কানহাইয়ার কেরিয়ার আর কমিউনিস্ট আদর্শবাদ: তার ছিঁড়ে গেছে কবে

মার্কস গুলে খাওয়া সত্ত্বেও পুঁজিবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা তেজস্বী সূর্যদের চেয়ে কানহাইয়া কুমারদের মধ্যে কম নয়।

পশ্চিমবঙ্গে তখন বামফ্রন্ট সরকার। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস, মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিপিএম নেতৃত্বে কেন তরুণ প্রজন্মকে দেখা যাচ্ছে না তা নিয়ে প্রবল আলোচনা চতুর্দিকে। কোনো এক সাংবাদিক সম্মেলনে তা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে সিপিএমের প্রতিনিধি যা বলেছিলেন তা অনেকটা এইরকম — গরীব খেটে খাওয়া মানুষের জন্যে যেসব তরুণ কাজ করতে চান, তাঁরা আমাদের পার্টিতে স্বাগত। কমিউনিস্ট পার্টিতে নেতৃত্বে আসা এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কাজের মধ্যে দিয়েই সংগঠন তার নেতা খুঁজে নেয়। কিন্তু নেতা হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি করা যায় না। নেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকলে আমাদের পার্টিতে আসবেন না।

সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিকে এই সাংবাদিক সম্মেলনের প্রতিবেদনে উদ্বেগ সহকারে লেখা হয়েছিল, সিপিএম নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন না যুবসমাজের উপর এই বিবৃতির কীরকম বিরূপ প্রভাব পড়বে। সিপিএম কি বলতে চাইছে কারোর যদি জীবনের লক্ষ্য হয় পরবর্তী অনিল বিশ্বাস বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য হওয়া, তার জন্যে পার্টিতে কোনো জায়গা নেই? বামপন্থীরা আবার প্রমাণ করল তারা যুবসমাজের অ্যাম্বিশনকে কোনো দাম দেয় না।

অন্যান্য সংবাদমাধ্যমেও অনুরূপ সমালোচনা হয়েছিল। এই বিশুদ্ধতা কার্যক্ষেত্রে সিপিএম কতটা বজায় রেখেছিল, সকলের জন্য একইভাবে রেখেছিল কিনা, কতজন নানাবিধ কায়েমী স্বার্থ নিয়েই সেই আমলে সিপিএম বা অন্য বাম দলগুলোতে ঢুকে পড়েছিল বিভিন্ন স্তরে — তা ভিন্ন আলোচনার বিষয় এবং সে আলোচনায় সিপিএমের অন্ধকার দিকগুলোই নিশ্চিতভাবে বেশি আলোকিত হবে। কিন্তু এই সহস্রাব্দের গোড়ায় একটা ক্ষমতাসীন দল বলছে নেতা হতে চাইলে আমাদের দলে আসবেন না, মানুষের জন্য কাজ করতে চাইলে আসুন। আর সে জন্যে সংবাদমাধ্যম তাদের নিন্দা করছে — এ কথা মনে পড়লে বুঝতে অসুবিধা হয় না, কেন দেশ আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সেদিন সোশাল মিডিয়া ছিল না। থাকলে সেখানেও যে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত সংবাদমাধ্যমের সাথে মিলে যেত, তা বলাই বাহুল্য। আসলে রাজনীতি যে আর পাঁচটা পেশার মতই একটা পেশা, তেমনটা হওয়াই যে কাম্য — একথা অর্থনৈতিক উদারীকরণের ভারতে সযত্নে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। আজ অমিত শাহকে ব্রিফকেস নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে যাঁরা নীতি-নৈতিকতার কথা তোলেন, তাঁরাই অনেকে ওই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার পুরোভাগে ছিলেন।

অ্যাম্বিশন, কেরিয়ার — এই শব্দগুলো যদি রাজনীতির জগতে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে, তার অনিবার্য ফল প্রশান্ত কিশোর, অমিত শাহ। এবং কানহাইয়া কুমার। কাঁটাবিহীন গোলাপ হয় না। টাকার বিনিময়ে যে কোনো পার্টিকে ভোটে জেতানোর চেষ্টা করা যার পেশা, সেই প্রশান্ত কিশোরকে জিনিয়াস বলব; আর অমিত শাহ টাকা দিয়ে বিধায়ক কিনে নিলে গেল গেল রব তুলব — এটা যে দ্বিচারিতা, তা স্বীকার করার সময় এসে গেছে। না করলে অমিত শাহদের শক্তি বাড়তেই থাকবে। তেমনি কানহাইয়া কুমার সিপিআই ছেড়ে কংগ্রেসে গেলে খুশি হব, বলব সে এমন একটা পার্টিতে গেল যেখানে ওর প্রতিভা কাজে লাগবে; আর জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া বা ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং বিজেপিতে গেলেই (ক্যাপ্টেন এখনো যাননি, এই লেখার সময় অমিত শাহের সাথে দেখা করবেন বলে খবর) জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করল বলে চেঁচাব, তা হয় না। রাজনীতির নীতিহীনতা নিয়ে যত বড় বড় কথাই বলা বা লেখা হোক, আসলে ও নিয়ে আমাদের কারোর মাথাব্যথা নেই। মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে শুধুমাত্র নীতিহীনতার ফলটা আমাদের পছন্দের দলের পক্ষে না গেলে।

এই সত্য মেনে নিয়ে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে আলোচিত বামপন্থী কানহাইয়া কুমারের কংগ্রেসে যোগদান নিয়ে আলোচনা করা যাক।

কানহাইয়া কেন সবচেয়ে আলোচিত? তিনি কি বিপুল ব্যবধানে কোনো নির্বাচনে জিতেছেন? না। তিনি কোনো বিরাট গণআন্দোলন সংগঠিত করেছেন? না। আসলে কানহাইয়া পাদপ্রদীপের আলো সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন বলে সবচেয়ে আলোচিত। অকারণে পাননি। কমিউনিস্টদের মধ্যে দীর্ঘদিন যাকে প্রায় কৌলীন্যের লক্ষণ বলে ধরা হত, ছাত্রাবস্থাতেই সেই কারাবাস তাঁকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছে। একেবারে প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতাদের মতই অকারণে, সম্পূর্ণ সাজানো কেসে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। যেহেতু ঘটনাটা ঘটেছিল ভারতের রাজধানীতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়টার নাম জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, স্বভাবতই দেশের সব টিভি ক্যামেরার চোখ পড়েছিল তাঁর উপর। নিঃসংশয়ে বলা যায়, কানহাইয়া নামক সেলিব্রিটির জন্ম হল হাজতবাস কাটিয়ে ফিরে আসার রাত্রে, যখন তিনি ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। প্রায় সব চব্বিশ ঘন্টার নিউজ চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার হল। সেদিন থেকেই রাজ্যসভা বা লোকসভার যে কোনো বামপন্থী সাংসদের চেয়েও সাধারণ ভারতীয়ের কাছে বেশি পরিচিত মুখ হয়ে উঠলেন কানহাইয়া। নিঃসন্দেহে তিনি সুবক্তা, তাই মুহুর্মুহু বিভিন্ন চ্যানেলের বিতর্কসভায় ডাক আসতে থাকল, কিছুদিনের মধ্যেই বইয়ের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর হল। এদিকে নিরাশায়, আলোহীনতায় ডুবে থাকা বাম দলগুলোর কর্মী, সমর্থকরা খড়কুটোর মত কানহাইয়াকে আঁকড়ে ধরলেন। কমিউনিস্ট হলেই বা, তাঁদের জন্ম ভারতে। আর ভারত হল অবতারবাদের দেশ, অবচেতনে সে মতবাদ সকলের মধ্যেই ঢুকে বসে আছে। কানহাইয়া কোথাও পাঁচ মিনিট কথা বললেও সে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। কানহাইয়া আরও বেশি করে আলোচিত হয়েছেন।

এসবের মধ্যে দিয়ে কানহাইয়ার একটি গুণই জনসমক্ষে এসেছে — তিনি সুবক্তা। মুশকিল হল রাজনীতি মানে শুধু বক্তৃতা দেওয়া নয়। কিন্তু সেকথা আমরা ভুলে গেছি বা বলা যায় ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতিকে যেমন পেশা বা কেরিয়ার করে তোলা হয়েছে আমাদের চোখে, তেমনি একে পারফর্মিং আর্টও করে তোলা হয়েছে। যে সেরা বক্তৃতা দেয়, সে-ই সেরা নেতা। কার বক্তৃতা কত হাজার শেয়ার হয়, কতগুলো লাইক পড়ে — সেগুলোই তার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতার প্রমাণ। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য পর্যাপ্ত হাসপাতালের বেড, অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করা নেতাসুলভ নয়। মৃত মানুষের জন্য ক্যামেরার সামনে কাঁদা নেতাসুলভ। নিকাশি ব্যবস্থার সংস্কার নেতার কর্তব্য নয়, এক গোড়ালি জলে দাঁড়িয়ে তদারক করা নেতাসুলভ। মিডিয়া আমাদের এমনটাই শিখিয়েছে। কে নেতা আর কে নেতা নয়, তা আর কাজ দিয়ে বিচার হয় না। মিডিয়া যাকে বেশি দেখায় তাকেই সবাই চেনে, সে-ই নেতা। কানহাইয়াকে সেই কারণেই অনেকের মনে হয়েছিল বামপন্থীদের আশা ভরসা। ইতিমধ্যে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে তিনি নিজের জায়গা বেগুসরাইতে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। কুণাল কামরা, স্বরা ভাস্করের মত বিখ্যাতরা তাঁর হয়ে মাঠে নেমে প্রচার করেছিলেন; বহু বিখ্যাত, অখ্যাত মানুষ অনলাইন প্রচার করেছিলেন, ক্রাউড ফান্ডিং করে তাঁর জন্য টাকা তুলেছিলেন। কিন্তু বেগুসরাইয়ে সিপিআই দীর্ঘকাল ধরে যা ভোট পেয়ে আসছে, তার চেয়ে খুব বেশি ভোট কিন্তু কানহাইয়া পাননি। তাতেও বামপন্থী কর্মী সমর্থকদের মনে তাঁকে নিয়ে আশা বজায় থেকেছে। কানহাইয়া যেন ম্যায় আজাদ হুঁ ছবির অমিতাভ বচ্চন। মিডিয়াই তাঁকে নেতা বানিয়ে ফেলল, তাঁকে কেবল কয়েকটা ভাল বক্তৃতা দিতে হল। মনে রাখা ভাল, কানহাইয়ার প্রতি যা যা অবিচার হয়েছিল, তার সবগুলোই উমর খালিদের প্রতিও হয়েছিল। কিন্তু মিডিয়া তাঁকে তত দেখায়নি, তাঁর দেওয়া স্লোগান নিয়ে র‍্যাপ তৈরি হয়নি। হয়ত তাই তিনি আমাদের চোখে নেতা হয়ে ওঠেননি, এক বছরের বেশি সময় ধরে ইউএপিএ মামলায় জেলে পচছেন, অভিযোগের শুনানি পর্যন্ত হয়নি।

মুশকিল হল, কেবল কমিউনিস্ট পার্টি নয়, ভারতের কোনো পার্টির ইতিহাসেই স্রেফ পাদপ্রদীপের আলো পেয়ে কেউ নেতা হয়ে উঠতে পারেনি। ইন্দিরা গান্ধীর পরিবারের সদস্য হয়েও রাহুল গান্ধী আজ পর্যন্ত পারেননি। কানহাইয়ার অমন বংশপরিচয় নেই, ফলে তাঁর পক্ষে পেরে ওঠা আরও শক্ত। তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চর্চা করার চেয়ে বেশি জরুরি, কানহাইয়ার দল বদল এ দেশের কমিউনিস্টদের সম্বন্ধে কী প্রমাণ করে তা নিয়ে আলোচনা করা। কমিউনিস্টরা দল পাল্টান না, আর কমিউনিস্ট পার্টিতে যে কেউ ঢুকতে পারে না — এই দুটো কথাই যে আর সূর্য পূর্ব দিকে ওঠার মত সত্য নেই তা পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছুদিন আগেই বোঝা গেছে। সম্প্রতি কেরালাতেও এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতাকে সাদরে সিপিএমে জায়গা দেওয়া হয়েছে। কানহাইয়ার ঘটনা বরং দেখাল, বামপন্থী ছাত্রনেতাদের রঙিন চশমা পরে দেখা বন্ধ করা উচিত। সিপিএমে বৃদ্ধতন্ত্র চলে এ অভিযোগ পুরনো। তা নিয়ে গোড়াতেই আলোচনা করা হয়েছে। সিপিআই নেতাদের মধ্যেও খুব যে তরুণ মুখ চোখে পড়ে এমন নয়। গত কয়েক বছরে এই সমালোচনা কাটিয়ে উঠতে দু দলের নেতাদের মধ্যেই সচেতন প্রয়াস দেখা গেছে। কানহাইয়া তার সুফল পেয়েছেন; যেমন পেয়েছেন সিপিএমের মীনাক্ষী, সৃজন, ঐশী, দীপ্সিতা, প্রতীকুর, পৃথারা। কিন্তু এঁদের সবাইকে তুলে আনা হয়েছে ছাত্র, যুব ফ্রন্ট থেকে। এঁদের নিয়ে সাধারণ সমর্থকরাও যারপরনাই আহ্লাদিত হয়েছেন, অথচ ভোট মিটে যাওয়ার পর এঁরা কে কোথায় তা বোঝা শক্ত হয়ে উঠেছে। তরুণ কৃষক নেতা বা শ্রমিক নেতা কি নেই, নাকি তারা ঝকঝকে চেহারার নয়, সুবক্তা নয় বলে ফুটেজ পাবে না — তাই তাদের সামনে আনা হয় না? কানহাইয়া কিন্তু দেখিয়ে দিলেন, আজকের ছাত্রনেতা মানেই সীতারাম ইয়েচুরি নয়, যে সর্বভারতীয় পরীক্ষায় প্রথম হয়েও আজীবন মন্ত্রী সান্ত্রী হওয়ার আশা না করে কমিউনিস্ট পার্টি করে যাবে। ছাত্রনেতা মানেই দীপঙ্কর ভট্টাচার্য নয়, যে উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হয়ে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটের মত প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেও বিদেশে মোটা মাইনের চাকরি নিয়ে চলে না গিয়ে বিহারের চাষাভুষোদের মধ্যে রাজনীতি করবে। মার্কস গুলে খাওয়া সত্ত্বেও পুঁজিবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা তেজস্বী সূর্যদের চেয়ে কানহাইয়া কুমারদের মধ্যে কম নয়। মার্কসবাদ যে তা বলেও না, একথা কমিউনিস্ট দলগুলোকে আবার স্মরণ করতে হবে।

শোনা যাচ্ছে কানহাইয়া কুমার এবং গুজরাতের নেতা জিগ্নেশ মেওয়ানির কংগ্রেসে যোগদান খোদ রাহুল গান্ধীর ইচ্ছায়। যিনি ন্যূনতম আয় প্রকল্পের কথা বলেন, ২০২১ সালে নাম করে ভারতের ক্রোনি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, বিজেপিকে অতিক্রম করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ভারতীয়ত্বের ধারণার বিরুদ্ধে বারবার বলেন, তাঁকে বৃহত্তর অর্থে বামপন্থী বলতে আপত্তি করার কারণ নেই। কিন্তু সে বামপন্থা কি ভারতের দুর্বল হয়ে পড়া কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিকল্প? দল হিসাবে কংগ্রেসের ইতিহাস দেখলে তা বলা শক্ত। অতএব সেই যুক্তিতে কানহাইয়ার কংগ্রেসে যোগদানে যে বামপন্থীরা খুশি, তাঁরা কদিন পরেই “যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই” বলতে শুরু করবেন সম্ভবত।

একই কবিতা রাহুলকেও আওড়াতে হতে পারে। জিগ্নেশের গণআন্দোলন গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা হয়ত নড়বড়ে গুজরাত বিজেপির বিপক্ষে কংগ্রেসের কাজে লাগবে, কিন্তু স্রেফ বাগ্মিতার জোরে কানহাইয়া বিহারে কংগ্রেসকে শক্ত জমিতে দাঁড় করাতে পারবেন — এমনটা এখুনি ভাবা যাচ্ছে না। লিবারেশন, সিপিএম এবং সিপিআইয়ে কানহাইয়ার প্রাক্তন কমরেডরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে অনেকটাই এগিয়ে। পার্টি সংগঠন তুলে নিয়ে যাওয়া এয়ার কন্ডিশনার খুলে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত। ছবি উইকিপিডিয়া থেকে

বর্ষার শব্দ

শিরীষ কাগজের চালাকি ভেদ করতে বর্ষার একটা গোটা মরসুমও লাগেনি। ভিতরে ঢুকতে পেয়ে তার সুরও গেল বদলে।

বর্ষার শব্দ আছে। বৃষ্টির শব্দ নয়, যে শব্দের কথা বলছি তা অন্য কোনো শব্দের সাথে মেলে না।

আমাদের বাড়িটা মজবুত এবং পাকা। কিন্তু বাবা-জ্যাঠাদের মধ্যে ঠাকুর্দার তৈরি বাড়ি ভাগাভাগি হওয়ার সময় বারান্দাটা আমাদের ভাগে পড়েনি। অথচ রোজ প্রচুর মানুষ আসেন বাবার কাছে নানা প্রয়োজনে, তাঁদের বসার জায়গা দেওয়া যায় না। তাই বারান্দার দরকার পড়ল। শিক্ষক বাবার মাইনে তখন হাজার দশেক। মাকে জিজ্ঞেস করলেন “লোন নিয়ে বারান্দাটা করে না ফেললে আগামী বর্ষায় খুব মুশকিলে পড়ব। কটা বছর ডাল, আলুসেদ্ধ খেয়ে থাকতে হবে কিন্তু। পারবে তো?” সে যুগের মধ্যবিত্ত গৃহিণীরা পারতেন না এমন কৃচ্ছ্রসাধন আজও আবিষ্কার হয়নি। সেই আমাদের বারান্দা হল, কিন্তু বাবা যা ঋণ পেলেন তাতে বারান্দার দেওয়াল প্লাস্টার হল না। মেঝে হল না, মাটি ফেলে সমান করে একটু কম দামের ইট পেতে দেওয়া হল তার উপর। নড়বড় করত, মায়ের শরীর বেশ ভারী বলে চলতে অসুবিধা হত প্রথম প্রথম। বাবা বলতেন “ও কিছু না, চলতে চলতে ওগুলো মাটিতে বসে যাবে। তখন আর অসুবিধা হবে না।” পাকা ছাদও হল না, কারণ ছাদ ঢালাইয়ের অনেক খরচ। কোথা থেকে বেশকিছু ফুটোওলা টিন জোগাড় হল, শিরীষ কাগজ দিয়ে ফুটো বোজানো হল, আমাদের পাকাবাড়ির বারান্দা পেল টিনের চাল। বর্ষা এসে পড়ল, সশব্দে। প্রথম দিন বৃষ্টি শুরু হওয়ার সময় অনেক রাত। আমরা তিনজনেই এমন বোকা, ভেবেছিলাম কেউ টিনের চালের উপর উঠে লাফাচ্ছে। ক্রমশ সে শব্দের সাথে ভাব হয়ে গেল।

শিরীষ কাগজের চালাকি ভেদ করতে বর্ষার একটা গোটা মরসুমও লাগেনি। ভিতরে ঢুকতে পেয়ে তার সুরও গেল বদলে। আস্ত চাল আর ফুটো চালে শব্দের তফাত অভ্যস্ত কান ছাড়া ধরা পড়ে না চট করে। ফুটো দিয়ে ইটের উপর পড়ার শব্দ আরেকরকম। জল পেয়ে ইটগুলোর চেহারা বদলে গেল, চটি ছাড়া বারান্দায় হাঁটা বারণ হল। সাপ, ব্যাঙ দুয়েরই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একমাত্র আমাদের বারান্দার ইটের মেঝেতেই দেখেছি। সাপগুলোর বাহারি চেহারা দেখে বহুবার ভেবেছি বিষাক্ত, কিন্তু প্রতিবারই দেখা গেছে ওগুলো হেলে। ইটের উপর জল পড়ার শব্দ একরকম, সেই জলে কাদায় হাঁটার শব্দ আরেকরকম। সব মিলিয়ে বর্ষার শব্দ।

সশব্দ বর্ষায় বিদ্যুৎ চালু থাকবে এমন প্রত্যাশা আমাদের ছিল না। বৃষ্টি থামলেই আসবে কিনা তা নিয়েই বরং বড়রা আলোচনা করতেন। বর্ষার শব্দের মধ্যে সন্ধেবেলায় লণ্ঠন বা ল্যাম্পের আলোয় পড়তে বসলে চেঁচিয়ে পড়ার দরকার হত। মনে মনে পড়লে বা লিখতে গেলে ধীরে ধীরে বুজে আসত চোখের পাতা — এমন সুরেলা, এমন ছান্দিক ছিল বর্ষার শব্দ। সাধারণত বাবা বাড়ি ফিরতেন রাত করে। বরাবরই মনে হত বাবা বাড়ির বাইরে থাকলে বর্ষার শব্দ একরকম, ফিরে এলে অন্যরকম।

তখন পাড়ায় টিভি বিরল। আমাদের পাশের বাড়িতেই ছিল একখানা। দৈবাৎ বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও লোডশেডিং হত না। তখন টিভি থেকে ভেসে আসা সিনেমার গান আর সংলাপে বর্ষার শব্দের রূপ খুলে যেত। বৃষ্টি, লোডশেডিং, পড়াশোনা শেষ, বাবা ফিরছেন না, ফিরলে খেতে বসব। ততক্ষণ কী হবে? মা গান গাইবেন। বর্ষার শব্দে যোগ হল মায়ের খালি গলার গান, বাড়িতে হারমোনিয়ামের প্রয়োজন বোধ হয়নি তখনো। মোমবাতির আলোয় তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে মা কতদূর ধেয়ে যেতেন তা বোঝার বয়স হওয়ার আগে থেকেই এই রুটিন। বোধহয় তাই এখনো বর্ষার শব্দ পেলেই কানের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতে থাকে। তার সবগুলোই প্রকৃতি পর্যায়ের গান নয়, বর্ষার গানও নয়। বোঝার বয়স কি আজও হয়েছে? কে জানে! বয়স আর বোঝার বয়স বোধহয় আলাদা। তাছাড়া সবটা কি কখনো বোঝা হবে? প্রথম যেদিন মাকে “সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি” গাইতে শুনেছিলাম আর চোখে দেখেছিলাম জল, সেদিন সে জলের কারণ বুঝিনি, আজও তো বুঝি না।

খালি গলায় গাইতে বাবাও ভালবাসতেন, অপেশাদার যাত্রা/নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন বলে কণ্ঠস্বরও ছিল চমৎকার। কখনো কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানি না, কিন্তু বহু কবিতা মুখস্থ ছিল। সেসব আবৃত্তি করার ইচ্ছে কেন জানি না বৃষ্টি এলেই সবচেয়ে প্রবল হত। বোধহয় বাবার মধ্যে রোম্যান্টিকতার ঘাটতি ছিল। কারণ এক্ষুণি চোখ বুজলে বর্ষার শব্দের সাথে বাবার গলায় শোনা যেসব কবিতা আজ মিশে যাচ্ছে, সেগুলো একটাও প্রেমের কবিতা নয় — কাজি নজরুলের ‘আমার কৈফিয়ৎ’, ‘কামাল পাশা’, রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেটা’। আর আশ্চর্য সব গল্পের আবহসঙ্গীত হয়ে আছে বর্ষার শব্দ। ঠাকুর্দার একখানা রেকর্ড প্লেয়ার আমাদের ভাগে পড়েছিল। কিছু ধার করা আর কিছু কেনা লং প্লেয়িং রেকর্ড চালাতাম তাতে। একটা রেকর্ডে বাজত ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’। একটা ছুটির দিনে শুনতে শুনতে লোডশেডিং। বাবার মুখে সেই প্রথম শুনলাম ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল চাকীর গল্প। কোনো এক বর্ষার দিনে শুনেছিলাম রুশ বিপ্লবের গল্প। আমি জানি বাবা কোনোদিন সের্গেই আইজেনস্টাইনের কোনো ছবি দেখেননি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নন্দনে প্রথমবার ব্যাটলশিপ পোটেমকিন দেখে মনে হয়েছিল এসব দৃশ্য বাবার চোখেই প্রথম দেখেছি। ফিদেল কাস্ত্রো, চে গেভারার গল্পও প্রথম শুনিয়েছিলেন কোন বৃষ্টিদিনে।

আমাদের জীবনে অনেকগুলো স্মরণীয় পরিবর্তন আসে ১৯৯০ সালে। সেই বসন্তে প্রথম মাকে ছেড়ে বেশ কয়েকদিন থাকতে হয়েছিল। বৈশাখ মাসের পাঁচ তারিখ হাসপাতালে মা আমার বোনকে জন্ম দিলেন। সে বছরই কোনো সরকারি সিদ্ধান্তে বাবার মাইনে বাড়ল অনেকখানি। একদিন আমাকে আর মাস ছয়েকের বোনকে বড় জেঠিমার কাছে রেখে বাবা-মা খানিকক্ষণের জন্য বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন একটা আশ্চর্য জিনিস নিয়ে। আপট্রনের পোর্টেবল টিভি। ততদিনে পাড়ায় প্রায় সব বাড়িতে টিভি এসে গেছে, কলকাতাবাসী আত্মীয়দের বাড়িতে এবং পাড়ার এক ধনী বন্ধুর বাড়িতে মনোরম রঙিন টিভিও দেখে ফেলেছি। সাদাকালো টিভি দেখে সামান্য মনখারাপ হয়েছিল, প্রকাশ করিনি। দোকান থেকে যিনি এসে টিভি চালানো, বন্ধ করা, চ্যানেল বদলানো, ছবির ঔজ্জ্বল্য বাড়ানো কমানো শেখাতে এসেছিলেন তিনি বললেন “কোম্পানি এই মডেলটা রঙিন টিভি হিসাবেই বানিয়েছিল। খরচে পোষাবে না বলে লাস্ট মোমেন্টে সাদাকালো করেছে।” এ কি কম সান্ত্বনা! পরদিন খেলার মাঠে ধনী বন্ধুটিকে সগর্বে জানিয়েছিলাম এই তথ্য। তখন ভুয়ো খবর আমাদের কল্পনাতেই ছিল না। এতকিছু বদলাল, বর্ষার শব্দ কিন্তু বদলায়নি। যতটুকু মাইনে বেড়েছিল তাতে দেওয়াল প্লাস্টার করা যায় না, বারান্দার মেঝে হয় না, পাকা ছাদ হয় না।

তা বলে কেউ গোমড়া মুখে থাকে না। আমার সাথে আমার বোনও বর্ষার শব্দ উপভোগ করতে শিখে গেল দ্রুত। বছর তিনেক পরে আমাদের বাড়িতে এল আরেকটা আশ্চর্যন্ত্র। ফিলিপসের টু ইন ওয়ান। একই যন্ত্রে ক্যাসেট চলে আবার এফ এম রেডিও চলে! দাদুর রেকর্ড প্লেয়ার বোনের জন্মের আগেই গত হয়েছেন। মাঝের কয়েকটা বছর বাড়িতে গান বজায় রেখেছিলেন বাবা-মা নিজেরাই। সামর্থ সীমিত, তাই বাবা বললেন যে মাসে টেপ রেকর্ডার কেনা হল, সে মাসে ক্যাসেট কেনা হবে না। মাসে মাসে একটা-দুটো করে ক্যাসেটে বাড়িতে এলেন সুমন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা, সলিল চৌধুরী, এ আর রহমান এবং অবশ্যই থরে থরে রবীন্দ্রনাথ। তখন আর বৃষ্টি হলেই লোডশেডিং হয় না আমাদের পাড়ায়। এক বর্ষার সকালে বাবার ইচ্ছে হল আবৃত্তি রেকর্ড করে রাখবে। যে গলা যাত্রার মাঠে শেষ সারির দর্শকের কাছেও পৌঁছে যেত অনায়াসে, সেই গলা তখন আর নেই। সেরিবেলা ডিজেনারেশনের অসুখে বাবার হাত কাঁপত আজন্ম দেখেছি, ততদিনে গলাও কাঁপতে শুরু করেছে। সেদিনের বর্ষার শব্দে মিশল কাঁপা গলায় ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’। সেখানেই শেষ নয়, রান্নাবান্নার মধ্যে থেকে টেনে এনে মাকে দিয়েও আবৃত্তি করানো হল মায়ের প্রিয় কবিতা ‘অভিসার’।

এখন চাকরি চলে যাওয়ার যুগ, মাইনে কমে যাওয়ার যুগ। তাই হয়ত বললে গল্পের মত শোনায়, কিন্তু সে সময় সত্যিই বাবার চাকরি যেতে পারে বা মাইনে কমে যেতে পারে আমরা জানতাম না। জানতাম মাইনে কেবল বাড়ে। কারোর বাবার মাইনে ঝটপট বাড়ে, আমাদের বাবার ধীরে ধীরে বাড়ে। ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে আমার যখন গোঁফ দাড়ি বেরোতে শুরু করেছে, তখন বর্ষার শব্দ বদলে গেল। কারণ ব্যাঙ্কের চোখে বাবার ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা বেড়েছে। অতএব বারান্দার পুরনো বাসিন্দা সাপ, ব্যাঙেদের কপাল পুড়ল। শান বাঁধানো মেঝে হল, দেওয়ালে প্লাস্টার হল। ফুটো টিনের চালের দিন ফুরোল। বারান্দা যে কেবল পাকা ছাদ পেল তা নয়, ছাদের উপর নতুন ঘরও হল। তারপর এল বর্ষা। আমরা চারজন আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে প্রবল ব্যথায় আবিষ্কার করলাম, আমাদের বর্ষার শব্দ দূরে সরে গেছে। সেবার বর্ষাটা মনখারাপে কেটেছে। কী যেন অমূল্য ধন আমাদের ছিল, আর নেই।

বর্ষা কিন্তু নির্দয় নয়। টিনের চাল না পেলে চুপ করে যাব, এমন জেদ নেই তার। আমাদের বাড়ির সামনেই খোলা মাঠ, সেখানে বিকেলে ক্রিকেট, ফুটবল খেলেছি কিন্তু সকালে গরু চরিয়েছে নাটুকাকু। এরপর থেকে আমাদের বর্ষার শব্দ ভরে রেখেছে সেই গরুদের ডাক, কাদা মাঠে বলে শট নেওয়ার ভোঁতা শব্দ আর গোলের তীক্ষ্ণ উল্লাস। ছাদের রেনওয়াটার পাইপ থেকে জল পড়ার শব্দ থেকেও বঞ্চিত হইনি। কলকাতার অনতিদূরে আমাদের মফস্বলে গত সাড়ে তিন দশকে শব্দদূষণ যত বেড়েছে, বর্ষা তত বোবা হয়েছে। গাছপালা, পশুপাখিও নিঃশব্দে উল্লাস করা শিখে গেছে। পাছে শব্দ করলে মানুষের চোখে পড়ে ছাঁটাইয়ের খাতায় নাম উঠে যায়!

আমরা কিন্তু বহাল তবিয়তে আছি। শুধু বৃষ্টি এলে মনে হয় কোনও একটা তার ছিঁড়ে গেছে কবে। সুর হারায়ে গেল।

ছবি: ইন্টারনেট থেকে

রাহুলে না, বাবুলে হ্যাঁ: তৃণমূলের প্রকৃত এজেন্ডা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে আর এস এসের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকেন, তাঁদের অন্যতম হলেন রাহুল গান্ধী।

বিরোধী জোটে কংগ্রেসকে নিয়ে আপত্তি না থাকলেও রাহুলকে নিয়ে তৃণমূলের ‘অ্যালার্জি’ আগেও রাজনৈতিক মহলের নজরে এসেছে। এ বার সুদীপের ওই মন্তব্যে দলের তরফে কার্যত সিলমোহর দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রাহুল গাঁধীকে মানুষ মোদীর বিকল্প হিসেবে দেখছে না। বারবার নির্বাচনী ব্যর্থতায় সুযোগ এবং সময় নষ্ট করা যাবে না। রাহুল সুযোগ পেয়েছেন। পারেননি।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জোটের বিকল্প হিসেবে জবরদস্ত বিশ্বাসযোগ্য মুখ সামনে রেখে প্রচারে যেতে হবে। আর তা হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’
— আনন্দবাজার পত্রিকা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২১

সকালের কাগজে যাঁরা এই খবর পড়েছেন, তাঁরা অনেকেই যে প্রবীণ তৃণমূল নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে একমত হবেন তা বলাই বাহুল্য। রাজীব-সোনিয়ার পুত্র রাহুল গান্ধী সত্যিই এমন একটা নির্বাচনও কংগ্রেসকে জেতাতে পারেননি, যা থেকে তাঁর সারা দেশের নেতা হওয়ার মত বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হতে পারে। উপরন্তু বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্কটের জন্য অনেকেই তাঁকে দায়ী করেছেন। রাজস্থানে অশোক গেহলত বনাম শচীন পাইলট লড়াইয়ে তিনি নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারেননি — এমন অভিযোগ আছে। মধ্যপ্রদেশে এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাধবরাও সিন্ধিয়ার পুত্র জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার দলত্যাগের পিছনেও রাহুল-প্রিয়াঙ্কার সিদ্ধান্তহীনতার অভিযোগ ওঠে। বিহারের নির্বাচনে কংগ্রেস একগাদা আসন নিয়েও জোটকে ডুবিয়েছে, তা না হলে নীতীশ কুমারের প্রস্থান অনিবার্য ছিল। উত্তরপ্রদেশে এখনো কংগ্রেসের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে না। গান্ধী পরিবারের লোক হওয়া ছাড়া রাহুলের নেতাসুলভ কোনো গুণ খুঁজে পাওয়া এখনো মুশকিল। অন্য দিকে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একা হাতে পশ্চিমবঙ্গকে কমিউনিস্টশূন্য করেছেন, প্রবল প্রতাপান্বিত মোদী-অমিত শাহ জুটিকে রুখে দিয়েছেন। বিজেপি-বিরোধী জোটের নেতৃত্বে তিনিই যে সবচেয়ে “জবরদস্ত বিশ্বাসযোগ্য মুখ”, তার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী-ই বা হতে পারে? কেবল একটাই খটকা। ২০২৪ সালের জানুয়ারির আগে যে নির্বাচন শুরু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর বিকল্প মুখ ঘোষণা করার ব্যগ্রতা কেন?

এই খটকা না কাটতেই, বিকেল না গড়াতেই, এসে পড়েছে আরেকটি খবর। বাবুল সুপ্রিয় যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী (তাঁরই দলীয় মুখপত্র যা লিখেছে বলে খবরে প্রকাশ, তাতে এই তকমা দিলে নিশ্চয়ই দোষ হবে না) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুযোগ্য ভ্রাতুষ্পুত্র, মমতা প্রধানমন্ত্রী হলে যিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হতেই পারেন, সেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং বাবুলকে পার্টিতে স্বাগত জানিয়েছেন।

এই দুটো খবর কয়েকদিন বা কয়েক মাসের ব্যবধানে এলে হয়ত এতটা খটকা লাগত না; দলবদল বাংলার রাজনীতিতে অভিনবত্ব হারিয়েছে বেশ কিছুদিন হল। কিন্তু কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে এসে পৌঁছনোয় কিঞ্চিৎ মুশকিল হয়েছে। কয়েকটি প্রশ্ন অনিবার্য বলে মনে হচ্ছে।

প্রথমত, গান্ধী পরিবারকে বাদ দিয়ে যে আজও কংগ্রেস হয় না, তা ভারতীয় রাজনীতির সাথে যে কোনো ভূমিকায় যুক্ত সকলেই জানেন। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তো জানেন বটেই। এ কথা ঠিক যে গত দশকেই টানা দশ বছর কংগ্রেসের নেতৃত্বে কেন্দ্রে এমন একটি সরকার চলেছে যার নেতৃত্বে ছিলেন ওই পরিবারের বাইরের একজন। কিন্তু সে নিতান্ত ঠেকায় পড়ে। উপরন্তু সেই সরকারের কার্যকলাপে রাশ টানতে একটি পরামর্শদাতা সমিতি ছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন সোনিয়া গান্ধী। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বহু বিধানসভা এবং দুটি লোকসভা নির্বাচন হয়ে গেছে। কংগ্রেসের উপর্যুপরি ব্যর্থতা সত্ত্বেও দলের সর্বোচ্চ পদে সোনিয়া আর রাহুলের বদলে কেউ আসীন হননি। রাহুল নিজে থেকে পদ ছেড়ে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু গান্ধী পরিবারের বাইরের কেউ সে পদে আসীন হতে চাননি। শশী থারুর, কপিল সিবাল, আনন্দ শর্মারা মধ্যে মধ্যে ঝড় তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাউল বাতাস সাতমহলা গান্ধীপুরীর হাজার বাতি নিভিয়ে দেওয়ার আগেই দিল্লির ট্র্যাফিকে হারিয়ে যায়। অতএব ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের পরেও কংগ্রেস সাংসদদের গতিবিধি যে রাহুল গান্ধীই ঠিক করবেন, তা সুদীপ ও মমতা, দুজনেই বিলক্ষণ জানেন। তাহলে এত আগে থেকে প্রকাশ্যে রাহুলকে অনুপযুক্ত নেতা হিসাবে দেগে দিলেন কেন? রাহুলকে চটিয়ে কী লাভ?

দ্বিতীয়ত, বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তৃণমূলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজেপির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ যখন সাম্প্রদায়িকতা নিয়েই শানানো হয়, তখন মন্ত্রী পদের অপব্যবহার করে আসানসোল দাঙ্গায় উস্কানি দেওয়ার অসংখ্য অভিযোগ আছে, মুসলমান বিদ্বেষ নিয়ে রাখঢাক করেন না — এমন একজনকে কেন নীল-সাদা কার্পেট পেতে দিল মুখ্যমন্ত্রীর দল?

প্রশ্নগুলো কারো কারো অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। সাহেবরা বলে থাকে, সাফল্যের মত সফল আর কিছু নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন চূড়ান্ত সফল। এ রাজ্যের রাজনীতিতে তিনি এখন উসেন বোল্ট, অর্থাৎ দৌড়তে দৌড়তে এক-আধবার পিছনে তাকালেও হাত দুয়েক ব্যবধানে জিতবেন। অতএব তাঁর পদক্ষেপগুলো নিয়ে ভাবার, সমালোচনা করার কোনো মানেই হয় না — এমনটা অনুরাগীরা বলতেই পারেন। কিন্তু ইতিহাসে যেমন বোল্ট আছেন, তেমন মিলখা সিংও আছেন। শোনা যায় রোম অলিম্পিকে তাঁর অবধারিত সোনা হাতছাড়া হয়েছিল অনেক এগিয়ে আছেন ভেবে গতি কমাতে গিয়ে। তাছাড়া স্লোগান হিসাবে যতই জনপ্রিয় হোক না কেন, মমতাও জানেন, রাজনীতি খেলা নয়। অতএব ভেবে পা ফেলা এবং যে পা-টা ফেললাম, সেটারও পর্যালোচনা করা উচিত। সুতরাং প্রশ্নগুলো উড়িয়ে দেওয়া সমীচীন হবে না।

বাংলা, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট রাজ্যগুলো, তামিলনাড়ু, জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখ বাদ দিলে ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির মুখ্য প্রতিপক্ষ হিসাবে থাকবে কংগ্রেস অথবা কংগ্রেসের উপস্থিতি আছে এমন জোট। কংগ্রেস একেবারেই প্রাসঙ্গিক নয়, এমন লোকসভা আসনের সংখ্যা কিছুতেই শ দেড়েকের বেশি নয়। এর সাথে আছে কেরালার মত রাজ্য, যেখানে কংগ্রেস ভাল ফল করতে পারে, কিন্তু বিজেপিই অপ্রাসঙ্গিক। ফলে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হলে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বা কংগ্রেসের উপস্থিতি আছে এমন জোটকে ভাল ফল করতেই হবে। তৃণমূল কংগ্রেসের অতি বড় সমর্থকও নিশ্চয়ই এতটা স্বপ্নের জগতে বাস করেন না, যে মনে করবেন ২০২৪ সালের মধ্যে তৃণমূল প্রথমে ত্রিপুরা, তারপর গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। তারপর বাড়তে বাড়তে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত হাত চিহ্নের সমান বা তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠবে জোড়াফুল? যদি উদার চিত্তে ধরে নেওয়া যায় লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ৪২-এ ৪২ পাবেন মমতা, ত্রিপুরার দুটো আসনেই জিতবেন, আসামের বাঙালিরাও তাঁকেই জয়যুক্ত করবেন, তাহলেও পঞ্চাশ পেরনো যাবে বড়জোর। বিজেপির ভারত জুড়ে বিপুল বিপর্যয় হলেও সরকার গড়তে কংগ্রেসের সমর্থন প্রয়োজন হবেই। নেতা হওয়ার অযোগ্য রাহুল গান্ধী তখন আজকের কথা মনে রেখে দিলে কী হবে? নাকি তাঁর কাছে সমর্থন চাওয়াই হবে না? ফ্যাসিবাদী সরকারের অপসারণ, নাকি মমতার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার? মূল লক্ষ্য কোনটি? হয় আমাদের সরকার হোক, নইলে যে যা পারে করুক, কিছু এসে যায় না — প্রকৃত এজেন্ডা এমন নয় তো?

বাবুলের তৃণমূলে যোগদানে এমন সন্দেহ প্রবল হয়। তার কারণ বাবুল আর যা-ই হোন, মুকুল নন। মুকুল রায়ের রাজনৈতিক দীক্ষা সঙ্ঘ পরিবারে নয়। তিনি বড়জোর রাজনৈতিক সুবিধাবাদী। বৃহত্তর ক্ষমতার স্বাদ পেতে কিম্বা ফৌজদারি অভিযোগের হাত থেকে বাঁচতে বিজেপিতে গিয়েছিলেন, সুযোগ বুঝে ফিরে এসেছেন। বাবুল কিন্তু কখনো তৃণমূলে ছিলেন না। অর্থাৎ এ প্রত্যাবর্তন নয়, পরিবর্তন। মুকুলের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ নেই। ভারতের রাজনীতিতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রভাব ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে যত বেড়েছে, তত ভারতের উদারপন্থীদের কাছে কোনো দল বা নেতার গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি হয়ে উঠেছে অসাম্প্রদায়িকতা। দ্বিতীয় ইউপিএ-র আমলে একের পর এক দুর্নীতি যখন প্রকাশ্যে আসছে, নির্ভয়া কান্ডে মানুষ ক্রমশ ধৈর্যহীন হয়ে পড়ছেন, তখন কংগ্রেসের পক্ষে শেষ যুক্তি হিসাবে খাড়া করা হত অসাম্প্রদায়িকতাকে। এই যুক্তি ২০১৪ সালের পর থেকে ক্রমশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে প্রায় সব রাজ্যে, কারণ বিজেপি-বিরোধী দলগুলির পাহাড়প্রমাণ ত্রুটি ঢাকা দেওয়ার উপায় নেই। অগত্যা বিজেপি-বিরোধী মানুষ ভেবে নিয়েছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত হোক, সাম্প্রদায়িক না হলেই হল। পশ্চিমবঙ্গের ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলও অনেকাংশে এই ভাবনার প্রতিফলন। বাবুল কিন্তু এই সামান্য পরীক্ষাতেও ফেল। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অগ্রণী সৈনিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যদি বাবুলও গ্রহণযোগ্য হন, তাহলে মনে করা অনুচিত হবে না, যে নেত্রীর লড়াই আসলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নয়, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও নয়, স্রেফ বিজেপি নামক রাজনৈতিক দলটির বিরুদ্ধে। যদি লোকসভা ত্রিশঙ্কু হয়, তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অবস্থায় না থাকেন, তখন আর কে সরকার গড়ল, না গড়ল — তা নিয়ে তাঁর আগ্রহ থাকবে না। তখন তাঁর কাছে রাহুল গান্ধীও যা, নরেন্দ্র মোদীও তাই।

ভারতে যাঁরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সত্যিই লড়ছেন, আর যাঁরা লড়ছেন বলে ভাবছেন, সকলেই নির্দ্বিধায় বলে থাকেন — আসল শত্রু হল আর এস এস। আসলে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র হওয়া থেকে বাঁচাতে হবে। জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে আর এস এসের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকেন, তাঁদের অন্যতম হলেন রাহুল গান্ধী। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করা হয়েছিল। বৈষ্ণোদেবীর মন্দিরে গিয়ে তিনি যে নরম হিন্দুত্ব চালান, তা কংগ্রেসী ঘরানার পুরনো রাজনীতি। কিন্তু জওহরলাল নেহরুর পরে সম্ভবত আর কোনো কংগ্রেস নেতা এত সরাসরি আর এস এস-কে আক্রমণ করতেন না। এ হেন রাহুলকে সাত তাড়াতাড়ি নেতৃত্ব দিতে পারেন না বলে দেগে দেওয়া এবং স্পষ্টত সংখ্যালঘুবিদ্বেষী, গণতান্ত্রিক আন্দোলনবিরোধী বাবুল সুপ্রিয়কে পার্টিতে জায়গা দেওয়া — এগুলো কি ধর্মনিরপেক্ষ জোটের নেত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করল? তাঁকে ভাবতে হবে। কারণ তিনি যাদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হবেন ভাবছেন, তারা ভাবতে পারে।

https://nagorik.net এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে।

শিক্ষক দিবসের প্রশ্ন: শিক্ষকদের বাঁচাবে কে?

কাকিমার এখন লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে মাসে এক হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু ছেলের উপর যে আশা ছিল, সে আশা পূরণ হল না।

কালের গতি রোধ করা যমেরও অসাধ্য। তাই আজ পশ্চিমবঙ্গেও শিক্ষক দিবস। নইলে যেখানে শিক্ষিকারা বিষ খেতে বাধ্য হন, সেখানে শিক্ষক দিবস বলে কিছু থাকতে পারে না। অণিমা নাথ, ছবি দাস, শিখা দাস, পুতুল মন্ডল, জোশুয়া টুডু, মন্দিরা সর্দারদের বিষ খাওয়া আসলে একটা ষড়যন্ত্র, অশান্তি সৃষ্টি করাই আসল উদ্দেশ্য ছিল — এমন অভিযোগ অবশ্য উঠেছে। [১] ওঠাই স্বাভাবিক। কৃষকরা আত্মহত্যা করলে যেমন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এবং তাদের অনুরাগীরা বলে থাকে “ক্ষতিপূরণের লোভে করেছে।” কবি এমনি এমনি লেখেননি, সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি। এ দেশে না জন্মালে আত্মহত্যা যে মরণোত্তর কিছু পাওয়ার লোভে করা সম্ভব এ তথ্য আপনি জানতে পারতেন? তেমনি প্রাথমিক স্কুলের কয়েকজন নগণ্য শিক্ষিকা যে একটা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারকে অস্থির করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে মানববোমার মত কাজ করতে পারেন — এ-ও অন্য কোথাও থাকলে জানা কঠিন হত। তাও আবার বিস্ফোরকবিহীন মানববোমা। মানে চারপাশে আর কেউ মরবে না, কারোর কোনো ক্ষতি হবে না। কেবল শিক্ষিকা নিজে মরবেন, আর তাতেই সরকার কেঁপে উঠবে। শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রতি আমাদের এত শ্রদ্ধা অবশিষ্ট আছে?

নেই। থাকলে ২০১৫ সালের মাদ্রাসা শিক্ষকদের অনশন আন্দোলনের কথা, ২০১৯ সালের প্যারাটিচারদের অনশনের কথা এবং স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে চাকরির প্রত্যাশায় থাকা হবু শিক্ষকদের অনশনের কথা মনে থাকত। কয়েকশো শিক্ষক বা হবু শিক্ষক ওই আন্দোলনগুলোতে অনশন করেছেন, খবরের কাগজের তিনের পাতায়, বা পাঁচের পাতায়, কি সাতের পাতায় খবর বেরিয়েছে। আমরা পাতা উল্টাতে গিয়ে হয়ত খেয়ালও করিনি। ছন্দা সাহার মৃত্যু (২০১৫) [২], রেবতী রাউতের মৃত্যু এবং তাপস বরের ব্রেন স্ট্রোক নিয়ে বিতর্ক (২০১৯) [৩] তৈরি হলে কখনো সখনো একটু হৈ চৈ হয়েছে। তারপর যে কে সেই। গত দশ বছরে এ রাজ্যে যে কোন আন্দোলনের প্রতি সরকারি উদাসীনতা এবং সামাজিক উদাসীনতার কারণে (শুধু সরকার কেন? আন্দোলনের ‘আ’ শুনলেই কারণ জানার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে আমরাও কি অভিসম্পাত দিই না?) সব ধরনের আন্দোলনকারী ভেবে নিতে বাধ্য হয়েছেন, জীবনের ঝুঁকি না নিলে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে না। তাই কেবল শিক্ষক, হবু শিক্ষকরা নয়, ডাক্তাররাও এই পর্বে অনশনের রাস্তা বেছে নিয়েছেন। বিষ খাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এক দিনে পৌঁছানো হয়নি।

এ রাজ্যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা কেমন আছেন খোঁজ নিতে গেলে প্রথমেই বিরাট অর্থনৈতিক বিভেদ চোখে পড়ে। স্কুলশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত স্থায়ী চাকরি করা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবস্থা যথেষ্ট সচ্ছল, অভিযোগের অবকাশ বলতে মহার্ঘ ভাতা নিয়ে রাজ্য সরকারের নিয়ে টালবাহানা। কিন্তু সেই অভিযোগ সমস্ত রাজ্য সরকারি কর্মচারীরই রয়েছে, কেবল তাঁদের নয়। চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করা প্যারাটিচারদের অবস্থা এর বিপরীত। তাঁরা মাস গেলে তেরো হাজার টাকার আশেপাশে মাইনে পান। প্রভিডেন্ট ফান্ড, প্রফেশনাল ট্যাক্স ইত্যাদি কেটে এগারো হাজার টাকার মত হাতে আসে, যোগ্যতা যা-ই হোক, অভিজ্ঞতা যত বছরেরই হোক। নিয়োগের শর্ত অনুযায়ী তাঁদের দায়িত্ব ছিল ক্লাসের পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের যত্ন নেওয়া, স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুলে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। অথচ স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ যেহেতু বন্ধ, তাই স্কুলগুলোতে শূন্য পদের অভাব নেই, ফলত কাজের চাপ যথেষ্ট। অতএব স্কুল কর্তৃপক্ষ অনন্যোপায়। প্যারাটিচাররা পুরো সময়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সমান ক্লাস নিচ্ছেন, সমানে সমানে পরীক্ষার খাতাও দেখছেন। এমনকি, গোড়ায় কথা ছিল সপ্তাহে তিনদিন তাঁরা কাজ করবেন। তা অবস্থা বিশেষে ছদিনই হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ কাজ বেশি, মাইনে কম — প্যারাটিচারদের জন্য এটাই নিয়ম।

কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও একইরকম বিভাজন তৈরি হয়েছে। পুরো সময়ের অধ্যাপনা শুরু করেই যেখানে হাজার পঞ্চাশেক টাকা মাইনে পাওয়া যাচ্ছে, বছরের পর বছর আংশিক সময়ের অধ্যাপক (যাঁদের এখন বলা হয় State Aided College Teacher — SACT) হয়ে থাকা নেট/স্লেট পাশ করা পিএইচডি অধ্যাপক, অধ্যাপিকারাও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকায় আটকে আছেন। কলেজের মর্জি মাফিক কোথাও কোথাও আরও কম। কলেজ সার্ভিস কমিশনের নিয়োগও অনিয়মিত। ফলে কলেজ চালানোর ক্ষেত্রে কিন্তু বড় ভূমিকা পালন করেন SACT-রা। অথচ ওঁদের পদগুলো, পরিভাষায়, নোশনাল। মানে কোনো SACT কোনো কারণে বিদায় নিলে তাঁর জায়গায় নতুন লোক পাওয়া যাবে না।

পশ্চিমবঙ্গে শিল্প নেই বহু বছর, কর্মসংস্থানের অভাব বর্তমান সরকারের আমলেই তৈরি হয়েছে এমন বললে নিতান্ত অন্যায় হবে। কলেজ সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ নিয়ে বামফ্রন্ট আমলেও বিস্তর ডামাডোল ছিল। কিন্তু দীর্ঘ অভাবের তালিকার পাশে যা ছিল, তা হল লেখাপড়া শিখতে পারলে এবং এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করলে শিক্ষকতার চাকরির নিশ্চয়তা। বাম আমলেই একসময় স্কুলের চাকরির নিয়োগে স্থানীয় স্তরে দুর্নীতির প্রচুর অভিযোগ উঠত। টাকা নিয়েই হোক অথবা নেতার সাথে পরিচিতি বা আত্মীয়তার সুবাদে যোগ্য প্রার্থীর বদলে অযোগ্য শিক্ষক, শিক্ষিকা নিয়োগ করা হচ্ছে — এমনটা কান পাতলেই শোনা যেত। স্কুল সার্ভিস কমিশন চালু হওয়ার পর ছবিটা বদলে গিয়েছিল। কতটা বদলেছিল? আমার পাড়ায় চপ ভাজেন এক কাকিমা; কাকুর ছোট দোকান ছিল। তাঁদের বড় ছেলে এম এ পড়ছিল। বছর কয়েক আগে একবার চপ কিনতে গিয়েছি, কাকিমা বড় মুখ করে বললেন “এরপর এসএসসিটা পাস করলে মাস্টারি পাবে। আমাদের সংসারটা দাঁড়িয়ে যাবে।” সেই এসএসসি আর তার দেওয়া হয়নি, কারণ পরীক্ষাটাই হয়নি। কাকিমার এখন লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে মাসে এক হাজার টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু ছেলের উপর যে আশা ছিল, সে আশা পূরণ হল না। ছেলে এখন কাকিমাকে ব্যবসায় সাহায্য করে। এইভাবেই কি ভবিষ্যতের শিক্ষক, শিক্ষিকা পাব আমরা?

এমন মনে করার কারণ নেই, যে পুরো সময়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা খুব ভাল আছেন। মাস গেলে মাইনেটা পেলেই মাস্টাররা খুশি, আর কিছু নিয়ে তারা ভাবে না। এমনিতেই একগাদা ছুটি পায়, অতিমারির ফলে তো আরও মজা হয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষিকাদের সম্বন্ধে এমন ভাবনা সাম্প্রতিককালে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। ফাঁকিবাজ পৃথিবীর সব পেশায়, সব কালে, সব দেশে থাকে। কিন্তু নিজের ধারণা নিয়ে বসে না থেকে শিক্ষক, শিক্ষিকাদের সাথে কথা বললে বোঝা যায় তাঁরা সুখে নেই।

মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বাতিল হয়ে যাওয়ার পর এক শিক্ষকের সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, পরীক্ষা বাতিল হয়ে যাওয়া খুবই দুঃখের। কিন্তু লেখাপড়াটা ঠিক করে হয়েছিল কি? অধিকাংশ স্কুলে শিক্ষক অপ্রতুল, এদিকে পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হাজারটা কাজ চেপেছে তাঁদের ঘাড়ে। সরকারের কল্যাণমূলক প্রকল্পের কাজকর্ম অনেকটাই তাঁদের করতে হয়। করতে গিয়ে পড়ানোর সময় কাটছাঁট হয়। আরও বললেন, পশ্চিমবঙ্গে গত দশ বছরে যে হারে জনসংখ্যা বেড়েছে, সে হারে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বাড়েনি। কাগজে, টিভিতে ছাত্রীর সংখ্যা বাড়া নিয়ে উল্লাস হয়, কিন্তু ছাত্রের সংখ্যা যে কমে যাচ্ছে সে কথা কেউ বলে না। এই ছাত্ররা যাচ্ছে কোথায়? তাঁর মতে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে জীবিকার সন্ধানে চলে যাচ্ছে। তাঁর আশঙ্কা, এই প্রবণতা অতিমারীর প্রকোপে আরও বেড়ে গেল। একেই দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া এবং বছর দুয়েক স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে আসছে। ওই শিক্ষকের আশঙ্কা, এরপর যখন স্কুল খুলবে তখন দেখা যাবে স্কুলছুট ছাত্রের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেছে।

উনি যা বলেননি, তা হল সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা গত দশ-পনেরো বছর ধরেই কমছে। গ্রামাঞ্চলের কথা জানি না, শহর ও শহরতলি এলাকায় তার একটা বড় কারণ বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রতি মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত বাবা-মায়েদের পক্ষপাত। এর প্রভাবে কোথাও কোথাও ছাত্রসংখ্যা এমনভাবে কমছে, যে স্বয়ং বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত স্কুলও উঠে যেতে বসেছিল বছর দুয়েক আগে। ইংরেজি মাধ্যম করে দিয়ে বাঁচানো হয়েছে। [৪] বাংলা মাধ্যম অনেক স্কুলকেই ইংরেজি মাধ্যম করে বাঁচানোর চেষ্টা রাজ্য সরকার করছেন। বাঁচছে কিনা বুঝতে আরও কয়েক বছর লাগবে, কিন্তু ওই রুগ্ন স্কুলগুলোর মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের নিশ্চিন্ত থাকার দিন গিয়েছে। কারণ ১৯৯১-এর পর থেকে শিক্ষার বেসরকারিকরণের সঙ্গে সঙ্গেই এ কথা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে শিক্ষা (স্বাস্থ্যের মতই) আরও একটা ব্যবসা। আর রুগ্ন ব্যবসা যে রাখতে নেই তা কেন্দ্র বা রাজ্য, কোনো সরকারই অস্বীকার করে না। ফলে আজকের পাকা চাকরি মানেই আর কালকের পাকা চাকরি নয়।

মুশকিল হল, পঞ্চাশ হাজার, ষাট হাজার, এমনকি এক-দেড় লাখ টাকা খরচ করে যেসব ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের ভর্তি করছেন, সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনেকেই ভদ্রজনোচিত মাইনে পান না। স্কুল মালিক কোটিপতি হচ্ছেন, অথচ মাস্টাররা যে তিমিরে সেই তিমিরেই। ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা বেসরকারি কলেজগুলোতে যাঁরা পড়ান, তাঁদের অবস্থাও তথৈবচ। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজের আংশিক সময়ের শিক্ষকদের কথা উপরে বলেছি। একই যোগ্যতার অনেকে মাসে পনেরো-কুড়ি হাজার টাকা বেতনে বেসরকারি কলেজগুলোতে পড়িয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার ক্লাস পিছু টাকা পান। কত পাবেন, কেমনভাবে পাবেন তা অনেক ক্ষেত্রেই কলেজ কর্তৃপক্ষের মেজাজ মর্জির উপর নির্ভর করে। বেসরকারি স্কুল এবং হাসপাতালের খরচ আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে মাঝেমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে হইচই হয়। মুখ্যমন্ত্রী বরাভয় নিয়ে আবির্ভূত হন, কাউকে ধমকে, কাউকে বাবা বাছা করে বুঝিয়ে অভিভাবকদের উপর চাপ কমাতে বলেন। কিন্তু মাস্টারদের মাইনে কোনো আলোচনার বিষয় হয় না। অবশ্য সরকারের বেতনভুক যে মাস্টাররা, তাঁদের আর্থিক দাবিদাওয়াই যখন কুকুরের ঘেউ ঘেউয়ের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে দাঁড়ায়, তখন বেসরকারি স্কুল, কলেজের শিক্ষকরা কার কাছে কী আশা করবেন?

২০১৮ সালে জগদ্বিখ্যাত টাইম পত্রিকা আমেরিকার পাবলিক স্কুলগুলোর মাস্টারদের পারিশ্রমিক নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওঁদের অবস্থা এত সঙ্গীন, যে একজন বলেছেন তিনি দিন গুজরান করার জন্য একসাথে তিনটে কাজ করেন, উপরন্তু ব্লাড প্লাজমা দান করেন।[৫] পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্তটা দেখিয়ে নিজেদের তার চেয়ে উন্নত প্রমাণ করায় আমরা ভারতীয়রা ওস্তাদ। অতএব সে প্রতিবেদন তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভাগ্যনিয়ন্তারা বলতেই পারেন, “আমরা অনেক ভাল রেখেছি।” সত্যিই তো। মাস্টারদের নিয়ে সরকারের তো বিশেষ মাথা ঘামানোর দরকার নেই। কী পড়ানো হবে, কেন পড়ানো হবে — সেসব কর্পোরেট জগত ইতিমধ্যেই ঠিক করতে শুরু করেছে, আগামী দিনে আরও করবে। যে শিক্ষা কর্পোরেটের কাজে লাগে না, তা যে শিক্ষাই নয় — সে ব্যাপারে ঐকমত্য শিগগির তৈরি হয়ে যাবে। কদিন পর আপনি নিজেই বলবেন, আপনার সন্তানের ছবি আঁকা, খেলাধুলো করা, গান গাওয়া, সাহিত্য পড়া বা ভাল করে অঙ্ক শেখাও তত জরুরি নয়, যত জরুরি কোডিং শেখা। আর সেটা করতে কড়া বা স্নেহময় মাস্টারমশাই, দিদিমণি লাগে না। লাগে একটা অ্যাপ। যাদের অ্যাপ নেই তারা শিখবে না। মিটে গেল।

শিক্ষক দিবসে দাঁড়িয়ে ভয় হচ্ছে, শেরনি ছবিতে যেমন ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে মানুষের কুকর্মের ফলে একসময় বাঘ দেখতে মিউজিয়ামে যেতে হবে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও না সেই অবস্থা হয়।

তথ্যসূত্র:

১) হিন্দুস্তান টাইমস
২) ওল্ড ইন্ডিয়া টুমোরো
৩) সংবাদ প্রতিদিন
৪) আনন্দবাজার পত্রিকা
৫) টাইম ডট কম

https://nagorik.net এ প্রকাশিত

তালিবান শাসন: ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া

এ দেশের শাসকরা তালিবান নন। কারণ তাঁরা অনেকেই গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলতে পারেন। উচ্চশিক্ষিত বলেই পাঠ্যের দিকে সজাগ দৃষ্টি।

খুব আতঙ্কে কাটছে আমাদের। পাশেই আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। ভীষণদর্শন বন্দুকধারীদের ছবি, মানুষের প্রাণপণ পালানোর ছবি আমরা টিভি, খবরের কাগজ অথবা সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে দেখছি। আফগান মানেই বর্বর, অথবা মুসলমানরা ওরকমই হয় — এরকম ভাবনার লোকেরা একরকম শান্তি পাচ্ছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ মনে পড়লে অশান্তি দ্বিগুণ। আফগানিস্তানের মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের কথা ভেবে ঘুম উড়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কেবল ‘কাবুলিওয়ালা’ লেখেননি। লিখেছিলেন “বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/ দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।/ দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশির বিন্দু।” এই লাইনগুলো স্মরণ থাকলে আতঙ্কিত হওয়ার জন্য আফগানিস্তান দেখার প্রয়োজন নেই। তালিবান যা যা করে থাকে তার প্রায় কোনোটাই এ দেশে ঘটতে বাকি নেই।

তারা যখন নব্বইয়ের দশকে প্রথম ক্ষমতায় আসে, তখন থেকেই এ কথা বলে অনেকে প্রবল নিন্দার মুখে পড়েছেন। বামিয়ানের বুদ্ধ মূর্তি ভেঙে ফেলা গর্হিত কাজ, কিন্তু বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রতিকার — এমন ব্যাখ্যাই চিৎকৃত প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কারণ তালিবান কাজটা করেছিল ক্ষমতায় এসে, বাবরি ভেঙেছিল ‘স্বতঃস্ফূর্ত জনতা’। এখন সেই স্বতঃস্ফূর্ত জনতাই দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা। নেশন কী চায় তারাই জানে। সেই চাহিদা অনুযায়ী এডিট করা ভিডিও ক্লিপ জুগিয়ে দেয় ক্ষমতাসীন দলের আই টি সেল, পুলিস তার ভিত্তিতেই সত্য মিথ্যা যাচাই না করে মানুষকে হাজতে পুরে দেয়, সে পচতে থাকে ইউএপিএ আইনে। শরিয়তি আইনের অবিচার এর চেয়ে আর কত বেশি?

তবু এ দেশের শাসকরা তালিবান নন। কারণ তাঁরা অনেকেই গড়গড়িয়ে ইংরেজি বলতে পারেন। উচ্চশিক্ষিত বলেই পাঠ্যের দিকে সজাগ দৃষ্টি। তাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর গল্প বাতিল করেন, দলিত লেখক বামা এবং সুখরথারিনিও বাতিল হন। এঁরা গান নিষিদ্ধ করে লোকসঙ্গীত গায়ককে হত্যা করেন না, অপছন্দের লেখা সরিয়ে দেন। সে কালের জার্মানির মত বই পোড়ানোও শুরু হয়ে গেছে। আমেদাবাদের বইয়ের দোকানে ঢুকে বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’ পুড়িয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে, আবার এসব বই পাওয়া গেলে দোকানই জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। আফগানিস্তানে তালিবরা যেটাকে ইসলাম বলে সেটাই ইসলাম। ভারতেও এখন সঙ্ঘ যাকে হিন্দুধর্ম বলে সেটাই হিন্দুধর্ম। তাই বাৎস্যায়নও হিন্দু সংস্কৃতি বিরুদ্ধ।

আরও পড়ুন সাহিত্য ও সাংবাদিকতা অপ্রিয় সত্য ছাড়া বৃথা

তালিবান নেতারা সগর্বে বলে, মেয়েদের কাজকর্ম, লেখাপড়া করতে হলে ইসলামের নির্দেশ মেনে বোরখা পরে বাইরে বেরোতে হবে। ইসলামে ঠিক কী বলা আছে তা তর্কসাপেক্ষ, কিন্তু তালিবানি শাসনে তাদের মুখের কথাই আইন। এ দেশে এখনো ১৯৫০ সালের সংবিধান চালু আছে বটে, কিন্তু মহিলাদের জীবনসঙ্গী নির্বাচন, জামাকাপড়ের মাপ, মোবাইল ফোন ব্যবহার, এমনকি চাউমিন খাওয়ার অভ্যাসেও যে সংস্কৃতির বারোটা বাজছে — তা বহুবার পরিষ্কার করে দিয়েছে সঙ্ঘ পরিবার। স্বয়ং মোহন ভাগবত প্রকাশ্যেই বলে থাকেন, মেয়েদের কাজ ঘর সামলানো। উত্তরপ্রদেশের দাসনার মন্দিরের মহন্ত যতি নরসিংহানন্দের ছাপার অযোগ্য ভাইরাল বিষোদ্গারে মহিলাদের সম্পর্কে ভাবনায় তালিবান-সঙ্ঘ ঐকমত্য পরিষ্কার। এখন বিজেপি এই ঘোর মুসলমান বিদ্বেষী লোকটিকে জিহাদি আখ্যা দিচ্ছে, কিন্তু তিনি দীর্ঘদিন ধরে কপিল মিশ্রর মত গুরুত্বপূর্ণ নেতার ঘনিষ্ঠ।

আর হত্যা? গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর, গৌরী লঙ্কেশদের কথা আমাদের মনে নেই। আরও অদরকারি আখলাক আহমেদ, পেহলু খানের মত অসংখ্য গণপিটুনির শিকারদের স্মৃতি। কারণ তাঁরা গরুর অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত। গত পরশু এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক বিচারপতি তো বলেই দিয়েছেন, গরুকে জাতীয় পশু ঘোষণা করে তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইন দরকার। গরুর কল্যাণ হলেই দেশের কল্যাণ হবে।

আশা করা যায় তালিবান সরকার শুয়োরের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার আগেই ভারত সরকার বিচারপতির স্বপ্ন সত্যি করবেন।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: