ভারত-পাক না হলে যাদের লাভ, হলে তাদের বেশি লাভ

তবে কি রাজনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করে ব্যবসায়িক লাভ করার রাস্তা তৈরি করা হয় ভারত-পাক ম্যাচে? মোটেই না।

১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধে যখন সীমান্তে আমাদের জওয়ানরা লড়ছিল, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

সুনীল গাভস্করকে যদি কেউ এই প্রশ্নটা করে বসে, তাহলে ভদ্রলোকের দেশপ্রেম বর্তমান সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রমাণ করা মুশকিল হবে। কারণ তিনি তখন অস্ট্রেলিয়ায় অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশের হয়ে খেলছিলেন। শুধু তা-ই নয়, সেই দলে গাভস্কর, বিষাণ সিং বেদি আর ফারোখ ইঞ্জিনিয়ার যেমন ছিলেন, তেমনি পাকিস্তানের ইন্তিখাব আলম, আসিফ মাসুদ, জাহির আব্বাসরাও ছিলেন। এমনকি যুদ্ধ নিয়ে সেই দলে রসিকতাও হত। যেমন সহখেলোয়াড় রিচার্ড হাটন (ইংল্যান্ড) বলেছিলেন যুদ্ধ করতে করতে ফারোখ যদি ইন্তিখাবের পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে দেন, তাহলেও ইন্তিখাব মরবেন না। ওঁর পেটে চর্বি এতই বেশি, যে বেয়নেট ওখানেই আটকে যাবে। এসব কথা গাভস্কর ‘সানি ডেজ’ নামে তাঁর বইতে সকৌতুকে লিখেছেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিনি বহু স্মরণীয় ইনিংস খেলেছেন, এমনকি শেষ টেস্ট ইনিংসেও অসম্ভব কঠিন পিচে প্রায় শতরান করে ফেলেছিলেন। অর্থাৎ ব্যাটসম্যান গাভস্কর পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের যারপরনাই জ্বালাতন করেছেন। তবু, সত্যিকারের যুদ্ধ চলাকালীনও পাক ক্রিকেটারদের সাথে কী ধরনের বন্ধুত্ব বজায় ছিল তা এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়। আরও বোঝা যায়, ভারত বা পাকিস্তানের সরকারও এই ক্রিকেটারদের একসাথে খেলা নিয়ে মাথা ঘামাননি। তাঁদের কাজ তখন যুদ্ধ পরিচালনা করা। তা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। ক্রিকেটারদের কাজ ক্রিকেট খেলা, তাঁরাও সেটাই করছিলেন। যে দেশের সাথে যুদ্ধ হচ্ছে সে দেশের ক্রিকেটারদের সাথে খেললে মহাভারত অশুদ্ধ হবে — এমন ভাবার ফুরসত ছিল না কারোর।

কিন্তু যুগ বদলেছে। ১৯৯৯ সালের পর থেকে ভারত-পাক যুদ্ধ আর হয়নি (প্রক্সি ওয়ার ১৯৪৭ থেকে কখনো থেমেছে কিনা সন্দেহ)। তবু পাকিস্তানের সাথে ক্রিকেটীয় সম্পর্ক রাখলে সীমান্তের জওয়ানদের অসম্মান করা হবে — এমন বলা হয়। পাকিস্তানের ছায়া মাড়ানোও বারণ। তাই আইপিএলে পর্যন্ত পাকিস্তানের ক্রিকেটার বা কোচ নেই বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। দু দেশের মধ্যে শেষবার সাদা বলের সিরিজ খেলা হয়েছিল ২০১২-১৩ মরসুমে আর শেষ টেস্ট সিরিজ ২০০৭ সালে। যখন কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলে, তখন কিন্তু জওয়ানদের অসম্মান করা হল বলে ভারত সরকার মনে করেন না। ফলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি বা বিশ্বকাপে ম্যাচটা হয়। এই ম্যাচে আইসিসির লক্ষ্মীর ভান্ডার উপচে পড়ে। পৃথিবীর যেখানেই খেলা হোক, অনাবাসী ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা মাঠ ভরিয়ে দেন। সরাসরি টিভি সম্প্রচারের সেদিন মোচ্ছব। যে প্রবল দেশপ্রেমিকরা এমনিতে দু দেশের মধ্যে খেলাধুলোর তীব্র বিরোধী, তাঁরা কেউ ম্যাচটা বয়কট করার ডাক দেন না। টুইটারে টিভি বন্ধ রাখার কোনো হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেনও চলে না।

আসলে সবার উপরে ব্যবসা সত্য, তাহার উপরে নাই। খেলা না হলে রাজনৈতিক লাভ, কিন্তু নিয়মিত খেলা হয় না বলেই আইসিসি টুর্নামেন্টে খেলা হলে ব্যবসায়িক লাভ দ্বিগুণ। আর সে লাভে হস্তক্ষেপ করলে মহাশক্তিধর নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহও অসুবিধায় পড়বেন। তাই রাত পোহালে ওয়ার্ল্ড টি২০-তে যে ভারত-পাক ম্যাচ, কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী হানার প্রতিবাদে সেই ম্যাচে খেলা উচিত নয় — এমন বিবৃতি দেন গিরিরাজ সিংয়ের মত কম গুরুত্বপূর্ণ বিজেপি নেতারা। অনুরাগ ঠাকুর বা অমিত শাহ নন। অমিতবাবুর সুপুত্র নিজেই দেশের ক্রিকেট বোর্ডের হর্তাকর্তা, চাইলেই তো ম্যাচ বয়কট করাতে পারতেন। বিরাট কোহলিদের মাত্র কয়েকটা পয়েন্টের লোকসান হত। কিন্তু পিতা পুত্রকে অমন করতে বলবেন না, কারণ আসল লোকসান হত কয়েকশো কোটি টাকার। কেবল বোর্ড নয়, সরকার-বান্ধব বহু ব্যবসায়ীর।

আরো পড়ুন টুপির আমি টুপির তুমি?

তবে কি রাজনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করে ব্যবসায়িক লাভ করার রাস্তা তৈরি করা হয় ভারত-পাক ম্যাচে? মোটেই না। জর্জ অরওয়েল খেলাধুলো সম্পর্কে বলেছিলেন, এ হল গুলিবর্ষণ না করে যুদ্ধ। কালেভদ্রে হওয়া ভারত-পাক ম্যাচে দু দেশের ক্রিকেটমোদীদের মধ্যে ঘৃণার বান ডাকে, সোশাল মিডিয়ায় খিস্তির ঢল নামে। দু দেশের সরকার তো তেমনটাই চান। বরং অন্য সময় এই ঘৃণা জিইয়ে রাখতে বাড়তি প্রয়াসের দরকার হয়, এই ম্যাচের আগে, পরে পায়ের উপর পা তুলে মজা দেখা যায়।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

‘১৯৯১ থেকে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পথ ত্যাগ করার ফল গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ১০১তম স্থান’

কেবল বলা হয়, সবকিছু খুলে দাও। সারা পৃথিবীতে আজ যতগুলো সফল অর্থনীতি আছে, কোনোটাই সবকিছু খুলে দিয়ে সফল হয়নি।

এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি হয়ে যাওয়া দারুণ অখুশি হওয়ার মত কোনো ঘটনা নয়, বলছেন অর্থনীতিবিদ

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ, অধুনা দিল্লির বাসিন্দা নিত্য নন্দ অর্থনীতির সঙ্গে দীর্ঘকাল যুক্ত রয়েছেন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, শিল্পায়ন, উন্নয়ন এবং পরিবেশগত ইস্যুগুলোতেই তাঁর আগ্রহ বেশি। ভারত সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রক ও সরকারি সংস্থার পরামর্শদাতা হিসাবে বহু বছর ধরে তিনি অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের কাজ করেছেন। তাছাড়া UNCTAD (United Nations Conference on Trade and Development), UNESCAP (United Nations Economic and Social Commission for Asia and the Pacific), UNDP (United Nations Development Programme)-র মত সংস্থা এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের কনসালট্যান্টের ভূমিকাও পালন করেছেন। এই মুহূর্তে তিনি কাউন্সিল ফর সোশাল ডেভেলপমেন্টের ডিরেক্টর। অতি সম্প্রতি লন্ডন ও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই India’s Industrial Policy and Performance: Growth, competition and competitiveness। নাগরিক ডট নেটের সাথে আলাপচারিতায় নিত্যবাবু ভারতের অর্থনীতির অভিমুখ, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পশ্চাদপসরণ থেকে শুরু করে এয়ার ইন্ডিয়ার বেসরকারিকরণ ও বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা সরিয়ে দিলেন।

গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ভারতের মত দেশে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণাকে কতটা উপযোগী বলে মনে করেন? অরবিন্দ কেজরিওয়াল যে বিপুল ভর্তুকি দিয়ে প্রায় জলের দরে বিদ্যুৎ জোগান, বা মমতা ব্যানার্জি যেভাবে নানা প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন জরুরি পরিষেবা বিনামূল্যে নাগরিকদের দিয়ে থাকেন — তাকে কীভাবে দেখেন?

দেখুন, সকলের জন্য ন্যূনতম খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা যে কোনো রাষ্ট্রের কর্তব্য। সেটাও আমরা করে উঠতে পারছি না। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ১১৬টা দেশের মধ্যে ১০১ নম্বরে পৌঁছে গেছি। নেপাল, পাকিস্তানের চেয়েও পিছনে। এই অবস্থায় রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক কাজকর্মের উপযোগিতা আলাদা করে বুঝিয়ে বলার আর দরকার পড়ে না। তবে একটা কথা বলতেই হবে, এই দুর্দশা কিন্তু স্রেফ গত এক-দেড় বছরের নয়। আমরা এই সময়টায় কী দেখলাম? কয়েক লক্ষ মানুষ লকডাউন আরম্ভ হতেই পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে শুরু করলেন। তা এঁরা সব মহানগরগুলোতে কেন এসেছিলেন? কাজ করে একটা ভাল জীবন পাবেন আশা করে তো? কিন্তু ভেবে দেখুন, কতটা ভঙ্গুর তাঁদের অবস্থা, যে এক মাস কাজ না থাকলেই না খেয়ে থাকতে হবে, সেই আশঙ্কায় তাঁরা ফিরে যেতে শুরু করলেন। এই অবস্থা তো আর তক্ষুণি হয়নি। তার মানে আমরা যতই গলা ফাটাই যে ১৯৯১ সালের পরে আমাদের জিডিপি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, আসলে কিন্তু বিরাট অংশের মানুষ চরম দুর্দশার মধ্যে রয়ে গেছে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে আমরা ৯৪ থেকে ১০১ হয়েছি। আগের সংখ্যাটাও কি গর্বের? আসলে গত তিরিশ বছর ধরেই আমরা ক্রমশ জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণা থেকে সরে এসেছি। এগুলো তারই ফল।

আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নটার কোনো সহজ উত্তর নেই। আমি নীতিগতভাবে এইসব পদক্ষেপের বিরোধী নই, কারণ গরীব নাগরিকদের সাহায্য করা দরকার। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু সমালোচনার জায়গা আছে। যেমন ধরুন কেজরিওয়াল যতখানি বিদ্যুৎ ভর্তুকি দিয়ে প্রায় বিনামূল্যে দিচ্ছেন, ততটা বোধহয় কোনো গরীব মানুষের দরকার হয় না। আমি মনে করি না কাউকে বাড়িতে এয়ার কন্ডিশনার চালানোর জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়া উচিত। সেটা পরিবেশরক্ষার দৃষ্টিভঙ্গিতেও খারাপ, অর্থনীতির দিক থেকেও খারাপ। দিল্লিতে কেজরিওয়াল নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থাকে অনেকটা গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু কোভিড অতিমারীতে আমরা দেখলাম এখানকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা কিন্তু তাতেও প্রয়োজন মেটানোর পক্ষে একেবারেই যথেষ্ট নয়। আমার মনে হয় বিদ্যুতে যে পরিমাণ ভর্তুকি দিল্লি সরকার দিচ্ছে, তাতে কাটছাঁট করে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সেই টাকা কাজে লাগালে তা অনেক বেশি জনকল্যাণমুখী হবে।

একটা কথা বলা দরকার। যে দেশটাকে আমরা গণতন্ত্রের স্বর্গ বা মক্কা বলে থাকি, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু আর কিছু থাকুক না থাকুক, গরীব বলেই আপনার ছেলেমেয়ে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে — এমনটা হয় না। ওখানকার সরকারি স্কুলগুলো যথেষ্ট ভাল। নিঃসন্দেহে কিছু বেসরকারি স্কুল আছে যেখানে লেখাপড়ার বাইরেও অনেককিছু শেখানো হয়। ঘোড়ায় চড়া, এটিকেট ইত্যাদি। সেখানে অনেক টাকাপয়সা থাকলে তবেই পড়াশোনা করা যায়। কিন্তু ওগুলো না শিখলেও তেমন ক্ষতি নেই। কিন্তু একজন গরীব ছাত্র বা ছাত্রী যে শিক্ষাটা না পেলেই নয়, তা থেকে কিন্তু বঞ্চিত হবে না। এ কথা কিন্তু আমাদের দেশ সম্বন্ধে নিঃসংশয়ে বলা যায় না। আমি নিজে পশ্চিমবঙ্গে পড়াশোনা করেছি বলে জানি, অনেককিছু ইতিমধ্যে বদলে গিয়ে থাকলেও আজও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্কুলগুলো নেহাত ফ্যালনা নয়। কিন্তু উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলোর অবস্থা মোটেই ভাল নয়। একেবারেই পড়াশোনা হয় না। মানে শেষমেশ ব্যাপারটা এই, যে গরীবের ছেলেমেয়ে শিক্ষার সুযোগ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। ন্যূনতম খাদ্য নিশ্চিত করার মত সবচেয়ে গরীবের ছেলেমেয়েরও ন্যূনতম শিক্ষা নিশ্চিত করাও কিন্তু যে কোনো রাষ্ট্রের কর্তব্য।

আচ্ছা, বিশ্বায়নের যুগে ভারতের মত উদার অর্থনীতি নিয়ে চলেছে যেসব বড় বড় রাষ্ট্র, তারা এখন কোন পথে হাঁটছে? বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদের যে সঙ্কটের কথা আমরা ইদানীং বামপন্থীদের মুখে শুনি, সেটা কতটা ঠিক বা ভুল?

আমাদের দেশে চীন কীভাবে চলেছে, দক্ষিণ কোরিয়া কীভাবে চলেছে, ব্রাজিল বা জার্মানি কীভাবে চলেছে সে সম্পর্কে যা বলা হয় আর আসলে দেশগুলোর অর্থনীতি যেভাবে চলেছে, তার মধ্যে কিন্তু অনেক তফাত আছে। বাম, দক্ষিণ — দু পক্ষই কোথাও না কোথাও পুরো সত্যিটা বলে না। এটাই বাস্তব।

আজ যদি আপনি বলেন চীন উদার অর্থনীতি অবলম্বন করে বিরাট এগিয়ে গেছে সেটা যেমন সম্পূর্ণ মিথ্যে, তেমনি যদি বলেন ওরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নিয়ে এগিয়েছে, তা-ও মিথ্যে। চীন আসলে দুরকম অর্থনীতির একরকম মেলবন্ধনের চেষ্টা করেছে। চীনের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কিন্তু বেশ জোরালো। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে যেমন প্রবল নিয়ন্ত্রণ আছে। ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ আছে। বিশ্বব্যাপী এখন যে চীনা কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ করছে, সেগুলো বেশিরভাগই কিন্তু সরকারি কোম্পানি। এভাবেই চীনের অর্থনীতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যে ফরচুন ৫০০ তালিকায় আমাদের দেশের যতগুলো কোম্পানি থাকে, তার চেয়ে ওদের কোম্পানির সংখ্যা অনেক বেশি।

আবার ছোট দেশ সিঙ্গাপুরের দিকে যদি তাকান। ওদের পাশ্চাত্যের অর্থনীতিবিদরা উদারনৈতিক দেশ বলে থাকেন। আসলে ওদের দেশে আমদানি শুল্ক বেশ কম। এইদিক থেকে ওরা উদার। কিন্তু অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে প্রবল সরকারি নিয়ন্ত্রণ আছে। এমনকি কোনো আবাসনে কোন জনগোষ্ঠীর কতজন লোক থাকবে সেটাও সরকার নিয়ন্ত্রণ করে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় গেলেও দেখতে পাবেন সরকার কিছু ক্ষেত্রে উদার হলেও অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। আসলে সব দেশই নিজের মত করে কোথাও না কোথাও সরকারি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানির মত দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এই সত্যিটা আমাদের দেশের লোকের সামনে বলা হয় না সাধারণত। কেবল বলা হয়, সবকিছু খুলে দাও। সারা পৃথিবীতে আজ যতগুলো সফল অর্থনীতি আছে, কোনোটাই সবকিছু খুলে দিয়ে সফল হয়নি।

আপনার কথা থেকেই এসে পড়ে বেসরকারিকরণের প্রসঙ্গ। সদ্য এয়ার ইন্ডিয়া কিনে নিল টাটা। অনেকে বলছেন জওহরলাল নেহরু পুঁজিপতিদের বিরোধী ছিলেন। তাই এয়ার ইন্ডিয়া টাটাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন, নরেন্দ্র মোদি ফিরিয়ে দিলেন। ভারতীয় অর্থনীতির একটা বড় ভুল এতদিনে সংশোধন করা হল। এই ব্যাখ্যা কতটা ঠিক? কারণ টাটাদের প্রকাশ করা হিসাব অনুযায়ী যখন ভারত সরকার এয়ার ইন্ডিয়া অধিগ্রহণ করেন, তখন তো কোম্পানি ঘাটতিতেই চলছিল, তাই না?

আসলে ১৯৫০-এর দশকে কী হয়েছিল, কেন হয়েছিল — সেগুলো না জেনেই যদি আজ কেন হচ্ছে তা নিয়ে মন্তব্য করি, তাহলে খুব বড় ভুল হয়ে যাবে। সেইসময় আমাদের দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, কোম্পানিগুলোর আর্থিক সঙ্গতির কথা মাথায় রাখা দরকার। এটা ঠিক যে টাটারাই এয়ার ইন্ডিয়ার ব্যবসাটা শুরু করেছিলেন। কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়া যেভাবে বাড়ছিল, তাঁরা কি সেই অনুযায়ী বাড়াতে পারতেন বা বাড়াতেন? সেটা আমরা কেউ জানি না। ১৯৬০-এর দশকে কিন্তু এয়ার ইন্ডিয়া এশিয়ার অন্যতম বড় এয়ারলাইন্স কোম্পানি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। বলা ভাল, এয়ার ইন্ডিয়াকে আমরা, অর্থাৎ আমাদের সরকার, ঠিকমত চালাতে পারল না। বা চালাতে চাইল না। কারণ প্রথমত, মোটামুটি ১৯৮০-র দশক থেকে, আরও বেশি করে ১৯৯১ সাল থেকে, আমরা চাই না কোনোকিছুর মালিকানা সরকারের হাতে থাকুক। এটা এমন একটা আদর্শগত ব্যাপার, যার ভালমন্দ আমরা ভেবে দেখি না। সেই অবস্থান থেকেই এত বছর ধরে এয়ার ইন্ডিয়াকে কী করে পুনরুজ্জীবিত করা যায়, ঠিক করে চালানো যায় — সে চিন্তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিইনি।

দ্বিতীয়ত, মাথায় যদি সাপে কামড়ায় আপনি কোথায় বাঁধন দেবেন? আজ মূল প্রশ্ন হল রাষ্ট্র কি জনকল্যাণের জন্য, নাকি পুঁজিপতিদের ব্যক্তিগত স্বার্থে সমস্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থান তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য? আমি কিন্তু বলছি না, যে নেহরুর সময়ে সবকিছু একেবারে উল্টো ছিল, তিনি পুঁজিপতিদের মোটেই রেয়াত করেননি। তখন সরকারিভাবে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তার সবই যে পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে তা কিন্তু নয়। অনেক ক্ষেত্রেই পুঁজিপতিদের সাহায্য করার জন্যই কাজগুলো করা হয়েছিল। কারণ তখন পুঁজিপতিদের হাতে তেমন টাকা ছিল না। আমাদের পরিকাঠামোগত শিল্প এবং ভারী শিল্প তৈরি করতে বড় বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন ছিল। তেমন বিনিয়োগ করতে পারার মত কটা কোম্পানি ছিল তখন এ দেশে, আর আজ কটা কোম্পানি আছে? দুটো বাস্তবতা একেবারে আলাদা। নেহরু একেবারে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন আর এখন শতকরা একশো ভাগ ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলছে — এমন কথা আমি বলব না। কিন্তু সরকার কিছুই করবে না — আজকের এই যে মতাদর্শ। একে প্রশ্ন করা দরকার।

প্রায় দশ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে এয়ার ইন্ডিয়া যেভাবে লসে রান করছিল, তাতে অদূর ভবিষ্যতে তার কোনো পুনরুজ্জীবনের আশা দেখছিলাম না। সেদিক থেকে এয়ার ইন্ডিয়া সরকারের হাত থেকে চলে যাওয়ায় যে আমরা খুব বেশি কিছু হারালাম তা মনে করার কারণ নেই। কিন্তু এটাও ঠিক যে টাটার কাছে এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি করে দেওয়ার সময়ে কোম্পানির বিপুল পরিমাণ দেনার বোঝা কিন্তু সরকারই ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছে। সরকারের ঘাড় মানেই তো সাধারণ মানুষের ঘাড়। সুতরাং এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি করে মানুষের লাভ হল, তাও বলা যাবে না।

আবার ভেবে দেখুন, এয়ার ইন্ডিয়া চালিয়ে কি একেবারে সাধারণ, গরীব ভারতবাসীর কোনো লাভ হয়? তা কিন্তু নয়। এয়ার ইন্ডিয়ায় যারা কাজ করে তারা সবাই যথেষ্ট ভাল বেতন পায়, বিমানচালক বা বিমানসেবিকার কাজ খুবই গ্ল্যামারাস পেশা হিসাবে সমাজে স্বীকৃত। আমাদের মত দেশে ওই পেশায় অত বেতন না দিলেও কিন্তু চলে। তাছাড়া আমরা যারা এয়ার ইন্ডিয়ার পরিষেবা ব্যবহার করি, তারাও কিন্তু কেউ গরীব লোক নই। সুতরাং গরীব মানুষের এতে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। তবে সব মিলিয়ে একটা সরকারি এয়ারলাইন্স বেসরকারি হয়ে গেল বলে খুব অখুশি হওয়ার কিছু আছে বলে আমি মনে করছি না।

সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, যার মেজরিটি শেয়ার হোল্ডার হল সিঙ্গাপুর সরকারের অধীন টেমাসেক হোল্ডিংস, তারা যথেষ্ট লাভজনক একটি সংস্থা। এমিরেটস, কাতার, এয়ার চায়না, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এয়ারলাইন্সের মত আরও বেশকিছুসরকারি বিমান সংস্থা আছে, যাদের কোভিড-১৯ অতিমারির আগে অব্দি ধারাবাহিক বৃদ্ধি হচ্ছিল এবং লাভে চলছিল। এয়ার ইন্ডিয়া তেমনটা পারল না কেন?

ঠিক কথাই যে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল এয়ারলাইন্স বলে যেগুলো গণ্য হয়, তার অনেকগুলোই পুরোপুরি সরকারি মালিকানায় চলে। আপনি যে নামগুলো করলেন তার মধ্যে আমি আরব দেশের এয়ারলাইন্সগুলোকে একটু আলাদাভাবে দেখি, কারণ ওরা যেহেতু তৈল উৎপাদক দেশ সেহেতু একটা বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। ওরা একেবারে বেস থেকে কম দামে তেল কিনে এয়ারলাইন্সগুলোকে একটু অন্যভাবে চালায়। ফলে ওদের সাথে অন্য এয়ারলাইন্সগুলোর তুলনা করা মুশকিল। কিন্তু সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে তো আর সে যুক্তি খাটে না। থাই এয়ারওয়েজও আলাদা কোনো সুবিধা পায় না। নিউজিল্যান্ড ছোট দেশ ঠিকই, তবু তার সরকারি মালিকানার এয়ারলাইন্স দিব্যি চলছে। এরকম অনেক উদাহরণ তো আছেই। আর্জেন্টিনার কথাও আলাদা করে বলা দরকার। ওদের সরকারি এয়ারলাইন্সের একসময় বেসরকারিকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু বেসরকারিকরণ সত্যি হল কিনা সেটা পরিষ্কার হল না। কারণ কোম্পানিটা কিনল কে? না ইউরোপের এক কোম্পানি। তারপর তারা চালাতে পারল না। যখন দেখা গেল এয়ারলাইন্সটা উঠে যাওয়ার জোগাড়, তখন জাতীয় সম্মানের প্রশ্ন এসে গেল। তাছাড়া কোম্পানি উঠে গেলে বহু কর্মচারী, যারা আর্জেন্টাইন নাগরিক, তাদের চাকরি চলে যাবে। সরকার মনে করল এটা হতে দেওয়া যায় না। তাই অনেক বেশি দামে তারাই আবার এয়ারলাইন্সটা কিনে নিল। আমাদের এখানেও যে সেরকম ঘটবে না সে গ্যারান্টি কেউ দিতে পারবে না।

সরকারের ব্যবসা করা কাজ নয়, ওটা ব্যবসায়ীদের উপরেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। এই যে কথাটা আমরা মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রী থাকার সময় থেকে শুনে আসছি, সেটা কতটা ঠিক বলে মনে করেন? সরকার ব্যবসা না করলে অর্থনীতিতে তার প্রভাব কি সর্বদা ভাল? ভারতীয় কর্পোরেটরা তো অনেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে অপচয় করেছে, যার ফলে বিপুল পরিমাণ নন-পারফর্মিং অ্যাসেটের দায় এখন ব্যাঙ্কগুলোর ঘাড়ে চেপেছে।

মনমোহন সিং কথাটা প্রথম যখন বলেছিলেন, তখন বলেছিলেন সরকারের ব্যবসা না করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মত সামাজিক ক্ষেত্রগুলোকে শক্তিশালী করার দিকে মন দেবে। কিন্তু আমরা দেখতেই পাচ্ছি, হয়েছে কিন্তু তার উল্টো। শুধু যে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ হল তা নয়; শিক্ষা, স্বাস্থ্যকেও তুলে দেওয়া হল বেসরকারি হাতে। তার ফলাফল আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং সরকার ব্যবসা করবে কি করবে না, তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হল ব্যবসা কেন করা হয় আর ব্যবসার সুফল কারা পায়? বেসরকারি হাতে ব্যবসা ছেড়ে দিতে চান ভাল কথা। কিন্তু তার ফল সাধারণ মানুষের জন্য ভাল হবে কিনা সেটা হল আসল কথা। প্রচুর বেসরকারি হাসপাতাল আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো বানানো হয়েছে গত তিরিশ বছরে। তার সুফল কি আমরা পেয়েছি? মনে হয় না, খুব বেশি লোক বলবে পেয়েছি। ঘটছে কী? গরীব পরিবারের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বিদ্যুৎ বা রেলের মত পরিকাঠামোগত শিল্পকে শুধু ব্যবসা হিসাবে দেখা কিন্তু অত্যন্ত অন্যায়। ধরুন রেলওয়ের সাথে যে কীভাবে কত লোক জড়িয়ে আছে তা বলে শেষ করা যাবে না। শুধু যাত্রী আর রেল কোম্পানি নয়, রেলওয়ের নানারকম জিনিসের সাপ্লায়ার, ট্রেন আর প্ল্যাটফর্মের হকার — সকলেই রেলের সাথে যুক্ত। অতএব রেলওয়ে ব্যবসা হিসাবে কতটা লাভ করছে বা করছে না — এই হিসাব দিয়ে যদি রেলওয়ের মূল্যায়ন করা হয়, তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তার ফল হবে মারাত্মক।

একটা ছোট উদাহরণ দিই। ধরুন একজন ব্যবসায়ী দুর্গাপুর থেকে কলকাতায় যাতায়াত করে একটা ছোট ব্যবসা করত। সে শস্তায় কিছু জিনিস বিক্রি করে করেকম্মে খাচ্ছিল। এখন রেলকে লাভজনক করতে গিয়ে আপনি যদি খুব বেশি ব্যয়সাধ্য করে তোলেন, তাহলে এই ধরনের ছোট ব্যবসায়ীর উৎপাদন খরচ কিন্তু বেড়ে যাবে। এরা আবার অনেকে বড় ব্যবসায়ীর সাপ্লাই লাইন হিসাবে কাজ করে। ফলে সেই ব্যবসার উৎপাদন খরচও বাড়বে। এইভাবে সবরকম ব্যবসায়ীর উপরেই চাপ বাড়বে। এক দিকে এসব করবেন আর অন্য দিকে আপনি অভিযোগ করবেন, চীনা জিনিসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছেন না, তারা আপনার বাজার দখল করে নিচ্ছে। আপনি তেলের দাম লিটার পিছু ১০০ টাকার বেশি করবেন, বিদ্যুতের খরচ চীনের দ্বিগুণ করবেন, পরিবহণ খরচ চীনের দ্বিগুণ করবেন। তারপর বলবেন, আমার ব্যবসায়ীরা কোনো কাজের নয়। এ তো কোনো কাজের কথা নয়।

অর্থাৎ সরকার এমন অনেক ব্যবসার সাথে যুক্ত, যেগুলো এক দিকে যেমন মানুষকে, বিশেষ করে গরীব মানুষকে নানারকম পরিষেবা দেয়, তেমনি অন্য দিকে আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থাটাকে সচল রাখে। কম খরচে নানারকম উৎপাদনে এই ক্ষেত্রগুলোর উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। একথা অগ্রাহ্য করে আপনি যদি লাভ কত হল, তা বিচার করেন তা হলে সে বিচার সম্পূর্ণ ভুল।

এই যে বহু বছর ধরে করদাতাদের টাকায় গড়ে ওঠা কোম্পানিগুলো সরকার এমন শর্তে বেসরকারি হাতে তুলে দিচ্ছেন, যা তাদের পক্ষে বেশ সুবিধাজনক। এই সরকারিগুলো সংস্থাগুলোর অবস্থার কিছুটা উন্নতি করে নিয়ে তারপর বিক্রির চেষ্টা করলে কি ভাল হত?

দেখুন, আজ সরকার যদি কোনো সরকারি সংস্থাকে বেসরকারি করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে কাজটা করে ফেলার অনেকরকম উপায় আছে। আপনি করদাতাদের স্বার্থের কথা বললেন। সত্যিই তো। আপনি দুর্গাপুরে যান, রাঁচিতে যান, ভোপালে যান বা অন্য কোথাও গিয়ে দেখুন, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পগুলো করার সময়ে কৃষক এবং অন্যান্য সাধারণ মানুষের থেকে জমি নেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের জন্য যত জমি দরকার তার চেয়ে অনেক বেশি জমি নেওয়া হয়েছিল। গরীব মানুষ নামমাত্র দামে বা বিনামূল্যে সরকারকে জমি দিয়েছিল। আমাদের গ্রামের দিকে অনেক জায়গায় সরকারি হাসপাতাল করার জন্য মানুষ স্বেচ্ছায় প্রায় বিনা পয়সায় জমি দিয়ে দিয়েছে। কেন? না তাদের প্রত্যাশা ছিল যে এই জমিতে হাসপাতাল হলে সেটা দেশের কাজে লাগবে, দেশের মানুষ শস্তায় বা বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবে। এটাও তো এক ধরনের বিনিয়োগ। আজ যদি সেই কারখানা, সেই হাসপাতাল বেসরকারিকরণ করে দেওয়া হয় তাহলে সেই মানুষগুলোর বিনিয়োগের মূল্য কীভাবে দেওয়া হবে? এগুলো নৈতিক প্রশ্ন।

দ্বিতীয়ত, আমি যদি বিক্রিই করি, তাহলে একই ধারায় কেন ভাবব? মানে যেমন ধরুন, এয়ার ইন্ডিয়া একটা দেনায় ডুবে থাকা কোম্পানি। কেউ কিনতেই চাইছিল না। তা বলে টাটা যে খুব ক্ষতিস্বীকার করে কিনেছে তা কিন্তু নয়। এই কেনাবেচায় ওদের একটাই বড় দায়ভার নিতে হল, সেটা হল এয়ার ইন্ডিয়ার বিপুল কর্মীবাহিনী। এয়ার ইন্ডিয়াতে একসময় যত কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে, হয়ত তত কর্মীর প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া এয়ার ইন্ডিয়া তার কর্মচারীদের যেসব সুযোগ সুবিধা দিয়ে এসেছে — বিনামূল্যে ভ্রমণ ইত্যাদি — সেগুলো কোথাও দেওয়া হয় না। আমার মতে সরকারের এই সুবিধাগুলো দেওয়া উচিত নয়। পর্যাপ্ত বেতন দেওয়া সত্ত্বেও এইসব সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এটা এয়ার ইন্ডিয়ার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ার একমাত্র কারণ না হলেও অন্যতম কারণ। সরকার কেন এইসব ক্ষেত্রে কাটছাঁট করে কোম্পানিটার পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করেনি সেটাও ভাবা দরকার।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত

লজ্জার ভাগ

ভিখারি দূরে থাক, হকারদের প্রবেশও নিষেধ। কেউ ফাঁকতালে গ্রীষ্মের দুপুরে ঢুকে পড়লে রক্ষীর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে।

উসকোখুসকো, পরিচর্যার অভাবে লাল হয়ে যাওয়া দড়ির মত চুল, পরনে রং বোঝা যায় না এমন সালোয়ার কামিজ, কাঁধে একটা কাপড়ের পোঁটলা, সঙ্গে হাড় জিরজিরে ছেঁড়া ফ্রক পরা বছর দশেকের একটি মেয়ে। এভাবে আমাদের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিলেন একজন বছর তিরিশের মহিলা। দিন পনেরো আগের কথা। কোনো ভণিতা নেই, দরজা খুলতেই বললেন “বাবু, দুটো কাপড় হবে? আমাদের পরার কাপড় নেই।” বাড়ির দরজায় এসে কেউ সরাসরি হাত পেতে দাঁড়ায়নি অনেককাল। তাই কিছুটা ধাক্কা লেগেছিল। নিজের ফ্ল্যাটের দিকে তাকিয়ে, বউ মেয়ের দিকে তাকিয়ে লজ্জাই হয়েছিল কিছুটা। গিন্নীর ব্যবস্থাপনায় বেশকিছু পুরনো জামাকাপড় প্রার্থীর হাতে তুলে দেওয়া গেল। বাচ্চা মেয়েটির চোখ দিয়ে খিদে এমন দৃষ্টিকটুভাবে চেয়ে ছিল, যে তার হাতে দুটো বিস্কুটও দেওয়া গেল। তাতেই বোঝা গেল, এমন নয় যে ওদের বাড়িতে অন্নের তবু সংস্থান আছে, কেবল বস্ত্র ভিক্ষা করতে হচ্ছে। মহিলা বলে বসলেন “বাবু, চাল হবে?” আসলে ইনি ভিক্ষাজীবী নন একেবারেই। বললেন অধুনা প্রায় জঙ্গলে পরিণত হিন্দমোটর কারখানার পরিত্যক্ত কোয়ার্টারগুলোর একটাতে থাকেন। কী কাজ করতেন বললেন না, কিন্তু বললেন কাজ ঘুচে গেছে অতিমারীর কোপে। কাপড় দিয়েছি গোটা কয়েক, মেয়ের হাতে বিস্কুট দিয়েছি না চাইতেই, কিঞ্চিৎ নগদও দিয়েছি। বোধহয় সে জন্যেই ভরসা করে চাল চেয়েছিলেন। কেন কে জানে, ফস করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল “হবে না।” একটিও কথা না বাড়িয়ে, পোঁটলার মুখ বেঁধে ফেলে দুজনে বিদায় নিলেন।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার পর মনে হল, ফিরে ডাকি। কিন্তু কোথায় যেন আটকে গেল। গিন্নী শুনে বললেন “হবে না বললে কেন? চাল তো ছিলই।” ভেবে দেখলাম, চাল আছে। অভাব তো নেই-ই, বরং উদ্বৃত্ত আছে। কিন্তু আমার দেবার মনটাই নেই। নিজের কাছে নানারকম যুক্তি খাড়া করে ফেললাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। যেমন, কাপড় দিলাম, টাকা দিলাম, আবার চালও দেব? বাড়াবাড়ি করা ভাল নয়। যদি চিনে রাখে, নিয়মিত আসা যাওয়া শুরু করে? প্রগতিশীল যুক্তিও খবরের কাগজের ক্রোড়পত্রের মত লাগিয়ে দিলাম পিছনে — ভিক্ষা দেওয়া ভাল নয়। এর সমর্থনে দু-একজন মহাপুরুষের উক্তিও মনে করার চেষ্টা করলাম, মনে পড়ল না। শেষ পর্যন্ত দুটো কথা স্বীকার না করে উপায় রইল না। প্রথমত, যিনি এসেছিলেন তিনি সারা বছর ধরাচূড়ো পরে ট্রেনে বাসে ভিক্ষা করে নেশার টাকা তুলে বেড়ানোর লোক নন। লজ্জার মাথা খেয়ে মেয়ের হাত ধরে ভিক্ষা করতে বেরিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, যদি বারবার ফিরেও আসেন, তাহলেও আমার যত আছে সবটা ভিক্ষা করে নিয়ে যাওয়ার শক্তি ওঁর নেই।

আসলে সংবেদনশীলতা বোধহয় একটা অভ্যাস। সে অভ্যাস আমার চলে গেছে, তাই কয়েক মিনিটের জন্যও আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়াতে পারি না। ভয় হয়, দুর্বলতম মানুষটিও আমার সব কেড়ে নেবে। অথচ নেওয়ার মত কী-ই বা পড়ে আছে আমাদের? এক সময় কিন্তু ছিল। যখন এ তল্লাটে বাড়ি বাড়ি আসতেন তাঁরা, যাঁদের আমরা সবাই ভিখিরি বলতাম।

ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ের যে জায়গাগুলো হুগলী শিল্পাঞ্চলের মধ্যে ধরা হত, তারই একটায় আজন্ম বসবাস করছি। আমার জন্মের আগে বা আমার জ্ঞান হওয়ার আগেই এ অঞ্চলের বেশকিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সমরেশ বসুর গল্প, উপন্যাসে এই অঞ্চলের যে ব্যস্ত শ্রমিক মহল্লার ছবি পাওয়া যায়, সেসব বিরল হয়ে আসতে শুরু করেছে ক্রমশ। র‍্যালিস ইন্ডিয়াকে প্রথম থেকেই পোড়োবাড়ি বলে জেনেছি, রিলাক্সন কারখানায় ধর্মঘট, শ্রমিক-মালিকের টানাপোড়েন চলছে — এসব শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। কিন্তু কৈশোরের শেষ পর্যন্ত হিন্দমোটর আর রিষড়ার অ্যালকালির সাইরেন ভুলতে দেয়নি যে আমরা শিল্পাঞ্চলে বাস করি। পাড়ার কাকু, জেঠু, দাদারা সাইরেন বাজার খানিক আগে-পরে সাইকেল নিয়ে কারখানার দিকে রওনা হতেন বা ফিরতেন। ওসব সকাল-বিকেলের ব্যাপার। দুপুরের নৈঃশব্দ্য, গৃহিণীদের দু দণ্ড বিশ্রামের শান্তি ভঙ্গ হত ভিখারিদের আগমনে।

যাঁরা আসতেন তাঁদের রোজ দেখতে দেখতে মুখ চেনা হয়ে যেত। এক লোলচর্ম বৃদ্ধা আসতেন। পিঠ বেঁকে মাটির সাথে প্রায় সমান্তরাল হয়ে গেছে, দু পা হেঁটেই হাঁপিয়ে পড়েন, টানা কথা বলতেও পারেন না। পয়সা দিলে ক্ষুণ্ণই হতেন। তাঁর দরকার ছিল চাল, ডাল অথবা আলু। তখন ফ্ল্যাটে থাকতাম না। নিজেদের বাড়ি ছিল, সে বাড়ির চাল ছিল টিনের, বৃষ্টি হলে জলও পড়ত। কিন্তু ওই বৃদ্ধাকে মা কখনো বলেননি, চাল হবে না। এ কেবল আমার বাড়ির গল্প নয়। এলাকায় দোতলা বাড়ি তখন গোনা যেত, আর টিভি থাকতে একটা-দুটো বাড়িতে। বৃদ্ধা সব বাড়ি থেকেই কিছু না কিছু পেতেন, ঠা ঠা দুপুরে জিরিয়ে নিতেন কোনো বারান্দায় বসে। হাফপ্যান্টের বয়সে কৌতূহলের সীমা থাকে না। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম “দিদা, তুমি ভিক্ষা করো কেন? তোমার বাড়িতে কেউ নেই?” ছিল, সবই ছিল। স্বামী না থাকলেও ছেলে ছিল, বৌমা ছিল, নাতি-নাতনি ছিল। কিন্তু তারা দেখে না, দু মুঠো খেতেও দেয় না — এমনটাই বলেছিলেন তিনি। দিদার মৃত্যুসংবাদও যথাসময়ে পাওয়া গিয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, আমাদের পাড়ার লোকেরাই চাঁদা তুলে তাঁর সৎকারের ব্যবস্থা করেছিল।

এক কাকু ছিল, যে শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ভিক্ষা করতে চাইত না। জন্মান্ধ, তার উপর টাকাপয়সার হিসাবও রাখতে পারত না ঠিক করে। তাই তার বাড়ি বাড়ি ধূপ বিক্রি করার ব্যবসা নামেই ব্যবসা। কোনো ক্রেতা তাকে সুযোগ পেয়ে ঠকিয়েছে কিনা জানি না, তবে যে ধূপ সে বিক্রি করতে আসত তার গন্ধ তেমন মনোমুগ্ধকর ছিল না। আদৌ কোনো গন্ধ ছিল কিনা সে-ও তর্কসাধ্য, অর্থাৎ পাইকারি বিক্রেতা তাকে বরাবরই ঠকিয়ে গেছে বলা যায়। সুতরাং কাকুর কোনোমতে গ্রাসাচ্ছাদন আসলে লোকের দয়ার উপরেই নির্ভরশীল ছিল। বয়স একটু বাড়তে মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণও দেখা দিয়েছিল, ফলে দুর্দশার শেষ ছিল না। তবু, কটু কথা শোনালেও, তাকে যৎসামান্য সাহায্য করার লোকের অভাব ছিল না আমাদের এই অকিঞ্চিৎকর মফস্বলে।

মাঝে মাঝে দেখা মুখও ছিল কয়েকজন। সেই সময়কার আর সব মফস্বল স্টেশনের মত, আমাদের কোন্নগর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেও ভিখারিদের দেখা পাওয়া যেত। তাছাড়া কালীপুজোর দিন সন্ধেবেলা আমারই বয়সী কিছু শুকনো মুখ ঘুরে বেড়াত। তারা শিশু হলেও আত্মসম্মান যথেষ্ট, তাই কখনো কারোর কাছে বাজি চায়নি। কিন্তু তাদের মুখের অন্ধকার দেখেও নিজের ভাগের আলো থেকে একটুও দেবে না কোন পাষাণ?

আশির দশক পেরিয়ে নব্বইয়ের দশকে এসে কিন্তু অন্য মানুষের দয়ায় বাঁচতে বাধ্য মানুষের সংখ্যা কমে গেল বহুগুণ। এলাকায় বন্ধ কারখানার সংখ্যা বাড়লেও চোখের সামনে দেখতে পেলাম, কিছু না কিছু করছে সকলেই। নিতান্ত ভিক্ষা করে খাওয়ার লোক আমাদের এলাকায় আর নেই দেখে অদ্ভুত স্বস্তিবোধ হত। আজ যৌবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমার বৃত্তের সমবয়স্ক এবং বয়োজ্যেষ্ঠ লোকেদের সাথে কথা বলে দেখি, নিজ নিজ এলাকায় তাঁদের অভিজ্ঞতাও এরকমই। অন্যের অনুগ্রহের ভরসায় জীবনধারণ করার চেয়ে গ্লানিকর কিছু নেই। সে গ্লানি দেখাও গ্লানিকর। তা কাউকে অবসন্ন করে, কাউকে ক্ষিপ্ত করে। ওই গ্লানি থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি বলেই মনে হয়েছিল মাঝের কয়েক বছর।

এখন ভারতের যে প্রান্তের মানুষের সাথেই কথা বলছি, মন খারাপ করা গল্প বলছেন সবাই। আলোকচিত্রীদের ক্যামেরাতেও ধরা পড়ছে মানুষের অসীম দুর্দশার ছবি। পথ দিয়ে চলে যাওয়া দুধের গাড়ি থেকে গড়িয়ে পড়া দুধ রাস্তা থেকে চেটে খাচ্ছেন একজন — এমন ছবিও আমরা দেখে ফেলেছি গত বছর। তার আগেই অবশ্য আমার কল্পনাশক্তিকে অবশ করে দিয়ে হুগলী জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের অধিবাসী এক বন্ধু জানিয়েছে, এক দুপুরে তারা সবে খেয়ে উঠে ঢেঁকুর তুলছে যখন, এক পথিক এসে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছে “ভাত হবে?” বছর তিরিশেকের ছেলেটি নিজের জন্মস্থানে মানুষকে এভাবে অভুক্ত থাকতে কখনো দেখেনি। ভারতের রাজধানীতে জন্মানো, বেড়ে ওঠা সাংবাদিক বন্ধুও এই দেড় বছরে একাধিকবার বলেছেন, যারা খেটে খেত, তারাও হাত পাততে বাধ্য হচ্ছে।

জানি না, পাঠক, এসব অভিজ্ঞতা কতটা মিলছে আপনাদের অভিজ্ঞতার সাথে। আমাদের নবগ্রাম অনেক বদলে গেছে, আমরা সবাই বদলে গেছি। এখানে এখন অনবরত বাড়ি ভাঙছে, ফ্ল্যাট উঠছে। সেসব ফ্ল্যাটে আমরা সম্ভ্রান্ত লোকেরা থাকি। আমার ফ্ল্যাটের সদর দরজা খোলা পেয়েই নিশ্চয়ই দোতলায় উঠে আসতে পেরেছিল ওই তরুণী মা আর তার মেয়ে। হয়ত আর কোনোদিন পারবে না। বহু ফ্ল্যাটে সজাগ রক্ষী আছে এসব বাজে লোককে আটকানোর জন্য। ভিখারি দূরে থাক, হকারদের প্রবেশও নিষেধ। কেউ ফাঁকতালে গ্রীষ্মের দুপুরে ঢুকে পড়লে রক্ষীর চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে। আপনি যদি তেমন কোনো ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হন, তাহলে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এইসব তিক্ত অভিজ্ঞতা, বমন উদ্রেককারী দৃশ্যের পসরা সাজাবার জন্য। এসব গালগল্প মনে হলে আমিই দায়ী।

আসলে অনুগ্রহ প্রার্থী মানুষ আমাকে বড় লজ্জায় ফেলেন। অতিমারীর সময় হঠাৎ লজ্জায় পড়তে হয়েছে তা নয়। এ লজ্জার শুরু এই সহস্রাব্দের গোড়ার দিকে। তার আগে নেহাত বালক ছিলাম, লজ্জা ঘৃণা ভয় — সবই কম ছিল। প্রথম লজ্জা পেলাম যখন সাহাগঞ্জের ডানলপ কারখানার শ্রমিকরা আমাদের বাড়িতে পুরুষ-মহিলাদের প্রসাধন সামগ্রী বিক্রি করতে এলেন। বাবার বয়সী লোক সামনে হাত জোড় করে দাঁড়ালে যে পায়ের নীচের মাটি দুলতে শুরু করে, সে অনুভূতি সেই প্রথম। আমরা যত বড় হয়েছি, বন্ধ কারখানার সংখ্যা যত বেড়েছে, তত বেড়েছে মরিয়া শ্রমিকদের যাতায়াত। এক পাড়ায় কতজন এক মাসে কতগুলো ডিওডোর‍্যান্ট কিনতে পারে? উত্তর জেনেও তাঁদের দলে দলে, বারবার আসতে হয়েছে আমাদের দুয়ারে। বিপন্ন মানুষের জন্যে, রোজগারের রাস্তা খোঁজা মানুষের জন্যে এই পৃথিবী কী ভীষণ ছোট! যাঁরা আসেন, তাঁদের কখনো না কখনো ফেরাতেই হয়। মেজাজ ভাল থাকলে নরম সুরে “সেদিন যেটা দিয়ে গেলেন, এখনো ফুরোয়নি যে, কাকু।” তিরিক্ষে হলে “এই তো আপনাদের ফ্যাক্টরিরই একজনের থেকে একটা জিনিস কিনলাম। কজনের থেকে কিনতে হবে রে বাবা?” মাসে মাসে এলে কয়েক জনের মুখ চেনা হয়ে যায়। তখন অনুগ্রহ প্রার্থনা আরও লজ্জায় ফেলে। কেউ কেউ নিজের অবস্থায় এতই লজ্জিত, যে সামান্য নখপালিশ কেনার জন্য হাঁটুর বয়সী গৃহবধূকে বলে ফেলেন “আপনাদের অশেষ দয়া। আপনারা আছেন বলেই আমার মেয়েটা খেতে পরতে পাচ্ছে মা।” আসলে তিনি জানেন এই বেচা কেনা চাহিদা-যোগানের অর্থনৈতিক নীতি অনুযায়ী হচ্ছে না, হচ্ছে অনুগ্রহের ভিত্তিতে।

গত দেড়-দুই দশক ধরে তবু এই ভানটুকু আমাদের আব্রু বজায় রেখেছিল। অতিমারী এসে সেটুকুও বুঝি কেড়ে নিল। ভিখারি হওয়া ছাড়া আর পথ রইল না অনেক মানুষের। নিজেকে এখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুঃশাসনীয় গল্পের নারীদের মত অসহায়, উলঙ্গ মনে হয়। দুঃখ ভাগ করলে কমে জানি, লজ্জা ভাগ করলে কমে কিনা জানি না। তাই খানিক আশায়, প্রিয় পাঠক, এই ঝুঁকি নিলাম।

https://aajkaal.in এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে।

সুখেন মুর্মুর চদরবদর: অচেনার আনন্দ, অজানার সংকট

ওলট পালট করে দিতে এই গল্পকার সিদ্ধহস্ত। ডাক্তার বর্মণের ভাই নিজের বাবা-মায়ের কাছেও এতই তুচ্ছ যে তার নামকরণ হয় ফাক্তার।

বাঙালির যৌনতা নিয়ে ছুতমার্গ আছে, বাঙালি পাঠক সাহিত্যে যৌনতা এসে পড়লেই নাক সিঁটকায় আর লেখকরাও সযত্নে যৌনতা এড়িয়ে যান — এই বহু পুরনো অভিযোগের ধার ইদানীং কমে গেছে। কারণ মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে পাঠকদের যৌনতা নিয়ে অস্বস্তি বিলক্ষণ কমে গেছে, লেখকরাও আর তত সলজ্জ নেই। অনেকেই যথেষ্ট “সাহসী”। কিন্তু অধিকাংশ যৌনতার বর্ণনা একমাত্রিক, একঘেয়ে। এক লেখকের যৌনতার বর্ণনা অন্যের গল্পে বসিয়ে দিলে তফাত করা যাবে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যায়, মহিলা লেখক বর্ণিত যৌনতাও একইরকম দামি অন্তর্বাসশোভিত, পুরুষের মনোরঞ্জনমূলক। সম্ভ্রান্ত মহিলার স্তনসন্ধির ওপারে উঁকিঝুঁকি মেরে পাঠককে কিছুটা নিষিদ্ধ আনন্দের শিহরণ দেওয়া ছাড়া সে বর্ণনা কিছুই করতে পারে না। তাই চমকে না উঠে উপায় থাকে না, যখন পড়ি:

এবার যে মানুষটা ঘরে আসে সে যেন অন্যরকম আলতাফ। নরম, ভালোবাসাময়, সেই সাদির সময়কার আলতাফের মতো মনে হয়। কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখে বিদ্যুৎ খেলে যায় আরতির। স্তনবৃন্তে দাঁত ফুটিয়ে আলতাফ হোসেন টাকা চায়। ঘাড়ের থেকে চুলের গোছা সরিয়ে চুমু খেলে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না আরতি। গোপন কয়েকটি টাকার কথা কবুল করে ফেলে। মারের মুখে কঠিন মেয়ে আরতি। সে-ই কিনা আদরে গলে গলে যায়। তার নিচু টালির চালের ছোট্ট ঘরের বিছানায় ঘুমন্ত ছেলেরা জেগে গেছে টের পায় না। টের পায় না অবশ হতে হতে বাষ্প হওয়ার সময়, ভুলে যায় দিন-রাত প্রতীক্ষার নাম ধরে ডাকার সময়গুলো। এভাবেই মেঘ থেকে মেঘে ঘন হয় আলিঙ্গন। ওষ্ঠের কাঁপন, লালা, ঢুকিয়ে দেওয়া জিহ্বামূল, অবশ অবশ সব খুশিতে না-পাওয়ার দিনগুলো মুছে যায় জলরঙা ছবির মতো। দেওয়াল থেকে নেমে-আসা ক্যালেন্ডারে নায়ক নায়িকার ছবিগুলি জ্যান্ত হয়। শরীর শরীর বলে ডাকে। প্রেম প্রেম বলে বাতাসে ওড়ায় আগুন, ছাই, বিষাদ। আলতাফের সবল শরীরের নীচে পিষ্ট হতে হতে টের পায়, এমনকি একদানা সোনার নাকছাবিটাও আলতাফ আদরে সোহাগে খুলে নিল…

পাঠক, ভুল কারণে উত্তেজিত হয়ে পড়বেন না যেন। তীব্র যৌনতার বর্ণনা উদ্ধৃত করে দুই ভিন্ন ধর্মের নরনারীর যৌন সঙ্গমকে গৌরবান্বিত করছি না। যৌনতা যে মনোমুগ্ধকর হয়েও হরণের হাতিয়ার হতে পারে, তা লিখে ফেলার মুনশিয়ানাকে তারিফ করছি মাত্র। লিখেছেন এণাক্ষী রায়। গল্পের নাম ‘ই-সেভেনের বারান্দা’। আরতির নাম আসলে আরতি নয়। তার নাম আয়েষা, সে আলতাফের বেগম। আয়েষাকে আরতি সাজতে হয় কারণ আমার আপনার মত ফ্ল্যাটমালিকরা আয়েষাকে আরতি জেনে সংসারের প্রায় সব দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু আসল পরিচয় জানলে রাতারাতি তাড়িয়েও দেয়। দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার চালানোর জন্য পরিচারিকার চাকরি আরতির কতটা দরকার, তা আলতাফের প্রেমের বহর দেখে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন। যদি না যৌনতার বর্ণনাটাই আপনাকে অভিভূত করে থাকে।

এণাক্ষীর গল্পের চতুর্থ বই সুখেন মুর্মুর চদরবদর অবশ্য বারবার অভিভূত করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। যেমন বিষয় নির্বাচনে, চরিত্র চিত্রণে; তেমনি গদ্যের বর্ণময়তায়। নাম গল্পটার কথাই ধরুন। নামটা পড়েই খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠেছেন তো? আমিও তাই করেছিলাম। এই গল্পের খেঁকুরে চেহারার ভদ্রলোকটিও হেসেছিল। আমরা কি আর জানি, চদরবদর একটা শিল্পমাধ্যম, যাতে আছে পুতুলনাচ দেখানো, গান গাওয়া, সারিন্দা বাজানো? গল্পের খেঁকুরে ভদ্রলোকের হাসি আপনি যতক্ষণে দেখতে পাবেন, ততক্ষণে আর তার অজ্ঞতায় আপনার হাসার উপায় থাকবে না। কারণ টের পাবেন, ওই হাসি প্রকৃতপক্ষে গল্পকারের রামচিমটি। অবশ্য ওই চিমটিতে আমাদের কী-ই বা এসে যায়? আমরা তো সুখেন মুর্মুর সহমর্মী নই, তার লুপ্ত হতে চলা বংশানুক্রমিক পেশার সংকট আমাদের সংকট নয়। সরকার টাকা দিচ্ছে গাছ কাটার অপকারিতা প্রচার করতে, আবার সেই সরকারই বহু সুপ্রাচীন গাছ কাটতে বলছে। তাহলে কোনটা উচিত কাজ? এই সংশয়ও আমাদের নয়। কারণ গাছ কাটা পড়লে বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় কোনো প্রেত আমাদের বলে উঠবে না “সুঁখেন, মেলা টাকা পায়ে ব্যাবাক ভুলি যাবা ধরিছিস বাউ!” আমরা বরং বিডিওর মত নিঃসংশয়। “উন্নয়ন তো দরকার!” তবে আমাদের দ্বিধাহীন জগতে সুখেন মুর্মুকে এনে ফেলে আমাদের কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে ফেলে দেন গল্পকার। বোঝা যায়, বাপ্পাদিত্য মণ্ডলের তৈরি প্রচ্ছদে যে পুতুলগুলো নাচছে সেগুলো শুধু সুখেন মুর্মুর পুতুল নয়, সে নিজেও পুতুল। তাকে দক্ষতর বাজিকর নাচাচ্ছে। গল্পটা পড়ার পর সন্দেহ হবে, আমাকেও কেউ নাচাচ্ছে না তো?

অস্বস্তির অবশ্য এখানে শেষ নয়, শুরু। এমন সব মানুষের গল্প এ বইতে এণাক্ষী আমাদের বলছেন, যাদের অস্তিত্ব যত কম জানা যায় তত স্বস্তিতে থাকা যায়। ধরুন আপনি যদি জানতে পারেন

এই ডিজিটাল যুগেও মেলায় মেলায় তাঁবু খাটিয়ে নাচ-গান হয়, এইসব দলগুলোকে বলে চিত্রহার। সার্কাসের দলের মতো তাঁবু নিয়ে নিয়ে ঘোরে চিত্রহার মালিকেরা। নায়ক নায়িকা ছাড়াও আরো নাচিয়ে লাগে। শাহরুখ খানের গায়ে সারাক্ষণ আঠার মতো লেপ্টে থাকতে চায় হিয়া। হিয়া মনে মনে শাহরুখ খান বললেও ছেলেটার আসল নাম রাজ। আবার রাজটাও আসল নাম নয়, নাচের দলের নাম। আসল নামের হদিশ হিয়া জানে না। নাচের সময় ভুল হলে হাত, কোমর এসব ধরে স্টেপ ঠিক করে দেয় শাহরুখ খান। এই স্পর্শটুকুর জন্য বারবার স্টেপে ভুল করে হিয়া। নিজের কাপড় গোঁজা বুকটা এগিয়ে ঠেকিয়ে দেয় শাহরুখ খানের শরীরে। প্রধান ড্যান্সার হবার জন্য এসব করতে হয় বুঝে গেছে হিয়া।

“ওই মেয়েগুলো ওইরকমই” বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন তো? ওভাবে পার পাবেন না। ‘চিত্রহার’ গল্পের হিয়া কিন্তু শহরের প্রান্তের “নেপালি বস্তি থেকে” আসা মেয়ে নয়। সে আমার আপনার মত পরিবারের ভাল স্কুলে পড়া মেয়ে। কেবল “কালো বলে হিয়া সবসময়ই হীনমন্যতায় ভোগে…পারতপক্ষে অঙ্কিতার পাশে পাশে হাঁটতে চায় না ও। অঙ্কিতার পাশে দাঁড়ালে যেন নিজের কালো রঙটা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।” পেরেন্টস-টিচার মিটিংয়ে অন্য মেয়েদের বাবা-মায়ের পাশে হিয়ার বাবা-মা বেমানান। তারাও হিয়ার বাবাকে ছোটলোক ভাবে, কারোর জন্মদিনে হিয়ার নেমন্তন্ন হয় না। হিয়া ব্রেকড্যান্স স্কুলে ভর্তি হতে চায় সবাইকে দেখিয়ে দেবে বলে। “বিপাশা বসু তো কালো, নায়িকা কাজলও কালো। ওরা যদি নায়িকা হতে পারে হিয়া কেন পারবে না?” ক্যান্সারের গ্রাসে চলে যাওয়া মা আর মদ্যে নিমজ্জিত বাবার মেয়ে চিত্রহারের মেয়ে হয়ে যায়। বহু বছর পরে, মা মারা যাওয়ার পরে “মাঠ-ঘাট পেরিয়ে রাত কাঁপিয়ে মুম্বাইয়ের ট্রেন চলে যায় অনেক দূরে। শুকনো পাতা থেকে ডানাগুলো খসে খসে পড়ে। হিয়ার এখন কখনো-কখনো মনে হয় — ওটা ফিরতি ট্রেন, সে ফিরে আসছে। কিন্তু কোথায় ফিরছে সেটা কিছু মনে আসে না।” যে মেয়ে ফিরে আসতে চায় সে কি খারাপ মেয়ে? কেন খারাপ? নাকি সে ভাল মেয়ে? কেন ভাল? পকেটের পয়সা দিয়ে অ্যাপ থেকে ই-বুক ডাউনলোড করে পড়বেন। তা থেকে এতসব হিং টিং ছট প্রশ্ন উঠে এলে কেমন ফেলতেও পারছি না, ওগরাতেও পারছি না অবস্থা হয় না, বলুন?

গল্প পড়েন কেন? চেনাকে নতুন করে চেনার জন্য, নাকি অচেনাকে চেনার জন্য? এ বই কিন্তু মূলত দ্বিতীয়টার জন্য। ভাবুন, এই শরৎকালে আপনি পড়ছেন ময়নার কথা (‘অসুরকন্যা’):

ও যা-দেখে অন্য কেউ দেখতে পায় না কেন! নীল আকাশে ফটফটে সাদা হাঁসগুলো উড়ে যায়। ওদের দুই-একটা পালক খসে পড়ে চেল নদীর ধারে। সেখানে পাথর ফুঁড়ে ওই পাখনার গাছ গজায় তখন। ওই বিষবাতাস ফরফর ক’রে পালকগুলো বাতাসে উড়িয়ে দেয়। ওই সাদা হাঁসের উড়ে যাওয়া, ওই হাঁসের পাখনার গাছ আর কেউ দেখতে পায় না। মনটা টনটনায় ময়নার। ঢ্যাঙ্কুরাকুড় শব্দ শোনা যায় মনের মধ্যে। এই শব্দটা কানে বাজলেই বাতাসে আরও বিষ ভরে ওঠে। বাতাসটা তখন ভারী ভারী ঠেকে। এই সময় বাগানের থেকে বোনাস পাওয়া যায়। তবু নতুন জামা কাপড় কেনে না ময়নারা।

কেন কেনে না? এণাক্ষীর গল্প কেবল সেই প্রশ্নের উত্তরে আটকে থাকে না। দুষ্ট আর শিষ্টের প্রতীক একেবারে উল্টে দেন তিনি।

ওলট পালট করে দিতে এই গল্পকার সিদ্ধহস্ত। ডাক্তার বর্মণের ভাই নিজের বাবা-মায়ের কাছেও এতই তুচ্ছ যে তার নামকরণ হয় ফাক্তার (‘লাল ঘোড়া কালো ঘোড়া’)। এফিডেভিট করিয়ে অমিতাবচ্চন নাম নিলেও সে তুচ্ছতা ঘোচে না। সেই ফাক্তারকেই এক নিমেষে কাউবয় গ্রেগরি পেক করে তোলেন এণাক্ষী। আর নিরুচ্চারে সীমান্তবর্তী গ্রামের পটভূমিতে লিখিত এই গল্পের নায়িকা হয়ে ওঠে ২০১১ সালে বিএসএফের গুলিতে নিহত ফেলানি খাতুন — এমনই তাঁর কলমের জোর।

গল্প বলার এমন জাদুশক্তির অধিকারী যাঁরা হন, বোধহয় তাঁরাই দেখাতে পারেন ‘কন্যাঋণ’ গল্পের মত সংযম। শেষ ওয়েব পেজে পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত এই গল্পকে প্রবীণ সাহিত্যিকের সাথে এক কন্যাপ্রতিম অনুরাগিনীর মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠার কাহিনীর চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না। সাম্প্রতিককালে এই কাহিনী গল্পে, কবিতায়, মুক্তগদ্যে চর্বিতচর্বণ করে প্রায় বিতৃষ্ণা ধরিয়ে দিয়েছেন এক প্রথিতযশা সাহিত্যিক। এণাক্ষীর জাদুকাঠি সেই বস্তাপচা কাহিনীকে কাঁপন ধরানো উপসংহার দিয়েছে। শেষ কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করার লোভ গল্পকারের চেয়েও বেশি সংযমে সামলে নিলাম। কারণ সবই সমালোচনা থেকে জেনে নেবেন — পাঠকের এই ফাঁকিবাজি এণাক্ষীর প্রাপ্য নয়।

কেতাব-e অ্যাপ প্রকাশিত এই ই-বুকের দাম ১০০ টাকা। বাংলায় লেখালিখি করা পশ্চিমবাংলায় এমনই অভিশাপ, যে দামটা এক প্লেট শস্তা বিরিয়ানির চেয়েও কম। আপনি যদি নতুন কিছু পড়তে চান, অচেনাকে ভয় না করেন — তাহলে এই দাম আপনার কাছে বাধা হবে না। তবে এমন হতেই পারে, যে গল্পের বইতে আপনি এসব চান না। সাহিত্যের কাছে আপনার মুখ্য চাহিদা ভাষার সৌন্দর্য। তাহলেও এ বই আপনাকে হতাশ করবে না। আর জ্বালাব না প্রিয় পাঠক। এ বইয়ের সবচেয়ে সুখপাঠ্য গল্পের খানিকটা দিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ করি:

ফুটন্ত জলে লম্বা লম্বা চাপাতা ফেললে, একটু পর আস্তে আস্তে হালকা করে রঙ বেরতে থাকে। অল্প অল্প করে সমস্ত জলটাই রঙিন হয়ে ওঠে একসময়। ভোরের আকাশটাকেও তেমন লাগে। অল্প অল্প করে হালকা লালচে রঙ ছড়িয়ে পড়তে পড়তে পুব দিকটা একসময় লাল হয়ে ওঠে। ভোরের আকাশটা পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় একরকম করে ফুটে ওঠে।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত

বাঙালির চেতনার রঙে শিল্প হল গো অ্যাজ ইউ লাইক

নৃত্যশিল্পের অনুপযোগী দুজন মানুষের পাবলিক পারফরম্যান্সের সমালোচনা করলে ফ্যাট শেমিংয়ের ওজর তোলা প্রমাণ করে আমাদের শিল্প বোধ গোল্লায় গিয়েছে।

শারদ উৎসব এসে পড়লেই বাঙালির আনন্দ আর ধরে না। মন্ত্রী সান্ত্রী থেকে শুরু করে আমাদের মত চুনোপুঁটি — সকলেরই নাচতে ইচ্ছে করা স্বাভাবিক। তবে সকলে ক্যামেরার সামনে নাচেন না। সেটা চান না বলে নাকি সুযোগ পান না বলে, সে অন্য কথা। কিন্তু আমাদের মধ্যে যাঁরা বিখ্যাত বা কুখ্যাত, তাঁদের সুযোগের অভাব নেই। অতএব তাঁরা লাইক কুড়োবার এমন মওকা ছাড়বেন কেন? সমস্যা হল, ক্যামেরার সামনে কিছু করছেন মানেই সেটা পাবলিক পারফরম্যান্স। আর তাতে কেবল লাইক নয়, সমালোচনা জোটে; ব্যঙ্গবিদ্রুপও। শোভন চ্যাটার্জি আর বৈশাখী ব্যানার্জির নাচের বেলাতেও তাই হয়েছে। কিন্তু বাঙালি যেহেতু বুদ্ধিজীবীর জাত, সেহেতু নিতান্ত লঘু ঘটনাকেও গুরুত্ব আরোপ করে তর্কের বিষয়বস্তু করে তুলতে না পারলে চলে না। তাই শোভনবাবু, বৈশাখী দেবীকে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা অন্যায় — এই সন্দর্ভ তৈরি হয়েছে। রীতিমত প্রবন্ধ লেখালিখি চলছে। যুক্তি মূলত দুটি। ১) দুজন মানুষ একে অপরকে ভালবাসে, একসাথে নাচতে ইচ্ছে হয়েছে বলে নেচেছে। এটা ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপার। সমালোচনা মানে অনধিকার চর্চা, ২) ওঁদের অন্য অনেক দিক থেকে সমালোচনা করা যেতে পারে। শারীরিক গঠন নিয়ে বিদ্রুপ করা কুরুচিকর।

প্রথম যুক্তিটির মত কুযুক্তি কমই হয়। বেসুরো গলায় বাথরুমে গান গাওয়া নিশ্চয়ই আমার ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু স্টেজে উঠে গাইলে কোনো শ্রোতা যদি বলেন “গাধার মত গাইছে”, তখন তেড়ে যাওয়া চলে না। শ্রোতারও ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে। আসলে প্রথম যুক্তি আসছে দ্বিতীয় যুক্তি থেকে। সেটি নিয়ে কিঞ্চিৎ দীর্ঘতর আলোচনা প্রয়োজন।

নৃত্যশিল্পের অনুপযোগী দুজন মানুষের পাবলিক পারফরম্যান্সের সমালোচনা করলে ফ্যাট শেমিংয়ের ওজর তোলা প্রমাণ করে আমাদের শিল্প বোধ গোল্লায় গিয়েছে। ইংরেজি ভাষায় নৃত্য, গীত, সাহিত্য, চিত্রকলা — সবকিছুকেই discipline বলা হয়। কারণ এসবের চর্চা করতে নিয়মানুবর্তিতা দরকার, অনুশীলন প্রয়োজন। গায়ক/গায়িকা হতে গেলে কেবল রোজ রেওয়াজ করতে হয় না, টক খাওয়ার লোভও ছাড়তে হয়। নৃত্যশিল্পী হতে গেলেও খাওয়া-দাওয়ায় নিজেকেই বিধিনিষেধ আরোপ করতে হয়, জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন আনতে হয়। এককথায় কিছু ত্যাগস্বীকার করতে হয়। অত কথা আজকাল আমরা বুঝি না। আমরা বুঝি প্রতিভা। অর্থাৎ উদয়শঙ্কর, মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার প্রমুখ বোকার হদ্দ ছিলেন। সারাজীবন ভরপেট খেয়ে ভুঁড়ি বাগিয়েও নাচ করতেই পারতেন। স্রেফ প্রতিভা দিয়েই কেল্লা ফতে হয়ে যেত।

আসলে দোষ শোভনবাবু, বৈশাখী দেবীর নয়। বাঙালি মাত্রেই কবি, গায়ক, অভিনেতা, নৃত্যশিল্পী ইত্যাদি হয়ে ভূমিষ্ঠ হয়। ইদানীং তা প্রমাণ করার জন্য রিয়ালিটি শো হয়েছে। ছানাপোনারা লসাগু, গসাগু শেখার আগেই গান গেয়ে স্বনামধন্য বিচারকদের থেকে প্রতিভার স্বীকৃতি পাচ্ছে। আগে বিখ্যাত গায়ক-গায়িকারা বলতেন সঙ্গীত নাকি সারাজীবন শিখতে হয়, আজকাল বছর পঁচিশ বয়সের শিল্পীরাও বিচারক। তার উপর আছে সোশাল মিডিয়া। পাঠ্য বইয়ের বাইরে কবিতা পড়িনি, কিন্তু ফেসবুকে রোজ কবিতা লিখছি, দু হাজার বন্ধুর মধ্যে পাঁচশো জন লাইক দিলেই প্রমাণ হল আমি কবি। বাড়ির শিশুটি সবে দু-একটি কবিতা আবৃত্তি করতে শিখেছে, বাবা-মা খুলে দিলেন ইউটিউব চ্যানেল। এক মাসেই মেয়ে বুঝে গেল সে একজন শিল্পী।

আরও পড়ুন সলিল চৌধুরী স্মরণে একটি মনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা

সোশাল মিডিয়ার বাইরেও একটি উপন্যাস লেখার পরেই তরুণ লেখক সম্পর্কে প্রবীণ বলছেন “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরেই…”। জনপ্রিয় কবি রাতারাতি সিনেমা পরিচালক হয়ে যাচ্ছেন, পারকাশনিস্ট সিনেমার নায়ক হচ্ছেন, নায়ক গায়ক হচ্ছেন, রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথার মাথামুন্ডু খেয়াল না করে কোরাসে গাওয়া হচ্ছে। সাহেবরা বলে discipline, আমাদের জোরালো দাবি জানানো উচিত, শিল্প মানে আসলে go as you like। যে লিখেছে সে আর তার ভক্তরা যাকে কবিতা বলবে, তা-ই কবিতা। অনর্থক কিনা, ছন্দের হদ্দমুদ্দ হয়েছে কিনা তা বিবেচ্যই নয়।

এমতাবস্থায় কপোত-কপোতী মনের আনন্দে নাচবেন, শিল্প সৃষ্টি করবেন, তার আবার সমালোচনা হবে কেন? তাল মিলুক আর না মিলুক, দেখতে যেমনই লাগুক, যারা বলবে ওটা নাচ নয় তারা তালিবান।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

চিরতরে কমিউনিস্টদের পর হয়ে যাবেন না কানহাইয়া

রাহুল গান্ধীর কংগ্রেসে ডাঙ্গের দল থেকে যাওয়া কানহাইয়ার সাথে আম্বেদকরপন্থী জিগ্নেশেরও জায়গা হয়েছে। কানহাইয়া আবার প্রায় সব বক্তৃতাতেই আম্বেদকরের কথা বলে থাকেন।

পরলোক থাকলে সেখানে হয়ত শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে মুচকি হাসছেন। কারণ দীর্ঘকাল তিনি যে পার্টির প্রবাদপ্রতিম নেতা ছিলেন এবং যে পার্টি থেকে তাঁর বহিষ্কারের অন্যতম কারণ কংগ্রেসকে ভারতীয় গণতন্ত্রের কালো দিনগুলোতে সমর্থন করা, সেই পার্টির উদীয়মান নেতা দল বদলে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন

এতদিনে সবাই জেনে গেছেন, কানহাইয়া জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের প্রথম প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নন, যিনি পরবর্তীকালে কংগ্রেসে যোগদান করলেন। কিন্তু কানহাইয়া আগের সকলের থেকে আলাদা। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোবার আগেই সারা দেশ তাঁকে চিনে গেছে। ইচ্ছামত এডিট করা ভিডিও ক্লিপকে হাতিয়ার করে তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। হাজতবাস করে এসেই তিনি যে বক্তৃতা দেন, তা তাঁকে রাতারাতি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। অতঃপর সুবক্তা কানহাইয়া ভাইরাল হয়ে যান। ভাইরাল ভিডিওর প্রভাব এখন ভাইরাল অসুখের চেয়ে কম নয়। ফলত কানহাইয়াকে নিয়ে কেবল বামপন্থী নয়, সমস্ত বিজেপিবিরোধী মানুষেরই প্রত্যাশা আকাশচুম্বী হয়েছিল। তিনি সিপিআই ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায় স্বভাবতই নৈতিকতার প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু তাছাড়াও বিষয়টিকে ভারতীয় বামপন্থার সাথে কংগ্রেসের সম্পর্কের নিরিখে দেখা প্রয়োজন।

স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে কমিউনিস্টরা কংগ্রেসকে কীভাবে দেখবেন তা নিয়ে বরাবর ধন্দে ভুগেছেন। তার অন্যতম কারণ জওহরলাল নেহরু। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কেবল সামাজিক চিন্তাধারার দিক দিয়ে প্রগতিশীল ছিলেন না, তাঁর অর্থনীতিও আধা-সমাজতান্ত্রিক। তার উপর তাঁর সোভিয়েত প্রীতি সর্বজনবিদিত। সোভিয়েত সরকার স্বাধীন ভারতের প্রথম দিককার উন্নয়নেও যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। ফলত ডাঙ্গের মত নেতারা কংগ্রেসকে শত্রু বলে ভাবতে চাননি। ১৯৫৯ সালে কেরালার নাম্বুদিরিপাদ সরকারকে নেহরু অন্যায়ভাবে ভেঙে দেওয়ার পরও নয়। অনতিকাল পরেই ভারত-চীন যুদ্ধ, কংগ্রেসের পক্ষাবলম্বন নিয়ে মতভেদ অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতে এমন পর্যায়ে পৌঁছল, যে প্রথমবার পার্টি ভাঙল। সেই ভাঙনের মাশুল ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন আজও দিয়ে চলেছে। তারপর থেকে অন্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর সাথে কংগ্রেসের সম্পর্ক বেশিরভাগ সময়ে আদায় কাঁচকলায় হলেও, সিপিআইয়ের সাথে অম্লমধুর। সত্তরের দশকে কেরালায় একসঙ্গে সরকার চালিয়েছে কংগ্রেস, সিপিআই। জরুরি অবস্থার সময়ে বোধহয় অনেক কংগ্রেসির চেয়েও ইন্দিরার প্রতি সিপিআইয়ের সমর্থন বেশি সোচ্চার ছিল।

সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কংগ্রেস সরকারের আগ্রাসন সিপিএম ও নকশালদের সাথে কংগ্রেসের শত্রুতাকে চিরস্থায়ী করেছে বলে মনে হত অনেকদিন পর্যন্ত। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে সিপিএমের সাথেও কংগ্রেসের সম্পর্ক বদলেছে। দিল্লিতে কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রীর সরকার চলছে সিপিএমের সমর্থনে — এ একসময় অকল্পনীয় ছিল। এমনকি ২০০৪-০৯ সেই সরকার চলার পরেও ভাবা যায়নি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় সিপিএম, কংগ্রেস জোট বেঁধে লড়তে পারে। তা-ও সম্ভব হয়েছে। সিদ্ধার্থশঙ্করের দমননীতিতে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন নকশালরা। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংসদীয় নকশালপন্থী দলটি কিন্তু সিদ্ধার্থশঙ্করের স্নেহভাজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হিসাবে দেখে। মমতার দল কংগ্রেস থেকে বেরিয়েই তৈরি এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সর্বার্থে কংগ্রেসের জায়গাই অধিকার করেছে। অতএব ব্যক্তির নৈতিকতার প্রশ্নে কানহাইয়ার দলবদল নিন্দার্হ হতে পারে, রাজনৈতিক নীতির দিক থেকে তিনি কতটা বিচ্যুত, তা তর্কসাপেক্ষ।

আরও পড়ুন কানহাইয়ার কেরিয়ার আর কমিউনিস্ট আদর্শবাদ: তার ছিঁড়ে গেছে কবে

ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন যে একশো বছরেও সারা দেশে প্রভাব বিস্তার করতে পারল না, তার কারণ হিসাবে অনেকেই আম্বেদকরপন্থীদের সঙ্গে ঐক্যের চেষ্টা না করাকে দায়ী করেন। ডাঙ্গে যখন মহারাষ্ট্রের গিরনি কামগর ট্রেড ইউনিয়নের নেতা, তখন সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল। কিন্তু আম্বেদকরের প্রস্তাব অনুযায়ী দলিত শ্রমিকদের বস্ত্রশিল্পের বয়ন বিভাগে কাজ করতে দেওয়ার দাবিকে ডাঙ্গে আন্দোলনের দাবিতে যুক্ত করতে রাজি হননি, ফলে ঐক্য হয়নি। মজার কথা, রাহুল গান্ধীর কংগ্রেসে ডাঙ্গের দল থেকে যাওয়া কানহাইয়ার সাথে আম্বেদকরপন্থী জিগ্নেশেরও জায়গা হয়েছে। কানহাইয়া আবার প্রায় সব বক্তৃতাতেই আম্বেদকরের কথা বলে থাকেন। কংগ্রেসে বাম ঘেঁষা আর্থসামাজিক চিন্তার রাহুলই শেষ কথা হয়ে উঠবেন, নাকি কপিল সিবালের মত বৃদ্ধ সিংহেরা নিজেদের মত চাপিয়ে দিতে সমর্থ হবেন — কানহাইয়ার ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে অনেকটা তার উপরেও নির্ভর করবে। তবে অদূর ভবিষ্যতেই এমন দিন আসতে পারে, যখন আজ বিশ্বাসঘাতক মনে হওয়া কানহাইয়ার হয়ে তাঁর প্রাক্তন কমরেডদের প্রচারে বেরোতে হবে।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

কানহাইয়ার কেরিয়ার আর কমিউনিস্ট আদর্শবাদ: তার ছিঁড়ে গেছে কবে

মার্কস গুলে খাওয়া সত্ত্বেও পুঁজিবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা তেজস্বী সূর্যদের চেয়ে কানহাইয়া কুমারদের মধ্যে কম নয়।

পশ্চিমবঙ্গে তখন বামফ্রন্ট সরকার। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস, মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিপিএম নেতৃত্বে কেন তরুণ প্রজন্মকে দেখা যাচ্ছে না তা নিয়ে প্রবল আলোচনা চতুর্দিকে। কোনো এক সাংবাদিক সম্মেলনে তা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে সিপিএমের প্রতিনিধি যা বলেছিলেন তা অনেকটা এইরকম — গরীব খেটে খাওয়া মানুষের জন্যে যেসব তরুণ কাজ করতে চান, তাঁরা আমাদের পার্টিতে স্বাগত। কমিউনিস্ট পার্টিতে নেতৃত্বে আসা এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কাজের মধ্যে দিয়েই সংগঠন তার নেতা খুঁজে নেয়। কিন্তু নেতা হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি করা যায় না। নেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকলে আমাদের পার্টিতে আসবেন না।

সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিকে এই সাংবাদিক সম্মেলনের প্রতিবেদনে উদ্বেগ সহকারে লেখা হয়েছিল, সিপিএম নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন না যুবসমাজের উপর এই বিবৃতির কীরকম বিরূপ প্রভাব পড়বে। সিপিএম কি বলতে চাইছে কারোর যদি জীবনের লক্ষ্য হয় পরবর্তী অনিল বিশ্বাস বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হওয়া, তার জন্যে পার্টিতে কোনো জায়গা নেই? বামপন্থীরা আবার প্রমাণ করল তারা যুবসমাজের অ্যাম্বিশনকে কোনো দাম দেয় না।

অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেও অনুরূপ সমালোচনা হয়েছিল। এই বিশুদ্ধতা কার্যক্ষেত্রে সিপিএম কতটা বজায় রেখেছিল, সকলের জন্য একইভাবে রেখেছিল কিনা, কতজন নানাবিধ কায়েমী স্বার্থ নিয়েই সেই আমলে সিপিএম বা অন্য বাম দলগুলোতে ঢুকে পড়েছিল বিভিন্ন স্তরে — তা ভিন্ন আলোচনার বিষয় এবং সে আলোচনায় সিপিএমের অন্ধকার দিকগুলোই নিশ্চিতভাবে বেশি আলোকিত হবে। কিন্তু এই সহস্রাব্দের গোড়ায় একটা ক্ষমতাসীন দল বলছে নেতা হতে চাইলে আমাদের দলে আসবেন না, মানুষের জন্য কাজ করতে চাইলে আসুন। আর সে জন্যে সংবাদমাধ্যম তাদের নিন্দা করছে — এ কথা মনে পড়লে বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন দেশ আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সেদিন সোশাল মিডিয়া ছিল না। থাকলে সেখানেও যে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত সংবাদমাধ্যমের সাথে মিলে যেত, তা বলাই বাহুল্য। আসলে রাজনীতি যে আর পাঁচটা পেশার মতই একটা পেশা, তেমনটা হওয়াই যে কাম্য — একথা অর্থনৈতিক উদারীকরণের ভারতে সযত্নে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। আজ অমিত শাহকে ব্রিফকেস নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে যাঁরা নীতি-নৈতিকতার কথা তোলেন, তাঁরাই অনেকে ওই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার পুরোভাগে ছিলেন।

অ্যাম্বিশন, কেরিয়ার — এই শব্দগুলো যদি রাজনীতির জগতে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, তার অনিবার্য ফল প্রশান্ত কিশোর, অমিত শাহ। এবং কানহাইয়া কুমার। কাঁটাবিহীন গোলাপ হয় না। টাকার বিনিময়ে যে কোনো পার্টিকে ভোটে জেতানোর চেষ্টা করা যার পেশা, সেই প্রশান্ত কিশোরকে জিনিয়াস বলব; আর অমিত শাহ টাকা দিয়ে বিধায়ক কিনে নিলে গেল গেল রব তুলব — এটা যে দ্বিচারিতা, তা স্বীকার করার সময় এসে গেছে। না করলে অমিত শাহদের শক্তি বাড়তেই থাকবে। তেমনি কানহাইয়া কুমার সিপিআই ছেড়ে কংগ্রেসে গেলে খুশি হব, বলব সে এমন একটা পার্টিতে গেল যেখানে ওর প্রতিভা কাজে লাগবে; আর জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া বা ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং বিজেপিতে গেলেই (ক্যাপ্টেন এখনো যাননি, এই লেখার সময় অমিত শাহের সাথে দেখা করবেন বলে খবর) জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করল বলে চেঁচাব, তা হয় না। রাজনীতির নীতিহীনতা নিয়ে যত বড় বড় কথাই বলা বা লেখা হোক, আসলে ও নিয়ে আমাদের কারোর মাথাব্যথা নেই। মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে শুধুমাত্র নীতিহীনতার ফলটা আমাদের পছন্দের দলের পক্ষে না গেলে।

এই সত্য মেনে নিয়ে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে আলোচিত বামপন্থী কানহাইয়া কুমারের কংগ্রেসে যোগদান নিয়ে আলোচনা করা যাক।

কানহাইয়া কেন সবচেয়ে আলোচিত? তিনি কি বিপুল ব্যবধানে কোনো নির্বাচনে জিতেছেন? না। তিনি কোনো বিরাট গণআন্দোলন সংগঠিত করেছেন? না। আসলে কানহাইয়া পাদপ্রদীপের আলো সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন বলে সবচেয়ে আলোচিত। অকারণে পাননি। কমিউনিস্টদের মধ্যে দীর্ঘদিন যাকে প্রায় কৌলীন্যের লক্ষণ বলে ধরা হত, ছাত্রাবস্থাতেই সেই কারাবাস তাঁকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছে। একেবারে প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতাদের মতই অকারণে, সম্পূর্ণ সাজানো কেসে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। যেহেতু ঘটনাটা ঘটেছিল ভারতের রাজধানীতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়টার নাম জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, স্বভাবতই দেশের সব টিভি ক্যামেরার চোখ পড়েছিল তাঁর উপর। নিঃসংশয়ে বলা যায়, কানহাইয়া নামক সেলিব্রিটির জন্ম হল হাজতবাস কাটিয়ে ফিরে আসার রাত্রে, যখন তিনি ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। প্রায় সব চব্বিশ ঘন্টার নিউজ চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার হল। সেদিন থেকেই রাজ্যসভা বা লোকসভার যে কোনো বামপন্থী সাংসদের চেয়েও সাধারণ ভারতীয়ের কাছে বেশি পরিচিত মুখ হয়ে উঠলেন কানহাইয়া। নিঃসন্দেহে তিনি সুবক্তা, তাই মুহুর্মুহু বিভিন্ন চ্যানেলের বিতর্কসভায় ডাক আসতে থাকল, কিছুদিনের মধ্যেই বইয়ের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর হল। এদিকে নিরাশায়, আলোহীনতায় ডুবে থাকা বাম দলগুলোর কর্মী, সমর্থকরা খড়কুটোর মত কানহাইয়াকে আঁকড়ে ধরলেন। কমিউনিস্ট হলেই বা, তাঁদের জন্ম ভারতে। আর ভারত হল অবতারবাদের দেশ, অবচেতনে সে মতবাদ সকলের মধ্যেই ঢুকে বসে আছে। কানহাইয়া কোথাও পাঁচ মিনিট কথা বললেও সে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। কানহাইয়া আরও বেশি করে আলোচিত হয়েছেন।

এসবের মধ্যে দিয়ে কানহাইয়ার একটি গুণই জনসমক্ষে এসেছে — তিনি সুবক্তা। মুশকিল হল রাজনীতি মানে শুধু বক্তৃতা দেওয়া নয়। কিন্তু সেকথা আমরা ভুলে গেছি বা বলা যায় ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতিকে যেমন পেশা বা কেরিয়ার করে তোলা হয়েছে আমাদের চোখে, তেমনি একে পারফর্মিং আর্টও করে তোলা হয়েছে। যে সেরা বক্তৃতা দেয়, সে-ই সেরা নেতা। কার বক্তৃতা কত হাজার শেয়ার হয়, কতগুলো লাইক পড়ে — সেগুলোই তার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতার প্রমাণ। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য পর্যাপ্ত হাসপাতালের বেড, অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করা নেতাসুলভ নয়। মৃত মানুষের জন্য ক্যামেরার সামনে কাঁদা নেতাসুলভ। নিকাশি ব্যবস্থার সংস্কার নেতার কর্তব্য নয়, এক গোড়ালি জলে দাঁড়িয়ে তদারক করা নেতাসুলভ। মিডিয়া আমাদের এমনটাই শিখিয়েছে। কে নেতা আর কে নেতা নয়, তা আর কাজ দিয়ে বিচার হয় না। মিডিয়া যাকে বেশি দেখায় তাকেই সবাই চেনে, সে-ই নেতা। কানহাইয়াকে সেই কারণেই অনেকের মনে হয়েছিল বামপন্থীদের আশা ভরসা। ইতিমধ্যে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে তিনি নিজের জায়গা বেগুসরাইতে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। কুণাল কামরা, স্বরা ভাস্করের মত বিখ্যাতরা তাঁর হয়ে মাঠে নেমে প্রচার করেছিলেন; বহু বিখ্যাত, অখ্যাত মানুষ অনলাইন প্রচার করেছিলেন, ক্রাউড ফান্ডিং করে তাঁর জন্য টাকা তুলেছিলেন। কিন্তু বেগুসরাইয়ে সিপিআই দীর্ঘকাল ধরে যা ভোট পেয়ে আসছে, তার চেয়ে খুব বেশি ভোট কিন্তু কানহাইয়া পাননি। তাতেও বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের মনে তাঁকে নিয়ে আশা বজায় থেকেছে। কানহাইয়া যেন ম্যায় আজাদ হুঁ ছবির অমিতাভ বচ্চন। মিডিয়াই তাঁকে নেতা বানিয়ে ফেলল, তাঁকে কেবল কয়েকটা ভাল বক্তৃতা দিতে হল। মনে রাখা ভাল, কানহাইয়ার প্রতি যা যা অবিচার হয়েছিল, তার সবগুলোই উমর খালিদের প্রতিও হয়েছিল। কিন্তু মিডিয়া তাঁকে তত দেখায়নি, তাঁর দেওয়া স্লোগান নিয়ে র‍্যাপ তৈরি হয়নি। হয়ত তাই তিনি আমাদের চোখে নেতা হয়ে ওঠেননি, এক বছরের বেশি সময় ধরে ইউএপিএ মামলায় জেলে পচছেন, অভিযোগের শুনানি পর্যন্ত হয়নি।

মুশকিল হল, কেবল কমিউনিস্ট পার্টি নয়, ভারতের কোনো পার্টির ইতিহাসেই স্রেফ পাদপ্রদীপের আলো পেয়ে কেউ নেতা হয়ে উঠতে পারেনি। ইন্দিরা গান্ধীর পরিবারের সদস্য হয়েও রাহুল গান্ধী আজ পর্যন্ত পারেননি। কানহাইয়ার অমন বংশপরিচয় নেই, ফলে তাঁর পক্ষে পেরে ওঠা আরও শক্ত। তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চর্চা করার চেয়ে বেশি জরুরি, কানহাইয়ার দল বদল এ দেশের কমিউনিস্টদের সম্বন্ধে কী প্রমাণ করে তা নিয়ে আলোচনা করা। কমিউনিস্টরা দল পাল্টান না, আর কমিউনিস্ট পার্টিতে যে কেউ ঢুকতে পারে না — এই দুটো কথাই যে আর সূর্য পূর্ব দিকে ওঠার মত সত্য নেই তা পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছুদিন আগেই বোঝা গেছে। সম্প্রতি কেরালাতেও এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতাকে সাদরে সিপিএমে জায়গা দেওয়া হয়েছে। কানহাইয়ার ঘটনা বরং দেখাল, বামপন্থী ছাত্রনেতাদের রঙিন চশমা পরে দেখা বন্ধ করা উচিত। সিপিএমে বৃদ্ধতন্ত্র চলে এ অভিযোগ পুরনো। তা নিয়ে গোড়াতেই আলোচনা করা হয়েছে। সিপিআই নেতাদের মধ্যেও খুব যে তরুণ মুখ চোখে পড়ে এমন নয়। গত কয়েক বছরে এই সমালোচনা কাটিয়ে উঠতে দু দলের নেতাদের মধ্যেই সচেতন প্রয়াস দেখা গেছে। কানহাইয়া তার সুফল পেয়েছেন; যেমন পেয়েছেন সিপিএমের মীনাক্ষী, সৃজন, ঐশী, দীপ্সিতা, প্রতীকুর, পৃথারা। কিন্তু এঁদের সবাইকে তুলে আনা হয়েছে ছাত্র, যুব ফ্রন্ট থেকে। এঁদের নিয়ে সাধারণ সমর্থকরাও যারপরনাই আহ্লাদিত হয়েছেন, অথচ ভোট মিটে যাওয়ার পর এঁরা কে কোথায় তা বোঝা শক্ত হয়ে উঠেছে। তরুণ কৃষক নেতা বা শ্রমিক নেতা কি নেই, নাকি তারা ঝকঝকে চেহারার নয়, সুবক্তা নয় বলে ফুটেজ পাবে না — তাই তাদের সামনে আনা হয় না? কানহাইয়া কিন্তু দেখিয়ে দিলেন, আজকের ছাত্রনেতা মানেই সীতারাম ইয়েচুরি নয়, যে সর্বভারতীয় পরীক্ষায় প্রথম হয়েও আজীবন মন্ত্রী সান্ত্রী হওয়ার আশা না করে কমিউনিস্ট পার্টি করে যাবে। ছাত্রনেতা মানেই দীপঙ্কর ভট্টাচার্য নয়, যে উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হয়ে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটের মত প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেও বিদেশে মোটা মাইনের চাকরি নিয়ে চলে না গিয়ে বিহারের চাষাভুষোদের মধ্যে রাজনীতি করবে। মার্কস গুলে খাওয়া সত্ত্বেও পুঁজিবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা তেজস্বী সূর্যদের চেয়ে কানহাইয়া কুমারদের মধ্যে কম নয়। মার্কসবাদ যে তা বলেও না, একথা কমিউনিস্ট দলগুলোকে আবার স্মরণ করতে হবে।

শোনা যাচ্ছে কানহাইয়া কুমার এবং গুজরাতের নেতা জিগ্নেশ মেওয়ানির কংগ্রেসে যোগদান খোদ রাহুল গান্ধীর ইচ্ছায়। যিনি ন্যূনতম আয় প্রকল্পের কথা বলেন, ২০২১ সালে নাম করে ভারতের ক্রোনি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, বিজেপিকে অতিক্রম করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ভারতীয়ত্বের ধারণার বিরুদ্ধে বারবার বলেন, তাঁকে বৃহত্তর অর্থে বামপন্থী বলতে আপত্তি করার কারণ নেই। কিন্তু সে বামপন্থা কি ভারতের দুর্বল হয়ে পড়া কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিকল্প? দল হিসাবে কংগ্রেসের ইতিহাস দেখলে তা বলা শক্ত। অতএব সেই যুক্তিতে কানহাইয়ার কংগ্রেসে যোগদানে যে বামপন্থীরা খুশি, তাঁরা কদিন পরেই “যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই” বলতে শুরু করবেন সম্ভবত।

একই কবিতা রাহুলকেও আওড়াতে হতে পারে। জিগ্নেশের গণআন্দোলন গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা হয়ত নড়বড়ে গুজরাত বিজেপির বিপক্ষে কংগ্রেসের কাজে লাগবে, কিন্তু স্রেফ বাগ্মিতার জোরে কানহাইয়া বিহারে কংগ্রেসকে শক্ত জমিতে দাঁড় করাতে পারবেন — এমনটা এখুনি ভাবা যাচ্ছে না। লিবারেশন, সিপিএম এবং সিপিআইয়ে কানহাইয়ার প্রাক্তন কমরেডরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে অনেকটাই এগিয়ে। পার্টি সংগঠন তুলে নিয়ে যাওয়া এয়ার কন্ডিশনার খুলে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত। ছবি উইকিপিডিয়া থেকে

বর্ষার শব্দ

শিরীষ কাগজের চালাকি ভেদ করতে বর্ষার একটা গোটা মরসুমও লাগেনি। ভিতরে ঢুকতে পেয়ে তার সুরও গেল বদলে।

বর্ষার শব্দ আছে। বৃষ্টির শব্দ নয়, যে শব্দের কথা বলছি তা অন্য কোনো শব্দের সাথে মেলে না।

আমাদের বাড়িটা মজবুত এবং পাকা। কিন্তু বাবা-জ্যাঠাদের মধ্যে ঠাকুর্দার তৈরি বাড়ি ভাগাভাগি হওয়ার সময় বারান্দাটা আমাদের ভাগে পড়েনি। অথচ রোজ প্রচুর মানুষ আসেন বাবার কাছে নানা প্রয়োজনে, তাঁদের বসার জায়গা দেওয়া যায় না। তাই বারান্দার দরকার পড়ল। শিক্ষক বাবার মাইনে তখন হাজার দশেক। মাকে জিজ্ঞেস করলেন “লোন নিয়ে বারান্দাটা করে না ফেললে আগামী বর্ষায় খুব মুশকিলে পড়ব। কটা বছর ডাল, আলুসেদ্ধ খেয়ে থাকতে হবে কিন্তু। পারবে তো?” সে যুগের মধ্যবিত্ত গৃহিণীরা পারতেন না এমন কৃচ্ছ্রসাধন আজও আবিষ্কার হয়নি। সেই আমাদের বারান্দা হল, কিন্তু বাবা যা ঋণ পেলেন তাতে বারান্দার দেওয়াল প্লাস্টার হল না। মেঝে হল না, মাটি ফেলে সমান করে একটু কম দামের ইট পেতে দেওয়া হল তার উপর। নড়বড় করত, মায়ের শরীর বেশ ভারী বলে চলতে অসুবিধা হত প্রথম প্রথম। বাবা বলতেন “ও কিছু না, চলতে চলতে ওগুলো মাটিতে বসে যাবে। তখন আর অসুবিধা হবে না।” পাকা ছাদও হল না, কারণ ছাদ ঢালাইয়ের অনেক খরচ। কোথা থেকে বেশকিছু ফুটোওলা টিন জোগাড় হল, শিরীষ কাগজ দিয়ে ফুটো বোজানো হল, আমাদের পাকাবাড়ির বারান্দা পেল টিনের চাল। বর্ষা এসে পড়ল, সশব্দে। প্রথম দিন বৃষ্টি শুরু হওয়ার সময় অনেক রাত। আমরা তিনজনেই এমন বোকা, ভেবেছিলাম কেউ টিনের চালের উপর উঠে লাফাচ্ছে। ক্রমশ সে শব্দের সাথে ভাব হয়ে গেল।

শিরীষ কাগজের চালাকি ভেদ করতে বর্ষার একটা গোটা মরসুমও লাগেনি। ভিতরে ঢুকতে পেয়ে তার সুরও গেল বদলে। আস্ত চাল আর ফুটো চালে শব্দের তফাত অভ্যস্ত কান ছাড়া ধরা পড়ে না চট করে। ফুটো দিয়ে ইটের উপর পড়ার শব্দ আরেকরকম। জল পেয়ে ইটগুলোর চেহারা বদলে গেল, চটি ছাড়া বারান্দায় হাঁটা বারণ হল। সাপ, ব্যাঙ দুয়েরই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একমাত্র আমাদের বারান্দার ইটের মেঝেতেই দেখেছি। সাপগুলোর বাহারি চেহারা দেখে বহুবার ভেবেছি বিষাক্ত, কিন্তু প্রতিবারই দেখা গেছে ওগুলো হেলে। ইটের উপর জল পড়ার শব্দ একরকম, সেই জলে কাদায় হাঁটার শব্দ আরেকরকম। সব মিলিয়ে বর্ষার শব্দ।

সশব্দ বর্ষায় বিদ্যুৎ চালু থাকবে এমন প্রত্যাশা আমাদের ছিল না। বৃষ্টি থামলেই আসবে কিনা তা নিয়েই বরং বড়রা আলোচনা করতেন। বর্ষার শব্দের মধ্যে সন্ধেবেলায় লণ্ঠন বা ল্যাম্পের আলোয় পড়তে বসলে চেঁচিয়ে পড়ার দরকার হত। মনে মনে পড়লে বা লিখতে গেলে ধীরে ধীরে বুজে আসত চোখের পাতা — এমন সুরেলা, এমন ছান্দিক ছিল বর্ষার শব্দ। সাধারণত বাবা বাড়ি ফিরতেন রাত করে। বরাবরই মনে হত বাবা বাড়ির বাইরে থাকলে বর্ষার শব্দ একরকম, ফিরে এলে অন্যরকম।

তখন পাড়ায় টিভি বিরল। আমাদের পাশের বাড়িতেই ছিল একখানা। দৈবাৎ বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও লোডশেডিং হত না। তখন টিভি থেকে ভেসে আসা সিনেমার গান আর সংলাপে বর্ষার শব্দের রূপ খুলে যেত। বৃষ্টি, লোডশেডিং, পড়াশোনা শেষ, বাবা ফিরছেন না, ফিরলে খেতে বসব। ততক্ষণ কী হবে? মা গান গাইবেন। বর্ষার শব্দে যোগ হল মায়ের খালি গলার গান, বাড়িতে হারমোনিয়ামের প্রয়োজন বোধ হয়নি তখনো। মোমবাতির আলোয় তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে মা কতদূর ধেয়ে যেতেন তা বোঝার বয়স হওয়ার আগে থেকেই এই রুটিন। বোধহয় তাই এখনো বর্ষার শব্দ পেলেই কানের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতে থাকে। তার সবগুলোই প্রকৃতি পর্যায়ের গান নয়, বর্ষার গানও নয়। বোঝার বয়স কি আজও হয়েছে? কে জানে! বয়স আর বোঝার বয়স বোধহয় আলাদা। তাছাড়া সবটা কি কখনো বোঝা হবে? প্রথম যেদিন মাকে “সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি” গাইতে শুনেছিলাম আর চোখে দেখেছিলাম জল, সেদিন সে জলের কারণ বুঝিনি, আজও তো বুঝি না।

খালি গলায় গাইতে বাবাও ভালবাসতেন, অপেশাদার যাত্রা/নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন বলে কণ্ঠস্বরও ছিল চমৎকার। কখনো কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানি না, কিন্তু বহু কবিতা মুখস্থ ছিল। সেসব আবৃত্তি করার ইচ্ছে কেন জানি না বৃষ্টি এলেই সবচেয়ে প্রবল হত। বোধহয় বাবার মধ্যে রোম্যান্টিকতার ঘাটতি ছিল। কারণ এক্ষুণি চোখ বুজলে বর্ষার শব্দের সাথে বাবার গলায় শোনা যেসব কবিতা আজ মিশে যাচ্ছে, সেগুলো একটাও প্রেমের কবিতা নয় — কাজি নজরুলের ‘আমার কৈফিয়ৎ’, ‘কামাল পাশা’, রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেটা’। আর আশ্চর্য সব গল্পের আবহসঙ্গীত হয়ে আছে বর্ষার শব্দ। ঠাকুর্দার একখানা রেকর্ড প্লেয়ার আমাদের ভাগে পড়েছিল। কিছু ধার করা আর কিছু কেনা লং প্লেয়িং রেকর্ড চালাতাম তাতে। একটা রেকর্ডে বাজত ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। একটা ছুটির দিনে শুনতে শুনতে লোডশেডিং। বাবার মুখে সেই প্রথম শুনলাম ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকীর গল্প। কোনো এক বর্ষার দিনে শুনেছিলাম রুশ বিপ্লবের গল্প। আমি জানি বাবা কোনোদিন সের্গেই আইজেনস্টাইনের কোনো ছবি দেখেননি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নন্দনে প্রথমবার ব্যাটলশিপ পোটেমকিন দেখে মনে হয়েছিল এসব দৃশ্য বাবার চোখেই প্রথম দেখেছি। ফিদেল কাস্ত্রো, চে গেভারার গল্পও প্রথম শুনিয়েছিলেন কোন বৃষ্টিদিনে।

আমাদের জীবনে অনেকগুলো স্মরণীয় পরিবর্তন আসে ১৯৯০ সালে। সেই বসন্তে প্রথম মাকে ছেড়ে বেশ কয়েকদিন থাকতে হয়েছিল। বৈশাখ মাসের পাঁচ তারিখ হাসপাতালে মা আমার বোনকে জন্ম দিলেন। সে বছরই কোনো সরকারি সিদ্ধান্তে বাবার মাইনে বাড়ল অনেকখানি। একদিন আমাকে আর মাস ছয়েকের বোনকে বড় জেঠিমার কাছে রেখে বাবা-মা খানিকক্ষণের জন্য বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন একটা আশ্চর্য জিনিস নিয়ে। আপট্রনের পোর্টেবল টিভি। ততদিনে পাড়ায় প্রায় সব বাড়িতে টিভি এসে গেছে, কলকাতাবাসী আত্মীয়দের বাড়িতে এবং পাড়ার এক ধনী বন্ধুর বাড়িতে মনোরম রঙিন টিভিও দেখে ফেলেছি। সাদাকালো টিভি দেখে সামান্য মনখারাপ হয়েছিল, প্রকাশ করিনি। দোকান থেকে যিনি এসে টিভি চালানো, বন্ধ করা, চ্যানেল বদলানো, ছবির ঔজ্জ্বল্য বাড়ানো কমানো শেখাতে এসেছিলেন তিনি বললেন “কোম্পানি এই মডেলটা রঙিন টিভি হিসাবেই বানিয়েছিল। খরচে পোষাবে না বলে লাস্ট মোমেন্টে সাদাকালো করেছে।” এ কি কম সান্ত্বনা! পরদিন খেলার মাঠে ধনী বন্ধুটিকে সগর্বে জানিয়েছিলাম এই তথ্য। তখন ভুয়ো খবর আমাদের কল্পনাতেই ছিল না। এতকিছু বদলাল, বর্ষার শব্দ কিন্তু বদলায়নি। যতটুকু মাইনে বেড়েছিল তাতে দেওয়াল প্লাস্টার করা যায় না, বারান্দার মেঝে হয় না, পাকা ছাদ হয় না।

তা বলে কেউ গোমড়া মুখে থাকে না। আমার সাথে আমার বোনও বর্ষার শব্দ উপভোগ করতে শিখে গেল দ্রুত। বছর তিনেক পরে আমাদের বাড়িতে এল আরেকটা আশ্চর্যন্ত্র। ফিলিপসের টু ইন ওয়ান। একই যন্ত্রে ক্যাসেট চলে আবার এফ এম রেডিও চলে! দাদুর রেকর্ড প্লেয়ার বোনের জন্মের আগেই গত হয়েছেন। মাঝের কয়েকটা বছর বাড়িতে গান বজায় রেখেছিলেন বাবা-মা নিজেরাই। সামর্থ সীমিত, তাই বাবা বললেন যে মাসে টেপ রেকর্ডার কেনা হল, সে মাসে ক্যাসেট কেনা হবে না। মাসে মাসে একটা-দুটো করে ক্যাসেটে বাড়িতে এলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা, সলিল চৌধুরী, এ আর রহমান এবং অবশ্যই থরে থরে রবীন্দ্রনাথ। তখন আর বৃষ্টি হলেই লোডশেডিং হয় না আমাদের পাড়ায়। এক বর্ষার সকালে বাবার ইচ্ছে হল আবৃত্তি রেকর্ড করে রাখবে। যে গলা যাত্রার মাঠে শেষ সারির দর্শকের কাছেও পৌঁছে যেত অনায়াসে, সেই গলা তখন আর নেই। সেরিবেলা ডিজেনারেশনের অসুখে বাবার হাত কাঁপত আজন্ম দেখেছি, ততদিনে গলাও কাঁপতে শুরু করেছে। সেদিনের বর্ষার শব্দে মিশল কাঁপা গলায় ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’। সেখানেই শেষ নয়, রান্নাবান্নার মধ্যে থেকে টেনে এনে মাকে দিয়েও আবৃত্তি করানো হল মায়ের প্রিয় কবিতা ‘অভিসার’।

এখন চাকরি চলে যাওয়ার যুগ, মাইনে কমে যাওয়ার যুগ। তাই হয়ত বললে গল্পের মত শোনায়, কিন্তু সে সময় সত্যিই বাবার চাকরি যেতে পারে বা মাইনে কমে যেতে পারে আমরা জানতাম না। জানতাম মাইনে কেবল বাড়ে। কারোর বাবার মাইনে ঝটপট বাড়ে, আমাদের বাবার ধীরে ধীরে বাড়ে। ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে আমার যখন গোঁফ দাড়ি বেরোতে শুরু করেছে, তখন বর্ষার শব্দ বদলে গেল। কারণ ব্যাঙ্কের চোখে বাবার ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা বেড়েছে। অতএব বারান্দার পুরনো বাসিন্দা সাপ, ব্যাঙেদের কপাল পুড়ল। শান বাঁধানো মেঝে হল, দেওয়ালে প্লাস্টার হল। ফুটো টিনের চালের দিন ফুরোল। বারান্দা যে কেবল পাকা ছাদ পেল তা নয়, ছাদের উপর নতুন ঘরও হল। তারপর এল বর্ষা। আমরা চারজন আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে প্রবল ব্যথায় আবিষ্কার করলাম, আমাদের বর্ষার শব্দ দূরে সরে গেছে। সেবার বর্ষাটা মনখারাপে কেটেছে। কী যেন অমূল্য ধন আমাদের ছিল, আর নেই।

বর্ষা কিন্তু নির্দয় নয়। টিনের চাল না পেলে চুপ করে যাব, এমন জেদ নেই তার। আমাদের বাড়ির সামনেই খোলা মাঠ, সেখানে বিকেলে ক্রিকেট, ফুটবল খেলেছি কিন্তু সকালে গরু চরিয়েছে নাটুকাকু। এরপর থেকে আমাদের বর্ষার শব্দ ভরে রেখেছে সেই গরুদের ডাক, কাদা মাঠে বলে শট নেওয়ার ভোঁতা শব্দ আর গোলের তীক্ষ্ণ উল্লাস। ছাদের রেনওয়াটার পাইপ থেকে জল পড়ার শব্দ থেকেও বঞ্চিত হইনি। কলকাতার অনতিদূরে আমাদের মফস্বলে গত সাড়ে তিন দশকে শব্দদূষণ যত বেড়েছে, বর্ষা তত বোবা হয়েছে। গাছপালা, পশুপাখিও নিঃশব্দে উল্লাস করা শিখে গেছে। পাছে শব্দ করলে মানুষের চোখে পড়ে ছাঁটাইয়ের খাতায় নাম উঠে যায়!

আমরা কিন্তু বহাল তবিয়তে আছি। শুধু বৃষ্টি এলে মনে হয় কোনও একটা তার ছিঁড়ে গেছে কবে। সুর হারায়ে গেল।

ছবি: ইন্টারনেট থেকে

রাহুলে না, বাবুলে হ্যাঁ: তৃণমূলের প্রকৃত এজেন্ডা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে আর এস এসের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকেন, তাঁদের অন্যতম হলেন রাহুল গান্ধী।

বিরোধী জোটে কংগ্রেসকে নিয়ে আপত্তি না থাকলেও রাহুলকে নিয়ে তৃণমূলের ‘অ্যালার্জি’ আগেও রাজনৈতিক মহলের নজরে এসেছে। এ বার সুদীপের ওই মন্তব্যে দলের তরফে কার্যত সিলমোহর দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রাহুল গাঁধীকে মানুষ মোদীর বিকল্প হিসেবে দেখছে না। বারবার নির্বাচনী ব্যর্থতায় সুযোগ এবং সময় নষ্ট করা যাবে না। রাহুল সুযোগ পেয়েছেন। পারেননি।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জোটের বিকল্প হিসেবে জবরদস্ত বিশ্বাসযোগ্য মুখ সামনে রেখে প্রচারে যেতে হবে। আর তা হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’
— আনন্দবাজার পত্রিকা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২১

সকালের কাগজে যাঁরা এই খবর পড়েছেন, তাঁরা অনেকেই যে প্রবীণ তৃণমূল নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে একমত হবেন তা বলাই বাহুল্য। রাজীব-সোনিয়ার পুত্র রাহুল গান্ধী সত্যিই এমন একটা নির্বাচনও কংগ্রেসকে জেতাতে পারেননি, যা থেকে তাঁর সারা দেশের নেতা হওয়ার মত বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হতে পারে। উপরন্তু বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্কটের জন্য অনেকেই তাঁকে দায়ী করেছেন। রাজস্থানে অশোক গেহলত বনাম শচীন পাইলট লড়াইয়ে তিনি নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারেননি — এমন অভিযোগ আছে। মধ্যপ্রদেশে এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাধবরাও সিন্ধিয়ার পুত্র জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার দলত্যাগের পিছনেও রাহুল-প্রিয়াঙ্কার সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগ ওঠে। বিহারের নির্বাচনে কংগ্রেস একগাদা আসন নিয়েও জোটকে ডুবিয়েছে, তা না হলে নীতীশ কুমারের প্রস্থান অনিবার্য ছিল। উত্তরপ্রদেশে এখনো কংগ্রেসের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে না। গান্ধী পরিবারের লোক হওয়া ছাড়া রাহুলের নেতাসুলভ কোনো গুণ খুঁজে পাওয়া এখনো মুশকিল। অন্য দিকে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একা হাতে পশ্চিমবঙ্গকে কমিউনিস্টশূন্য করেছেন, প্রবল প্রতাপান্বিত মোদী-অমিত শাহ জুটিকে রুখে দিয়েছেন। বিজেপি-বিরোধী জোটের নেতৃত্বে তিনিই যে সবচেয়ে “জবরদস্ত বিশ্বাসযোগ্য মুখ”, তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী-ই বা হতে পারে? কেবল একটাই খটকা। ২০২৪ সালের জানুয়ারির আগে যে নির্বাচন শুরু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর বিকল্প মুখ ঘোষণা করার ব্যগ্রতা কেন?

এই খটকা না কাটতেই, বিকেল না গড়াতেই, এসে পড়েছে আরেকটি খবর। বাবুল সুপ্রিয় যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী (তাঁরই দলীয় মুখপত্র যা লিখেছে বলে খবরে প্রকাশ, তাতে এই তকমা দিলে নিশ্চয়ই দোষ হবে না) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুযোগ্য ভ্রাতুষ্পুত্র, মমতা প্রধানমন্ত্রী হলে যিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হতেই পারেন, সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং বাবুলকে পার্টিতে স্বাগত জানিয়েছেন।

এই দুটো খবর কয়েকদিন বা কয়েক মাসের ব্যবধানে এলে হয়ত এতটা খটকা লাগত না; দলবদল বাংলার রাজনীতিতে অভিনবত্ব হারিয়েছে বেশ কিছুদিন হল। কিন্তু কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে এসে পৌঁছনোয় কিঞ্চিৎ মুশকিল হয়েছে। কয়েকটি প্রশ্ন অনিবার্য বলে মনে হচ্ছে।

প্রথমত, গান্ধী পরিবারকে বাদ দিয়ে যে আজও কংগ্রেস হয় না, তা ভারতীয় রাজনীতির সাথে যে কোনো ভূমিকায় যুক্ত সকলেই জানেন। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তো জানেন বটেই। এ কথা ঠিক যে গত দশকেই টানা দশ বছর কংগ্রেসের নেতৃত্বে কেন্দ্রে এমন একটি সরকার চলেছে যার নেতৃত্বে ছিলেন ওই পরিবারের বাইরের একজন। কিন্তু সে নিতান্ত ঠেকায় পড়ে। উপরন্তু সেই সরকারের কার্যকলাপে রাশ টানতে একটি পরামর্শদাতা সমিতি ছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন সোনিয়া গান্ধী। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বহু বিধানসভা এবং দুটি লোকসভা নির্বাচন হয়ে গেছে। কংগ্রেসের উপর্যুপরি ব্যর্থতা সত্ত্বেও দলের সর্বোচ্চ পদে সোনিয়া আর রাহুলের বদলে কেউ আসীন হননি। রাহুল নিজে থেকে পদ ছেড়ে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু গান্ধী পরিবারের বাইরের কেউ সে পদে আসীন হতে চাননি। শশী থারুর, কপিল সিবাল, আনন্দ শর্মারা মধ্যে মধ্যে ঝড় তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাউল বাতাস সাতমহলা গান্ধীপুরীর হাজার বাতি নিভিয়ে দেওয়ার আগেই দিল্লির ট্র্যাফিকে হারিয়ে যায়। অতএব ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের পরেও কংগ্রেস সাংসদদের গতিবিধি যে রাহুল গান্ধীই ঠিক করবেন, তা সুদীপ ও মমতা, দুজনেই বিলক্ষণ জানেন। তাহলে এত আগে থেকে প্রকাশ্যে রাহুলকে অনুপযুক্ত নেতা হিসাবে দেগে দিলেন কেন? রাহুলকে চটিয়ে কী লাভ?

দ্বিতীয়ত, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তৃণমূলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজেপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ যখন সাম্প্রদায়িকতা নিয়েই শানানো হয়, তখন মন্ত্রী পদের অপব্যবহার করে আসানসোল দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার অসংখ্য অভিযোগ আছে, মুসলমান বিদ্বেষ নিয়ে রাখঢাক করেন না — এমন একজনকে কেন নীল-সাদা কার্পেট পেতে দিল মুখ্যমন্ত্রীর দল?

প্রশ্নগুলো কারো কারো অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। সাহেবরা বলে থাকে, সাফল্যের মত সফল আর কিছু নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন চূড়ান্ত সফল। এ রাজ্যের রাজনীতিতে তিনি এখন উসেন বোল্ট, অর্থাৎ দৌড়তে দৌড়তে এক-আধবার পিছনে তাকালেও হাত দুয়েক ব্যবধানে জিতবেন। অতএব তাঁর পদক্ষেপগুলো নিয়ে ভাবার, সমালোচনা করার কোনো মানেই হয় না — এমনটা অনুরাগীরা বলতেই পারেন। কিন্তু ইতিহাসে যেমন বোল্ট আছেন, তেমন মিলখা সিংও আছেন। শোনা যায় রোম অলিম্পিকে তাঁর অবধারিত সোনা হাতছাড়া হয়েছিল অনেক এগিয়ে আছেন ভেবে গতি কমাতে গিয়ে। তাছাড়া স্লোগান হিসাবে যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, মমতাও জানেন, রাজনীতি খেলা নয়। অতএব ভেবে পা ফেলা এবং যে পা-টা ফেললাম, সেটারও পর্যালোচনা করা উচিত। সুতরাং প্রশ্নগুলো উড়িয়ে দেওয়া সমীচীন হবে না।

বাংলা, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট রাজ্যগুলো, তামিলনাড়ু, জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখ বাদ দিলে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির মুখ্য প্রতিপক্ষ হিসাবে থাকবে কংগ্রেস অথবা কংগ্রেসের উপস্থিতি আছে এমন জোট। কংগ্রেস একেবারেই প্রাসঙ্গিক নয়, এমন লোকসভা আসনের সংখ্যা কিছুতেই শ দেড়েকের বেশি নয়। এর সাথে আছে কেরালার মত রাজ্য, যেখানে কংগ্রেস ভাল ফল করতে পারে, কিন্তু বিজেপিই অপ্রাসঙ্গিক। ফলে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বা কংগ্রেসের উপস্থিতি আছে এমন জোটকে ভাল ফল করতেই হবে। তৃণমূল কংগ্রেসের অতি বড় সমর্থকও নিশ্চয়ই এতটা স্বপ্নের জগতে বাস করেন না, যে মনে করবেন ২০২৪ সালের মধ্যে তৃণমূল প্রথমে ত্রিপুরা, তারপর গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। তারপর বাড়তে বাড়তে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত হাত চিহ্নের সমান বা তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে জোড়াফুল? যদি উদার চিত্তে ধরে নেওয়া যায় লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ৪২-এ ৪২ পাবেন মমতা, ত্রিপুরার দুটো আসনেই জিতবেন, আসামের বাঙালিরাও তাঁকেই জয়যুক্ত করবেন, তাহলেও পঞ্চাশ পেরনো যাবে বড়জোর। বিজেপির ভারত জুড়ে বিপুল বিপর্যয় হলেও সরকার গড়তে কংগ্রেসের সমর্থন প্রয়োজন হবেই। নেতা হওয়ার অযোগ্য রাহুল গান্ধী তখন আজকের কথা মনে রেখে দিলে কী হবে? নাকি তাঁর কাছে সমর্থন চাওয়াই হবে না? ফ্যাসিবাদী সরকারের অপসারণ, নাকি মমতার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার? মূল লক্ষ্য কোনটি? হয় আমাদের সরকার হোক, নইলে যে যা পারে করুক, কিছু এসে যায় না — প্রকৃত এজেন্ডা এমন নয় তো?

বাবুলের তৃণমূলে যোগদানে এমন সন্দেহ প্রবল হয়। তার কারণ বাবুল আর যা-ই হোন, মুকুল নন। মুকুল রায়ের রাজনৈতিক দীক্ষা সঙ্ঘ পরিবারে নয়। তিনি বড়জোর রাজনৈতিক সুবিধাবাদী। বৃহত্তর ক্ষমতার স্বাদ পেতে কিম্বা ফৌজদারি অভিযোগের হাত থেকে বাঁচতে বিজেপিতে গিয়েছিলেন, সুযোগ বুঝে ফিরে এসেছেন। বাবুল কিন্তু কখনো তৃণমূলে ছিলেন না। অর্থাৎ এ প্রত্যাবর্তন নয়, পরিবর্তন। মুকুলের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ নেই। ভারতের রাজনীতিতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রভাব ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে যত বেড়েছে, তত ভারতের উদারপন্থীদের কাছে কোনো দল বা নেতার গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হয়ে উঠেছে অসাম্প্রদায়িকতা। দ্বিতীয় ইউপিএ-র আমলে একের পর এক দুর্নীতি যখন প্রকাশ্যে আসছে, নির্ভয়া কান্ডে মানুষ ক্রমশ ধৈর্যহীন হয়ে পড়ছেন, তখন কংগ্রেসের পক্ষে শেষ যুক্তি হিসাবে খাড়া করা হত অসাম্প্রদায়িকতাকে। এই যুক্তি ২০১৪ সালের পর থেকে ক্রমশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে প্রায় সব রাজ্যে, কারণ বিজেপি-বিরোধী দলগুলির পাহাড়প্রমাণ ত্রুটি ঢাকা দেওয়ার উপায় নেই। অগত্যা বিজেপি-বিরোধী মানুষ ভেবে নিয়েছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত হোক, সাম্প্রদায়িক না হলেই হল। পশ্চিমবঙ্গের ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলও অনেকাংশে এই ভাবনার প্রতিফলন। বাবুল কিন্তু এই সামান্য পরীক্ষাতেও ফেল। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অগ্রণী সৈনিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যদি বাবুলও গ্রহণযোগ্য হন, তাহলে মনে করা অনুচিত হবে না, যে নেত্রীর লড়াই আসলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নয়, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও নয়, স্রেফ বিজেপি নামক রাজনৈতিক দলটির বিরুদ্ধে। যদি লোকসভা ত্রিশঙ্কু হয়, তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অবস্থায় না থাকেন, তখন আর কে সরকার গড়ল, না গড়ল — তা নিয়ে তাঁর আগ্রহ থাকবে না। তখন তাঁর কাছে রাহুল গান্ধীও যা, নরেন্দ্র মোদীও তাই।

ভারতে যাঁরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সত্যিই লড়ছেন, আর যাঁরা লড়ছেন বলে ভাবছেন, সকলেই নির্দ্বিধায় বলে থাকেন — আসল শত্রু হল আর এস এস। আসলে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হওয়া থেকে বাঁচাতে হবে। জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে আর এস এসের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকেন, তাঁদের অন্যতম হলেন রাহুল গান্ধী। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করা হয়েছিল। বৈষ্ণোদেবীর মন্দিরে গিয়ে তিনি যে নরম হিন্দুত্ব চালান, তা কংগ্রেসী ঘরানার পুরনো রাজনীতি। কিন্তু জওহরলাল নেহরুর পরে সম্ভবত আর কোনো কংগ্রেস নেতা এত সরাসরি আর এস এস-কে আক্রমণ করতেন না। এ হেন রাহুলকে সাত তাড়াতাড়ি নেতৃত্ব দিতে পারেন না বলে দেগে দেওয়া এবং স্পষ্টত সংখ্যালঘুবিদ্বেষী, গণতান্ত্রিক আন্দোলনবিরোধী বাবুল সুপ্রিয়কে পার্টিতে জায়গা দেওয়া — এগুলো কি ধর্মনিরপেক্ষ জোটের নেত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করল? তাঁকে ভাবতে হবে। কারণ তিনি যাদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হবেন ভাবছেন, তারা ভাবতে পারে।

https://nagorik.net এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে।

শিক্ষক দিবসের প্রশ্ন: শিক্ষকদের বাঁচাবে কে?

কাকিমার এখন লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে মাসে এক হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু ছেলের উপর যে আশা ছিল, সে আশা পূরণ হল না।

কালের গতি রোধ করা যমেরও অসাধ্য। তাই আজ পশ্চিমবঙ্গেও শিক্ষক দিবস। নইলে যেখানে শিক্ষিকারা বিষ খেতে বাধ্য হন, সেখানে শিক্ষক দিবস বলে কিছু থাকতে পারে না। অণিমা নাথ, ছবি দাস, শিখা দাস, পুতুল মন্ডল, জোশুয়া টুডু, মন্দিরা সর্দারদের বিষ খাওয়া আসলে একটা ষড়যন্ত্র, অশান্তি সৃষ্টি করাই আসল উদ্দেশ্য ছিল — এমন অভিযোগ অবশ্য উঠেছে। [১] ওঠাই স্বাভাবিক। কৃষকরা আত্মহত্যা করলে যেমন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং তাদের অনুরাগীরা বলে থাকে “ক্ষতিপূরণের লোভে করেছে।” কবি এমনি এমনি লেখেননি, সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি। এ দেশে না জন্মালে আত্মহত্যা যে মরণোত্তর কিছু পাওয়ার লোভে করা সম্ভব এ তথ্য আপনি জানতে পারতেন? তেমনি প্রাথমিক স্কুলের কয়েকজন নগণ্য শিক্ষিকা যে একটা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারকে অস্থির করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে মানববোমার মত কাজ করতে পারেন — এ-ও অন্য কোথাও থাকলে জানা কঠিন হত। তাও আবার বিস্ফোরকবিহীন মানববোমা। মানে চারপাশে আর কেউ মরবে না, কারোর কোনো ক্ষতি হবে না। কেবল শিক্ষিকা নিজে মরবেন, আর তাতেই সরকার কেঁপে উঠবে। শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রতি আমাদের এত শ্রদ্ধা অবশিষ্ট আছে?

নেই। থাকলে ২০১৫ সালের মাদ্রাসা শিক্ষকদের অনশন আন্দোলনের কথা, ২০১৯ সালের প্যারাটিচারদের অনশনের কথা এবং স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে চাকরির প্রত্যাশায় থাকা হবু শিক্ষকদের অনশনের কথা মনে থাকত। কয়েকশো শিক্ষক বা হবু শিক্ষক ওই আন্দোলনগুলোতে অনশন করেছেন, খবরের কাগজের তিনের পাতায়, বা পাঁচের পাতায়, কি সাতের পাতায় খবর বেরিয়েছে। আমরা পাতা উল্টাতে গিয়ে হয়ত খেয়ালও করিনি। ছন্দা সাহার মৃত্যু (২০১৫) [২], রেবতী রাউতের মৃত্যু এবং তাপস বরের ব্রেন স্ট্রোক নিয়ে বিতর্ক (২০১৯) [৩] তৈরি হলে কখনো সখনো একটু হৈ চৈ হয়েছে। তারপর যে কে সেই। গত দশ বছরে এ রাজ্যে যে কোন আন্দোলনের প্রতি সরকারি উদাসীনতা এবং সামাজিক উদাসীনতার কারণে (শুধু সরকার কেন? আন্দোলনের ‘আ’ শুনলেই কারণ জানার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে আমরাও কি অভিসম্পাত দিই না?) সব ধরনের আন্দোলনকারী ভেবে নিতে বাধ্য হয়েছেন, জীবনের ঝুঁকি না নিলে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে না। তাই কেবল শিক্ষক, হবু শিক্ষকরা নয়, ডাক্তাররাও এই পর্বে অনশনের রাস্তা বেছে নিয়েছেন। বিষ খাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এক দিনে পৌঁছানো হয়নি।

এ রাজ্যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা কেমন আছেন খোঁজ নিতে গেলে প্রথমেই বিরাট অর্থনৈতিক বিভেদ চোখে পড়ে। স্কুলশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত স্থায়ী চাকরি করা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবস্থা যথেষ্ট সচ্ছল, অভিযোগের অবকাশ বলতে মহার্ঘ ভাতা নিয়ে রাজ্য সরকারের নিয়ে টালবাহানা। কিন্তু সেই অভিযোগ সমস্ত রাজ্য সরকারি কর্মচারীরই রয়েছে, কেবল তাঁদের নয়। চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করা প্যারাটিচারদের অবস্থা এর বিপরীত। তাঁরা মাস গেলে তেরো হাজার টাকার আশেপাশে মাইনে পান। প্রভিডেন্ট ফান্ড, প্রফেশনাল ট্যাক্স ইত্যাদি কেটে এগারো হাজার টাকার মত হাতে আসে, যোগ্যতা যা-ই হোক, অভিজ্ঞতা যত বছরেরই হোক। নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী তাঁদের দায়িত্ব ছিল ক্লাসের পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের যত্ন নেওয়া, স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুলে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। অথচ স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ যেহেতু বন্ধ, তাই স্কুলগুলোতে শূন্য পদের অভাব নেই, ফলত কাজের চাপ যথেষ্ট। অতএব স্কুল কর্তৃপক্ষ অনন্যোপায়। প্যারাটিচাররা পুরো সময়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সমান ক্লাস নিচ্ছেন, সমানে সমানে পরীক্ষার খাতাও দেখছেন। এমনকি, গোড়ায় কথা ছিল সপ্তাহে তিনদিন তাঁরা কাজ করবেন। তা অবস্থা বিশেষে ছদিনই হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ কাজ বেশি, মাইনে কম — প্যারাটিচারদের জন্য এটাই নিয়ম।

কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একইরকম বিভাজন তৈরি হয়েছে। পুরো সময়ের অধ্যাপনা শুরু করেই যেখানে হাজার পঞ্চাশেক টাকা মাইনে পাওয়া যাচ্ছে, বছরের পর বছর আংশিক সময়ের অধ্যাপক (যাঁদের এখন বলা হয় State Aided College Teacher — SACT) হয়ে থাকা নেট/স্লেট পাশ করা পিএইচডি অধ্যাপক, অধ্যাপিকারাও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকায় আটকে আছেন। কলেজের মর্জি মাফিক কোথাও কোথাও আরও কম। কলেজ সার্ভিস কমিশনের নিয়োগও অনিয়মিত। ফলে কলেজ চালানোর ক্ষেত্রে কিন্তু বড় ভূমিকা পালন করেন SACT-রা। অথচ ওঁদের পদগুলো, পরিভাষায়, নোশনাল। মানে কোনো SACT কোনো কারণে বিদায় নিলে তাঁর জায়গায় নতুন লোক পাওয়া যাবে না।

পশ্চিমবঙ্গে শিল্প নেই বহু বছর, কর্মসংস্থানের অভাব বর্তমান সরকারের আমলেই তৈরি হয়েছে এমন বললে নিতান্ত অন্যায় হবে। কলেজ সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ নিয়ে বামফ্রন্ট আমলেও বিস্তর ডামাডোল ছিল। কিন্তু দীর্ঘ অভাবের তালিকার পাশে যা ছিল, তা হল লেখাপড়া শিখতে পারলে এবং এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করলে শিক্ষকতার চাকরির নিশ্চয়তা। বাম আমলেই একসময় স্কুলের চাকরির নিয়োগে স্থানীয় স্তরে দুর্নীতির প্রচুর অভিযোগ উঠত। টাকা নিয়েই হোক অথবা নেতার সাথে পরিচিতি বা আত্মীয়তার সুবাদে যোগ্য প্রার্থীর বদলে অযোগ্য শিক্ষক, শিক্ষিকা নিয়োগ করা হচ্ছে — এমনটা কান পাতলেই শোনা যেত। স্কুল সার্ভিস কমিশন চালু হওয়ার পর ছবিটা বদলে গিয়েছিল। কতটা বদলেছিল? আমার পাড়ায় চপ ভাজেন এক কাকিমা; কাকুর ছোট দোকান ছিল। তাঁদের বড় ছেলে এম এ পড়ছিল। বছর কয়েক আগে একবার চপ কিনতে গিয়েছি, কাকিমা বড় মুখ করে বললেন “এরপর এসএসসিটা পাস করলে মাস্টারি পাবে। আমাদের সংসারটা দাঁড়িয়ে যাবে।” সেই এসএসসি আর তার দেওয়া হয়নি, কারণ পরীক্ষাটাই হয়নি। কাকিমার এখন লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে মাসে এক হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু ছেলের উপর যে আশা ছিল, সে আশা পূরণ হল না। ছেলে এখন কাকিমাকে ব্যবসায় সাহায্য করে। এইভাবেই কি ভবিষ্যতের শিক্ষক, শিক্ষিকা পাব আমরা?

এমন মনে করার কারণ নেই, যে পুরো সময়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা খুব ভাল আছেন। মাস গেলে মাইনেটা পেলেই মাস্টাররা খুশি, আর কিছু নিয়ে তারা ভাবে না। এমনিতেই একগাদা ছুটি পায়, অতিমারির ফলে তো আরও মজা হয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষিকাদের সম্বন্ধে এমন ভাবনা সাম্প্রতিককালে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। ফাঁকিবাজ পৃথিবীর সব পেশায়, সব কালে, সব দেশে থাকে। কিন্তু নিজের ধারণা নিয়ে বসে না থেকে শিক্ষক, শিক্ষিকাদের সাথে কথা বললে বোঝা যায় তাঁরা সুখে নেই।

মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বাতিল হয়ে যাওয়ার পর এক শিক্ষকের সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, পরীক্ষা বাতিল হয়ে যাওয়া খুবই দুঃখের। কিন্তু লেখাপড়াটা ঠিক করে হয়েছিল কি? অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষক অপ্রতুল, এদিকে পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হাজারটা কাজ চেপেছে তাঁদের ঘাড়ে। সরকারের কল্যাণমূলক প্রকল্পের কাজকর্ম অনেকটাই তাঁদের করতে হয়। করতে গিয়ে পড়ানোর সময় কাটছাঁট হয়। আরও বললেন, পশ্চিমবঙ্গে গত দশ বছরে যে হারে জনসংখ্যা বেড়েছে, সে হারে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বাড়েনি। কাগজে, টিভিতে ছাত্রীর সংখ্যা বাড়া নিয়ে উল্লাস হয়, কিন্তু ছাত্রের সংখ্যা যে কমে যাচ্ছে সে কথা কেউ বলে না। এই ছাত্ররা যাচ্ছে কোথায়? তাঁর মতে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে জীবিকার সন্ধানে চলে যাচ্ছে। তাঁর আশঙ্কা, এই প্রবণতা অতিমারীর প্রকোপে আরও বেড়ে গেল। একেই দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া এবং বছর দুয়েক স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে আসছে। ওই শিক্ষকের আশঙ্কা, এরপর যখন স্কুল খুলবে তখন দেখা যাবে স্কুলছুট ছাত্রের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেছে।

উনি যা বলেননি, তা হল সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা গত দশ-পনেরো বছর ধরেই কমছে। গ্রামাঞ্চলের কথা জানি না, শহর ও শহরতলি এলাকায় তার একটা বড় কারণ বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রতি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বাবা-মায়েদের পক্ষপাত। এর প্রভাবে কোথাও কোথাও ছাত্রসংখ্যা এমনভাবে কমছে, যে স্বয়ং বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত স্কুলও উঠে যেতে বসেছিল বছর দুয়েক আগে। ইংরেজি মাধ্যম করে দিয়ে বাঁচানো হয়েছে। [৪] বাংলা মাধ্যম অনেক স্কুলকেই ইংরেজি মাধ্যম করে বাঁচানোর চেষ্টা রাজ্য সরকার করছেন। বাঁচছে কিনা বুঝতে আরও কয়েক বছর লাগবে, কিন্তু ওই রুগ্ন স্কুলগুলোর মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের নিশ্চিন্ত থাকার দিন গিয়েছে। কারণ ১৯৯১-এর পর থেকে শিক্ষার বেসরকারিকরণের সঙ্গে সঙ্গেই এ কথা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে শিক্ষা (স্বাস্থ্যের মতই) আরও একটা ব্যবসা। আর রুগ্ন ব্যবসা যে রাখতে নেই তা কেন্দ্র বা রাজ্য, কোনো সরকারই অস্বীকার করে না। ফলে আজকের পাকা চাকরি মানেই আর কালকের পাকা চাকরি নয়।

মুশকিল হল, পঞ্চাশ হাজার, ষাট হাজার, এমনকি এক-দেড় লাখ টাকা খরচ করে যেসব ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের ভর্তি করছেন, সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনেকেই ভদ্রজনোচিত মাইনে পান না। স্কুল মালিক কোটিপতি হচ্ছেন, অথচ মাস্টাররা যে তিমিরে সেই তিমিরেই। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা বেসরকারি কলেজগুলোতে যাঁরা পড়ান, তাঁদের অবস্থাও তথৈবচ। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজের আংশিক সময়ের শিক্ষকদের কথা উপরে বলেছি। একই যোগ্যতার অনেকে মাসে পনেরো-কুড়ি হাজার টাকা বেতনে বেসরকারি কলেজগুলোতে পড়িয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার ক্লাস পিছু টাকা পান। কত পাবেন, কেমনভাবে পাবেন তা অনেক ক্ষেত্রেই কলেজ কর্তৃপক্ষের মেজাজ মর্জির উপর নির্ভর করে। বেসরকারি স্কুল এবং হাসপাতালের খরচ আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে মাঝেমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে হইচই হয়। মুখ্যমন্ত্রী বরাভয় নিয়ে আবির্ভূত হন, কাউকে ধমকে, কাউকে বাবা বাছা করে বুঝিয়ে অভিভাবকদের উপর চাপ কমাতে বলেন। কিন্তু মাস্টারদের মাইনে কোনো আলোচনার বিষয় হয় না। অবশ্য সরকারের বেতনভুক যে মাস্টাররা, তাঁদের আর্থিক দাবিদাওয়াই যখন কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে দাঁড়ায়, তখন বেসরকারি স্কুল, কলেজের শিক্ষকরা কার কাছে কী আশা করবেন?

২০১৮ সালে জগদ্বিখ্যাত টাইম পত্রিকা আমেরিকার পাবলিক স্কুলগুলোর মাস্টারদের পারিশ্রমিক নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওঁদের অবস্থা এত সঙ্গীন, যে একজন বলেছেন তিনি দিন গুজরান করার জন্য একসাথে তিনটে কাজ করেন, উপরন্তু ব্লাড প্লাজমা দান করেন।[৫] পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্তটা দেখিয়ে নিজেদের তার চেয়ে উন্নত প্রমাণ করায় আমরা ভারতীয়রা ওস্তাদ। অতএব সে প্রতিবেদন তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভাগ্যনিয়ন্তারা বলতেই পারেন, “আমরা অনেক ভাল রেখেছি।” সত্যিই তো। মাস্টারদের নিয়ে সরকারের তো বিশেষ মাথা ঘামানোর দরকার নেই। কী পড়ানো হবে, কেন পড়ানো হবে — সেসব কর্পোরেট জগত ইতিমধ্যেই ঠিক করতে শুরু করেছে, আগামী দিনে আরও করবে। যে শিক্ষা কর্পোরেটের কাজে লাগে না, তা যে শিক্ষাই নয় — সে ব্যাপারে ঐকমত্য শিগগির তৈরি হয়ে যাবে। কদিন পর আপনি নিজেই বলবেন, আপনার সন্তানের ছবি আঁকা, খেলাধুলো করা, গান গাওয়া, সাহিত্য পড়া বা ভাল করে অঙ্ক শেখাও তত জরুরি নয়, যত জরুরি কোডিং শেখা। আর সেটা করতে কড়া বা স্নেহময় মাস্টারমশাই, দিদিমণি লাগে না। লাগে একটা অ্যাপ। যাদের অ্যাপ নেই তারা শিখবে না। মিটে গেল।

শিক্ষক দিবসে দাঁড়িয়ে ভয় হচ্ছে, শেরনি ছবিতে যেমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে মানুষের কুকর্মের ফলে একসময় বাঘ দেখতে মিউজিয়ামে যেতে হবে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও না সেই অবস্থা হয়।

তথ্যসূত্র:

১) হিন্দুস্তান টাইমস
২) ওল্ড ইন্ডিয়া টুমোরো
৩) সংবাদ প্রতিদিন
৪) আনন্দবাজার পত্রিকা
৫) টাইম ডট কম

https://nagorik.net এ প্রকাশিত