সুখেন মুর্মুর চদরবদর: অচেনার আনন্দ, অজানার সংকট

ওলট পালট করে দিতে এই গল্পকার সিদ্ধহস্ত। ডাক্তার বর্মণের ভাই নিজের বাবা-মায়ের কাছেও এতই তুচ্ছ যে তার নামকরণ হয় ফাক্তার।

বাঙালির যৌনতা নিয়ে ছুতমার্গ আছে, বাঙালি পাঠক সাহিত্যে যৌনতা এসে পড়লেই নাক সিঁটকায় আর লেখকরাও সযত্নে যৌনতা এড়িয়ে যান — এই বহু পুরনো অভিযোগের ধার ইদানীং কমে গেছে। কারণ মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে পাঠকদের যৌনতা নিয়ে অস্বস্তি বিলক্ষণ কমে গেছে, লেখকরাও আর তত সলজ্জ নেই। অনেকেই যথেষ্ট “সাহসী”। কিন্তু অধিকাংশ যৌনতার বর্ণনা একমাত্রিক, একঘেয়ে। এক লেখকের যৌনতার বর্ণনা অন্যের গল্পে বসিয়ে দিলে তফাত করা যাবে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেখা যায়, মহিলা লেখক বর্ণিত যৌনতাও একইরকম দামি অন্তর্বাসশোভিত, পুরুষের মনোরঞ্জনমূলক। সম্ভ্রান্ত মহিলার স্তনসন্ধির ওপারে উঁকিঝুঁকি মেরে পাঠককে কিছুটা নিষিদ্ধ আনন্দের শিহরণ দেওয়া ছাড়া সে বর্ণনা কিছুই করতে পারে না। তাই চমকে না উঠে উপায় থাকে না, যখন পড়ি:

এবার যে মানুষটা ঘরে আসে সে যেন অন্যরকম আলতাফ। নরম, ভালোবাসাময়, সেই সাদির সময়কার আলতাফের মতো মনে হয়। কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখে বিদ্যুৎ খেলে যায় আরতির। স্তনবৃন্তে দাঁত ফুটিয়ে আলতাফ হোসেন টাকা চায়। ঘাড়ের থেকে চুলের গোছা সরিয়ে চুমু খেলে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না আরতি। গোপন কয়েকটি টাকার কথা কবুল করে ফেলে। মারের মুখে কঠিন মেয়ে আরতি। সে-ই কিনা আদরে গলে গলে যায়। তার নিচু টালির চালের ছোট্ট ঘরের বিছানায় ঘুমন্ত ছেলেরা জেগে গেছে টের পায় না। টের পায় না অবশ হতে হতে বাষ্প হওয়ার সময়, ভুলে যায় দিন-রাত প্রতীক্ষার নাম ধরে ডাকার সময়গুলো। এভাবেই মেঘ থেকে মেঘে ঘন হয় আলিঙ্গন। ওষ্ঠের কাঁপন, লালা, ঢুকিয়ে দেওয়া জিহ্বামূল, অবশ অবশ সব খুশিতে না-পাওয়ার দিনগুলো মুছে যায় জলরঙা ছবির মতো। দেওয়াল থেকে নেমে-আসা ক্যালেন্ডারে নায়ক নায়িকার ছবিগুলি জ্যান্ত হয়। শরীর শরীর বলে ডাকে। প্রেম প্রেম বলে বাতাসে ওড়ায় আগুন, ছাই, বিষাদ। আলতাফের সবল শরীরের নীচে পিষ্ট হতে হতে টের পায়, এমনকি একদানা সোনার নাকছাবিটাও আলতাফ আদরে সোহাগে খুলে নিল…

পাঠক, ভুল কারণে উত্তেজিত হয়ে পড়বেন না যেন। তীব্র যৌনতার বর্ণনা উদ্ধৃত করে দুই ভিন্ন ধর্মের নরনারীর যৌন সঙ্গমকে গৌরবান্বিত করছি না। যৌনতা যে মনোমুগ্ধকর হয়েও হরণের হাতিয়ার হতে পারে, তা লিখে ফেলার মুনশিয়ানাকে তারিফ করছি মাত্র। লিখেছেন এণাক্ষী রায়। গল্পের নাম ‘ই-সেভেনের বারান্দা’। আরতির নাম আসলে আরতি নয়। তার নাম আয়েষা, সে আলতাফের বেগম। আয়েষাকে আরতি সাজতে হয় কারণ আমার আপনার মত ফ্ল্যাটমালিকরা আয়েষাকে আরতি জেনে সংসারের প্রায় সব দায়দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু আসল পরিচয় জানলে রাতারাতি তাড়িয়েও দেয়। দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার চালানোর জন্য পরিচারিকার চাকরি আরতির কতটা দরকার, তা আলতাফের প্রেমের বহর দেখে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন। যদি না যৌনতার বর্ণনাটাই আপনাকে অভিভূত করে থাকে।

এণাক্ষীর গল্পের চতুর্থ বই সুখেন মুর্মুর চদরবদর অবশ্য বারবার অভিভূত করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। যেমন বিষয় নির্বাচনে, চরিত্র চিত্রণে; তেমনি গদ্যের বর্ণময়তায়। নাম গল্পটার কথাই ধরুন। নামটা পড়েই খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠেছেন তো? আমিও তাই করেছিলাম। এই গল্পের খেঁকুরে চেহারার ভদ্রলোকটিও হেসেছিল। আমরা কি আর জানি, চদরবদর একটা শিল্পমাধ্যম, যাতে আছে পুতুলনাচ দেখানো, গান গাওয়া, সারিন্দা বাজানো? গল্পের খেঁকুরে ভদ্রলোকের হাসি আপনি যতক্ষণে দেখতে পাবেন, ততক্ষণে আর তার অজ্ঞতায় আপনার হাসার উপায় থাকবে না। কারণ টের পাবেন, ওই হাসি প্রকৃতপক্ষে গল্পকারের রামচিমটি। অবশ্য ওই চিমটিতে আমাদের কী-ই বা এসে যায়? আমরা তো সুখেন মুর্মুর সহমর্মী নই, তার লুপ্ত হতে চলা বংশানুক্রমিক পেশার সংকট আমাদের সংকট নয়। সরকার টাকা দিচ্ছে গাছ কাটার অপকারিতা প্রচার করতে, আবার সেই সরকারই বহু সুপ্রাচীন গাছ কাটতে বলছে। তাহলে কোনটা উচিত কাজ? এই সংশয়ও আমাদের নয়। কারণ গাছ কাটা পড়লে বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় কোনো প্রেত আমাদের বলে উঠবে না “সুঁখেন, মেলা টাকা পায়ে ব্যাবাক ভুলি যাবা ধরিছিস বাউ!” আমরা বরং বিডিওর মত নিঃসংশয়। “উন্নয়ন তো দরকার!” তবে আমাদের দ্বিধাহীন জগতে সুখেন মুর্মুকে এনে ফেলে আমাদের কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে ফেলে দেন গল্পকার। বোঝা যায়, বাপ্পাদিত্য মণ্ডলের তৈরি প্রচ্ছদে যে পুতুলগুলো নাচছে সেগুলো শুধু সুখেন মুর্মুর পুতুল নয়, সে নিজেও পুতুল। তাকে দক্ষতর বাজিকর নাচাচ্ছে। গল্পটা পড়ার পর সন্দেহ হবে, আমাকেও কেউ নাচাচ্ছে না তো?

অস্বস্তির অবশ্য এখানে শেষ নয়, শুরু। এমন সব মানুষের গল্প এ বইতে এণাক্ষী আমাদের বলছেন, যাদের অস্তিত্ব যত কম জানা যায় তত স্বস্তিতে থাকা যায়। ধরুন আপনি যদি জানতে পারেন

এই ডিজিটাল যুগেও মেলায় মেলায় তাঁবু খাটিয়ে নাচ-গান হয়, এইসব দলগুলোকে বলে চিত্রহার। সার্কাসের দলের মতো তাঁবু নিয়ে নিয়ে ঘোরে চিত্রহার মালিকেরা। নায়ক নায়িকা ছাড়াও আরো নাচিয়ে লাগে। শাহরুখ খানের গায়ে সারাক্ষণ আঠার মতো লেপ্টে থাকতে চায় হিয়া। হিয়া মনে মনে শাহরুখ খান বললেও ছেলেটার আসল নাম রাজ। আবার রাজটাও আসল নাম নয়, নাচের দলের নাম। আসল নামের হদিশ হিয়া জানে না। নাচের সময় ভুল হলে হাত, কোমর এসব ধরে স্টেপ ঠিক করে দেয় শাহরুখ খান। এই স্পর্শটুকুর জন্য বারবার স্টেপে ভুল করে হিয়া। নিজের কাপড় গোঁজা বুকটা এগিয়ে ঠেকিয়ে দেয় শাহরুখ খানের শরীরে। প্রধান ড্যান্সার হবার জন্য এসব করতে হয় বুঝে গেছে হিয়া।

“ওই মেয়েগুলো ওইরকমই” বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন তো? ওভাবে পার পাবেন না। ‘চিত্রহার’ গল্পের হিয়া কিন্তু শহরের প্রান্তের “নেপালি বস্তি থেকে” আসা মেয়ে নয়। সে আমার আপনার মত পরিবারের ভাল স্কুলে পড়া মেয়ে। কেবল “কালো বলে হিয়া সবসময়ই হীনমন্যতায় ভোগে…পারতপক্ষে অঙ্কিতার পাশে পাশে হাঁটতে চায় না ও। অঙ্কিতার পাশে দাঁড়ালে যেন নিজের কালো রঙটা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।” পেরেন্টস-টিচার মিটিংয়ে অন্য মেয়েদের বাবা-মায়ের পাশে হিয়ার বাবা-মা বেমানান। তারাও হিয়ার বাবাকে ছোটলোক ভাবে, কারোর জন্মদিনে হিয়ার নেমন্তন্ন হয় না। হিয়া ব্রেকড্যান্স স্কুলে ভর্তি হতে চায় সবাইকে দেখিয়ে দেবে বলে। “বিপাশা বসু তো কালো, নায়িকা কাজলও কালো। ওরা যদি নায়িকা হতে পারে হিয়া কেন পারবে না?” ক্যান্সারের গ্রাসে চলে যাওয়া মা আর মদ্যে নিমজ্জিত বাবার মেয়ে চিত্রহারের মেয়ে হয়ে যায়। বহু বছর পরে, মা মারা যাওয়ার পরে “মাঠ-ঘাট পেরিয়ে রাত কাঁপিয়ে মুম্বাইয়ের ট্রেন চলে যায় অনেক দূরে। শুকনো পাতা থেকে ডানাগুলো খসে খসে পড়ে। হিয়ার এখন কখনো-কখনো মনে হয় — ওটা ফিরতি ট্রেন, সে ফিরে আসছে। কিন্তু কোথায় ফিরছে সেটা কিছু মনে আসে না।” যে মেয়ে ফিরে আসতে চায় সে কি খারাপ মেয়ে? কেন খারাপ? নাকি সে ভাল মেয়ে? কেন ভাল? পকেটের পয়সা দিয়ে অ্যাপ থেকে ই-বুক ডাউনলোড করে পড়বেন। তা থেকে এতসব হিং টিং ছট প্রশ্ন উঠে এলে কেমন ফেলতেও পারছি না, ওগরাতেও পারছি না অবস্থা হয় না, বলুন?

গল্প পড়েন কেন? চেনাকে নতুন করে চেনার জন্য, নাকি অচেনাকে চেনার জন্য? এ বই কিন্তু মূলত দ্বিতীয়টার জন্য। ভাবুন, এই শরৎকালে আপনি পড়ছেন ময়নার কথা (‘অসুরকন্যা’):

ও যা-দেখে অন্য কেউ দেখতে পায় না কেন! নীল আকাশে ফটফটে সাদা হাঁসগুলো উড়ে যায়। ওদের দুই-একটা পালক খসে পড়ে চেল নদীর ধারে। সেখানে পাথর ফুঁড়ে ওই পাখনার গাছ গজায় তখন। ওই বিষবাতাস ফরফর ক’রে পালকগুলো বাতাসে উড়িয়ে দেয়। ওই সাদা হাঁসের উড়ে যাওয়া, ওই হাঁসের পাখনার গাছ আর কেউ দেখতে পায় না। মনটা টনটনায় ময়নার। ঢ্যাঙ্কুরাকুড় শব্দ শোনা যায় মনের মধ্যে। এই শব্দটা কানে বাজলেই বাতাসে আরও বিষ ভরে ওঠে। বাতাসটা তখন ভারী ভারী ঠেকে। এই সময় বাগানের থেকে বোনাস পাওয়া যায়। তবু নতুন জামা কাপড় কেনে না ময়নারা।

কেন কেনে না? এণাক্ষীর গল্প কেবল সেই প্রশ্নের উত্তরে আটকে থাকে না। দুষ্ট আর শিষ্টের প্রতীক একেবারে উল্টে দেন তিনি।

ওলট পালট করে দিতে এই গল্পকার সিদ্ধহস্ত। ডাক্তার বর্মণের ভাই নিজের বাবা-মায়ের কাছেও এতই তুচ্ছ যে তার নামকরণ হয় ফাক্তার (‘লাল ঘোড়া কালো ঘোড়া’)। এফিডেভিট করিয়ে অমিতাবচ্চন নাম নিলেও সে তুচ্ছতা ঘোচে না। সেই ফাক্তারকেই এক নিমেষে কাউবয় গ্রেগরি পেক করে তোলেন এণাক্ষী। আর নিরুচ্চারে সীমান্তবর্তী গ্রামের পটভূমিতে লিখিত এই গল্পের নায়িকা হয়ে ওঠে ২০১১ সালে বিএসএফের গুলিতে নিহত ফেলানি খাতুন — এমনই তাঁর কলমের জোর।

গল্প বলার এমন জাদুশক্তির অধিকারী যাঁরা হন, বোধহয় তাঁরাই দেখাতে পারেন ‘কন্যাঋণ’ গল্পের মত সংযম। শেষ ওয়েব পেজে পৌঁছনোর আগে পর্যন্ত এই গল্পকে প্রবীণ সাহিত্যিকের সাথে এক কন্যাপ্রতিম অনুরাগিনীর মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠার কাহিনীর চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না। সাম্প্রতিককালে এই কাহিনী গল্পে, কবিতায়, মুক্তগদ্যে চর্বিতচর্বণ করে প্রায় বিতৃষ্ণা ধরিয়ে দিয়েছেন এক প্রথিতযশা সাহিত্যিক। এণাক্ষীর জাদুকাঠি সেই বস্তাপচা কাহিনীকে কাঁপন ধরানো উপসংহার দিয়েছে। শেষ কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করার লোভ গল্পকারের চেয়েও বেশি সংযমে সামলে নিলাম। কারণ সবই সমালোচনা থেকে জেনে নেবেন — পাঠকের এই ফাঁকিবাজি এণাক্ষীর প্রাপ্য নয়।

কেতাব-e অ্যাপ প্রকাশিত এই ই-বুকের দাম ১০০ টাকা। বাংলায় লেখালিখি করা পশ্চিমবাংলায় এমনই অভিশাপ, যে দামটা এক প্লেট শস্তা বিরিয়ানির চেয়েও কম। আপনি যদি নতুন কিছু পড়তে চান, অচেনাকে ভয় না করেন — তাহলে এই দাম আপনার কাছে বাধা হবে না। তবে এমন হতেই পারে, যে গল্পের বইতে আপনি এসব চান না। সাহিত্যের কাছে আপনার মুখ্য চাহিদা ভাষার সৌন্দর্য। তাহলেও এ বই আপনাকে হতাশ করবে না। আর জ্বালাব না প্রিয় পাঠক। এ বইয়ের সবচেয়ে সুখপাঠ্য গল্পের খানিকটা দিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ করি:

ফুটন্ত জলে লম্বা লম্বা চাপাতা ফেললে, একটু পর আস্তে আস্তে হালকা করে রঙ বেরতে থাকে। অল্প অল্প করে সমস্ত জলটাই রঙিন হয়ে ওঠে একসময়। ভোরের আকাশটাকেও তেমন লাগে। অল্প অল্প করে হালকা লালচে রঙ ছড়িয়ে পড়তে পড়তে পুব দিকটা একসময় লাল হয়ে ওঠে। ভোরের আকাশটা পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় একরকম করে ফুটে ওঠে।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

One thought on “সুখেন মুর্মুর চদরবদর: অচেনার আনন্দ, অজানার সংকট”

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading