একজিট পোল: অঙ্কে কাঁচার সমীক্ষা

ভোটদান হয়ে যাওয়া মাত্রই সমীক্ষক, সাংবাদিক তো বটেই; এমনকি ভোটারদেরও বোধহয় আর ইস্যু নিয়ে আগ্রহ থাকে না। সংখ্যাই তখন শেষ কথা।

অঙ্কে ভাল হতে না পারলে জীবন বৃথা — কথাটা বাবা বলতেন। অঙ্কের থেকে পালিয়ে বেড়িয়ে, কোনমতে মাধ্যমিক পাস করার পরে আর অঙ্কের ছায়া না মাড়িয়ে দিব্যি চাকরি বাকরি পেয়ে গিয়ে বাবার দিকে সগর্বে তাকাতাম, ভাবখানা “হুঁ হুঁ, কেমন দিলাম?” বাবা বুঝতেন কিন্তু কিছু বলতেন না। এখন জীবিত থাকলে নির্ঘাত পাল্টা বলতেন “কেমন দিলাম?” বুথফেরত সমীক্ষা বা এক্সিট পোলের ফলাফল এসে পড়েছে। সেগুলোতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হৈ হৈ করে প্রত্যাবর্তন[১] (পি মার্কসের সমীক্ষা) থেকে শুরু করে বিজেপির নিরঙ্কুশ পরিবর্তন[২] (ইন্ডিয়া টিভি-পিপলস পালসের সমীক্ষা) পর্যন্ত সবকটা সম্ভাবনাই দেখা গেছে। যেন এক্সিট পোলের ঈশ্বর রাবীন্দ্রিক দাড়িওয়ালা রবি শাস্ত্রী। বলছেন “মিত্রোঁ, অল থ্রি রেজাল্টস পসিবল।” একই নির্বাচনের এক্সিট পোলের ফলাফল কেন এমন আকাশ পাতাল হয় তা নিয়ে মাথা চুলকানো ছাড়া আর উপায় নেই। কারণ খেলা যখন ছিল অঙ্কের সনে, তখন লুকোচুরি খেলেছি। যা নয়ে হয় না, তা কি আর নব্বইতে হয়?

একা এক্সিট পোলে রক্ষে নেই, অতিমারী দোসর। টিভির পর্দা জুড়ে সম্ভাব্য আসন সংখ্যা, ভোট শতাংশ — এসবের সাথেই নেচে বেড়াচ্ছে করোনায় আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা। কাল তিন লাখ আক্রান্ত হলে আজ চার লাখ, কাল আড়াই হাজার মানুষ মরে থাকলে আজ সাড়ে তিন হাজার। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে খবর নয়, লোটোর ফলাফল দেখছি। যাদের সংখ্যা মিলে যাচ্ছে তারা হয়ত আনন্দে আত্মহারা। যাদের মিলছে না তারা হয়ত কলসী দড়ি খুঁজছে। বা হয়ত দু পক্ষই কলসী দড়ি খুঁজে রাখছে, কারণ চাইলেই তো নিজের পছন্দসই একখানা সমীক্ষার ফল হাতের কাছে পাওয়া যায়। অপছন্দের ফলের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলে ভোরবেলা গঙ্গার পাড়ে প্রাতঃকৃত্য করতে বসা লোকেদের মত নিজের চোখ ঢেকে ফেললেই আরো দুটো দিন নিজস্ব বুদ্বুদে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। সে বুদ্বুদ সময় হলে আপনি ফাটবে, আঙুল দিয়ে ফাটানোর প্রয়োজন হবে না। তৃণমূল, বিজেপির বাইরে বাম, কংগ্রেস বা আই এস এফের সমর্থকদেরও উৎকণ্ঠ হয়ে থাকার কারণ আছে। তাঁদেরও শূন্য (ইন্ডিয়া টুডে-অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়ার সমীক্ষা) থেকে ২৫ (এবিপি-সি ভোটারের সমীক্ষা) পর্যন্ত সবরকম সম্ভাবনা দেখানো হয়েছে।

এমন বহু বাসনায় প্রাণপণে চাইতে চাইতে মনে হয় আমরা সকলেই সংখ্যা হয়ে গেছি। ৪৭ফ, ৬৯ঙ ইত্যাদি। নইলে আমার মত অঙ্কে কাঁচা লোকের সাথে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোন তফাতই থাকে না! তাঁরাও অঙ্কের সাথে লুকোচুরি খেলেন! টিভি ক্যামেরা দেখাচ্ছে, মানুষ নিজে টুইট করছে, ফেসবুকে পোস্ট করছে অক্সিজেনের অভাবের কথা, হাসপাতালে শয্যার অপ্রতুলতার কথা। অথচ ঐ মহামান্য জনসেবকরা সগর্বে বলে চলেছেন কোথাও কোন অভাব নেই। ফুটপাথে সার বেঁধে মড়া পোড়ানোর দৃশ্য সবাই দেখতে পাচ্ছে, অথচ তাঁদের খাতায় মৃতের সংখ্যা দুই অঙ্কে পৌঁছাতেই চাইছে না। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর আরো সোজাসাপ্টা লোক। তিনি বলে দিয়েছেন চেঁচামেচি করলে মৃতেরা ফিরে আসবে না। অতএব সংখ্যা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। অনেকের অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গেও নাকি সংখ্যা কমিয়ে বলা চলছে, তবে ওসব বলতে নেই। বিজেপি এসে যাবে। তাই আমিও বলছি না।

এখন কথা হচ্ছে সংখ্যা কি কথা বলে? আমাদের কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে? কোভিড জনিত সংখ্যার ভাষা তো মন্ত্রীসান্ত্রীরা বুঝছেন না দেখাই যাচ্ছে। আমরা কি বুঝছি? বুথফেরত সমীক্ষা থেকে তার কোন আঁচ পেলাম না। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের শেষ তিন দফা ভোটের সময় দেশের কোভিড পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হয়েছে, রাজ্যেরও। উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, হরিয়ানার পথে এবং পার্কে মড়া পোড়ানোর ছবি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তা সত্ত্বেও কি সোনার বাংলার প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করলাম আমরা? সমীক্ষায় তার কোন উত্তর পেলাম না। অবশ্য প্রশ্নটা করা হয়েছিল কিনা তা জানি না। দেড় বছর ধরে যে অতিমারী চলছে, তার মোকাবিলায় রাজ্যের তৃণমূল সরকার আর কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মধ্যে কোন তফাত দেখলেন কি ভোটাররা? তারও উত্তর রবিবার নির্বাচনের ফলে থাকবে হয়ত। নাকি থাকবে না? সিপিএমের কমিউনিটি ক্যান্টিন কি ভোটারদের প্রভাবিত করেছে? নাকি বিপদের সময়ে ত্রাণমূলক কাজ করার সঙ্গে সরকার চালানোর যোগ্যতার কোন সম্পর্ক নেই — এমনটাই ভোটারদের রায়? সে প্রশ্নের জবাবও খুঁজছিলাম। টিভিতে জনমত সমীক্ষা দেখানোর সময় যেভাবে ইস্যুভিত্তিক মত দেখানো হত, বুথফেরত সমীক্ষায় তেমন দেখলাম না। ফলে এ প্রশ্নের উত্তরও পেলাম না।

আসলে ভোটদান হয়ে যাওয়া মাত্রই সমীক্ষক, সাংবাদিক তো বটেই; এমনকি ভোটারদেরও বোধহয় আর ইস্যু নিয়ে আগ্রহ থাকে না। সংখ্যাই তখন শেষ কথা। খুব সম্ভবত ভোটের ফল বেরোবার সময়েও একই ঘটনা ঘটবে। “খেলা হবে” না “সোনার বাংলা” — কোন স্লোগান জিতল তা নিয়েই সরগরম থাকবে টিভি স্টুডিও। আমরাও বাহারী গ্রাফিক্স দেখে বোঝার চেষ্টা করব কোন এলাকা সবুজ ছিল, গেরুয়া হল; কোথায় গেরুয়া হয়ে গেল সবুজ। কারণ খোঁজার পরিশ্রম কে আর করতে চায়? শীতলকুচির আগে পরে ভোটদানে কোন পরিবর্তন লক্ষ করা গেল কিনা এ নিয়ে কোন আলোচনা হবে কি? একসময় হত। আজকাল এসব দুরাশা মনে হয়, কারণ যুগ বদলে গেছে, রোজ আরো বদলাচ্ছে। কদিন আগে অব্দিও জানতাম দলবদল হয় ভোটের পর। উত্তর-পূর্ব ভারতে হয়েছে, কর্ণাটকে হয়েছে, মধ্যপ্রদেশে হয়েছে, মহারাষ্ট্রে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে দেখা গেল ভোটের আগেই দলবদল। পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের চেয়ে প্রচারে অনেক বেশি আলোচিত হল দলবদল। বুথফেরত সমীক্ষা নিয়ে আলোচনাতেও একটি চ্যানেলে বিজেপির মুখপাত্র একটুও লজ্জা না পেয়ে বলে দিলেন, মুখ্যমন্ত্রী তো নিজেই বলেছেন ওঁরা দুশো আসন না পেলে গদ্দাররা চলে যাবে। সুতরাং ফল যা-ই হোক, সরকার তো আমাদেরই হবে। আশঙ্কা হয়, ফল প্রকাশের দিনও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে কে কে দল বদল করছেন। করলে বিধানসভার চেহারাটা কেমন হবে? মুহুর্মুহু রং বদলানো একটা গ্রাফিক হয়ত অনবরত আসবে আমাদের টিভির পর্দায়। জয়ী দলের মুখপাত্র গেয়ে উঠতেও পারেন “যদি আমাকে অসৎ বলো, আমি বলব অঙ্কে কাঁচা।”

তথ্যসূত্র:
[১]। https://www.anandabazar.com/elections/west-bengal-assembly-election/west-bengal-exit-poll-result-2021-tmc-may-win-this-election-with-a-tough-fight-with-bjp-maximum-exit-poll-shows-dgtl/cid/1278553

[২]। https://www.indiatvnews.com/elections/news-west-bengal-election-exit-poll-2021-with-india-tv-tmc-mamata-banerjee-bjp-congress-left-live-updates-701359

https://guruchandali.com/ এ প্রকাশিত