বাবার আদরের ছোট ছেলে নন, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা প্রথম প্রজন্মের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার; তার উপর তিনি কলকাতার ছেলে নন, শিলিগুড়ি থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। সেই কারণেই বোধহয় বাঙালির আবেগের এখনো তেমন বিস্ফোরণ ঘটেনি। তার আবেগ উস্কে দেয় কলকাতার যে খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলো, তারাও এখনো ঈষদুষ্ণ; টগবগিয়ে ফুটছে না। এর পাশে সৌরভ গাঙ্গুলির খেলোয়াড় জীবন মনে পড়লে অবাক লাগে।

জীবনের প্রথম দুটো টেস্টে শতরান করার পরে বাংলা কাগজগুলো স্রেফ সৌরভের প্রশংসা করে থামত না। তাঁকে যে কোনো মুহূর্তে বাদ দেওয়া হতে পারে, এমন আশঙ্কা সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হত। ওয়েস্ট ইন্ডিজে সৌরভ একটা টেস্টে বাদ পড়লেন। বাংলা কাগজে টেস্ট ম্যাচের রিপোর্টের থেকেও বেশি জল্পনা কল্পনা হল ভারতীয় দলে কতজন ব্রুটাস আছে তা নিয়ে। অধিনায়ক শচীন যে সৌরভকে মোটেই পছন্দ করেন না, তিনি ছেলেবেলার বন্ধু বিনোদ কাম্বলির জন্যে সৌরভকে বলি দিচ্ছেন — এসব কথা আমরা তখন গোগ্রাসে গিলতাম। আশ্চর্যের ব্যাপার, সৌরভকেই অধিনায়ক শচীন টাইটান কাপে নিজের ওপেনিং পার্টনার করে নিলেন। সেই জুটি একদিনের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা জুটি হয়ে উঠল। ২০০২ সালে অধিনায়ক সৌরভই সেই জুটি কিছুদিনের জন্য ভেঙে দিয়েছিলেন। আর কাম্বলি? তাঁর কেরিয়ার বেশি লম্বা হয়নি। তিনি বহু বছর পরে এক সংবাদমাধ্যমকে দুঃখ করে বলেছিলেন, শচীন আমার ছোটবেলার বন্ধু অথচ আমাকে একটু সাহায্য করল না। করলে আমার কেরিয়ারটা অন্যরকম হতে পারত। অধিনায়ক হিসাবে শচীন যে ঠিক লোকের উপরেই ভরসা করেছিলেন, সৌরভের কেরিয়ারই তার প্রমাণ।

গ্রেগ চ্যাপেলের আমলে তো চ্যাপেল আর দ্রাবিড় হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির জাতীয় শত্রু। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটারটি যে কত বড় বদমাইশ, সে কথা গজাল দিয়ে বাঙালির মাথায় গুঁজে দিয়েছিল কলকাতার সংবাদমাধ্যম। তার ফল পাওয়া গিয়েছিল হাতে নাতে। সেইসময় ইডেন উদ্যানে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একটা একদিনের ম্যাচে গোটা স্টেডিয়াম সমর্থন করেছিল গ্রেম স্মিথের দলকে। ভারতীয় অধিনায়ক বোল্ড হতে দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়েছিলেন। তখন ভারতের বিপক্ষ দলকে সমর্থন করলে গ্রেফতার করার রেওয়াজ ছিল না। দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না।

২০১৮ সালে অস্ত্রোপচারের জন্যে ভারতীয় টেস্ট দলের এক নম্বর উইকেটরক্ষক ঋদ্ধিমানকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল, তাঁর জায়গা নিয়েছিলেন ঋষভ পন্থ। ঋদ্ধিমান যে সেইসময় ভারতের সেরা উইকেটরক্ষক তা নিয়ে কোথাও কোনো বিতর্ক ছিল না, বরং তিনিই বিশ্বসেরা কিনা তা নিয়ে আলোচনা হত। সৈয়দ কিরমানি থেকে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট — কিংবদন্তি উইকেটরক্ষকরা সকলেই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। অথচ ঋদ্ধিমান ফিট হয়ে যাওয়ার পর তৎকালীন অধিনায়ক বিরাট কোহলি আর কোচ রবি শাস্ত্রী কিন্তু তাঁকে তাঁর জায়গা ফিরিয়ে দেননি। ঋষভ ঋদ্ধিমানের অনুপস্থিতিতে ইংল্যান্ডে শতরান করেছিলেন সত্যি, একবার এক ইনিংসে পাঁচটা ক্যাচ নিয়েছিলেন তা-ও সত্যি। কিন্তু তাঁর কিপিং যে মোটেই টেস্ট ক্রিকেটের মানের নয়, তা সাদা চোখেও ধরা পড়ত। বিশেষ করে স্পিনাররা বল করলে একেকসময় ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়াত। তবু ক্রমশ ঋদ্ধি হয়ে গেলেন টিম ম্যানেজমেন্টের দ্বিতীয় পছন্দ, ঋষভ বারবার ব্যর্থ না হলে অথবা আহত না হলে ঋদ্ধির জন্য প্রথম একাদশের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তাতে সময়ে সময়ে বোলারদের উপর নিদারুণ অবিচার হচ্ছে দেখে নতুন সূত্র তৈরি করা হল, বিদেশে কিপিং করবেন ঋষভ আর দেশে ঋদ্ধি। সবসময়ে সেটাও অবশ্য মানা হয়নি। আশ্চর্যের কথা, পড়তি ফর্মের সৌরভকে বাদ দেওয়া হয়েছিল বলে যে সাংবাদিকরা প্রায় ধর্মযুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন, তাঁরা ফর্মে থাকা ঋদ্ধিমানের প্রতি অবিচার নিয়ে বিশেষ শব্দ খরচ করেননি।

ঋষভের ফর্ম মুখ বন্ধ করে রেখেছিল — এই যুক্তি কিন্তু খাটবে না। কারণ প্রমাণিত যোগ্যতার সিনিয়র খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতিতে দারুণ খেলেও তিনি ফিরে আসায় জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে জুনিয়রকে — এমন ঘটনা কোহলি-শাস্ত্রী জমানায় একাধিকবার ঘটেছে। বোলারদের ক্ষেত্রে তো আকছার এমনটা হয়েই থাকে। কিন্তু সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা ব্যাটার করুণ নায়ারের। ২০১৬ সালে চোটের জন্য অজিঙ্ক রাহানে দলের বাইরে থাকায় খেলতে নেমে করুণ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শতরান নয়, দ্বিশতরান নয়, ত্রিশতরান করেছিলেন। পরের টেস্টে কিন্তু রাহানে নিজের জায়গা ফেরত পান। করুণ তারপর আর মাত্র তিনটে সুযোগ পেয়েছিলেন। রাহানেকে জায়গা ফিরিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে তখন অধিনায়ক কোহলি বলেছিলেন, একটা পারফরম্যান্স অন্য একজন খেলোয়াড়ের কয়েক বছরের পরিশ্রমের মূল্য চুকিয়ে দিতে পারে না। আজ রাহানের ফর্ম নেই, দল থেকে বাদ পড়েছেন বলে অনেকেই কোহলির এই মন্তব্য পড়ে নাক সিঁটকাবেন। কিন্তু সেদিন রাহানের গড় ছিল প্রায় পঞ্চাশ। সুতরাং কোহলি ভুল কিছু বলেননি। তবে দু বছরের মধ্যেই ঋষভের নড়বড়ে কিপিং আর একটা শতরান যে কী করে ঋদ্ধিমানের চার বছরের মসৃণ কিপিং আর তিনটে শতরানের চেয়ে বেশি মূল্যবান হয়ে গেল, সে এক রহস্য।

আরও বড় রহস্য হল ব্যোমকেশে আপ্লুত কলকাতা শহরের সংবাদমাধ্যমের এই রহস্য উন্মোচনে উৎসাহের অভাব। সৌরভকে বাদ দিয়ে গ্রেগ চ্যাপেল দুর্গার অসুর হয়ে গিয়েছিলেন। সে সময় ফেলুদার ছবি করার সত্ব সন্দীপ রায় ছেড়ে দিলে, আর রিমেক হুজুগ থাকলে, নির্ঘাত মন্দার বোসের নাম রাহুল দ্রাবিড় করে দেওয়া হত। এ যুগে কিন্তু কলকাতার সংবাদমাধ্যমে কোহলি বন্দনায় ছেদ পড়েনি। তাঁর ট্যাটু থেকে হেলথ ড্রিঙ্ক, প্রেম-অপ্রেম সবই বাঙালিকে ষোড়শোপচারে খাওয়ানো হয়েছে। এমনও নয় যে বাংলার গৌরব সৌরভ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান বলেই ঋদ্ধির ব্যাপারটা মানিয়ে নেওয়া হয়েছে। কারণ সৌরভ বোর্ড সভাপতি হয়েছেন ২০১৯ সালে; ঋদ্ধিমানকে যখন দু নম্বর করে দেওয়া হল, তখন বোর্ড বলে প্রায় কিছুই ছিল না। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত অ্যাড হক কমিটির মাথা হিসাবে বোর্ড চালাচ্ছিলেন বিনোদ রাই। তিনি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল থাকাকালীন মনমোহন সিং সরকারের প্রতি যতটা কড়া ছিলেন, ঠিক ততটাই শিথিল ছিলেন কোহলি-শাস্ত্রীর টিম ম্যানেজমেন্টের প্রতি।

আসলে ভারতীয় ক্রিকেট কোনোদিনই পুরোপুরি ক্রিকেটিয় যুক্তি মেনে চলে না, আর ভারতীয় সাংবাদিকতা বহুদিন হল সাংবাদিকতার যুক্তি মেনে চলে না। ক্রিকেট সাংবাদিকতা তো নয়ই। এ দেশের ক্রিকেট সাংবাদিকতার মহীরুহরা সেই সৌরভ, শচীনদের সময় থেকেই খেলাটিকে ভুলে বাণীতে মনোনিবেশ করেছেন। সৌরভের নয়নাভিরাম কভার ড্রাইভের বিশ্লেষণে নয়, তাঁদের ওস্তাদি ছিল সৌরভ অমুক জায়গা থেকে তমুক জায়গায় যেতে যেতে গাড়িতে কী বললেন তার স্টেনোগ্রাফি করায়। ক্রিকেট সাংবাদিকতাকে সফলভাবে গসিপ সাংবাদিকতায় পরিণত করা হয়েছে গত শতকের শেষ থেকেই।

এখন মুশকিল হল, চেতেশ্বর পূজারা, রাহানে, ঋদ্ধিমানের মত লোকেরা ক্রিকেট খেলতে শিখেছেন। আক্রমণাত্মক ইংরেজি বলতে শেখেননি; বলিউডি নায়িকার সাথে প্রেম করতে পারেননি; মাঠে নেমে স্রেফ ক্যাচ ধরে, স্টাম্পিং করে আর রান করে চলে আসা যে কর্তব্য নয় তা-ও বোঝেননি। ফলে তাঁদের গ্ল্যামার নেই। যার গ্ল্যামার নেই তার খেলা সম্পর্কে লেখার ক্ষমতা আমাদের সাংবাদিকরা হারিয়েছেন, পাঠকের অভ্যাসও নষ্ট করে দিয়েছেন। এখন ঋদ্ধিমান বাদ পড়েছেন বলে আপনি যতই সহানুভূতি দেখান, বিরাট কী খেলেন, টুরের মাঝের বিরতিতে অনুষ্কাকে নিয়ে কোথায় গেলেন — এসব লিখলে আপনি হামলে পড়ে পড়বেন। ঋদ্ধিমান কোন অনুশীলনের জোরে যশপ্রীত বুমরার ঘন্টায় নব্বই মাইল গতিতে ধেয়ে আসা প্রচণ্ড সুইং হওয়া বলও অক্লেশে তালুবন্দি করেন তা নিয়ে লিখলে আপনার পানসে লাগবে। সৌরভ কেবল বাঙালি নন, তাঁর গ্ল্যামার ছিল। কালোকোলো বেঁটেখাটো রোগাসোগা ঋদ্ধির সেটা নেই। আছে বিরাটের, আছে রবি শাস্ত্রীর। তাঁরা ফোন ধরা বন্ধ করে দিলে আমাদের সাংবাদিকরা চোখে অন্ধকার দেখবেন। এখন সোশাল মিডিয়ার যুগ; বাংলা কাগজে, সাইটে বা চ্যানেলে বিরাটের সমালোচনা করে রিপোর্টার নিশ্চিন্তে তাঁর সাথে হেঁ হেঁ করতে যাবেন, সে গুড়ে বালি। ঠিক বিরাটের কানে পৌঁছে যাবে, অমুক জায়গায় তমুক কথা লেখা হয়েছে। আর সহিষ্ণুতায় এই প্রজন্মের তারকারা একেবারে শজারুপ্রতিম। ওসব ঝামেলায় কে পড়তে যাবে বাপু? কী জানি তা দিয়ে তো আর সাংবাদিকতা হয় না এ যুগে, হয় কাকে চিনি তা দিয়ে। বিরাট, রবিকে চিনলেই লাভ। ঋদ্ধিমানকে তো যে টিভিতে খেলা দেখে সে-ও চেনে।

অর্থাৎ যে গ্ল্যামারাস, ক্ষমতাশালী — তার সাতখুন মাফ।

কিন্তু জনরুচিকে সবসময়, সব বিষয়ে ইচ্ছে মতো চালনা করতে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী পারেন না; ক্রিকেট মাঠের উডওয়ার্ড, বার্নস্টাইনরা তো কোন ছার। তাই এই মুহূর্তে ঋদ্ধিমানের বাদ পড়া নিয়ে কিঞ্চিৎ লেখালিখি করতেই হচ্ছে। হাজার হোক, বাঙালি ক্রিকেটার বংশে বাতি দিতে উনিই তো ছিলেন। তাঁকে বাদ দেওয়ায় জাতির ভাবাবেগ বিলক্ষণ ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের ক্রিকেট সাংবাদিকরা বাজার বোঝেন। ঋদ্ধিমানের চোখের জল বিকোবে ভাল। অতএব দ্রাবিড়কে খলনায়ক বানানোর প্রকল্প আবার চালু হয়েছে। যখন ঋদ্ধিমানের হয়ে কলম ধরা উচিত ছিল তখন এঁরা নিদ্রামগন ছিলেন, এখন গগন অন্ধকার করে প্রমাণ করতে নেমেছেন, আটত্রিশে পা দিতে চলা ঋদ্ধিমানকে বাদ দেওয়া ঘোরতর অন্যায়।

সদ্য ভাষা শহিদ দিবস গেল বলে ঋদ্ধিকে শহিদ ঠাওরাতে যতই মন চাক, ক্রিকেটিয় যুক্তি কিন্তু অন্য কথা বলে। ঋষভের ব্যাটিং গড় এখন প্রায় চল্লিশ, ঋদ্ধিমানের তিরিশও নয়। উপরন্তু গত বছরের অস্ট্রেলিয়া সফরে ব্রিসবেনে যে ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলেছেন ঋষভ, মানতেই হবে সে ইনিংস খেলা ঋদ্ধিমানের পক্ষে সম্ভব নয়। ঋষভের কিপিংয়েও উন্নতি হয়েছে সম্প্রতি। তার কারণ হয়ত ঋদ্ধি স্বয়ং। দ্রাবিড়কে খলনায়ক বানানোর জন্য এক সাংবাদিক সম্প্রতি রবি শাস্ত্রীর ইয়াব্বড় সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ঋদ্ধিকে এক নম্বর থেকে দু’নম্বর করে দেওয়া কোচ সেখানে তাঁকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন এমন টিমম্যান দেখা যায় না। নিজে খেলতে পাবে না জেনেও হাতে ধরে ঋষভকে শিখিয়েছে। তাকে এভাবে বিদায় করা অনুচিত।

আরও পড়ুন নিশীথিনী-সম

অর্থাৎ টেস্ট ক্রিকেটে কী করে কিপিং করতে হয় একজন জানত না। তা সত্ত্বেও তাকে খেলানো হয়েছে এবং তাকে খেলতে শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে, যে খেলতে জানত। এখন কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করা হচ্ছে। দ্রাবিড়কে মগনলাল মেঘরাজ বানাতে হবে বলে এক বাঙালি সাংবাদিক এই অশ্রু বিসর্জনের পরিসরটি তৈরি করে দিলেন।

সাংবাদিকদের দোষত্রুটি নিয়ে এত কথা লেখার কি কোনো দরকার আছে? সত্যিই দ্বিধায় ছিলাম। দ্বিধা কাটিয়ে দিল ঋদ্ধিমানের একটি টুইট। ১৯ তারিখ সকালে এক টুইটে ঋদ্ধিমান জানালেন, এতক্ষণ যাঁদের নিন্দা করছি তেমনই এক “শ্রদ্ধেয়” সাংবাদিক সাক্ষাৎকার চেয়েছিলেন। তিনি পাত্তা দেননি বলে সাংবাদিকটি গ্যাংস্টারের কায়দায় হুমকি দিয়েছেন, ফল ভাল হবে না। এই সাক্ষাৎকার-সর্বস্ব সাংবাদিকরা সাংবাদিকতার যতটা ক্ষতি করেন, ততটাই ক্ষতি করেন ক্রিকেটারদের এবং ক্রিকেটের। এঁরাই অফসাইডের রাজা সৌরভকে বোঝাতেন, যে অত সহজে বাউন্ডারি মারতে পারে তার রানিং বিটুইন দ্য উইকেটসে উন্নতি না করলেও চলে। এঁরাই সৌরভের টেকনিকের ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা ধারাভাষ্যকারদের বাঙালিবিরোধী প্রতিপন্ন করতেন। ফলে সৌরভের শর্ট বল খেলার দুর্বলতা রয়েই গেল, নইলে তাঁর মতো প্রতিভাবানের টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র হাজার সাতেক রান আর ৪২ গড় নিয়ে কেরিয়ার শেষ করার কথা নয়। ফলে এই সাংবাদিকদের কুপ্রভাব নিয়ে যতদূর সম্ভব লেখা দরকার বইকি। আগে কেউ ঋদ্ধিমানের মত চ্যাট ফাঁস করে দিয়ে এঁদের কাঠগড়ায় তোলেনি। হয়ত সোশাল মিডিয়া ছিল না বলে তা করা সম্ভবও ছিল না। এখন শোনা যাচ্ছে, বোর্ড নাকি ঘটনার তদন্ত করবে।

সে তদন্তে অবশ্য সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকটির শাস্তির সম্ভাবনা কম, উল্টে ঋদ্ধিমান না শাস্তি পেয়ে যান। কারণ সাংবাদিকরা কেবল নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকতেই শীর্ষস্থানীয় ক্রিকেটার, কোচ, কর্তাদের চাটুকারিতা করেন তেমন নয়। ওঁরা চাটুকারিতা যথেষ্ট পছন্দ করেন এবং ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত নানা এজেন্ডা চরিতার্থ করতে এই সাংবাদিকদের ব্যবহার করে থাকেন। ফলে এই সাংবাদিকদের একেকজন প্রবল ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। নইলে একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারকে এমন হুমকি দেওয়ার ক্ষমতা হবে কী করে?

ঋদ্ধিমানের মত নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেটারের দল থেকে বাদ পড়লে মনখারাপ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনার উত্তাপ কেটে গেলে তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন, এই বয়সে রিজার্ভ কিপার করে না রেখে তাঁকে সোজাসাপ্টা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দিয়ে দ্রাবিড় যথার্থ কাজই করেছেন। ২০ তারিখ ইডেনে ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের পর সাংবাদিক সম্মেলনে দ্রাবিড় পরিষ্কার বলেছেন, তিনি চাননি ঋদ্ধিমানের মত একজন সংবাদমাধ্যম থেকে বাদ পড়ার খবরটা জানুন।৩ বরং সিনিয়র ক্রিকেটারকে আলাদা করে “তোমাকে আর নিতে পারছি না” বলার সৌজন্য ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে খুব কম টিম ম্যানেজমেন্ট এবং নির্বাচন কমিটি দেখিয়েছে। ঋদ্ধি অভিমান করে বলছেন “আমাকে ঘুরিয়ে অবসর নিতে বলা হয়েছে”। তাঁর অভিমানে যে সাংবাদিকদের মাঠের বাইরের মশলাই রান্নার একমাত্র উপকরণ, তারা ছাড়া আর কারো লাভ হচ্ছে না। ভারতীয় ক্রিকেটের দুর্ভাগ্য,সচিন তেন্ডুলকরকে গোটা দুয়েক রেকর্ড ভাঙার জন্য ২০১১ বিশ্বকাপের পরেও খেলতে দেওয়া হয়েছিল। আর মহেন্দ্র সিং ধোনিকে বয়ে বেড়াতে হয়েছিল তিনি প্রবল প্রতাপশালী ক্রিকেট কর্তার কোম্পানির লোক বলে। নইলে ৩৭-৩৮ বছর বয়সের লোকের জায়গা সর্বোচ্চ স্তরের ক্রিকেটে অবশিষ্ট নেই।

আইপিএল সর্বোচ্চ স্তরের ক্রিকেট নয়।

ইনস্ক্রিপ্টে প্রকাশিত

IPL auction: Where privilege holds court

Suhana and Aryan Khan look so like their father that even somebody who has stopped following showbiz and news, shall know they are Shah Rukh Khan’s children the moment he/she sees them. But this Saturday afternoon, while watching the Indian Premier League (IPL) auction I was wondering who the other girl beside them was at the Kolkata Knight Riders table. Wonder does not last in the age of social media. Within a few minutes, I came to know that she is Juhi Chawla’s daughter Jhanvi. The revelation came through a Twitter thread where people were arguing over dynasty. Some were scandalised that Jhanvi, Suhana and Aryan were judging the ability of some hard-working professionals whilst being present at the auction just by privilege of birth. The other lot argued, it was not their fault that they were born to rich and famous parents. Some went to the extent of saying: their parents worked hard, yours didn’t. Deal with it.

I found the conversation more comical than caustic because it reminded me what Rahul Gandhi, India’s most hated dynast, had said in Parliament just ten days ago. “There are two Indias — one for the rich, one for the poor — and the gap between the two was widening,” he had said. “Today, the earnings of 84 percent of Indians have dwindled, pushing them towards poverty.” I couldn’t help laughing. The IPL auction was making people from this 84 percent argue for and against the privilege of the 16 per cent.

We came to know in 2019 that India’s unemployment rate is at a 45-year-old high. The pandemic has only worsened the situation. If Gautama Buddha were alive today and the mother of a jobless youth went to him asking for her son’s/daughter’s job, Buddha would have asked her to bring a handful of mustard from a home where joblessness or pay cuts have not hit. The lady’s only hope would be the hotel where the IPL auction was held. Even during this distress, 204 cricketers found themselves worth Rs. 550 crore.

I am not going to put you off by talking about migrant labourers. I don’t need to. Because even Indian cricketers outside the IPL fold are part of the 84 per cent. If you look around, you will find enough reports about domestic cricketers deep in debt running their family in absence of first-class cricket. But IPL, supposedly, is the fountain that feeds the stream of domestic cricket. That fountain kept flowing during the pandemic, even shifting countries in the midst of waves of crisis. Which all means that the Ranji Trophy not taking place should matter little financially to cricketers, groundsmen, umpires, scorers et al. But it did. The Board, busy keeping the fountain alive, did not care about the stream. Compensation (and a much-needed hike) was announced only in September 2021. One can clearly see the two Indias here. IPL’s India deals in hundreds of crores, the rest of Indian cricket has to suffer an agonising wait for a few lakhs.

Read Troll comes full circle for Kohli and how

Like the debate over dynasty, the point about hard work and talent will obviously rear its beautiful head here. Some will definitely say, “Those who have enough talent and work hard play IPL.” Of course, T20 is the best form of cricket to judge talent and hard work. Don’t let banal commentators and star cricketers doing lip service tell you otherwise. This is not the era where cricketers will be happy receiving Rs one lakh each from a Lata Mangeshkar-led fundraiser, after winning the World Cup. It is the age of Chris Gayle and Kieron Pollard, who are comfortable not playing for their country as they can make a killing playing in T20 leagues all over the world. It is also the age of Liam Livingstone and Tim David, who may never stake a claim to cricketing immortality but are treasured more than World Cup-winning Eoin Morgan and the Bradmanesque Steve Smith. Talent and hard work are so key to IPL success that Paul Valthaty, Manvinder Bisla became footnotes soon after big success; Pravin Tambe succeeded at an age when life insurance policies mature, with a physique Virat Kohli still has nightmares about. There is also the story of hat-trick man Ajit Chandila, who like many others, shone only in IPL. But we shall not talk about these forgottens lest it opens a can of worms.

After every IPL auction, we invariably read some rags to riches stories. A player who has played only tennis ball cricket, someone who was not a professional cricketer even six months back or somebody who has never been selected for any first-class side. In short, you do not necessarily need to come through the dusty ranks of the domestic system to get into the IPL. It wholly depends on your marketability and ability (specifically in short format). A modern day, glorified slave market, the IPL auction is. Then you land on the biggest stage possible and rake in the moolah. Through a system that reduces a rigorous discipline into a TRP-driven melodrama. The other, and more problematic aspect of IPL is that nobody is sure of the logic with which and IPL auction plays out.

Obviously, it would be wrong to grudge young men of this poor, jobless country the chance to get rich. But we tend to forget, rags to riches stories hold charm only because there are more rags than riches. Today India has more billionaires than ever, along with unprecedented unemployment. Talent needs opportunity, to announce its presence and work, to work hard. Both are in short supply for us — the 84 per cent. Celebrating the pomp of IPL and arguing about the privilege of its elite is actually a nice way to laugh at ourselves. The joke actually is on us.

Originally published on newsclick

হিজাব না হলেও হিজাবির পক্ষ নিতেই হবে আমাদের

২০০৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ক্লাসের ছাত্র ছিলাম। একদিন রাখালদার ক্যান্টিনে কয়েকজন সহপাঠিনীর সাথে শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আমার বক্তব্য ছিল, ওগুলো পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের চিহ্ন, অতএব বর্জনীয়। তাদের বক্তব্য ছিল, শাঁখা-সিঁদুর পরলে সুন্দর দেখায়, তাই ওগুলো ভাল। এর অর্ধ দশক পরে আমরা সকলেই বিয়ে করেছি। সেদিনের বন্ধুদের সাথে ২০০৫ সালের পর আর সাক্ষাৎ হয়নি, কিন্তু তারা কেউ বৈপ্লবিক হয়ে উঠে শাঁখা-সিঁদুর ত্যাগ করেছে এমন সংবাদ পাইনি। আমি নিজে মন্ত্র পড়ে বিয়ে করব না, এই দাবিতে কিঞ্চিৎ ধুলো ওড়ানোর পর মন্ত্র পড়েই বিয়ে করেছি। বেঁকে বসেছিলাম বলে আমৃত্যু প্রগতি চর্চা করা, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি করা আত্মীয়রা, কোন মন্ত্রের কী মাহাত্ম্য, কেন মন্ত্র না পড়লে বিয়ে সম্পূর্ণতা পায় না — এসব বুঝিয়েছিলেন। বিয়ের পরে বউয়ের শাঁখা-সিঁদুর পরাও বন্ধ করতে পারিনি। আমার মত অসংখ্য পুরুষ এরপরেও নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ (কেউ কেউ নাস্তিক) বলে। তাতে খুব একটা দোষ দেখি না, কারণ ‘ফিমেল এজেন্সি’। ভারতীয় উপমহাদেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের উচ্চবর্গীয় পুরুষ আমরা। ‘ফিমেল এজেন্সি’ কথাটা ২০০৩ সালে আমার জানাই ছিল না, পরবর্তীকালেও আমার মাতৃভাষায় এই অর্থবোধক কোনো শব্দবন্ধের সন্ধান পাইনি। তাই আমাদের ধারণায় শাঁখা-সিঁদুর কেউ পরে না, সর্বদাই পরানো হয়। হিজাব বা বোরখাও পরানো হয়। কিন্তু বর্তমান বিতর্কে যা জরুরি, তা হল বাঙালি হিন্দু উচ্চবর্গীয় মহিলা ও পুরুষরা অনেকে শাঁখা-সিঁদুর পরায় ফিমেল এজেন্সি থাকে মানলেও হিজাব বা বোরখা পরায় ফিমেল এজেন্সি থাকতে পারে তা মানেন না। ফলে যে মুসলমান পুরুষের বাড়ির মেয়ে, বউরা হিজাবি, তারা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বা নাস্তিক বললে আমরা হাসাহাসি করি। অতএব কর্ণাটকে যা হচ্ছে, তাকে কেবল লিঙ্গ রাজনীতি দিয়ে বিচার করে স্রেফ রাষ্ট্র মেয়েদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে বলে চেঁচামেচি করা মস্ত ফাঁকি। আসলে রাষ্ট্র মুসলমানদের কোণঠাসা করছে, মুসলমান মেয়েদের লেখাপড়া করার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে।

কর্ণাটক সরকার ইতিমধ্যেই রাজ্যের স্কুল, কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে কয়েক দিনের জন্য, এবং গতকাল কর্ণাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ঋতুরাজ আওয়াস্তির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ হিজাবি ছাত্রীদের পিটিশনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত হিজাব বা বোরখা এবং গেরুয়া বস্ত্র — কোনোটাই পরা যাবে না, এমন বলেছেন। ছাত্রীদের আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে এবং দেবদত্ত কামাথ প্রতিবাদ করেন। তাঁদের বক্তব্য, এমন রায় সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত নাগরিকদের স্বাধীন ধর্মাচরণের অধিকার লঙ্ঘন করে। কিন্তু বিচারকরা রাজ্যে শান্তি ফেরাতে চান, এই যুক্তিতে দু পক্ষকেই ধর্মীয় পোশাক পরতে নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ প্রথমত, সাংবিধানিক অধিকার স্থগিত রাখা চলে — এমন দৃষ্টান্ত তৈরি হল। দ্বিতীয়ত, একটা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার একটা ধরনকে তাদের উত্যক্ত করার উদ্দেশ্যে তৈরি বিশেষ আচরণের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে দেওয়া হল। এমনটা করা হল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু মেয়ের স্কুল, কলেজে পড়ার অধিকারকে বিপন্ন করে। নিঃসংশয়ে বলা যায়, হিন্দু মেয়েদের পড়ার অধিকার একটা গোটা রাজ্যে একদিনের জন্যও বিপন্ন হলে “হিন্দু খতরে মে হ্যায়” চিৎকারে কান পাতা দায় হত। তখন বিচারব্যবস্থায় বিশ্বাস রাখা ইত্যাদি ভাল ভাল কথা কারোর খেয়াল থাকত না। টিভি চ্যানেল, সোশাল মিডিয়া, রাস্তাঘাট — সর্বত্র চর্চা হত দেশটা জেহাদিদের হাতে চলে গেছে। কেউ স্বেচ্ছায় হিজাব/বোরখা পরুক আর অনিচ্ছায় পরুক, লেখাপড়া করতে হলে ওটা ত্যাগ করে স্কুল কলেজে আসতে হবে — এই বক্তব্যের আসল উদ্দেশ্য তার লেখাপড়া নিশ্চিত করা নয়, তার লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়।

জনপ্রিয় স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান কুণাল কামরা তাঁর এক শোতে বিজেপি সরকারের তিন তালাক নিষিদ্ধ করা নিয়ে বলেছিলেন, আইনটা পাস হওয়ার পর বিজেপির লোকেদের ঢাকঢোল নিয়ে উল্লাস করতে দেখে ভাবলাম, এরা তো মুসলিম মহিলা নয়! এদের এত উল্লাসের কারণ কী? তারপর বুঝলাম, এরা মুসলিম মহিলাদের ক্ষমতায়নে উল্লসিত নয়। এরা আসলে মুসলিম পুরুষদের বিশেষ সুবিধা চলে যাওয়া উদযাপন করছে। হিজাব বিতর্কেও এ কথা মনে রাখা জরুরি। মুসলমান মেয়েদের হিজাব পরে পড়াশোনা করতে না দেওয়া মানে হিন্দুত্বের এক ঢিলে অনেক পাখি মারা।

শাঁখা-সিঁদুর, ঘোমটা চালু করেছিল পুরুষরা, হিজাবও তাই। অতএব মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদেরও বুঝিয়ে দেওয়া হল, “তোদের মেয়েদেরও আমাদের মর্জি মত চলতে হবে। দ্যাখ কেমন লাগে।” কর্ণাটক হাইকোর্টের মামলার রায় কী হবে জানা নেই, কবে হবে তা-ও অনিশ্চিত। ভারতীয় আদালত “তারিখ পে তারিখ”-এর জন্য প্রসিদ্ধ। তার উপর রায়ে যে পক্ষ অসন্তুষ্ট হবে, তারা হয়ত উচ্চতর আদালতে যাবে। মামলা যত দীর্ঘ হবে, মেয়েগুলোর স্কুল কলেজে যাওয়া তত বেশিদিন বন্ধ থাকবে। ইতিমধ্যে অন্যান্য রাজ্যেও একই হুজ্জত শুরু হবে। উপরন্তু, এরপর দাবি উঠবে হিজাব/বোরখা পরে চাকুরিস্থলেও যাওয়া চলবে না। সব মহিলাই মুসকানের মত অসমসাহসী এমন ভাবার কারণ নেই। তাছাড়া আমরা ভিডিওতে দেখেছি, কিছু ছাত্রছাত্রী হিজাবি মেয়েদের নিজেদের নিরাপত্তায় ঘিরে রেখে কলেজ থেকে বার করে নিয়ে যাচ্ছে। অফিস কাছারিতে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। স্কুল কলেজের পড়ুয়াদের চেয়ে বড়রা বরাবরই বেশি সাম্প্রদায়িক। তার উপর আছেন কতিপয় প্রগতিবাদী। তাঁরা দাড়ি চুলকে বোঝাতে বসবেন, কেন হিজাব প্রতিক্রিয়াশীল, অতএব ওটা ত্যাগ করেই চাকরি করতে বেরোনো উচিত। ঠিক যেমন সবরিমালা মন্দিরে মহিলাদের ঢুকতে দেওয়ার সুপ্রিম কোর্টের আদেশ যখন কেরালা সরকার বলপূর্বক বলবৎ করছিল, তখন অনেক প্রগতিবাদী জোর তর্ক করছিলেন, মন্দিরে ঢোকা ব্যাপারটাই প্রতিক্রিয়াশীল। একটা কমিউনিস্ট সরকার কেন এতে মদত দেবে? অর্থাৎ মহিলারা মন্দিরে ঢুকতে চাইলেও সে ইচ্ছার মূল্য নেই। পুরুষরা প্রগতিশীলতার যে সংজ্ঞা ঠিক করবেন মহিলারা তার বাইরে কিছু ভাবলে তা প্রগতিশীলতা নয়।

বর্তমান বিতর্ক যে হিজাবে থামবে না, মহিলাদের দমন করাতেও নয়, সেটা কিন্তু বুঝে নেওয়া দরকার। সন্দেহ নেই ক্রমশ হিন্দু মহিলারা কী পরে বাইরে বেরোবেন তা নিয়েও গুন্ডামি প্রেরিত বিতর্ক তৈরি করা হবে, কারণ মৌলবাদ এবং সংখ্যাগুরুবাদ তার নিজের সম্প্রদায়ের মহিলাদেরও বন্ধু হয় না। কিন্তু উপস্থিত এ দেশের সংখ্যাগুরুবাদের পাখির চোখ মুসলমানের অধিকার হরণ। অতএব কিছুদিন পর মুসলমান পুরুষের ফেজ পরা নিয়েও আপত্তি করা হবে। বাড়িতে ফেজ পরো, অন্যত্র নয় — এমন বলা হতে পারে। তারপর বলা হবে অত ইঞ্চির বেশি দাড়ি রাখা যাবে না। যে প্রগতিশীলরা আজ ফিমেল এজেন্সিকে পাত্তা দেন না, সব ‘চয়েস’ মেনে নেওয়া যায় না বলেন — তাঁরা সেদিনও নির্ঘাত বলবেন ফেজ পরা আসলে পশ্চাদপরতা, সুতরাং বর্জনীয়। লম্বা দাড়ি রাখার অপকারিতা নিয়েও পশ্চিমবঙ্গের টিভি চ্যানেলে অনায়াসে বিতর্ক চলতে পারে, উত্তর সম্পাদকীয় কলমে লেখালিখি হতে পারে, ছন্দ মিলিয়ে মিষ্টি কবিতাও লেখা হবে নিশ্চয়ই। সে কবিতা ফেসবুকে ভাইরালও হবে। রাজ্য সরকার হয়ত বলবে “আমরা সব ধর্মকে সমান গুরুত্ব দিই। তাই দাড়ি কাটায় বিশেষ ভর্তুকি দেওয়া হবে।” কারণ বাংলা প্রগতিশীল মানুষের রাজ্য।

সন্ধে হলেই বাংলা মেগাসিরিয়ালে দেখা যায় সম্ভ্রান্ত হিন্দু উচ্চবর্ণ একটা লোকের দুটো বউ — একজন স্বীকৃত, আরেকজন এমনি এমনি। দুজনের মধ্যে তীব্র রেষারেষি চলছে, চিত্রনাট্য এমনি এমনি বউয়ের প্রতি সহানুভূতিশীল। স্বীকৃত বউ মানেই দজ্জাল, কুটিল। আবার যে সিরিয়ালের চিত্রনাট্য স্বীকৃত বউয়ের প্রতি সহানুভূতিশীল, সেখানে যত দোষ অন্য মহিলাটির। দুটি ক্ষেত্রেই বাবুটি ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেন না, নেহাত ছলাকলায় পা হড়কে গেছে। এ সম্পর্কে পরিবারের অন্যরা, এমনকি রেজিস্টার্ড স্ত্রীও দেখা যায় নিঃসন্দেহ। শ্বশুরমশাই অকালকুষ্মাণ্ডটিকে ত্যাজ্যপুত্র করতে চাইলেও স্ত্রী বাধা দেন। তাতেই প্রমাণ হয় তিনি কত মহান। ভদ্রজন হাঁ করে এসব গেলেন, তারপর বোরখা পরা বা লম্বা দাড়ির মুসলমান দেখলে বলেন “ওরা ভীষণ গোঁড়া, ব্যাকডেটেড।”

কর্ণাটকের হিজাব কাণ্ডে বোধহয় একটাই লাভ হয়েছে। আক্রমণটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে যাওয়ায় আমাদের কারো কারো শিরদাঁড়া দিয়ে শেষপর্যন্ত ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেছে। আমাদের খেয়াল হয়েছে “এভাবেই শুরু হয়”। ব্যাপারটা ভাল। কারণ কবি বলেছেন, আসলে রাত্রির অবসানে প্রভাত হয় না। যখন চিত্ত জাগে, তখনই প্রভাত হয়। কিন্তু সত্যি কথাটা হল, শুরু অনেক আগেই হয়েছে। আমরা ঘুমোচ্ছিলাম।

সারা ভারতে গরুর মাংস খাওয়া বা নিয়ে যাওয়া বা বিক্রি করার অপরাধে কতজন মুসলমানকে পিটিয়ে মারা হয়েছে — এখন আর তার সঠিক হিসাব পাওয়া মুশকিল হবে। সোশাল মিডিয়ায় “মুসলমান বিক্রেতার থেকে জিনিস কিনবেন না, ওদের অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করুন” বলে ডাক দেওয়া হয়েছে। সে ডাক একেবারে বৃথা যায়নি। লকডাউনের সময়ে মুসলমানরাই করোনা ছড়াচ্ছে, এরকম প্রচারের জেরে পশ্চিমবঙ্গেও কোনো কোনো এলাকায় মুসলমান ফলওয়ালা, সব্জিওয়ালাকে খেদিয়ে দেওয়ার ঘটনা শোনা গেছে। মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করা হয়েছে। প্রথমে দেশব্যাপী আন্দোলন, তারপর অতিমারীর ধাক্কায় সরকার সে আইন প্রয়োগ করে উঠতে পারেনি। বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত, নিজস্ব স্বর আছে এবং হিজাব বা বোরখা পরেন না — এমন মুসলমান মহিলাদের ছবি নিয়ে তাঁদের কাল্পনিক অনলাইন নিলামও হয়েছে।

কিন্তু আমাদের অনেকেরই এতদিন বক্তব্য ছিল, ওসব মুসলমানদের সমস্যা, ওরা বুঝুক গে। এবার বোধহয় একটা মেয়েকে এক পাল ছেলের তাড়া করা দেখে খেয়াল হয়েছে, কলেজে ওই মেয়েটার মত বোরখা বা হিজাব পরা মেয়ের সংখ্যা কম, আমাদের ছেলেমেয়েরাই বেশি। কলেজ গুন্ডামির জায়গা হয়ে উঠলে, এসবের জেরে বন্ধ হয়ে থাকলে আমাদের ছেলেমেয়েদেরও বিপদ। অবশ্য খেয়াল যে হয়েছে, এ হয়ত আমার কল্পনাবিলাস। শুরু যেভাবেই হোক, শেষ যে এভাবে হয় না ইতিহাসে তার প্রমাণ আছে। এখনো যদি না সকলে না বুঝি, যে হিজাবের না হলেও হিজাবির পক্ষ নিতেই হবে, তাহলে আমাদের শেষটাও একইভাবে হবে।

তথ্যসূত্র:

১। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

https://nagorik.net এ প্রকাশিত। ছবি টুইটার থেকে