দলে দলে দলবদলের খেলায় বাঙালি এখন দিব্যি দড়

পেপ বার্সেলোনার একগুচ্ছ খেলোয়াড়কে বায়ার্ন মিউনিখ বা ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে আনতে পারেননি। মুকুল দলে দলে বিজেপি নেতা, কর্মীকে তৃণমূলে আনছেন। আস্ত জেলা কমিটি তুলে আনছেন।

টিভিতে ইউরো দেখছেন? হিংসা হচ্ছে না? প্রায় সব মাঠেই দর্শক আছে। অথচ এ দেশে আমরা ভয়ে ভয়ে বাজার যাচ্ছি, ট্রেন চলছে না বলে বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে কাজে যেতে হচ্ছে, তিতিবিরক্ত মানুষ স্পেশাল ট্রেন আটকে দিচ্ছেন, ছেলেমেয়েরা স্কুল কলেজ যাওয়া ভুলে গেছে, বড় বড় পরীক্ষা বাতিল, খেলাধুলোর তো প্রশ্নই নেই। ফাঁকা মাঠে ইন্ডিয়ান সুপার লিগ আর অর্ধেক ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ ছাড়া ভারতে দেখার মত খেলা হয়নি সেই গত বছরের মার্চ থেকে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের খেলাপাগল লোকেদের খেলা দেখার তেষ্টা যে কমেনি, বরং বেড়েছে — সেকথা রাজ্যের নেতৃবৃন্দ বিলক্ষণ জানেন। অতএব নির্বাচনে স্লোগান হল “খেলা হবে”। ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম কথাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে শ্রবণেন সোয়া ভোজনম তো বটে। সোয়াই বা কেন? এক জনসভায় তো মুখ্যমন্ত্রী হুইল চেয়ার থেকে দর্শকদের দিকে একটা সত্যিকারের ফুটবলই ছুঁড়লেন। হাড্ডাহাড্ডি খেলার মাঠে দর্শকদের প্রাণ যাওয়ার ইতিহাস সারা পৃথিবীতেই আছে। ইডেনে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ দেখতে গিয়ে ১৬ জনের মৃত্যুর কথা এ রাজ্যের কে না জানে? এবারের নির্বাচনও ছিল মরণপণ লড়াই, অতএব বেশকিছু প্রাণ গেল।

তবে মাঠের খেলার সাথে রাজনীতির খেলার বড় তফাত হল মাঠের খেলার শুরু আছে, শেষ আছে। শেষ হলে জয়ী দলের অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন পরাজিত অধিনায়ক বিরাট কোহলির কাঁধে মাথা রাখতে পারেন, কোহলি ঠেলে সরিয়ে দেন না। আইসিসির কাছে অকারণ নালিশ ঠুকে ট্রফি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও করেন না। কিন্তু রাজনীতির খেলার সূচনা, উপসংহারের ঠিক নেই। অনেকে ভাবেন কেবল নির্বাচনটুকু খেলা। “খেলা হবে” স্লোগান যাঁর মাথা থেকে বেরিয়েছিল, তিনিও হয়ত তাই ভেবেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের ফল বেরোনো মাত্রই পরাজিত বিজেপি বুঝিয়ে দিল, বিধানসভা নির্বাচনটা বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালের মত ‘ওয়ান-অফ’ খেলা নয়, লম্বা সিরিজ।

খেলা হবে আর আনুষঙ্গিক উত্তেজনাগুলো থাকবে না তা কি হয়? সৌরভোত্তর বাঙালি না হয় ক্রিকেটের দিকে বেশি ঝুঁকেছে, কিন্তু তার সেরা খেলা এখনও ফুটবল। নইলে ইস্টবেঙ্গলকে আই এস এল খেলানোর জন্য মুখ্যমন্ত্রী মাঠে নামেন? ফুটবলের অন্যতম আকর্ষণ হল ‘ট্রান্সফার মার্কেট’। এই বিলিতি কথাটা হালের আমদানি। গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশক অব্দি যখন টিভির চ্যানেল ঘোরালেই ইউরোপের লিগ দেখা যেত না; সেইসময় আমরা বলতাম ‘দলবদল’। দিবারাত্র খবরের চ্যানেল ছিল না, ডিজিটাল মাধ্যম ছিল না, কিন্তু সকালের কাগজ তেতে থাকত দলবদলের খবরে। আজ পড়লাম কৃশানু-বিকাশ মোহনবাগানে যাচ্ছেন, কালই ছবি বেরোল “ইস্টবেঙ্গলের গোপন আস্তানায় আড্ডার আসরে অভিন্ন জুটি”। সঙ্গে হয়ত পল্টু দাসের উক্তি “ওরা ঘরের ছেলে, আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবে?” মহমেডান ছাড়ছেন চিমা? সুদীপ চ্যাটার্জি কি দল বদলাবেন? কার অফার নিয়ে ভাবছেন শিশির ঘোষ? বিজয়ন-সত্যেন কি সত্যিই কেরালা পুলিস ছেড়ে মোহনবাগানে আসছেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে মাঠে বল পড়ার আগেই ফুটবল মরসুম শুরু হয়ে যেত। একসময় রীতিমত অপহরণের অভিযোগে জেরবার হয়ে আই এফ এ চালু করল টোকেন ব্যবস্থা। টোকেন যার, ফুটবলার তার। তখন আবার এক ক্লাবকে টোকেন দিয়ে ফেলে পুলিসে ডায়রি করা শুরু হল টোকেন হারিয়ে গেছে বা কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে।

আই এস এল যুগের তরুণ বাঙালির কাছে এসব গল্পকথা মনে হবে। কলকাতা লিগকে দুয়োরানি করে দিয়েছিল যে আই-লিগ, তাও তো এখন সবার পিছে সবার নীচে। কিন্তু মাঝবয়সী বা বার্ধক্যে উপনীত ফুটবলপ্রেমীরা নিশ্চয়ই গত কয়েক মাস স্মৃতিমেদুরতায় ভুগছেন। ভোটের মরসুমে ফিরে এসেছে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগের উত্তেজনা। প্রত্যেকবার অমিত শাহ উড়ে আসার কয়েকদিন আগে থেকে চ্যানেলে, কাগজে, ফেসবুকে আলোচনা চলেছে কোন কোন তৃণমূল নেতা বিজেপিতে যাচ্ছেন, কোন কোন সাংসদ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন, কোন সিপিএম কাউন্সিলর কোন দিনের সভায় বিজেপিতে যোগ দেবেন। সন্দেহ নেই বিজেপির রিক্রুটারদের কাছে সে আমলের টুটু বসু, পল্টু দাস, মহম্মদ ওমররা নস্যি। তৃণমূল মন্ত্রিসভার সদস্য শুভেন্দু অধিকারী থেকে প্রবীণ সিপিএম নেতা অশোক ভট্টাচার্যের ডান হাত শঙ্কর ঘোষ পর্যন্ত কাকে না বঁড়শিতে গেঁথেছেন? তৃণমূলও হাত গুটিয়ে বসে ছিল না, তবে দলে টানা লোকেদের ধারে এবং ভারে তারা পিছিয়ে ছিল। সৌমিত্র খাঁয়ের ঘর ভাঙা ছাড়া আর তেমন সাফল্য কোথায়? তাছাড়া কৃশানু এক দলে, বিকাশ অন্য দলে থাকলে লাভ কী?

ফুটবলের দলবদল শেষ হয়ে যেত মরসুম শুরু হওয়ার আগেই। ‘মিড-সিজন ট্রান্সফার উইন্ডো’ ব্যাপারটা ইউরোপ থেকে শেখা হল অনেক পরে। কিন্তু সে তো উইন্ডো, মানে জানলা। নির্বাচনের পরে যা খুলে গেছে তা সিংহদুয়ার। ধীরেন দে, জ্যোতিষ গুহ পর্যন্ত ফেল পড়ে যাবেন মুকুল রায়ের সামনে। বাংলা সংবাদমাধ্যমে তাঁকে চাণক্য বলা হচ্ছে ইদানীং, অচিরেই মোরিনহো বা গুয়ার্দিওলার সাথে তুলনা করতে হবে। যদিও তাঁদেরও এমন চৌম্বকশক্তি নেই। পেপ বার্সেলোনার একগুচ্ছ খেলোয়াড়কে বায়ার্ন মিউনিখ বা ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে আনতে পারেননি। মুকুল দলে দলে বিজেপি নেতা, কর্মীকে তৃণমূলে আনছেন। আস্ত জেলা কমিটি তুলে আনছেন। খেলার আরও রোমহর্ষক হয়ে উঠছে। মুকুলবাবু বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান হতে চলেছেন। বিরোধীরা আপত্তি করেছিলেন, ও পদটায় বিরোধী দলের বিধায়ককে বসানোই তো দস্তুর। কারণ শাসক দলে থাকা বিধায়ক সরকারি হিসাবপত্র পরীক্ষা করলে যে গলতি মাপ করে দেবেন না, তার নিশ্চয়তা নেই। জবাবে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন মুকুলবাবু তো বিজেপিরই বিধায়ক, তৃণমূল তাঁকে সমর্থন করবে কেবল।

পিকে ব্যানার্জি আর অমল দত্ত যখন যথাক্রমে ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের কোচ ছিলেন, তখন উত্তেজনার পারদ চড়েই থাকত। ডায়মন্ড ম্যাচের আগে সে কি প্রবল বাদানুবাদ! একবার ভাবুন তো, যদি পিকে একইসঙ্গে দুই দলেরই কোচ হতেন? সাইডলাইনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত দৌড়ে বেড়াতেন, বাইচুংকে নির্দেশ দিতেন “অপেক্ষা করলে হবে না, বল কাড়তে হবে।” তারপর বাইচুং গোল করতেই বাসুদেব মণ্ডলকে বকতেন “হচ্ছেটা কী? তুই থাকতে বাইচুং সাপ্লাই পাচ্ছে কেন?” মুকুল রায় খেলাটাকে সেই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন করেছিলেন, বাঙালি মুকুলবাবুর বিশ্বরূপ দেখছে। এদিকেও তিনি, ওদিকেও তিনি।

আরও পড়ুন রাহুলে না, বাবুলে হ্যাঁ: তৃণমূলের প্রকৃত এজেন্ডা নিয়ে কিছু প্রশ্ন

যে সময়ের কথা বলে লেখা শুরু করেছিলাম, সে সময় বাঙালির গুমোর ছিল, আর যা-ই হোক, ফুটবলে আমরা ভারতসেরা, কলকাতা হল ভারতীয় ফুটবলের মক্কা। সে গর্ব গোয়ায় গুঁড়িয়ে গেছে অনেককাল আগে। আরেক অহঙ্কার ছিল বাংলার রাজনীতি। এখানে মারামারি, খুনোখুনি হয়। কিন্তু আয়ারাম গয়ারাম সংস্কৃতি নেই, ওসব গোবলয়ের ব্যাপার। আজকের ট্রান্সফার মার্কেটে সে গর্বও ধূলিসাৎ।

অবশ্য রাজনীতি খেলা হয়ে দাঁড়ালে এসব হবেই। যে কোন ঘটনাই প্রথমবার ঘটলে চোখ কপালে ওঠে, দ্বিতীয়বার আর কেউ উচ্চবাচ্য করে না। ফলে খেলা যত এগোবে, নেতাদের যাওয়া আসা বাঙালিরও গা-সওয়া হয়ে যাবে। রবি শাস্ত্রী ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় উত্তেজক ম্যাচের শেষে বলতেন, আসলে জয়ী হল খেলাটা। এ ক্ষেত্রেও যে খেলাটাই জিতবে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ হারবে, হারছে সাধারণ নাগরিক।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

বিবি বিদায় নিলেও বদলাবে না ইজরায়েল

বিবি লঙ্কা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, এখন সেখানে যে যাবে সে-ই হবে রাবণ।

“… সরে যাওয়ার পর তাঁর উত্তরাধিকার বলতে আরও সুরক্ষিত একটা দেশ থাকবে না, থাকবে একটা গভীরভাবে বিভাজিত সমাজ, যা দেওয়ালের আড়ালে বাস করে।” কথাগুলো লিখেছিলেন একজন প্রধানমন্ত্রীর জীবনীকার, ২০১৮ সালে প্রকাশিত জীবনীতে। দেশটা নানা ভাষা নানা মতের দেশ ভারত নয়। নেতার নাম নরেন্দ্র মোদী নয়। দেশটার নাম ইজরায়েল, নেতার নাম বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু, বইটার নাম বিবি, লেখক ইজরায়েলি সাংবাদিক আনশেল ফেফার। একটানা বারো বছর, সব মিলিয়ে ১৫ বছর, ক্ষমতায় থাকার পর আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় বন্ধু বিবি সম্প্রতি পদচ্যুত হলেন।

বিবির বন্ধু, শত্রু উভয়েই বলেন পদ আঁকড়ে থাকায় তাঁর জুড়ি নেই। বহুদিন থেকেই গদি টলোমলো। দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, ২০১৯ সালে প্রথম ক্ষমতাসীন ইজরায়েলি নেতা হিসাবে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন। অভিযোগ তিনি কোটিপতিদের কাছ থেকে দামি উপহার নিয়েছেন, তার বদলে সংবাদমাধ্যম ও টেলিকম কোম্পানির মালিকদের অন্যায় সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন। বিবির বন্ধুর দেশে এসব কোনও অভিযোগই নয়। যারা অভিযোগ করছে তাদের পাপ্পু, দেশদ্রোহী, আর্বান নকশাল ইত্যাদি বলে দিলেই ঝামেলা চুকে যায়। কিন্তু ইজরায়েলে তা হবার জো নেই। অতিমারীর মধ্যেও বিরাট মিছিল হয়েছে বিবিকে সরানোর দাবিতে। কিন্তু বিবির অমিত শাহ না থাকলেও কৌশল আছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন কৌশলের জোরেই তিনি বিরোধীদের দ্বিধাবিভক্ত করে রেখে এতদিন ক্ষমতায় টিকে গেলেন। শেষমেশ তাঁরই প্রাক্তন চিফ অফ স্টাফ, প্যালেস্তাইন সম্বন্ধে তাঁরই মত গোঁড়া মানসিকতার নাফতালি বেনেত্তে থেকে শুরু করে আরব ইসলামিস্ট পর্যন্ত সকলে হাত মিলিয়ে নেতানিয়াহুকে পদচ্যুত করতে পারলেন।

যা যা অভিযোগ আছে তাতে বছর দশেক কারাবাসের সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু বিবি সফলভাবে ইজরায়েলকে প্রবলভাবে যুযুধান দেশে পরিণত করেছেন। তিনি যখন ক্ষমতায় আসেন তখন প্যালেস্তাইন সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের যেটুকু সম্ভাবনা ছিল, এখন আর তা-ও নেই বলে মনে করা হচ্ছে। পিটিয়ে সবকিছুই ঠান্ডা করে দেওয়া যায় — এই মানসিকতা দেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। উত্তরসূরী বেনেত্তের সাথে নেতানিয়াহুর মতাদর্শগত তফাত নেই। অর্থাৎ বিবি লঙ্কা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, এখন সেখানে যে যাবে সে-ই হবে রাবণ।

আরও পড়ুন বিবিসিকে বাদ দিয়ে বিশ্বগুরু থাকতে পারবেন মোদী?

ইজরায়েল অবশ্য রাষ্ট্র হিসাবে বিবির আগে থেকেই আধিপত্যবাদী। তবে বিবির মত বুক ফুলিয়ে আধিপত্যবাদকে আদর্শ হিসাবে খাড়া করতে সকলে পারে না। ১০ই জুলাই ১৯৯৬ তারিখে মার্কিন কংগ্রেসে প্রথম বক্তৃতাতেই তিনি বলেছিলেন হিব্রু ধর্মশাস্ত্রে লেখা আছে, ঈশ্বর তাঁর ভক্তদের শক্তি দেবেন এবং শান্তি দিয়ে আশীর্বাদ করবেন। অতএব শক্তি থেকেই যে শান্তি আসে — এটাই সত্য। গোদা বাংলায় বললে, সবই ব্যাদে আছে এবং ব্যাদে যা আছে তা-ই শেষ সত্য। বোঝা শক্ত নয়, কেন বিবি আর মোদী সাহেবের গলাগলি হয়েছিল। কেনই বা স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকারের অনুসৃত বিদেশনীতি থেকে সরে এসে ইজরায়েলের দিকে ঝুঁকে পড়ল মোদী সরকার, কেন ভারতের আন্দোলনকারীদের মোবাইল ফোনে পেগ্যাসাসের মত ইজরায়েলি সফটওয়্যারের উঁকি ঝুঁকি শুরু হল।

মোদীর মতাদর্শগত শিক্ষা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের হাতে আর সেই সঙ্ঘের গুরু গোলওয়ালকর ছিলেন নাজি ভক্ত। ‘উই, অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’ বইতে ইহুদী নিধনের জন্য তিনি জার্মানির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তা সত্ত্বেও মোদী কী করে ইজরায়েলের সাথে গা মাখামাখি করেন, তা নিয়ে বিজেপি-বিরোধীদের প্রায়ই বিস্ময় প্রকাশ বা কটাক্ষ করতে দেখা যায়। তাঁরা আসলে এখনও হলোকস্টের যুগে পড়ে আছেন, মোদী আর বিবি এগিয়ে গেছেন। দুজনেই জানেন এ যুগে আর এক লপ্তে গণহত্যা করে ‘শত্রু’ জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সম্ভব নয়। শক্তি প্রদর্শন করে ক্রমশ প্রান্তিক করে দেওয়াই পথ। সে কাজ করতে পারলে কে ক্ষমতায়, তাতে কিছু এসে যায় না। ভারতকে ইজরায়েলের মত লঙ্কায় পরিণত করতে বিবির সাহায্য প্রয়োজন ছিল। মোদীর পরে যে দলের যিনিই আসুন, তিনি যেন বেনেত্তির মতই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন তা নিশ্চিত করতে হবে তো।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

Meet Pakistani director who used Rabindrasangeet

Mehreen Jabbar. Photo from her website

Kolkata: About a week back, Bengalis on social media were pleasantly surprised by the emergence of a video clip where a beautiful girl is seen singing “amaro porano jaha chay”, one of Rabindranath Tagore’s most popular compositions, as an equally handsome young man listens with eyes wide open. This romantic situation is as common for Bengalis as mustard oil to cook hilsa, albeit these were Pakistani actors Yumna Zaidi and Feroze Khan. They were speaking in Urdu but the song was in impeccable Bangla, that too, a Rabindrasangeet! The clip soon went viral among Bengalis. Sure there were doubters who asked if it was a carefully done deep fake, but enterprising Bengalis soon found out that it was actually a scene from Geo TV’s 2019 serial Dil Kya Kare. They even found that director Mehreen Jabbar had herself posted another sequence on Instagram, where Yumna is seen singing the other part of the same song.

It was enough to make everyone in Bengal curious about Mehreen. How did a Pakistani lady like her come to know of a Rabindrasangeet? Who sang the song for her? Why did she decide to use a Bangla song in an Urdu serial? And, of course, that question every Bengali asks at the drop of a hat: is Mehreen somehow connected to Bengal?

She not only answered those, taking time out of her busy schedule, but also spoke about the subcontinent’s shared cultural heritage and how politics often makes us forget how similar we, the people of India, Pakistan and Bangladesh, are. Excerpts from the exclusive interview to eNewsroom:

How did you find Rabindranath Tagore? I know you have worked with people like Debajyoti Mishra and Nandita Das but is there a bigger Bengal connection that led you to him?

I found this piece because my friend Sharvari Deshpande [Indian actor and singer], who sang it, was in New York some years back, and she had sung it at a gathering. I was immediately drawn to the song even though I didn’t understand the words. Later, I got her to send the translations to me and I totally fell in love with it, knew that I wanted to use it in the serial because it gelled well with the character of Yumna Zaidi. Therefore, I asked Sharvari to record it and send it to me.

Have you read Rabindranath in original or via translation? Has he become a habit for you or do you read him/listen to his songs occasionally?

I had never read him either in original or through translation, so it was a discovery for me as well. Going forward, I’m intrigued and curious because I simply fell in love with him. This is an education for me, which I hope to take farther.

What prompted you to use a Rabindrasangeet in an Urdu serial?

It was purely an emotional response. I loved the song so much and by pure luck, it was fitting in really well with two or three scenes I used the piece in. It wasn’t in the script to start with. I think that came about later, when I was going through the story [by Asma Nabeel], and felt at these places this would be the most appropriate piece to use.

Is it common among Pakistani youth to sing Rabindrasangeet? Do they really sing them among themselves as shown in the serial?

Unfortunately, it’s not that common unless people have family who are Bengali, or lived in Bangladesh, or know about West Bengal. I’m sure there are such people in Pakistan but I haven’t been part of any such gathering. So, this was a new situation that we depicted.

You were born the year Bangladesh seceded from Pakistan and became an independent country. The conflict started over the use of Urdu over Bangla in the then east Pakistan. There is still some antipathy towards Urdu at least in my part of Bengal because of that. This is partly why Bengalis in West Bengal are euphoric seeing these clips. Almost every media platform has done a story on this. People here want to know if Pakistan has got over its cultural opposition to Bangla. To be specific, was the use of Rabindrasangeet received well, or did you face problems for using a Bangla song in your work?

Unfortunately, the younger lot in Pakistan, including me, never heard much discussion about 1971. There wasn’t much examination of the incidents either. With the result that there is no opposition to using Bangla, or any preconceived notion about it. They (the youth) are very open. Unfortunately, there hasn’t been enough cultural exchange with Bangla as opposed to Bollywood cinema, which is very popular in Pakistan. Because people can easily understand Hindi. Having said that, I think there’s great scope for exploring this aspect. There was no problem using Bangla at all, and in future I really doubt there would be.

Dil Kya Kare was aired in 2019. After the “amaro porano jaha chay” clip, a few other clips have emerged of other Pakistani serials where Bangla songs, not Rabindrasangeet, have been used. Can you tell me how long has this been going on and what is the reason? I mean, is there a sizeable Bangla-speaking audience in Pakistan? Or is it done to attract spectators from Bangladesh or West Bengal, keeping in mind this is the age of OTT platforms?

I would love to see the other clips where Bangla songs have been used in Pakistani serials. I think that is fantastic. I’m not personally aware of it. It’s incredible if that’s happened. But when I used this song, there was no motive in mind. It was just a beautiful rendition by Sharvari, and it went well with the story. That was the main reason. I’m just very happy that so many years after the serial was aired, it has been noticed and appreciated. That is really heart-warming to realise that.

Last question. How difficult is it for today’s artists to proactively share the cultural legacy of the subcontinent? Are there social or political obstacles? If the answer is yes, then do you see a light at the end of the tunnel?

It’s a good question. It’s unfortunate that one of the first casualties of differences between governments are the artists. They should be the last ones affected. It’s funny that trade goes on, other exchanges go on but the artists on all three sides are always marginalised. That is unfortunate. However, there are people who are still trying to collaborate. As you know, I’ve done Ramchand Pakistani in 2008, I’ve done Ek Jhoothi Love Story for Zee5, hopefully I’ll be doing another one for them. I hope this exchange continues because that is the only way, I feel, for people to get to know each other. Because there is ignorance and lack of understanding but so many similarities, so many things we share: the love for the land, for food, for clothing. There’s so much that is similar, even though we are different. There’s a shared humanity that exists in all three countries. I don’t think enough has been done to highlight that in a positive way. I hope all the governments loosen the leash because artists and art are all about creating an understanding and respect for each other.

I also feel Pakistan is unfortunately under-represented in both India and Bangladesh, especially in India. Not enough Pakistani drama or music or books get shared in your country. Whereas there’s a lot more coming in from India. But one has to always hope and not be negative. We must always hope for a better future.

Published on https://enewsroom.in

শাহেনশাহ ও ফ্যাসিবিরোধী ইশতেহার

তৃণমূল-বিজেপির লড়াইটা তাহলে রাজনৈতিক নয়, আদর্শগতও নয়? ওটা আক্ষরিক অর্থেই খেলা? এসব প্রশ্ন কোন সংবাদমাধ্যমকে করতে দেখা যাচ্ছে না।

অমিতাভ বচ্চনের নায়ক জীবনের শেষ দিকের ছবি শাহেনশাহ । সেখানে অমিতাভের একই অঙ্গে দুটো রূপ। রাতের বেলায় তিনি সাদা চুল, সাদা দাড়িতে অদ্ভুতদর্শন কালো পোশাক পরে লোহার হাত দিয়ে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন করে বেড়ান। দিনের বেলায় খাকি উর্দি পরে যা যা করা উচিৎ নয়, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে ঠিক সেগুলোই করে বেড়ান। অপরাধীদের সমঝে চলেন, একটু আধটু ঘুষ-টুষও নিয়ে থাকেন। গত ৩০-৪০ বছরে বলিউডি নীতিবোধ আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেঁধিয়ে গেছে, সে আমরা ভারতের যে প্রান্তেই থাকি আর যে ভাষাতেই কথা বলি। আমরা এখন বিশ্বাস করি, একই লোক দিনের বেলায় ঘুষ খেয়ে রাতের বেলায় গুন্ডা বদমাইশদের টাইট দিতেই পারে। তাই সন্ন্যাসী রাজা ছবিতে উত্তমকুমার ফিরে এসেছেন দেখে গ্রামের লোক যেমন আপ্লুত হয়, মুকুল রায় বিজেপি থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে ফিরে এসেছেন দেখেও আমরা তেমনি আবেগে ভাসি। আমরা মানে বিজেপি-বিরোধী, ফ্যাসিবাদ-বিরোধীদের কথা বলছি। আসলে যাঁদের উদ্যোগে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ দখল করার আন্তরিক প্রচেষ্টা বিফল হল আর কি। এ তো নেহাত বানিয়ে বলা নয়, স্বয়ং মমতা ব্যানার্জি স্বীকার করেছেন।

এ রাজ্যে তো এখন দুটোই পক্ষ — বিজেপি আর বিজেপি-বিরোধী। বিজেপি মানে কেবল ৭৭ জন বিধায়ক নয়। রাজ্য সরকারের যে কোনও বিষয়ে যারা সমালোচনা করে, তারা সকলেই বিজেপি। এমনটাই বিজেপি-বিরোধীরা, মানে যাঁরা এ যাত্রায় বাংলাকে বাঁচালেন, তাঁরা বলে দিয়েছেন। আপাতত তর্কের খাতিরে কথাটা সত্য ধরে নিয়ে বলি, এর বাইরে একটা পক্ষ থাকার কথা ছিল, যে কোনও চালু গণতন্ত্রে থাকে। তা হল সংবাদমাধ্যম। দুঃখজনকভাবে সে পক্ষটা আর পশ্চিমবঙ্গে আছে বলে মনে হচ্ছে না। থাকলে কোনও কাগজ, কোনও চ্যানেল প্রশ্ন তোলে না, যে বিজেপিকে আটকানোর জন্য মানুষ তৃণমূলকে ঢেলে ভোট দিলেন সেই বিজেপির সর্বভারতীয় পদাধিকারীকে মমতা ব্যানার্জি কেন দলে নিচ্ছেন? উল্টে সোৎসাহে আলোচনা চলছে, মুকুলবাবু বিজেপির কত বড় “অ্যাসেট” ছিলেন, তাঁকে কেড়ে নেওয়ায় বিজেপির কেমন কোমর ভেঙে দেওয়া গেল। সংবাদমাধ্যমের একটা মস্ত সুবিধা হল, রাজনৈতিক নেতাদের যা-ও বা প্রশ্ন করা যায়, তাদের প্রশ্ন করা যায় না। নইলে জিজ্ঞেস করা যেত, নিজে জেতা ছাড়া মুকুল রায় বিজেপির আর কোন লাভের কারণ হয়েছেন? নিজের এলাকায় নিজের ছেলেকেও যিনি জেতাতে পারেন না, তিনি কোন বিচারে “অ্যাসেট”? এই প্রশ্নগুলো আগাম আন্দাজ করে কোন কোন সংবাদমাধ্যম বলেছে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সাফল্যের কাণ্ডারী ছিলেন মুকুলবাবু। কিমাশ্চর্যম তৎপরম! পশ্চিমবঙ্গের মত এত বড় রাজ্যের একটা জেলার একজন প্রভাবশালী নেতা নাকি গোটা রাজ্যের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলেছিলেন! আচ্ছা, নাহয় ফেলেছিলেন। তাহলে বিধানসভায় পারলেন না কেন? তবে কি ইচ্ছা করেই এবার আর প্রভাব ফেললেন না? যদি তা-ই হয় তাহলে কেন করলেন এমন? এসব প্রশ্নের উত্তর না থাকতে পারে, কিন্তু সর্বদা উত্তর জোগানো তো সংবাদমাধ্যমের কাজ নয়, তাদের কাজ সর্বদা প্রশ্ন করা। সেসব করতে বিশেষ কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বরং বেচারা মুকুলবাবুকে বিজেপি কেমন প্রান্তিক করে দিয়েছিল, তা দিনরাত আমাদের জানানো হচ্ছে।

এই প্রান্তিক তত্ত্বটা খেয়াল করার মত। কারণ ভোটের ফল বেরোবার পরপর পড়া যাচ্ছিল দিলীপ ঘোষের মত জননেতাকে বিজেপি এবারের নির্বাচনে প্রান্তিক করে দিয়েছিল, তাই এই ফল। এখন আবার মুকুলবাবুর প্রান্তিকতার কথা শোনা যাচ্ছে। এদিকে মুকুলবাবুর প্রস্থান সম্পর্কে দিলীপবাবুর বক্তব্য হল, বিজেপিতে যারা আসে তাদের সবাই টিকতে পারে না, কারণ ওখানে “তপস্যা” করতে হয়। টিএমসি-র মত কাট মানি আর সিন্ডিকেট কালচারের দল থেকে এসে বিজেপিতে টেকা মুশকিল। তা এই দুজনেই যদি প্রান্তিক হয়ে থাকেন, তাহলে কেন্দ্রে ছিলেন কে? শুভেন্দু অধিকারী? আচ্ছা, যদি কদিন পরে তাঁকেও বিজেপি প্রান্তিক করে দেয়, তাহলে তিনিও কি তৃণমূলে ফেরত আসবেন? এখন সংবাদমাধ্যম বলছে বিজেপি যখন ২০০ আসনের স্বপ্নে বুঁদ ছিল, তখন মুকুলবাবু তিন-তিনটে পরামর্শ দিয়েছিলেন। যার মধ্যে দুটো হল ধর্মীয় মেরুকরণ না করা আর মমতা ব্যানার্জিকে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করা। তার ফলেই নাকি তাঁকে কোণঠাসা হয়ে পড়তে হয়। বিজেপিতে যোগ দিয়েও ধর্মীয় মেরুকরণের বিপক্ষে বলার মত নায়কোচিত দু-একটা কাজ কি আর শুভেন্দুবাবুও করেননি? তিনি যখন ফিরে আসবেন, তখন নিশ্চয়ই আমরা সেসব জানতে পারব।

অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী নিজ মুখে বহুবার বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর কাছে মুকুল আর শুভেন্দু এক নয়। মুকুলবাবুকে মাতৃক্রোড়ে ফিরিয়ে নেওয়ার দিন সাংবাদিক সম্মেলনে তো বলেছেনই, মুকুলের সাথে কোনদিন মতপার্থক্য হয়নি এবং মুকুল বিজেপিতে গিয়েও কোনদিন পার্টির বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলেনি। মুখ্যমন্ত্রী নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন, বয়সও হয়েছে। হয়ত স্মৃতি সবসময় ঠিকমত কাজ করে না। তার উপর মনটা দরাজ, ছোটখাট কথা মনে রাখেন না। কিন্তু সাংবাদিকদের কেউ কি প্রশ্ন তুলেছেন, মতপার্থক্য না হয়ে থাকলে একটা লোক পার্টি ছেড়ে অন্য পার্টিতে গেল কেন? গেলেও যদি সম্মুখসমরে ছেড়ে আসা পার্টির বিরুদ্ধে সত্যিই একটা কথাও না বলে থাকে, সে-ও তো ভারী আশ্চর্যের কথা। ইউরো চলছে, ফুটবলপ্রেমীরা জানেন যে ইউরোপের এক ক্লাবের ফুটবলার নিজের দলে খুব একটা খেলার সুযোগ না পেলে অনেকসময় সেই মরসুমেই অন্য ক্লাবে খেলতে চলে যান। কখনো কখনো দেখা যায় পুরনো ক্লাবের বিরুদ্ধে খেলায় গোলও করে ফেলেছেন। তাতে কিন্তু পরে আবার পুরনো ক্লাবে খেলা আটকায় না। মুকুলবাবুর বিজেপিতে যাওয়াও কি তেমন ব্যাপার ছিল? তৃণমূল-বিজেপির লড়াইটা তাহলে রাজনৈতিক নয়, আদর্শগতও নয়? ওটা আক্ষরিক অর্থেই খেলা? এসব প্রশ্ন কোন সংবাদমাধ্যমকে করতে দেখা যাচ্ছে না। দেখে শুনে মনে হয় তাঁরাও পক্ষ নিয়ে বসে আছেন। স্রেফ লাভ ক্ষতির অঙ্কে চলা সংবাদমাধ্যমের মালিকরাও ফ্যাসিবিরোধী সঙ্ঘে যোগ দিয়েছেন নাকি? হবেও বা।

অবশ্য মুকুলবাবুর ঘরে ফেরা আরও কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যে প্রশ্নগুলো করা ফ্যাসিবিরোধী সংবাদমাধ্যমের কর্তব্য। যেমন ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ক্যাম্পেনের মানুষজন এবং লিবারেশন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য — যাঁদের মমতা ব্যানার্জি নাম করে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন — তাঁরা কি মিথ্যে এত মেহনত করলেন? ওঁরা তো বরাবরই বলছিলেন এবারের লড়াই বাংলার মনীষা বাঁচানোর লড়াই। এটা কেবল রাজনৈতিকও নয়, রীতিমত সামাজিক সাংস্কৃতিক লড়াই। তৃণমূলের জয় এবং বিজেপির পরাজয়ের পরেও তো দীপঙ্করবাবু একাধিক সাক্ষাৎকারে এবং খবরের কাগজে নিজের লেখাপত্রে বারবার বলেছেন বাংলার মানুষ বিভাজনের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন বলেই এই ফলাফল হয়েছে। তা সেই ফলাফলের সুবিধা পেল যে দল, সেই দলের তাহলে কিছুই এসে যায় না মানুষ কী জন্যে ভোট দিয়েছে তা নিয়ে? তারা ফ্যাসিবাদী দলের নেতাকে দলে নিতেই পারে? বিজেপি ফ্যাসিবাদী নাকি স্রেফ অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী, তা নিয়ে শূন্য পাওয়া সিপিএমে সেই ২০১৪ থেকে বিতর্ক চলেছে। বিজেপিকে ফ্যাসিবাদী বলে না মেনে নেওয়াই যে সিপিএমের কমতে কমতে শূন্য হয়ে যাওয়ার কারণ — সে কথা বিকল্প বামেরা বারবার বলেছেন। অর্থাৎ তাঁদের নিজেদের কোন সংশয় নেই যে বিজেপি ফ্যাসিবাদী। তাহলে সেই দলের নেতাকে দলে নেওয়ার পরেও কি তৃণমূল ফ্যাসিবিরোধী দল রইল? লিবারেশন মুকুলবাবুর প্রত্যাবর্তন নিয়ে যে বিবৃতি দিয়েছে তার বয়ান এইরকম:

রাজ্যের গণ রায় সার্বিকভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে ছিল। ক্ষমতার লোভে দলবদল করে বিজেপিতে গিয়ে যারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে আজ আবার ক্ষমতার আকর্ষণেই তারা বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফিরে এলে আবার জনতার রায় নিতে হবে। এই দলবদলের সুবিধাবাদী রাজনীতি থেকে পশ্চিমবঙ্গের ও দেশের রাজনৈতিক পরিসরকে মুক্ত করা আজ গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

এই বিবৃতিতে কোথাও ফ্যাসিবিরোধী দল হিসাবে তৃণমূলের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ল না কমল, নাকি একই রইল তা নিয়ে কোন মন্তব্য নেই। “মৌনং সম্মতি লক্ষণম” কথাটা যদি ঠিক হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে লিবারেশন মনে করছে বিশ্বাসযোগ্যতা যেমন ছিল তেমনই আছে। কেবল “আবার জনতার রায় নিতে হবে”, অর্থাৎ মুকুলবাবু (আরও যাঁরা আসতে চলেছেন, বোধহয় তাঁরাও) পদত্যাগ করে আবার ভোটে দাঁড়িয়ে বিধায়ক হলেই আর আপত্তি নেই। লিবারেশনের কর্মী সমর্থকরা সোশাল মিডিয়ায় যা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে তাঁদের অনেকের ধারণা এতে বিজেপির শক্তি কমল। তাই তাঁরা বরং উল্লসিত। সত্যিই শক্তি কমল কিনা তা অচিরেই বোঝা যাবে, কিন্তু ফ্যাসিবাদী বলতে কী বোঝায় সেই প্রশ্ন নিয়ে তাহলে আবার আলোচনা করা প্রয়োজন। ভারতে বিজেপি-বিরোধী সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে যে মতটা, তা হল বিজেপিকে যে ভোট দেয় সে-ই ফ্যাসিবাদী। এই মত ঠিক না ভুল সেটা আলাদা কথা, কিন্তু বিজেপি নেতারা ফ্যাসিবাদী, তবে অন্য দলে চলে গেলেই আর ফ্যাসিবাদী থাকে না — এই চিন্তায় নতুনত্ব আছে। গোয়বেলস বা গোয়রিং যদি নাজি পার্টি ছেড়ে দিতেন, তাহলে কি তাঁরা আর নাজি থাকতেন না? এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দিতে হবে। কেবল লিবারেশনকে নয়, সমস্ত বিজেপি-বিরোধী তৃণমূলে উদ্ধার খোঁজা মানুষকেই দিতে হবে। আজ সংবাদমাধ্যম এসব প্রশ্ন তুলছে না বলে হয়ত দিতে হচ্ছে না, অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে দিতেই হবে। দীপঙ্করবাবুর মত নেতৃস্থানীয়দের হয়ত প্রকাশ্যে দিতে হবে, বাকিদের নিজেদের বিবেকের কাছে উত্তর দিতে হবে। কারণ ফ্যাসিবাদ এত সহজে হারে না। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়েছে বলেই বিজেপি-আরএসএস হেরে গেছে, এমন ভাবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

নেই বলেই সাধারণ অবস্থায় যে কোন সরকারকে তার যেসব কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্নের মুখে ফেলা উচিৎ, তৃণমূল সরকারকে সেগুলোর ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কোন কারণ নেই। অথচ সকলেই তা করে চলেছেন। আমি একটা বিজেপি-বিরোধী ওয়েবসাইটের হয়ে লিখতাম। আমার লেখায় সাধারণত উল্লিখিত খবরগুলোর তথ্যসূত্র দিয়ে থাকি। কোন একটা লেখায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারও যে কোরোনা আক্রান্তের সংখ্যায় কারচুপি করছে, মৃতের সংখ্যা গোপন করছে — এমন অভিযোগের কথা লিখেছিলাম। অভিযোগটা আমার নয়। যে কাগজ সেই অভিযোগ তুলেছিল, সেই কাগজের প্রতিবেদনের লিঙ্ক দিয়েছিলাম। সাইটের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন লেখাটা নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করতে গিয়ে বললেন “এ কি আর একা পশ্চিমবঙ্গ সরকার করে? সবাই তো করে। এ আর লেখার কী আছে?” আমার লেখাটা অবিকৃত অবস্থাতেই প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু সাইটের মনোভাব এ থেকে বোঝা যায়। মূলধারার সংবাদমাধ্যমেরও একই মনোভাব। যোগী বা শিবরাজ সিং চৌহানের রাজ্যের যেসব কুকর্ম নিন্দাযোগ্য, তা এ রাজ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশযোগ্যও নয়।

পশ্চিমবঙ্গের সাথে সাথেই কেরালায় বিধানসভা নির্বাচন হল। এখানে যেমন তৃণমূল কংগ্রেস হৈ হৈ করে জিতল, ওখানে তেমনই আধিপত্য নিয়ে জিতেছে সিপিএম নেতৃত্বাধীন এলডিএফ। সেই মন্ত্রিসভার কে কে সদস্য হলেন, কেন হলেন — তা নিয়ে এ রাজ্যের এবং সারা দেশের সংবাদমাধ্যমে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হল। বিজেপি-বিরোধীরাই সমালোচনার পুরোভাগে ছিলেন। এ রাজ্যের মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে কিন্তু একটা শব্দও কেউ উচ্চারণ করলেন না। অথচ যাঁদের মন্ত্রী করা হয়েছে তাঁদের সম্বন্ধে নারদকাণ্ড সামনে আসার পর মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন এরা এরকম জানলে মন্ত্রী করতেন না। এবার জানা সত্ত্বেও কেন করলেন, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললেন না। সংবাদমাধ্যমের কথা নাহয় বাদ দেওয়া গেল, যাঁরা আগামী দিনে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে মোদীর বিকল্প হিসাবে মমতাকে ভাবছেন — তাঁদেরও কি দায়িত্ব নয় মমতার সরকারকে উন্নততর করতে চাপ দেওয়া?

এ রাজ্যে এখন সংসদীয় ক্ষমতার দিক থেকে কংগ্রেস টিমটিম করে জ্বলছে, বামপন্থীরা নেই। বিধানসভায় বামফ্রন্ট নেই, বাইরেও থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে ফরোয়ার্ড ব্লকের ঘোষণায়। গত দশ বছরে এরা যে বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ তা-ও স্পষ্ট। নইলে সারদার মত সবচেয়ে গরীব মানুষকে সর্বস্বান্ত করে দেওয়া আর্থিক কেলেঙ্কারির পরেও দুবার কোন দল ক্ষমতায় ফিরতে পারে না। তা এই যখন অবস্থা, তখন সরকারকে কড়া প্রশ্ন করার কাজটা বিজেপি-বিরোধী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কেন করছেন না? নিজ নিজ ক্ষমতায় ইয়াসের পর ত্রাণ পৌঁছে দিতে তাঁরা যত উৎসাহী, গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে পরিবেশের বারোটা বাজানো হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে তাঁরা তত উৎসাহী নন কেন? পৃথিবীর কোন সমুদ্র সৈকত আগাগোড়া কংক্রিটে বাঁধিয়ে দিয়ে সমুদ্রের দোরগোড়ায় বাজার বসানো হয়? দীঘা নিয়ে এই প্রশ্ন এ রাজ্যের পরিবেশবিদরা করবেন না? বাঁধ তৈরি, মেরামতি — এসব প্রশ্নই বা কাদের জন্য তোলা রয়েছে? ই এম বাইপাসের দু ধারের অজস্র গাছ কেটে কংক্রিটে বাঁধিয়ে রেলিং দেওয়াকে যখন সৌন্দর্যায়ন বলে চালানো হয়, তখন নাহয় চুপ ছিলেন। এখন অন্তত মুখ খুলুন। যশোর রোডের ধারের গাছগুলোকে বাঁচাতে গিয়েছিল যে পড়ুয়ারা, তাদের কথা কারো মনে আছে আজ? নাকি এসব প্রশ্ন পরের সাইক্লোন অব্দি থুড়ি পরের নির্বাচন অব্দি তোলা থাকবে?

নির্বাচনের ফল বেরোবার পরের দেড় মাস বামপন্থীদের, বিশেষ করে সিপিএমের, কী করা উচিৎ তা নিয়ে কয়েক গিগাবাইট লেখা হয়ে গেল (আমিও লিখেছি)। সরকারের কী করা উচিৎ সে আলোচনা কি এবার শুরু হওয়া উচিৎ নয়? নাকি বাকি দেশে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাই সংবাদমাধ্যম এবং বিরোধীদের কাজ, কিন্তু এ রাজ্যে সরকারকে রক্ষা করা কাজ? ভারতের ফ্যাসিবিরোধী ইশতেহার কি সেরকমই বলছে?

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত। ছবি টুইটার থেকে।

নবীন প্রজন্মের পাকিস্তানিদের বাংলার প্রতি কোনও দ্বেষ নেই, বলছেন ভাইরাল হওয়া পাক সিরিয়ালের পরিচালক

আমার গানটা ভীষণ ভাল লেগেছিল আর ঘটনাচক্রে আমার সিরিয়ালের দুটো তিনটে মুহূর্তের সঙ্গে গানটার বক্তব্য আশ্চর্যভাবে মিলে যাচ্ছিল।

মহরীন জব্বার। ছবি ইনস্টাগ্রাম থেকে

বাংলা ভাষার সাথে পাকিস্তানের যথেষ্ট সাংস্কৃতিক আদান প্রদান হয়নি, আক্ষেপ মহরীন জব্বারের

কয়েকদিন ধরে সোশাল মিডিয়ার বাঙালিরা দুটো ক্লিপ নিয়ে আপ্লুত। সেখানে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের এক টিভি সিরিয়ালের দৃশ্যে নায়িকা (য়ুমনা জ্যায়দি) রবীন্দ্রনাথের ‘আমার পরাণ যাহা চায়’ গানটা গাইছেন। ডিপ ফেকের যুগে কোনকিছুতেই চট করে বিশ্বাস করা যায় না, কিন্তু প্রথম ক্লিপ প্রকাশ্যে আসার কিছু পরেই সংশয় দূর হল। দেখা গেল দিল কেয়া করে নামের ওই সিরিয়ালের পরিচালক নিজেই ইনস্টাগ্রামে ওই গানের অন্য একটা অংশ পোস্ট করেছিলেন। পাকিস্তান এমন একটা দেশ, যে দেশের সরকার বাংলাভাষীদের উপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তা থেকে এক বিরাট আন্দোলনের জন্ম হয়, যার পরিণতি মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, সেই দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ। স্বভাবতই তাঁর লেখা গান আজকের পাকিস্তানের টিভি সিরিয়ালে গাওয়া হয়েছে দেখে দুই বাংলার মানুষ আপ্লুত। পশ্চিমবঙ্গের খবরের কাগজে, ওয়েবসাইটে রীতিমত খবর। যদিও এই সিরিয়াল জিও টিভিতে দেখানো হয়েছিল ২০১৯-এ, ভারতে এখন একটা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত সে কারণেই এতদিন পরে সোশাল মিডিয়ার সূত্রে বাঙালির চোখে পড়া। এই গান পাকিস্তানের সিরিয়ালে কে ব্যবহার করলেন? কেনই বা ব্যবহার করলেন? তবে কি কোন বাঙালি আছেন এই প্রযোজনার নেপথ্যে? উদ্বেলিত বাঙালি হৃদয়ে অনেক প্রশ্ন। নাগরিক ডট নেটকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর আস্তানা থেকে এইসব প্রশ্নের বিস্তারিত জবাব দিলেন ওই ধারাবাহিকের পরিচালক মহরীন জব্বার

মহরীনের প্রথম ছায়াছবি রামচন্দ পাকিস্তানি-তে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছিলেন কলকাতার দেবজ্যোতি মিশ্র। নন্দিতা দাস সে ছবিতে অভিনয়ও করেন। ফলে বাংলা বা কলকাতা তাঁর সম্পূর্ণ অপরিচিত নয়।

আপনি একেবারে প্রথম ছবি থেকে বাঙালিদের সাথে কাজ করছেন। রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে আপনার আলাপ কি সেই সূত্রে? নাকি অন্য কোনভাবে আপনার বাংলার সাথে যোগ ছিল এবং সে পথেই রবীন্দ্রনাথে পৌঁছেছেন?

আমি এই গানটা পেয়েছি আসলে আমার বন্ধু শর্বরী দেশপাণ্ডের কাছ থেকে, মানে সিরিয়ালে গানটা যে প্লেব্যাক করেছিল। ও একবার নিউ ইয়র্কে এসেছিল। তখন একটা আড্ডায় ওই গানটা গায়। শোনা মাত্রই গানটা আমাকে আকর্ষণ করে, যদিও আমি তখন কথাগুলোর মানে জানতাম না। কিন্তু ভাল লেগেছিল বলে আমি পরে ওকে গানটা অনুবাদ করে পাঠাতে বলি। অনুবাদ পড়ার পর গানটার প্রেমে পড়ে যাই। এতটাই, যে আমি বুঝতে পারি এই গানটা আমাকে দিল কেয়া করে-তে ব্যবহার করতেই হবে। কারণ য়ুমনা জ্যায়দির চরিত্রটার সাথে এই গানটা দারুণ মিশ খায়। তখন আমি শর্বরীকে গানটা রেকর্ড করে আমাকে পাঠাতে বলি।

আপনি কি বাংলায় বা অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন? ওই গানটার সংস্পর্শে আসার পরে ওঁর লেখা পড়া বা ওঁর গান শোনা কি অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে বা মাঝে মাঝে শুনছেন?

না, আমি কখনো কোন ভাষাতেই রবীন্দ্রনাথ পড়িনি। ওই গানটার মধ্যে দিয়েই আমি তাঁকে আবিষ্কার করি এবং আশ্চর্য হয়ে যাই। স্রেফ প্রেমে পড়ে যাই। ওটা আমার কাছেও একটা শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা ছিল। আশা করি ভবিষ্যতে এই শিক্ষাটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।

আচ্ছা, একটা উর্দু সিরিয়ালে বাংলা রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করার কথা হঠাৎ কেন মনে হল?

ওটা একেবারেই আবেগমথিত প্রতিক্রিয়া। আমার গানটা ভীষণ ভাল লেগেছিল আর ঘটনাচক্রে আমার সিরিয়ালের দুটো তিনটে মুহূর্তের সঙ্গে গানটার বক্তব্য আশ্চর্যভাবে মিলে যাচ্ছিল। আমার চিত্রনাট্যে তো গানটা প্রথমে ছিল না। পরে যখন সিরিয়ালের পুরো গল্পটা পড়ছি (আসমা নবীলের লেখা), তখন আমার মনে হল যে অমুক অমুক জায়গায় এই গানটাই সবচেয়ে উপযুক্ত।

পাকিস্তানের যুবক যুবতীদের মধ্যে কি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার চল আছে? আপনার সিরিয়ালে যেমন দেখিয়েছেন তেমনভাবে নিজেদের মধ্যে আড্ডায় তারা কি এসব গান গায়?

সত্যি কথা বলতে, যদি কারোর কোন বাঙালির সাথে পারিবারিক সম্পর্ক থাকে বা সে বাংলাদেশে কোন সময় থেকে থাকে, কি পশ্চিমবঙ্গের সাথে যোগাযোগ থাকে, তাহলে আলাদা কথা। নচেৎ নয়। আমি নিশ্চিত পাকিস্তানে সেরকম মানুষ অনেকেই আছেন, তবে সেরকম আড্ডায় আমার নিজের কখনো থাকার সুযোগ হয়নি। সুতরাং সিরিয়ালে যা দেখিয়েছি সেটা একেবারেই অভিনব দৃশ্য।

মজার কথা, আপনি যে বছরে জন্মেছেন সে বছরেই পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। পশ্চিম পাকিস্তান আর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব  শুরু হয়েছিল উর্দু বনাম বাংলা নিয়ে, যে কারণে আমাদের পশ্চিমবঙ্গে এখনো অনেকের উর্দু ভাষার প্রতি রাগ আছে। আবার এই ক্লিপগুলো জনপ্রিয় হয়েছেও কতকটা সেই কারণেই। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব সংবাদমাধ্যম এই নিয়ে খবর করেছে। মানুষ ভীষণ খুশি। অনেকের প্রশ্ন, পাকিস্তানে কি তাহলে বাংলার প্রতি আর কোন সাংস্কৃতিক বিরোধিতা নেই? মানে খুব নির্দিষ্টভাবে যদি জিজ্ঞেস করি, আপনার সিরিয়ালে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করায় কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? বাংলা গান ব্যবহার করেছেন বলে কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি তো?

আসলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম, আমি যখন তরুণ ছিলাম তখনকার কথা ধরেই বলছি, ১৯৭১-এর ঘটনাবলী নিয়ে খুব একটা আলাপ আলোচনা, পর্যবেক্ষণ — এসবের মধ্যে দিয়ে যায়নি। তার আবার একটা সুফল আছে। সেটা হল তাদের মধ্যে কোন বাংলা বিরোধিতা নেই। বাংলা ভাষাটা সম্পর্কে কোন গোঁড়ামিও নেই। তাদের মনের দরজা খোলা। তবে দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষার সাথে পাকিস্তানের ততটা সাংস্কৃতিক আদান প্রদান হয়নি, যতটা হিন্দির সাথে হয়েছে। যেমন বলিউডের সিনেমা আমাদের ওখানে দারুণ জনপ্রিয়। কারণটা অনেকটাই ভাষাগত। পাকিস্তানের মানুষ হিন্দিটা চট করে বুঝতে পারে। সেই কারণেই আমার মনে হয় বাংলা নিয়ে অনেককিছু করা যেতে পারে। এ নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা দরকার। আমি তো বাংলা ব্যবহার করে কোন অসুবিধায় পড়িনি। মনে হয় না ভবিষ্যতেও কোন সমস্যা হবে।

দিল কেয়া করে টিভিতে দেখানো হয়েছিল ২০১৯-এ। “আমার পরান যাহা চায়”-এর ক্লিপগুলো সোশাল মিডিয়ায় এসে পড়ার পর আরো বেশকিছু পাকিস্তানি সিরিয়ালের ক্লিপ পাওয়া যাচ্ছে, যেগুলোতে বাংলা গান (রবীন্দ্রসঙ্গীত নয় অবশ্য) ব্যবহার করা হয়েছে। আপনার কি জানা আছে কবে থেকে এই ধারা শুরু হয়েছে? কেনই বা পাকিস্তানি সিরিয়ালে বাংলা গানের ব্যবহার শুরু হল? পাকিস্তানে কি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাংলা বলা মানুষজন আছেন? নাকি এটা ওটিটির যুগ, সেকথা মাথায় রেখে পরবর্তীকালে বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের যে দর্শকরা দেখবেন, তাঁদের আকর্ষণ করার জন্যে করা হচ্ছে?

আমি অন্য পাকিস্তানি সিরিয়ালের ক্লিপগুলো দেখিনি, তবে যদি এরকম হয়ে থাকে, আমার মনে হয় ব্যাপারটা চমৎকার। আমি যখন এই গানটা ব্যবহার করেছিলাম তখন কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে করিনি। শর্বরী গানটা অপূর্ব গেয়েছিল। আর দেখলাম আমার সিরিয়ালের গল্পটার সাথে গানটা খাপ খাচ্ছে। ব্যাস, ওটাই কারণ। আমি খুব খুশি যে টিভিতে সিরিয়ালটা শেষ হয়ে যাওয়ার এত বছর পরে হলেও ব্যাপারটা আপনাদের নজরে পড়েছে এবং ভাল লাগছে।

শেষ প্রশ্ন। এই মুহূর্তে এই উপমহাদেশের শিল্পীদের পক্ষে আমাদের যৌথ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ভাগ করে নেওয়া কতটা কঠিন? সামাজিক বা রাজনৈতিক বাধা কতখানি? অদূর ভবিষ্যতে সেই বাধা সরে যাওয়ার আশা আছে বলে কি আপনি মনে করেন?

দেখুন, মুশকিল হল এই তিনটে দেশের (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ) সরকারগুলোর মধ্যে কোনরকম মতপার্থক্য হলেই প্রথম আঘাতটা আসে শিল্পীদের উপর। অথচ তাঁদের একেবারে শেষে আক্রান্ত হওয়ার কথা। কিরকম মজার কথা ভাবুন, ব্যবসা বাণিজ্য চলতে থাকে অথচ তিনটে দেশেই শিল্পীদের এক কোণে ঠেলে দেওয়া হয়। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তবে এই পরিস্থিতিতেও এমন কেউ কেউ আছেন যাঁরা একসঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছেন। আপনি তো জানেনই, আমি ২০০৮ সালে রামচন্দ পাকিস্তানি করেছি ভারতীয় শিল্পীদের সঙ্গে। এক ঝুঠি লাভ স্টোরি করেছি জি ফাইভের জন্য। সম্ভবত ওদের জন্য আরো একটা কাজ আমি করব। আশা করি এই আদান প্রদান বন্ধ হবে না। কারণ আমার মনে হয় একমাত্র এই পথেই আমরা একে অপরকে জানতে পারি, চিনতে পারি। আমাদের একের অপরের সম্বন্ধে অনেক অজ্ঞতা আছে। আমাদের মধ্যে অনেক ভুল বোঝাবুঝিও আছে। অথচ আমাদের কত মিল! কতকিছু রয়েছে যা আমরা সকলেই ভালবাসি। দেশের মাটির প্রতি আমাদের ভালবাসা একরকম, আমাদের খাদ্যাভ্যাস, আমাদের পোশাক আশাক — সবেতেই তো অনেক মিল। তফাতগুলো সত্ত্বেও এতগুলো মিল আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা তিনটে দেশের মানুষেরই মনুষ্যত্ব আছে। আমার মনে হয় না সেকথা যথেষ্ট জোর দিয়ে বলা হয়েছে, দেখানো হয়েছে। তাছাড়া আমার মনে হয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে উপমহাদেশের অন্য দুটো দেশে পাকিস্তানের সংস্কৃতি যথেষ্ট পরিমাণে পৌঁছয়নি। বিশেষ করে ভারতে। সেখানে তেমনভাবে পাকিস্তানের নাটক বা সিনেমা দেখা যায় না, পাকিস্তানের সঙ্গীত শোনা যায় না বা সেখানকার বই পড়া যায় না। বরং পাকিস্তানে ভারতের সাংস্কৃতিক কাজকর্ম অনেক সুলভ। তবে আমি আশাবাদী এবং মনে করি সবসময়ই ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব নেওয়া উচিৎ। তাই আমার ধারণা ভবিষ্যতে এই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

https://nagorik.net এ প্রকাশিত

Has the CPI(M) forgotten its strong federal roots?

Then state finance minister Ashok Mitra was his mainstay in this fight. It was as much a demand for more administrative rights as economic independence

Photos from internet

On May 30, the West Bengal state committee of the Communist Party of India (Marxist) came up with its assessment of the assembly election results, in which the party won no seats. The document explaining this disaster states that most of the 32 seats won by the Left Front in 2016 have gone to Trinamool Congress (TMC) – 23, to be precise.

At one point, the document says, in Bengali, “Because of the Bharatiya Janata Party’s (BJP’s) aggressive words, Trinamool’s election rigging, corruption, anarchy in every sector, absence of democracy etc. could not become electoral issues. People chose Trinamool Congress as the main opposition to the BJP. In addition, Trinamool was able to use the welfare schemes to garner support. There was extreme polarisation between Trinamool Congress and BJP. That is probably the main reason behind this result.”

This is as candid an admission of being wrong as you would get from the CPI(M). The West Bengal leadership has been maintaining since 2011 that the BJP and TMC are two sides of the same coin, so they have often dismissed governor Jagdeep Dhankhar’s attempts to overstep his jurisdiction and Mamata Banerjee’s sharp reaction to these moves as ‘drama’. This document shows that the CPI(M) is ready to rethink the political line that regards both TMC and BJP equally harmful. The fact that the welfare schemes CPI(M) leaders called “doles” during the election campaign have been marked as reasons for TMC’s popular support is a significant shift.

One may have expected this document to impact the party’s behaviour, but this doesn’t seem to be happening at the moment. Case in point is the ongoing battle between Banerjee’s and Narendra Modi’s governments.

Senior CPI(M) leader Sujan Chakraborty has termed the Centre’s decision to unilaterally transfer chief secretary Alapan Bandyopadhyay as “vindictive”, but added that the chief secretary’s role has been reduced to that of a “ghatak (matchmaker)” under the TMC government. Earlier in May, ministers of the state were arrested by the Central Bureau of Investigation (CBI) in a case where the chargesheet had already been submitted. CPI(M)’s Rajya Sabha MP Bikash Bhattacharya, a lawyer, wasted no time in saying the arrests were fair. The Calcutta high court’s subsequent interim bail order, however, made it clear that it is not as straightforward as Bhattacharya made it sound. Even the CPI(M)’s official stance differed from his, but he has neither been censured for his comments nor asked to explain them.

This proves there is still no consensus in the party ranks about the ways to deal with the TMC, and the CPI(M) does not regard the BJP’s repeated attempts to destabilise the West Bengal government as a threat to federalism but as a usual political tussle between TMC and BJP. During the election campaign, the Left-Congress-Indian Secular Front combine had talked about the need to break the TMC-BJP binary. It looks like the CPI(M) itself is still stuck in that binary, and does not recognise the greater issues at play. It would not be out of context to delve into history at this point.

The party at the Centre trying to destabilise an opposition party’s state government is not new. The first party at the receiving end was the undivided Communist Party of India (CPI). The Kerala government led by its legendary leader E.M.S. Namboodiripad was toppled in 1959, and finding out how many times Indira Gandhi’s government used Article 356 of the Constitution could exhaust a seasoned statistician. But the BJP’s consistency and determination in breaking the back of federalism is unparalleled.

What is happening in Bengal is basically the logical progression of what began with the dilution of Article 370 and bifurcation of Jammu and Kashmir. It continued with passing a law that makes the Arvind Kejriwal government subservient to the Lieutenant Governor. The arrests and the fight over the chief secretary are not attacks on the chief minister or the TMC. These are attacks on the rights of state governments and the political courtesies governing Centre-state relationship. This is about showing who’s boss.

This is exactly what the Jyoti Basu-led Left front government fought against in the 1980s. Basu maintained all along that the Centre was not in charge, and states should be on equal footing. His cry was not just for a bigger share of the Centre’s revenue; his was a principled stand for all states. Then state finance minister Ashok Mitra was his mainstay in this fight. It was as much a demand for more administrative rights as economic independence; that’s why they found other non-Congress chief ministers like Ramakrishna Hegde, M.G. Ramachandran, N.T. Rama Rao and Farooq Abdullah by their side. They held two meetings in 1983, in Srinagar and Kolkata, and a sub-committee was formed to draft a list of demands. Mitra led that sub-committee. Their commitment to the cause is best proved by the case of Jammu and Kashmir.

On July 2, 1984, governor Jagmohan dismissed the National Conference government led by Farooq. The then Karnataka chief minister, Hegde, chaired a meeting with non-Congress leaders at Karnataka Bhavan in New Delhi. The resolution release afterwards criticised the Centre for murdering democracy in Kashmir. A delegation reached Srinagar the next day to express solidarity with Abdullah and the people of J&K. Mitra recalls in his memoirs that Basu directed him to be present at the meeting in New Delhi and join the delegation to Srinagar. Delivering a speech to the public gathered in front of the National Conference office, he writes, was one of his fondest memories.

But senior CPI(M) leader Mohammad Salim, while speaking to this writer, confirmed that his party views the ongoing conflict purely as a partisan issue. “There’s no question of federalism here,” he declared. “This is just the governments using their agencies against each other. Only the leftists think about federalism. Our party has fought for it in the past, we wanted Sarkaria Commission’s recommendations implemented. Neither the TMC nor BJP has ever thought about federalism. The bickering over the Narada accused or the chief secretary is nothing but the failed state’s attempt to divert the headlines. Mamata has failed to provide relief to people after Cyclone Yaas, the Centre hasn’t done anything either. That’s why the chief secretary is being made an issue. Similarly, when people needed vaccines and they couldn’t provide it, they fought over the Narada-accused leaders.”

In reality, though, the fight for federalism was put on the back burner while the CPI(M) was still in power. Mitra writes in Apila Chapila (translation by the author), “After I left Writers’ Buildings [he resigned in 1987 for reasons not relevant to this article], I found the West Bengal government has suddenly become a good boy. There’s no overdraft, spending is well within the scope of earnings, so the budget is zero deficit. My unequivocal opinion is, this complete change of stance is highly incompatible with the state government’s approach. Fat overdraft indicated the states are struggling because of the one-sided relationship with the Centre. Doing away with it means announcing to the world that all problems have been solved, there’s no financial constraint. Now we can sleep peacefully.”

Mitra wrote this in the early 2000s. The Goods and Services Tax (GST) was not yet in existence. There is hardly any dispute today that the GST has further tilted the scales in favour of the Central government. And the chairman of the GST council that is credited with planning everything was Asim Dasgupta, Mitra’s successor in Basu’s cabinet. He resigned from the council in 2011, but by his own admission, 80% of the job had already been done. Dasgupta’s contribution was even acknowledged by then Union finance minister Arun Jaitley when the GST was launched in 2017.

The decay of the Left as an opposition has had huge implications for West Bengal, and the job of turning this seems to be getting harder by the day. A strong right-wing party has now become the only opposition in a state famous for its secular, socialist ethos. The CPI(M), still the biggest leftist party in terms of number of members, has no time to waste if they are to stay relevant. State Congress president Adhir Ranjan Chowdhury has already said he does not want to put up a candidate against Mamata Banerjee in the by-election at Bhowanipore. If Chowdhury’s party agrees with his proposal, it may mean curtains on the Left-Congress combine. In that case, comrades have a long fight ahead. What are they doing to ensure it is not a lonely one?

The state committee’s statement mentioned at the beginning of this article had said, “To turn this primary review into a comprehensive one, discussions will have to be held and opinions sought at the booth and branch level.” At the moment, the CP(M) is distributing a questionnaire among its workers and supporters via the district committees to do that. It has two sets of questions, under the heads ‘political’ and ‘organisational’. The first three questions in the first set are all about the party’s policy regarding the TMC:

  1. Is it really true that there was strong anti-incumbency against the TMC before the elections? Did we overestimate that sentiment? Did we underestimate Trinamool Congress?
  2. Did people reject our campaign about the understanding between the TMC and BJP? Which party was our main target across the election campaign? TMC or BJP? Or did we maintain equidistance?
  3. How have the welfare schemes and subsidies from the TMC government impacted the recipients? Have we assessed that?

The answers, and whether the leadership is willing to make changes according to them, could hold the key to the CPI(M)’s future in West Bengal.

A section of the party, however, feels where they stand vis-à-vis Banerjee or the BJP is irrelevant. What matters is whether they can still identify with the poor and have the stomach to fight for issues that affect them. This view is best articulated in an article written in Bengali by young trade union leader and Darjeeling district committee member Sudip Dutta, for party mouthpiece Ganashakti: “We have to go to the rural and urban poor, and get the strength for class struggle from them. The most promising strategy for modern revolution is hidden amongst this socio-economic populace divided into innumerable groups.”

Originally published here

https://thewire.in/politics/west-bengal-cpim-tmc-federalism

কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত: পুরনো পড়া ভুলে গেছেন কমরেডরা?

তরুণরা না জানলেও মাঝবয়সী বা প্রবীণদের নিশ্চয়ই মনে আছে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত ব্যাপারটা একেবারেই নতুন নয়।

“কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত বলতে তোর কী মনে পড়ে, তোপসে?”

“মোদী বনাম মমতা।”

জয়বাবা ফেলুনাথ ছবির সংলাপ অদল বদল করে নিয়ে আজকাল সোশাল মিডিয়ায় অনেক মিম ঘুরে বেড়ায়। এরকম একটা মিম তৈরি হওয়াও আশ্চর্য নয়। তবে তরুণরা না জানলেও মাঝবয়সী বা প্রবীণদের নিশ্চয়ই মনে আছে কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত ব্যাপারটা একেবারেই নতুন নয়। সাংবিধানিকভাবেই রাজ্য সরকারগুলোকে কেন্দ্রীয় সরকারের তুলনায় পিগমি করে রাখা হয়েছে এবং এই সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস দরকার — এই দাবিতে সবচেয়ে সরব ছিলেন যে মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর নাম জ্যোতি বসু। বস্তুত, আশির দশকে অকংগ্রেসি রাজ্যগুলোর কেন্দ্রের বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিত বামফ্রন্ট সরকার। ১৯৭৭-এ তৈরি হওয়া বামফ্রন্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র তাঁর আপিলা-চাপিলা গ্রন্থে সেকথা সবিস্তারে লিখেছেন। আজকের বাংলা সংবাদমাধ্যম এই সংঘাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল, কিন্তু সেদিনের সরকারকে বিস্তর টিটকিরি সহ্য করতে হয়েছিল। বলা হত, কেন্দ্রের টাকা না পাওয়া নিয়ে কাঁদুনি গেয়ে সরকার নিজের দায়িত্ব এড়াচ্ছে।

ব্যাপারটা যে তা ছিল না, বরং সমস্ত রাজ্যের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অধিকার বাড়ানোর জন্য অতি প্রয়োজনীয় লড়াই ছিল, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, ১৯৮৩ সালে শ্রীনগরে রাজ্যগুলোর দাবি জোরদার করতে ফারুক আবদুল্লার ডাকা সম্মেলনে খসড়া দাবি সনদ তৈরি করার জন্য গঠিত উপসমিতির সঞ্চালক হিসাবে অশোকবাবুর উপস্থিতি। ঐ বছরই ডিসেম্বরে কলকাতায় জ্যোতিবাবুর আমন্ত্রণে ঐ মর্মে আরো একটি বৈঠক হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে যখন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল ন্যাশনাল কনফারেন্স সরকারকে পদচ্যুত করেন, তখন জ্যোতিবাবুর নির্দেশে অশোকবাবু দিল্লী গিয়ে কংগ্রেস বিরোধীদের সভায় যোগ দেন এবং পরদিন শ্রীনগরে রাজ্যপালের সাথে দেখা করে প্রতিবাদ করেন; কাশ্মীরের মানুষের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করে ন্যাশনাল কনফারেন্সের সদর দপ্তরের ব্যালকনি থেকে জড়ো হওয়া জনতার উদ্দেশে ভাষণও দেন।

১৯৮৩-তে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়নের জন্য গঠিত সারকারিয়া কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করতে হবে — এ ছিল সেইসময় জ্যোতিবাবু, অশোকবাবুদের জোরালো দাবি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তা মানেনি। মানলে মমতা দেবীর জগদীপ ধনখড়কে সহ্য করতে হত না। তার চেয়েও বড় কথা, জম্মু ও কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দেওয়া; দিল্লীর রাজ্য সরকারকে আইন বদলে ফেলে ঠুঁটো জগন্নাথ করে দেওয়া এবং মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার, মুখ্যসচিবকে নিয়ে টানাটানি করে পশ্চিমবঙ্গে অস্থিরতা তৈরি করা — যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর এই ধারাবাহিক আঘাত হানা বিজেপির পক্ষে শক্ত হত।

আরও পড়ুন Has the CPI(M) forgotten its strong federal roots?

দুর্ভাগ্যজনক যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্যে পূর্বসুরীদের এই লড়াইয়ের ইতিহাস সিপিএমের বর্তমান নেতৃত্বের মনে আছে, এমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল সম্বন্ধে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির মতামত প্রকাশিত হয়েছে। বলা হয়েছে “তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে তীব্র মেরুকরণ হয়ে যায়। নির্বাচনী ফলাফলের এটিই সম্ভবত মূল কারণ।” নির্বাচনের প্রচারেও সিপিএমের (বা সংযুক্ত মোর্চার) পক্ষ থেকে এই বাইনারি ভাঙতে চাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। গত এক মাসের ঘটনাবলীকে সিপিএম নিজেই কিন্তু ওই বাইনারির ঊর্ধ্বে উঠে দেখতে পারছে না। ভোট পরবর্তী এই লড়াই যে কেবল বিজেপি বনাম তৃণমূল নয়, বরং কেন্দ্রীয় সরকার বনাম রাজ্য সরকার — তা তারা এখনো বুঝছে না। মন্ত্রীদের গ্রেপ্তারিকে সিপিএমের আইনজীবী নেতা বিকাশ ভট্টাচার্য চটজলদি সমর্থন করেছিলেন। পার্টির মতামত তাঁর সঙ্গে মেলেনি, কিন্তু সে জন্যে বিকাশবাবুকে তিরস্কার করা হয়েছে বলেও খবর নেই। মুখ্যসচিবের ঘটনায় সুজন চক্রবর্তী যদিও বলেছেন এটা কেন্দ্রের প্রতিহিংসামূলক আচরণ, সাথে জুড়ে দিয়েছেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজের সমালোচনা।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিধানসভা, লোকসভায় অনুপস্থিত দলের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো-টাঠামো নিয়ে ভেবে লাভ কী? উত্তর হল, বাইনারি ভেঙে যে বিরোধী পরিসর পুনরায় দখল করা এখন সিপিএমের লক্ষ্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে গেলে সেই পরিসরই আর থাকবে না। কারণ কেন্দ্রের হাতে সমস্ত ক্ষমতা চলে যাওয়া একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার ঠিক আগের ধাপ।

উত্তরবঙ্গ সংবাদে প্রকাশিত

%d bloggers like this: