ভোটদান হয়ে যাওয়া মাত্রই সমীক্ষক, সাংবাদিক তো বটেই; এমনকি ভোটারদেরও বোধহয় আর ইস্যু নিয়ে আগ্রহ থাকে না। সংখ্যাই তখন শেষ কথা।
অঙ্কে ভাল হতে না পারলে জীবন বৃথা — কথাটা বাবা বলতেন। অঙ্কের থেকে পালিয়ে বেড়িয়ে, কোনমতে মাধ্যমিক পাস করার পরে আর অঙ্কের ছায়া না মাড়িয়ে দিব্যি চাকরি বাকরি পেয়ে গিয়ে বাবার দিকে সগর্বে তাকাতাম, ভাবখানা “হুঁ হুঁ, কেমন দিলাম?” বাবা বুঝতেন কিন্তু কিছু বলতেন না। এখন জীবিত থাকলে নির্ঘাত পাল্টা বলতেন “কেমন দিলাম?” বুথফেরত সমীক্ষা বা এক্সিট পোলের ফলাফল এসে পড়েছে। সেগুলোতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হৈ হৈ করে প্রত্যাবর্তন[১] (পি মার্কসের সমীক্ষা) থেকে শুরু করে বিজেপির নিরঙ্কুশ পরিবর্তন[২] (ইন্ডিয়া টিভি-পিপলস পালসের সমীক্ষা) পর্যন্ত সবকটা সম্ভাবনাই দেখা গেছে। যেন এক্সিট পোলের ঈশ্বর রাবীন্দ্রিক দাড়িওয়ালা রবি শাস্ত্রী। বলছেন “মিত্রোঁ, অল থ্রি রেজাল্টস পসিবল।” একই নির্বাচনের এক্সিট পোলের ফলাফল কেন এমন আকাশ পাতাল হয় তা নিয়ে মাথা চুলকানো ছাড়া আর উপায় নেই। কারণ খেলা যখন ছিল অঙ্কের সনে, তখন লুকোচুরি খেলেছি। যা নয়ে হয় না, তা কি আর নব্বইতে হয়?
একা এক্সিট পোলে রক্ষে নেই, অতিমারী দোসর। টিভির পর্দা জুড়ে সম্ভাব্য আসন সংখ্যা, ভোট শতাংশ — এসবের সাথেই নেচে বেড়াচ্ছে করোনায় আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা। কাল তিন লাখ আক্রান্ত হলে আজ চার লাখ, কাল আড়াই হাজার মানুষ মরে থাকলে আজ সাড়ে তিন হাজার। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে খবর নয়, লোটোর ফলাফল দেখছি। যাদের সংখ্যা মিলে যাচ্ছে তারা হয়ত আনন্দে আত্মহারা। যাদের মিলছে না তারা হয়ত কলসী দড়ি খুঁজছে। বা হয়ত দু পক্ষই কলসী দড়ি খুঁজে রাখছে, কারণ চাইলেই তো নিজের পছন্দসই একখানা সমীক্ষার ফল হাতের কাছে পাওয়া যায়। অপছন্দের ফলের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলে ভোরবেলা গঙ্গার পাড়ে প্রাতঃকৃত্য করতে বসা লোকেদের মত নিজের চোখ ঢেকে ফেললেই আরো দুটো দিন নিজস্ব বুদ্বুদে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। সে বুদ্বুদ সময় হলে আপনি ফাটবে, আঙুল দিয়ে ফাটানোর প্রয়োজন হবে না। তৃণমূল, বিজেপির বাইরে বাম, কংগ্রেস বা আই এস এফের সমর্থকদেরও উৎকণ্ঠ হয়ে থাকার কারণ আছে। তাঁদেরও শূন্য (ইন্ডিয়া টুডে-অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়ার সমীক্ষা) থেকে ২৫ (এবিপি-সি ভোটারের সমীক্ষা) পর্যন্ত সবরকম সম্ভাবনা দেখানো হয়েছে।
এমন বহু বাসনায় প্রাণপণে চাইতে চাইতে মনে হয় আমরা সকলেই সংখ্যা হয়ে গেছি। ৪৭ফ, ৬৯ঙ ইত্যাদি। নইলে আমার মত অঙ্কে কাঁচা লোকের সাথে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোন তফাতই থাকে না! তাঁরাও অঙ্কের সাথে লুকোচুরি খেলেন! টিভি ক্যামেরা দেখাচ্ছে, মানুষ নিজে টুইট করছে, ফেসবুকে পোস্ট করছে অক্সিজেনের অভাবের কথা, হাসপাতালে শয্যার অপ্রতুলতার কথা। অথচ ঐ মহামান্য জনসেবকরা সগর্বে বলে চলেছেন কোথাও কোন অভাব নেই। ফুটপাথে সার বেঁধে মড়া পোড়ানোর দৃশ্য সবাই দেখতে পাচ্ছে, অথচ তাঁদের খাতায় মৃতের সংখ্যা দুই অঙ্কে পৌঁছাতেই চাইছে না। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর আরো সোজাসাপ্টা লোক। তিনি বলে দিয়েছেন চেঁচামেচি করলে মৃতেরা ফিরে আসবে না। অতএব সংখ্যা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। অনেকের অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গেও নাকি সংখ্যা কমিয়ে বলা চলছে, তবে ওসব বলতে নেই। বিজেপি এসে যাবে। তাই আমিও বলছি না।
এখন কথা হচ্ছে সংখ্যা কি কথা বলে? আমাদের কী কথা তাহার সাথে, তার সাথে? কোভিড জনিত সংখ্যার ভাষা তো মন্ত্রীসান্ত্রীরা বুঝছেন না দেখাই যাচ্ছে। আমরা কি বুঝছি? বুথফেরত সমীক্ষা থেকে তার কোন আঁচ পেলাম না। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের শেষ তিন দফা ভোটের সময় দেশের কোভিড পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হয়েছে, রাজ্যেরও। উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, হরিয়ানার পথে এবং পার্কে মড়া পোড়ানোর ছবি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তা সত্ত্বেও কি সোনার বাংলার প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করলাম আমরা? সমীক্ষায় তার কোন উত্তর পেলাম না। অবশ্য প্রশ্নটা করা হয়েছিল কিনা তা জানি না। দেড় বছর ধরে যে অতিমারী চলছে, তার মোকাবিলায় রাজ্যের তৃণমূল সরকার আর কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের মধ্যে কোন তফাত দেখলেন কি ভোটাররা? তারও উত্তর রবিবার নির্বাচনের ফলে থাকবে হয়ত। নাকি থাকবে না? সিপিএমের কমিউনিটি ক্যান্টিন কি ভোটারদের প্রভাবিত করেছে? নাকি বিপদের সময়ে ত্রাণমূলক কাজ করার সঙ্গে সরকার চালানোর যোগ্যতার কোন সম্পর্ক নেই — এমনটাই ভোটারদের রায়? সে প্রশ্নের জবাবও খুঁজছিলাম। টিভিতে জনমত সমীক্ষা দেখানোর সময় যেভাবে ইস্যুভিত্তিক মত দেখানো হত, বুথফেরত সমীক্ষায় তেমন দেখলাম না। ফলে এ প্রশ্নের উত্তরও পেলাম না।
আসলে ভোটদান হয়ে যাওয়া মাত্রই সমীক্ষক, সাংবাদিক তো বটেই; এমনকি ভোটারদেরও বোধহয় আর ইস্যু নিয়ে আগ্রহ থাকে না। সংখ্যাই তখন শেষ কথা। খুব সম্ভবত ভোটের ফল বেরোবার সময়েও একই ঘটনা ঘটবে। “খেলা হবে” না “সোনার বাংলা” — কোন স্লোগান জিতল তা নিয়েই সরগরম থাকবে টিভি স্টুডিও। আমরাও বাহারী গ্রাফিক্স দেখে বোঝার চেষ্টা করব কোন এলাকা সবুজ ছিল, গেরুয়া হল; কোথায় গেরুয়া হয়ে গেল সবুজ। কারণ খোঁজার পরিশ্রম কে আর করতে চায়? শীতলকুচির আগে পরে ভোটদানে কোন পরিবর্তন লক্ষ করা গেল কিনা এ নিয়ে কোন আলোচনা হবে কি? একসময় হত। আজকাল এসব দুরাশা মনে হয়, কারণ যুগ বদলে গেছে, রোজ আরো বদলাচ্ছে। কদিন আগে অব্দিও জানতাম দলবদল হয় ভোটের পর। উত্তর-পূর্ব ভারতে হয়েছে, কর্ণাটকে হয়েছে, মধ্যপ্রদেশে হয়েছে, মহারাষ্ট্রে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে দেখা গেল ভোটের আগেই দলবদল। পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের চেয়ে প্রচারে অনেক বেশি আলোচিত হল দলবদল। বুথফেরত সমীক্ষা নিয়ে আলোচনাতেও একটি চ্যানেলে বিজেপির মুখপাত্র একটুও লজ্জা না পেয়ে বলে দিলেন, মুখ্যমন্ত্রী তো নিজেই বলেছেন ওঁরা দুশো আসন না পেলে গদ্দাররা চলে যাবে। সুতরাং ফল যা-ই হোক, সরকার তো আমাদেরই হবে। আশঙ্কা হয়, ফল প্রকাশের দিনও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হবে কে কে দল বদল করছেন। করলে বিধানসভার চেহারাটা কেমন হবে? মুহুর্মুহু রং বদলানো একটা গ্রাফিক হয়ত অনবরত আসবে আমাদের টিভির পর্দায়। জয়ী দলের মুখপাত্র গেয়ে উঠতেও পারেন “যদি আমাকে অসৎ বলো, আমি বলব অঙ্কে কাঁচা।”
আসলে আমাদের বিয়ের দিন যেমন ঠাকুর্দার ছবি বার করা হয়, কারণ আমাদের একটা বংশপরিচয় আছে, সত্যজিতের পথের পাঁচালী বা অপরাজিত সেই ধরনের ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাঙালি আজকাল সেইসব ছবিই দেখে যেখানে সত্যজিৎ রায় ঈশপের মত নীতিবাক্য প্রচার করেন, নাগরিককে বললেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে শতবর্ষ পার হওয়া সত্যজিৎ রায়ের ছবি নিয়ে কথা বলার জন্য সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের চেয়ে যোগ্যতর লোক পাওয়া দুষ্কর। তা বলে তাঁর সাথে কথা বলতে বসে সিনেমার গণ্ডিতে আটকে থাকলে ভুল হয়। তিনি আসলে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ও বিনাশের একজন একনিষ্ঠ পাঠক। তাই তাঁর সত্যজিৎ আলোচনা কেবল সেলুলয়েডে আটকে থাকে না। নাগরিক ডট নেটের পক্ষ থেকে কিছু প্রশ্ন পেশ করে আলোচনা উপভোগ করলেন প্রতীক।
সঞ্জয়দা, আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস আর বিজ্ঞান প্রায় সম্মুখসমরে। সেই প্রেক্ষিতে সত্যজিতের বিজ্ঞানমনস্কতাকে আপনি কীভাবে দেখেন? মানে দেবী, মহাপুরুষ বা গণশত্রু ছবিতে দেখি ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর স্পষ্ট অবস্থান। আবার তাঁর গল্পগুলোতে, এমনকি প্রফেসর শঙ্কুর মত কল্পবিজ্ঞানের গল্পেও, অনেক অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। সেগুলোকে কিন্তু সবসময় অসম্ভব বা বুজরুকি হিসাবে দেখানো হয়নি।
এই প্রশ্নটার উত্তরে প্রথমেই বলব, সত্যজিৎ রায় নিজে রসিকতা করে বলতেন যে তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু ভূতে বিশ্বাস করেন। যে ধরনের অলৌকিকতা বা ব্যাখ্যার অতীত কিছু ঘটনা তিনি দেখেছেন, সেগুলো সাধারণ সংস্কারের মত তাঁর মধ্যে কাজ করেছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সত্যজিৎ রায় একজন যুক্তিবাদী। ব্যাপারটা অপরাজিত ছবিতে প্রথম দেখা যায়। অপু স্কুলে গিয়ে প্রথম দেশ শব্দটার মানে জানল। তারপর ইন্সপেক্টর তার প্রশংসা করে গেলেন, হেডমাস্টার তাকে লিভিংস্টোনের ভ্রমণ বৃত্তান্ত দিলেন, বাইরের বই পড়ার উৎসাহ দিলেন। এরপর সে বাড়িতে সাইফনের পরীক্ষা করছে, গ্রহণ যে রাহু কেতুর ব্যাপার নয়, চন্দ্র সূর্যের বিশেষ অবস্থানের ফলে হয় — সেটা মাকে বোঝাচ্ছে। অপু প্রথম ভাষার রহস্য (মেটাফর, মেটোনিমি ইত্যাদি) জানছে, ল্যাবরেটরি দেখছে। অর্থাৎ সত্যজিতের স্বাধীনোত্তর দেশে আদর্শ নাগরিক গড়ে তোলার যে অভিপ্রায়, তার মধ্যে সবসময়েই থাকছে ধর্মমুক্ত যুক্তিবাদের উন্মোচন, যার উৎস আমরা ইউরোপের রেনেসাঁয় পাই। আমাদের দেশে এই যুক্তিবাদের আগমন উনিশ শতকে। সত্যজিৎ এমন একটা পরিবারের সদস্য ছিলেন, যেখানে আমরা উনিশ শতক বলতে যা বোঝাই তার সমস্তটাই ছিল। কেবল উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার এবং সত্যজিৎ নয়, মনে রাখতে হবে কলকাতার বাইরে যে ক্রিকেট খেলা হত ময়মনসিংহে, তারও উদ্গাতা ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরেরই এক ভাই সারদারঞ্জন রায়। ফলে ইউরোপিয় আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যগুলো প্রথম যুগের সত্যজিতের মধ্যে খুবই সক্রিয়।
দেবী ছবিতে শুধু যে অন্ধ কুসংস্কার কোন অভিশাপের জন্ম দিতে পারে, কীভাবে এক ধরনের ফিমেল হিস্টিরিয়ার উৎপত্তি হতে পারে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত করেছেন শুধু তা-ই নয়, ভারতীয় সম্পর্কের বিন্যাস দেখানোর ক্ষেত্রেও তিনি প্রায় বিপ্লবী। শ্বশুরমশাইয়ের পায়ে দয়াময়ী তেল মাখিয়ে দেওয়ার পরে, ফ্রয়েডিয় প্রতিস্থাপনের তত্ত্ব মেনেই সত্যজিৎ দেখান যে সেই রাত্তিরেই শ্বশুরের স্বপ্নে মা কালী দেখা দেন। আসলে পুত্রবধূর শরীর স্পর্শে যদি কোন সুখানুভূতি হয়, তা আমাদের সচেতন নীতিবোধকে আঘাত করে। তার প্রতিক্রিয়াতেই কালী দর্শন। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বুঝতে পারি না, যে গণশত্রু, হীরক রাজার দেশে বা মহাপুরুষ ছবিতে, তিনি যে কেবল আচারগুলোর মধ্যেকার সংস্কারান্ধতাকে আক্রমণ করছেন, তা নয়। ধর্ম আরো বড় জিনিস। বিশেষত ভারতবর্ষে ধর্ম, অন্তত হিন্দুধর্ম, একটা সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা। এটা কোন বাঁধাধরা ধর্ম নয় এবং সেই কারণেই সেখান থেকে বিপদের সম্ভাবনাও বেশি। সত্যজিৎ সারাজীবনই এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর প্রগতি চিন্তায় কোন খাদ ছিল না।
আসলে আমার মনে হয় সমস্যার জায়গাটা হল আমাদের উনিশ শতকীয় প্রগতি চিন্তা। তাকে নবজাগরণ বা অন্য যে নামেই ডাকুন, তার মধ্যে এক ধরনের দ্বৈততা (ambiguity) ছিল। আমরা যেমনভাবে বাইরের জগতের প্রগতির কথা ভেবেছিলাম, তেমনভাবে অন্তর্জগতের প্রগতির কথা ভাবিনি। এটা ঠাকুর পরিবারের ক্ষেত্রেও সত্য, কেশবচন্দ্র সেনের পরিবারের ক্ষেত্রে সত্য, এমনকি বিদ্যাসাগরের পরিবারের ক্ষেত্রেও সত্য। আমাদের পরিবারের নারী সদস্যদের উন্নতি এবং পুরুষ সদস্যদের মানসিকতার মধ্যে বিরাট পার্থক্য থেকে গেছে। এই স্ববিরোধটা আমার মনে হয় উনিশ শতকের ঐতিহ্য যাঁরা বহন করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যেই আছে। সত্যজিৎ রায়ও সেই সমস্যা থেকে মুক্ত নন।
আপনি বললেন সত্যজিতের মধ্যে উনিশ শতকের মনীষা ছিল। তা ইদানীং অনেকেই যে বলছেন সেই সময়ের সমস্ত অর্জন আমরা বাঙালিরা হারিয়ে ফেলছি, তাহলে ঐ মনীষার অংশ হিসাবে সত্যজিতের ছবিও কি অদূর ভবিষ্যতে বাঙালির কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
আপনি তো ভিমরুলের চাকে ঢিল মারলেন। দেখুন, বাঙালিরা অনেক বানানো সত্যের মধ্যে বাস করে। চলচ্চিত্র আমার ভাত কাপড়ের জোগান দেয় বলেই আমি জানি যে সত্যজিৎ রায়ের ছবি সত্যি সত্যি কতটা দেখা হয় আজকাল। সত্যজিৎ রায়ের ছবি বলতে আজকের বাঙালি মধ্যবিত্ত, মানে আমার আপনার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কোন ছবিগুলো বোঝে? শেষ তিনটে ছবি — গণশত্রু, শাখা প্রশাখা, আগন্তুক; ফেলুদার ছবিগুলো — সোনার কেল্লা, জয়বাবা ফেলুনাথ এবং একটা ছোটদের জন্য ছবি — গুপী গাইন বাঘা বাইন। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের যে ঐতিহাসিক পর্ব, যখন তাঁর শিল্প শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছে, অর্থাৎ ১৯৫৫ সালের পথের পাঁচালী থেকে ১৯৬৪ সালের চারুলতা পর্যন্ত, সেই ছবিগুলো কজন দ্যাখে? এমনকি তাঁর যে বিখ্যাত শহর ত্রয়ী — জনঅরণ্য, সীমাবদ্ধ, প্রতিদ্বন্দ্বী — যেখানে অপূর্ব কুমার রায়ের মধ্যে দিয়ে উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে নাগরিকের যে পুনর্নির্মাণ সত্যজিৎ রায় করেছিলেন, সেই ধারণাকে তিনি নিজেই প্রশ্ন করেছেন, সেই ছবিগুলোই বা কতটা দেখা হয়?
অপরাজিত ছবির অপু গ্লোব হাতে কলকাতা শহরে পা দিয়েছিল এবং হ্যারিসন রোডের দিকে তাকিয়েছিল। আর প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির সিদ্ধার্থ যখন গ্র্যান্ড হোটেলের সামনে থেকে বা লিন্ডসে স্ট্রিটের সামনে থেকে একটি অবলিক অ্যাঙ্গেল ক্যামেরায় একজন তরুণীর বক্ষদেশের প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। যদি ভাবা যায় বাঙালি যুবকের অপূর্ব থেকে সিদ্ধার্থে রূপান্তর হল। বা শ্যামলেন্দুতে রূপান্তর হল, যে চাকরিতে উন্নতির জন্য খুনের অভিপ্রায় বহন করতে পারে। সোমনাথের কথা ভাবুন। যুবক অপূর্ব গ্লোব হাতে বিশ্ববোধের শরিক হতে চেয়েছিল। সেই যুবকের স্বপ্ন এমনভাবে ভেঙে গেল, যে সে সোমনাথ হয়ে নৈশ অভিযানে মেয়েমানুষের সাপ্লায়ার হয়ে গেল। সত্যজিতের এই যে স্বপ্নের নির্মাণ এবং স্বপ্নভঙ্গ, এখানেই তিনি শিল্পী হিসাবে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। অথচ এইসব ছবি আজকাল বড় একটা কেউ দেখে না। চারুলতা, দেবী, কাঞ্চনজঙ্ঘা কেউ দ্যাখে? অভিযান ছবিটা কবে কে শেষ দেখেছে? অপরাজিত ছবিটা তো প্রায় দেখাই হয় না। পথের পাঁচালীই বা কতটা দেখা হয়? দেখা হয় সেইসব ছবি, যেখানে সত্যজিৎ রায় ঈশপের গল্পের মত নীতিবাক্য প্রচার করেন। তখন সত্যজিৎ রায়ের শরীরও খারাপ হয়ে গেছে। তাই এই ছবিগুলো নেহাতই সামাজিক অনুশাসনের দায়িত্ব নেয়।
সঞ্জয়দা, আপনার কি মনে হয় সত্যজিতের কাজ নিয়ে চর্চা করার বদলে, তাঁর দর্শন নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার বদলে, তাঁর আবহসঙ্গীতকে রিংটোন বানিয়ে, ছবির ব্যর্থ রিটেলিং করে বা যেখানে সেখানে সেগুলো থেকে এক-আধটা সংলাপ গুঁজে দিয়ে আমরা রবীন্দ্রপুজোর মত সত্যজিৎ পুজো শুরু করে দিয়েছি?
আসলে আমাদের বিয়ের দিন যেমন ঠাকুর্দার ছবি বার করা হয়, কারণ আমাদের একটা বংশপরিচয় আছে, সত্যজিতের পথের পাঁচালী বা অপরাজিত সেই ধরনের ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ দ্যাখে না, কিন্তু সবাই জানে ওগুলো ক্লাসিক। এমনও বলা চালু হয়েছে যে সত্যজিৎ রায় আজ আর প্রাসঙ্গিক নন। আজকাল টিভিতে এমন সব অলৌকিক মেগা সিরিয়াল চলে, যা দেখে ভূতেদেরও গা ছমছম করবে। তার গল্পগুলো সপ্তদশ শতকেও অবাস্তব ছিল। কিন্তু সেগুলো যে চলছে, তার মানে এগুলোর সামাজিক অনুমোদন আছে। তা এমন সমাজের তো সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেখার কোন কারণ নেই। তিনি একটা উপলক্ষ মাত্র। তাঁর যে ছবিগুলো দেখা হয়, সেগুলো একটা বার্তা পাওয়ার জন্য। যেমন আগন্তুক বা হীরক রাজার দেশে। এগুলো জনপ্রিয় কেন? কারণ এগুলোতে এমন বার্তা রয়েছে, আমাদের মনের দুর্বলতা, ভীতি থেকে যেগুলোর প্রতি আমরা সমর্থন আশা করি। “দড়ি ধরে মারো টান/রাজা হবে খানখান” বলে যে বিদ্রোহ, তা আমাদের সহজে ইচ্ছাপূরণের সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়। মনমোহনবাবু বাইরে থেকে এসে আমাদের হঠাৎ ভাল করে দেন, আমরা ভাবি যে আমরা বাঙালিরা আবার হঠাৎ একদিন জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লব। পরিশ্রম, মেধা এবং ধীশক্তির কোন প্রয়োজন নেই।
বাংলায় ইদানীং গোয়েন্দা গল্প নিয়ে বহু নির্দেশক ছবি, ওয়েব সিরিজ ইত্যাদি করছেন। অথচ সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র ফেলুদাকে নিয়ে তিনি নিজে দুটোর বেশি ছবি করেননি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশকে নিয়েও তিনি ‘চিড়িয়াখানা’ করেছিলেন অনেকটা দায়ে পড়ে। অথচ তিনি তো রহস্য গল্প লিখতে ভালবাসতেন। ছবি করার ক্ষেত্রে এই অনিচ্ছা কেন সেদিকটায় যদি একটু আলোকপাত করেন।
আসলে কী জানেন, সত্যজিৎ রায়ের সময়ে, এমনকি সত্তরের দশকেও, বাঙালি স্থিরতার প্রতীক ছিল। ফেলুদা রহস্য অনুসন্ধান করত এবং রহস্যভেদ করত। ছোটদের জন্যে লেখা সত্যজিৎদের পরিবারে বংশ পরম্পরায় চলেছে। উপেন্দ্রকিশোর লিখেছেন একেবারে শিশুদের জন্য, সুকুমার রায় লিখেছেন অনতি কিশোরদের জন্য, আর সত্যজিৎ লিখেছেন যারা প্রায় স্কুলের শেষ ধাপে — তাদের জন্য। ফেলুদার গল্পগুলো মূলত কিশোরপাঠ্য, ফলে প্রায় স্ত্রী চরিত্র বর্জিত। কিন্তু আজ যে গল্পগুলো নিয়ে ছবি তৈরি হচ্ছে, সেগুলো এক ঈশ্বর পরিত্যক্ত সমাজের লক্ষণ।
এই সমাজের মানুষ সামাজিক সংলাপের জন্য অন্য কোন এজেন্সির দ্বারস্থ। রাষ্ট্রাতিরিক্ত কাউকে তার দরকার। রাষ্ট্র স্বাধীনতার এই সত্তর-আশি বছর পরে আর খুব একটা নির্ভরযোগ্য রক্ষাকবচ বলে মনে হচ্ছে না আমাদের। স্বাধীনতার প্রথম প্রতিশ্রুতি ফিকে হয়ে গেছে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকে আমরা ঈশ্বরকে নির্বাসন দিয়েছি। কবচ, তাবিজ, শেকড় হিসাবে বা আমাদের ভাষার ব্যবহারে যতটা ঈশ্বরকে কাজে লাগাই, তত কিন্তু বিশ্বাস হিসাবে কাজে লাগাই না। আজকের নিরীশ্বর মানুষ, জীবনানন্দ দাশের ভাষায় “মানুষ কাউকে চায় — তার সেই নিহত উজ্জ্বল / ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনো সাধনার ফল”। রাষ্ট্র এবং ঈশ্বর যদি অশক্ত হন, তাহলে নিরাপত্তা পেতে আমাদের একটা মধ্যস্থ এজেন্সি দরকার। সেই এজেন্সিটা কে? সেটা হল রাষ্ট্রাতিরিক্ত চরিত্র — গোয়েন্দা। মনে রাখবেন, গোয়েন্দা কিন্তু পুলিস নয়। সে অপরাধ আটকানোর দায়িত্ব নিতে পারে না, কিন্তু অপরাধের সমাধান করে দেয়। বাকি কাজ পুলিস করে।
অর্থনৈতিক উদারীকরণের পরে হঠাৎ যে বিত্তস্ফীতি মধ্যবিত্তদের মধ্যে, তারপর খবরের কাগজ পড়লেই বোঝা যায়, আমাদের অপরাধেরও মাত্রা বদল ঘটে গেছে। এখন কলকাতা শহরে যে ধরনের অপরাধ হয়, এমনকি যৌন অপরাধ হয়, সেগুলো আগে হত না। এই সমাজ কার কাছে দায়বদ্ধ থাকতে চায়? সে সেলফ জাস্টিসের ভাবনায়, আত্মসমর্থনের জন্য, এমন একজনকে খুঁজে নেয়, যে তার হয়ে এই কাজটা করে দেবে। বাঙালি এমন এক সমাজ গড়ে তুলেছে, যেখানে অন্য কিছু ভাবার জায়গা নেই।
তবে দুঃখের বিষয়, স্রেফ ক্যামেরা দক্ষতা বা সম্পাদনা দক্ষতার দিক থেকেও সত্যজিৎ রায় অন্য পর্যায়ের শিল্পী ছিলেন। এখনকার এঁদের কোন দক্ষতাই নেই। আমি যখন রূপকলা কেন্দ্রের প্রধান ছিলাম, সেখানে সৌমেন্দু রায় পড়াতেন। তিনি আমাকে একবার বলেছিলেন “যা অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে সঞ্জয়, তাতে তুমি ক্যামেরা চালাচ্ছ, না সুব্রতদা (সুব্রত মিত্র) ক্যামেরা চালাচ্ছেন, বোঝা যাবে না। কারণ ডিজিটাল ক্যামেরা সেলফ কারেক্টিং মোডে চলে। যেমন এডিটিং সফটওয়্যার সবটাই নিজেই করে নেয়। ফলে এখনকার ছবিগুলোতে আপনি ঝলসানি পাচ্ছেন। ঝলসানি মানে কিন্তু সিনেমার উৎকর্ষ নয়। ভারতীয় সমাজ যেভাবে বিবর্তিত হচ্ছে, আপনি বাংলা ছবিতে তার কোন প্রমাণ দেখতে পান? এমনকি নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের আন্দোলন নিয়ে যারা গর্ব করে, তারাও কি বাংলা ছবিতে নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের কোন প্রভাব দেখাতে পেরেছে? পারেনি।
আচ্ছা, খুদে পাঠকদের পক্ষ থেকে একটা প্রশ্ন। সত্যজিৎ প্রফেসর শঙ্কুর গল্প নিয়ে ছবি করেননি কেন?
যে কোন ছবি বানানোর ব্যাপারেই সত্যজিৎ রায়ের একটা জোরালো বিশ্বাস ছিল। আমরা সবাই যদি সেই বিশ্বাসের শরিক হতে পারতাম, তাহলে বাংলার চলচ্চিত্র শিল্প আজকের গাড্ডায় গিয়ে পড়ত না। সত্যজিৎ মনে করতেন, কেউ যদি তাঁকে ছবি করতে টাকা দেন, তাঁর একটা ন্যূনতম রিটার্ন পাওয়া উচিৎ। ফলে তিনি প্রথম থেকেই খুব কম বাজেটে ছবি করার কথা ভাবতেন। তাঁর মার্কেট কারা? প্রধানত বাঙালি মধ্যবিত্ত। তাই এদের রুচি অনুযায়ীই তিনি ছবি বানাতেন এবং কম খরচে বানাতেন। ছোটরা সঙ্গতভাবেই জানতে চাইতে পারে তিনি শঙ্কুকে নিয়ে কেন ছবি করলেন না? আমি যোগ করব, সত্যজিৎ রায় নিজে তো ঘনাদার গল্পের খুব ভক্ত ছিলেন। তা নিয়েই বা কেন ছবি করলেন না? এই গোটা জগৎটাকেই উনি বাইরে রাখলেন কেন? উত্তরটা সোজা। আসলে ঘনাদা বা প্রফেসর শঙ্কুতে যে টেকনিকাল এফেক্ট দরকার, সেই এফেক্ট আনতে সত্যজিৎ রায়কে যে প্রবল পরিশ্রম এবং খরচ করতে হত, তা আজকের বাঙালি পরিচালক ভাবতে পারে না। সে তো বিভূতিভূষণের গল্প নিয়ে ছবি করতে আফ্রিকায় চলে যেতে পারে। সে হনুমান টুপি পরে নরওয়েতে বসে থাকে। সেই সময়ে এই পরিমাণ খরচ সত্যজিৎ রায়ের সাধ্যের বাইরে ছিল।
প্রযোজকদের ব্যাপারটাও মনে রাখতে হবে। আর ডি বনশল কিন্তু এমন ব্যবসা করতেন যার ব্যালান্স শীট হয়, অডিট রিপোর্ট হয়। আজকাল কিছু রহস্যজনক বিনিয়োগকারী হয়েছে বাংলা সিনেমায়। তাদের টাকা কোথা থেকে আসে, তারা কেন বিনিয়োগ করে, করতে না পারলে কোথায় চলে যায় — কেউ বলতে পারবে না। গত দশ-পনেরো বছরের বা পুরো একুশ শতকেরই এই ইতিহাসের হদিশ কোন সেন্ট্রাল বা স্টেট এজেন্সির কাছে নেই।
শেষ প্রশ্ন। লেখক হিসাবে সত্যজিৎ রায়কে আপনি কোনখানে রাখবেন? প্রশ্নটা করছি কারণ শিশু-কিশোর সাহিত্যে তাঁর জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত হলেও অশোক মিত্রের মত মানুষ লিখেছেন “আমার গলা কেটে ফেললেও বলতে আদৌ সম্মত হব না যে সত্যজিৎ তেমন বাংলা গদ্য লিখতে জানতেন।”
নিরপেক্ষভাবে বলছি, অশোক মিত্র সমগ্র বাংলা সাহিত্যের কথা ভেবে লিখেছেন এবং এটা আংশিক সত্য। তিনি খুব ভুল বলেননি, তবে একটু নির্দয় হয়েছেন। কারণ তাঁর মাথায় হয়ত ছিল সাহিত্য রচনায় সত্যজিতের পারিবারিক ঐতিহ্য। তাঁর বংশের শিশুসাহিত্যিকরা যে মানের, ধরুন সুকুমার রায় বা লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ রায় সেই মানের সাহিত্যিক ছিলেন না। যদিও তিনি দাবি করতেন সাহিত্য তাঁর রক্তে, সিনেমাটাই বরং আমদানি। আসলে সিনেমাই পেশা হওয়ার কারণে সত্যজিতের যে কোন গল্পেই দৃশ্য খুব গুরুত্ব পেত। দার্জিলিং জমজমাট, গ্যাংটকে গন্ডগোল বা বাদশাহী আংটি পড়লে দেখবেন দার্জিলিং, গ্যাংটক এবং লখনৌ ঘোরার জন্য কোন টুরিস্ট বোর্ডের গাইডবুক লাগবে না। একেবারে চিত্রনাট্যকারের ভঙ্গিতে, ক্যামেরা মুভমেন্ট যেভাবে হবে, সেভাবে সত্যজিৎ লিখতেন। কিন্তু শুধু চোখ তো সাহিত্য তৈরি করে না, অন্য অনুভূতিগুলোও করে। সত্যজিৎ সেগুলোর দিকে নজর দেওয়ার সময় পাননি। এটা সত্য। আবার তাঁর জনপ্রিয়তাও এই কারণেই। সত্যজিতের লেখা পড়লে ভাবতে হয় না।
সুকুমারের আবোল তাবোল কিন্তু মহত্তর সৃষ্টি, কারণ তার মধ্যে অনেক ভাবনার জায়গা আছে। আপনি প্রথম পড়ার সময় খুব মজা পাবেন, কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারবেন অনেক গভীরতর ভাবনা আছে লেখাগুলোর মধ্যে। সত্যজিৎ রায়ের লেখা শুধুই পড়ার আনন্দে পড়ার জন্য। যেন তরতর করে গাড়ি চলছে স্টেশনে না থেমে। এগুলো রেল যাত্রায় বা বড় প্লেন যাত্রায় নিখুঁত সঙ্গী হতে পারে। কিন্তু এমন নয় যে এগুলো মানুষের মনে স্থায়ী হতে পারে। সে চেষ্টা সত্যজিৎ করেনওনি। দৈবাৎ তাঁর ছবি তেমন না চললে তিনি বইগুলোর রয়্যালটি থেকে অনেক লাভ করতেন।
এই প্রসঙ্গে বলি, পরিচালক হিসাবে তাঁর পারিশ্রমিক কিন্তু খুব কম ছিল। আজকের পরিচালকরা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন যে সেদিনকার হিসাবে তাঁদের আজকের পারিশ্রমিকের চার ভাগের এক ভাগও সত্যজিৎ কোনদিন নেননি। যখন তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, তখনো।
এত দিনে মাথায় ঢুকেছে যে শক্তিশালী জাতিবিদ্বেষী যখন মারতে আসে তখন স্রেফ নামটা দেখেই মারে।
প্রত্যেকটা নির্বাচন কিছু ইস্যু নিয়ে প্রবল আলাপ আলোচনা বাকবিতণ্ডা সৃষ্টি করে আর কিছু ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচন সেইভাবেই একটা উত্তেজনার বিষয় আড়চোখে লক্ষ্য করে, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই এবারের নির্বাচন এত কিছু নিয়ে এত বেশি উত্তাপ, কদর্যতা, হিংসার উদ্রেক করেছে যে এই বিষয়টা যদি অষ্টম দফা পর্যন্তও নির্বাচনী ইস্যু না হয়ে ওঠে, তাহলে হয়ত আপাতত ভালই হয়। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে ইস্যুটাকে আর পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
বিষয় বাঙালির উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স। আর সেখানেই কিনা সরকারি ফতোয়া জারি হয়েছে কাজকর্মে যতদূর সম্ভব হিন্দি ব্যবহার করতে হবে। উচ্চশিক্ষায় যুক্ত বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন। বাঙালিকে নিজ দেশে পরবাসী করে দেওয়ার চক্রান্ত; বাংলার ভাষা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পিত আক্রমণ — এইসব অভিযোগ উঠেছে। সংস্থার গবেষকরা তাঁদের মত করে প্রতিবাদ করেছেন। সংস্থা বেগতিক দেখে নিজেদের আদেশের অন্যরকম ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।১ এদিকে আবার শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, প্রতিবাদের মুখে ফেরত আনা হয়েছে। নির্বাচনের পরেই আবার রবীন্দ্রনাথ উধাও হবেন কিনা তা সময় বলবে। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে তো এখন নিশ্চিন্তে বলা চলে “সে মন্দিরে দেব নাই”। বিশ্বভারতীর চতুর্দিকে পাঁচিল তুলে বসুধাকে খণ্ড ক্ষুদ্র করেই উপাচার্য সন্তুষ্ট নন, তিনি নাকি বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়ে যাবেন।২
এই ঘটনাগুলো দীর্ঘ মেয়াদে পশ্চিমবঙ্গের বা সারা পৃথিবীর বাঙালি সংস্কৃতির পক্ষে যতই ক্ষতিকর হোক, শতকরা নব্বই জন বাঙালির ভাবিত না হলেও চলত। আজকাল মহেন্দ্রলাল সরকার নামটা শুনলে কেউ কেউ আনন্দবাজার গোষ্ঠীর মালিকদের আত্মীয় বলে সন্দেহ করে, আর রবীন্দ্রনাথের পদবি বহুকাল হল তাঁর নামকে অতিক্রম করে গেছে। ফলে ঘরে একখানা ছবি ঝুলিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু এসবের পাশাপাশি এমন কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে, যেগুলো উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান গবেষণা বা শিল্প সাহিত্যের সাথে দৈনন্দিন সম্পর্কহীন ছা পোষা মধ্যবিত্তেরও ঘুম কেড়ে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ঘটনাগুলো সংখ্যায় এখনো বেশ কম, হয়ত সোশাল মিডিয়ার যুগ না হলে খুব বেশি লোক জানতেও পারত না। কিন্তু লক্ষণ হিসাবে ভাল নয়। কদিন আগেই ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে রোহিত মজুমদার নামে এক বাঙালি যুবক অভিযোগ করলেন, বড়বাজার অঞ্চলে ব্যবসার কাজে এসে বেশ কিছু হিন্দিভাষী লোকের হাতে তিনি হেনস্থা হন এবং হিন্দি বোঝেন না বলে তাঁদের বাংলায় কথা বলতে অনুরোধ করায় তাঁকে বলা হয় বাংলা বলতে হলে বাংলাদেশে চলে যেতে হবে।৩ প্রায় একই সময়ে এক যুবক ফেসবুকেই ভিডিও পোস্ট করে অভিযোগ করেন হুগলী জেলার হিন্দমোটরে এক হিন্দিভাষী নাকি তাঁকে বাড়ি ভাড়া দেননি আমিষাশী হওয়ার অপরাধে। এ পর্যন্ত প্রকাশ পাওয়া সবচেয়ে কুৎসিত অভিযোগ উঠেছে কোন্নগরে। হোলির দিন অবাঙালি যুবকরা জোর করে ঘরে ঢুকে বাঙালি মহিলাকে নাকি রঙ মাখিয়েছে। প্রতিবাদ করায় এবং হোলি বাঙালিদের উৎসব নয়, বাঙালিরা দোল খেলে বলায় নাকি উত্তর এসেছে নেমপ্লেটে লিখে রাখা উচিৎ যে বাঙালি। এবং ২ তারিখের পর মজা দেখানো হবে।৪
কোন্নগরের ঘটনায় এফ আই আর দায়ের করা হয়েছে। হুমকির কথাটা সত্য হোক আর না হোক, সোশাল মিডিয়ায় কিন্তু সত্যিই এমন ভিডিও ঘুরছে, যেখানে হিন্দিভাষী কয়েকজন লোক আঙুল নেড়ে চোখ রাঙিয়ে বলছে ২ তারিখের পর বাঙালিদের দেখে নেওয়া হবে, কারণ “পশ্চিমবঙ্গে এবার আমাদের সরকার হচ্ছে।” এখানে আমরা কারা — সে ভারী কঠিন প্রশ্ন। এখন অব্দি দেশে যেটুকু সাংবিধানিক নিয়মকানুন অবশিষ্ট আছে, তাতে সরকার কোন দলের বা জোটের হয়। বাঙালির সরকার বা অবাঙালির সরকার হয় বলে তো জানি না। তবে রোজ কত কি ঘটে যাহা তাহা। সব কি আর জানি? সত্যি কথাটা এই, যে অতীতে যে জায়গাটা হুগলী শিল্পাঞ্চল ছিল সেখানে বা কলকাতার বেশকিছু অঞ্চলে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় প্রায়শই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে শিগগির এমন একদিন আসবে যখন হিন্দিভাষীরা তাঁদের উপর ছড়ি ঘোরাবেন। বাঙালি বাংলাতেই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে যাবে, সংস্কৃতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এই আতঙ্কই চলতি নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বহিরাগত তত্ত্বে উঁকি মেরেছিল। কিন্তু সম্ভবত হিন্দিভাষী ভোটারদের সংখ্যা ফেলে দেওয়ার মত নয় বলে ও তত্ত্ব নিয়ে বেশি কাটাছেঁড়া করা হল না।
রাজনৈতিক দলগুলো উপর্যুক্ত ঘটনাবলী নিয়ে মাথা না ঘামালেও, বাংলা পক্ষের মত সংগঠন কিন্তু বীর বিক্রমে মাঠে নেমে পড়েছে। “গুটখাখোর” জাতীয় কিছু সগর্ব জাতিবিদ্বেষী শব্দাবলী তাদের হাতিয়ার। যেন বাঙালিরা কেউ গুটখার ধারে কাছে যায় না, অথবা গুটখা খেলেই যে কোন মানুষ আক্রমণাত্মক, বাঙালি বিদ্বেষী, ধর্ষণোদ্যত পুরুষে পরিণত হয়। শুধু তা-ই নয়, এদের ফেসবুক লাইভগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ঠিক যেভাবে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানদের একগাদা সন্তান, তাই তাদের রাজনৈতিক দলগুলো তোষণ করে বলে বক্তৃতা দিয়ে থাকে; বাংলাপক্ষের নেতৃবৃন্দও সুযোগ পেলেই হিন্দিভাষীদের সন্তানের সংখ্যা বাঙালিদের চেয়ে বেশি, তাই তাদের রাজনৈতিক দলগুলো তোষণ করে — এসব বলে থাকেন। বেশিক্ষণ সেসব বক্তৃতা শুনলে মনে হয় ‘হিন্দু খতরে মে হ্যায়’ নামক হিন্দি ছবির বাংলায় ডাব করা প্রিন্ট দেখছি, যার নাম ‘বাঙালি বিপন্ন’।
বাঙালি যে বিপন্ন তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহের অবকাশ নেই। যা রটে তার কিছু তো বটে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় গবেষণা সংস্থা বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কেবল বাংলায় হচ্ছে তা নয়, সারা ভারতে চলছে। কিন্তু কোন পক্ষের উগ্রতাকে শিরোধার্য না করে এই বিপন্নতার কারণ খুঁজতে গেলে বাঙালির পক্ষে একগাদা অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠে আসে।
পৃথিবীতে এমন কোন ভাষা সংস্কৃতি নেই যাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব অন্য ভাষার লোকেরা নিয়েছে। কেনই বা নেবে? এমন ভাষাও পাওয়া যাবে না, যা বিপুল সংখ্যক মানুষ ব্যবহার করেন অথচ অনেকেই ব্যবহার যে করেন তা স্বীকার করতে কুণ্ঠিত বোধ করেন। এই অনন্য গুণটি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি গত দুই-তিন দশকে আয়ত্ত করেছে। শহর ও মফস্বলের সম্পন্ন বাঙালি এখন ছেলেমেয়েকে কেবল ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়ে সন্তুষ্ট নয়, দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে রাখে হিন্দি। বাংলা নৈব নৈব চ। দুনিয়া অনেক বদলে গেছে, ভাল করে ইংরেজি জানা না থাকলে চাকরি বাকরি পাওয়া যাবে না — এ যুক্তি অনস্বীকার্য। কিন্তু হিন্দি লিখতে পড়তে শেখা বঙ্গসন্তানদের কী করে কোটিপতি হতে সাহায্য করবে তা বোঝা দুষ্কর। হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলোতে কর্মসংস্থানের অবস্থা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় খারাপ বৈ ভাল নয়; দিল্লী, মুম্বইতে থেকে কাজকর্ম করতে হলে হিন্দি বলতে পারাই যথেষ্ট। সেটুকু আমাদের সোনার ছেলেমেয়েরা হিন্দি সিনেমার দৌলতে যথেষ্ট ভাল আয়ত্ত করে ফেলে। তবু ২০১৭ সালে যখন তৃণমূল সরকার ঘোষণা করল প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা পড়াতেই হবে, সম্ভ্রান্ত বাঙালি বাবা-মায়েদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। দার্জিলিঙের গোর্খা, নেপালি, ভুটিয়া, লেপচা বা দক্ষিণবঙ্গের আদিবাসীরা এর প্রতিবাদ করলে কারণ বোঝা যায়। হিন্দি বা ইংরেজির মত বাংলাও তাঁদের মাতৃভাষা নয়। তাঁদের কেন এই ভাষা শিখতেই হবে? কিন্তু কলকাতা ও তার আশপাশের বাঙালির যে উষ্মা প্রকাশ, তা হিন্দিভাষী হয়ে ওঠার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা ছাড়া আর কিছু দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব কি? তা এই যখন ইচ্ছা, তখন আর “ওরা আমাদের টিকতে দেবে না” — এই চিন্তা করা কেন? দোল কথাটা তো এমনিও ভুলেই গেছেন, হোয়াটস্যাপ করেন ‘হ্যাপি হোলি’। তা এবার থেকে না হয় হোলিই খেলবেন।
সম্প্রতি চেন্নাইয়ের এক অনুষ্ঠানে ঘোষিকা হিন্দিতে কথা বলায় ভারত বিখ্যাত এ আর রহমান৫ মুচকি হেসে আপত্তি জানিয়ে মঞ্চ ত্যাগ করেছেন। ভিডিওটা দেখে মনে পড়ল, বছর দুয়েক আগে হংস মধ্যে বক যথা বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের এক বৈঠকে হাজির হয়েছিলাম। সেখানে তাঁরা আলোচনা করছিলেন হিন্দুত্ববাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে বাংলাকে কী করে বাঁচানো যায়। সকলেই একমত হলেন যে ওঁদের কিছু করার নেই। রাজনৈতিক কর্মীদের সরকারে এসে বাংলার অর্থনীতির হাল ফেরাতে হবে, তাহলেই সংস্কৃতি বাঁচবে। বাংলায় লিখে পুরস্কারপ্রাপ্ত এক সাহিত্যিক জোর দিয়ে বললেন, প্রয়োজন না থাকলে নিজের সন্তানকে তিনি বাংলা পড়াবেন না। আরেক বিপ্লবী সাহিত্যিকও তাঁকে সমর্থন করলেন। এই কারণেই তামিলনাড়ুর তামিলরা বিপন্ন নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি বিপন্ন। মনে রাখা ভাল, রহমান মোটেই তামিলপক্ষের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর নন। ভারতের বেশিরভাগ লোক বরং তাঁকে চিনেছে তিনি হিন্দি ছবিতে কাজ করেছেন বলেই। কিন্তু তিনি বোঝেন কোথায় সীমারেখা টানতে হয়। তার চেয়েও বড় কথা, নিজের ভাষা সংস্কৃতির প্রতি শিল্পী হিসাবে তাঁর যে দায়িত্ব তা তিনি রাজনৈতিক কর্মীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন না।
অনেককাল আগে থেকেই বাঙালি ভদ্রসমাজ ইংরেজি ভাল করে শিখলেই হবে, বাংলা এলেবেলে — এই তত্ত্ব চালু করে বিরাট অংশের বাঙালির থেকে নিজেদের আলাদা করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বড় সাধ ছিল বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা হবে। সে প্রয়াসে বহুকাল আগেই জল ঢালা হয়ে গেছে, কারণ বাঙালি বিদ্বানরা নিজে শিখতে পারলেই যথেষ্ট হল মনে করেন। বিদ্বানের সংখ্যা বাড়িয়ে কী লাভ? এইভাবে বাংলা ক্রমশ কেবল শিল্প, সাহিত্যের ভাষায় পরিণত হয়েছে। এখন উল্টে তারই বিরুদ্ধে অভিযোগ “কোন কাজে লাগে না তো।” যেন যুগ বদলের সাথে সাথে কাজের ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার পরিবর্তন করা, নতুন পরিভাষা, নতুন শব্দ তৈরি করা অন্য ভাষার লোকেদের কাজ ছিল। সে যা-ই হোক, কথা হচ্ছে কাজে লাগে না বলে সাধারণ চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত যখন নিজের সংস্কৃতিকে বাতিলই করে দিয়েছেন তখন আর ভয় কী? ছেলেমেয়েকে বাংলা বই পড়ানো দূরে থাক, বাংলা টিভি চ্যানেল পর্যন্ত দেখতে বারণ করেছেন। তা কেন্দ্রীয় সরকার আর আপনার হিন্দিভাষী প্রতিবেশীরা যদি বাংলা বলাটুকুও বন্ধ করে দেন, সে তো ভালই, তাই না? আসলে এত দিনে মাথায় ঢুকেছে যে শক্তিশালী জাতিবিদ্বেষী যখন মারতে আসে তখন স্রেফ নামটা দেখেই মারে। “জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না” বললে তখন রেহাই পাওয়া যাবে না। তাই আপ্রাণ জাতি পরিচয় তুলে ধরে পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা। তবে বাঙালির সে চেষ্টাতেও ফাঁকিবাজির ছাপ স্পষ্ট। আক্রমণের লক্ষ্য বড়বাজারের বিহারী ঠেলাওয়ালা থেকে কোটিপতি ভুজিয়াওয়ালা পর্যন্ত সকলেই। অথচ নিজের ভুলে যাওয়া ভাষা সংস্কৃতিকে নতুন করে জানার চেষ্টা নেই। ক্রমশ শক্তি বাড়িয়ে চলা হিন্দুরাষ্ট্র আগামী দিনে হয়ত আইন করে সমস্ত সরকারি কাজে হিন্দি ভাষা ছাড়া অন্য ভাষাগুলোকে ব্রাত্য করে দেবে। তখন নির্ঘাত বাঙালির প্রতিরোধ হবে বিহারী গোয়ালার থেকে দুধ না কেনা, উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা সবজিওয়ালাকে বয়কট করা ইত্যাদি। আমরা পশ্চিমবঙ্গের ভদ্রলোকেরা জানি, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে “কম্পিটিশনে” পিছিয়ে পড়তে হয়। বরাক উপত্যকা বা বাংলাদেশের বাঙালিদের মত বোকা হাঁদা নই যে ভাষার জন্যে প্রাণ দিতে যাব।
বাংলা ছবির টাইটেল কার্ড, যা আজকাল বাংলা হরফের চেয়ে রোমানে বেশি লেখা হয়, অনতিবিলম্বেই দেবনাগরীতেও লেখা হবে। কারণ বাঙালি শিল্পীর মত সুবোধ প্রজাতি ভূভারতে নেই। ওঁরা ছটপুজোয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার ছুটি দেয় কেন সে প্রশ্ন করেননি, এ রাজ্যে হঠাৎ হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়ের কী প্রয়োজন তাও জিজ্ঞেস করেননি। রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রদের পাশে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি কোন সংস্কৃতির লক্ষণ, সে নিয়েও তাঁরা ভাবেননি। সুতরাং আশা করা যায় কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে কেবল ভক্তিমূলক আর পুরাণাশ্রয়ী হিন্দি ছবি দেখানো হলেও তাঁরা আপত্তি করবেন না। এমনিতেও আজকের চিত্রতারকাদের অনেকেই বাংলা বলেন শেক্সপিয়রের মত।
পুরস্কারপ্রাপ্ত এবং বিপ্লবী সাহিত্যিকরাও নিশ্চয়ই হিন্দিতে লেখা শিখে নেবেন। বাংলার আর মার্কেট কই? হিন্দি লেখার মার্কেট গোটা ভারত।
এখন কোথায় গেল কোলবালিশ আর কোথায় গেল প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান, যা সবদিক থেকে পাশ্চাত্যের চেয়ে উন্নত? কোনটাই পারল না তো বাঁচাতে?
কাব্যি করবেন না। এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ, এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চের প্রত্যেকটা বাঁশ আমাদের নিজের হাতে পোঁতা। এখন চোখ বড় বড় করে বিস্ময় প্রকাশ করলে চলবে না। যখন বেসরকারিকরণকে সর্বসন্তাপহর বটিকা বলেছিলেন, যখন সিগারেটে সুখটান দিয়ে বলেছিলেন “ফেলো কড়ি মাখো তেল”, তখন ভেবেছিলেন হাসপাতালে শয্যা খালি থাকলে তবে আপনার মেডিক্লেম কাজে লাগবে? মনে ছিল না অক্সিজেন কম পড়লে আপনি কোটিপতি হলেও লাভ হবে না?
ডাক্তার কাফিল খান নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে অক্সিজেন আনিয়ে শিশুদের প্রাণ বাঁচাতে গিয়েছিলেন। সেই অপরাধে উত্তরপ্রদেশ সরকার তাঁকে হাজতবাস করাল দীর্ঘদিন। আজ সেই রাজ্যে শ্মশানে জায়গা নেই বলে ফুটপাথে পোড়ানো হচ্ছে মৃতদেহ।
A report by @lokeshRlive from Ghaziabad tearing into govt’s suppression of Covid casualties in UP.
কে নির্বাচিত করেছিল এমন সরকারকে? ক্রেনিয়াস গ্রহের অ্যাং আর তার জাতভাইরা? এখন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নিজেও কোভিডাক্রান্ত। কিন্তু গত বছর যখন প্রধানমন্ত্রীর বিধানে ভাইরাস তাড়াতে থালা বাজিয়েছিলেন, সে দৃশ্য যারা হাঁ করে টিভিতে দেখেছে, নিজেও সোৎসাহে থালা বাজিয়েছে — তারা তো এই দেশেরই মানুষ। পথে ঘাটে ঝগড়া করেছে, হোয়াটস্যাপ ফরোয়ার্ডকে বেদবাক্য বলে ধরে নিয়ে আওয়াজের চোটে করোনা ভাইরাস মরে যাবে, এই তত্ত্ব প্রচার করেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারীরা — তারা সবাই এ দেশের মানুষ। এর বিপরীতে করোনা অতিমারী আসলে এক পাহাড়প্রমাণ ফাঁকি, লড়াই আন্দোলন দমন করার জন্য সরকারের তৈরি এক ধাপ্পা, করোনা সাধারণ সর্দিকাশি, ফ্লু-এর চেয়ে বেশি কিছু নয় — প্রবল আত্মবিশ্বাসে এসব বলে গেছে যারা, তারাও কেউ ভিনগ্রহের বাসিন্দা নয়।
ইন্ডিয়ান মেডিকাল অ্যাসোসিয়েশন জানাচ্ছে এখন অব্দি চলতি অতিমারীতে অন্তত ৭৩৯ জন এম বি বি এস ডাক্তার মারা গেছেন, এই দ্বিতীয় ঢেউতেই তিনজন। আই এম এ না বললেও আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় জানি — ডাক্তার, নার্সরা বারো ঘন্টা, ষোল ঘন্টা ডিউটি করছেন সেই গত বছরের মার্চ থেকে। খাওয়ার সময় নেই, বাথরুমে যাওয়ার সময় নেই, ঋতুমতী মহিলারা ন্যাপকিন বদলানোর সময় পর্যন্ত পাচ্ছেন না। তাঁদের ধন্যবাদ জানানোর জন্যই নাকি মহামতি নরেন্দ্র মোদী থালা বাসন বাজাতে বলেছিলেন দেশের সকলকে। এ দেশের অনুগত মানুষ তাঁর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ ঘটা করে ১.৭ লক্ষ কোটি টাকার কোভিড-১৯ ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। তাতে সাফাই কর্মচারী, ওয়ার্ড বয়, নার্স, আশা কর্মী, প্যারামেডিক, টেকনিশিয়ান, ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ প্রমুখের জন্য ৫০ লক্ষ টাকার বিমা প্রকল্প ছিল। ২৬শে মার্চ, ২০২০ তারিখে মন্ত্রী বলেছিলেন এতে নাকি প্রায় ২২ লক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী উপকৃত হবেন। এ বছরের ২৪শে মার্চ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সার্কুলার জারি করে সেই বিমা প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছে। [১]
‘দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ জানাচ্ছে এই এক বছরে মাত্র ২৮৭ জন এই বিমার টাকা দাবি করেছেন। এই ধূর্ত, নির্দয় সরকারকে গদিতে বসিয়েছে কি পাকিস্তানের মানুষ? রাজ্যে রাজ্যে (পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই) এদেরই ক্ষমতায় আনতে উদগ্রীব কি বাংলাদেশের মানুষ?
পশ্চিমবঙ্গে তো আবার আজকাল বাংলাদেশ বাদ দিয়ে কোন আলোচনা চলে না। ওটা যে আলাদা দেশ তা গুলিয়ে যায় অনেকসময়। ও দেশের ধর্ষিতাকে এ রাজ্যের নির্বাচনে ইস্যু করার চেষ্টা হয়। ও দেশের লোকে পশ্চিমবঙ্গ ভরে গেছে বলে যারা ভীষণ চিন্তিত, তাদের স্বভাবতই এ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থা নিয়ে ভাবার সময় নেই। মুশকিল হল আমরা এ দেশে ভ্যাক্সিন পাঠাচ্ছি, সে দেশে ভ্যাক্সিন পাঠাচ্ছি বলে প্রধানমন্ত্রী আস্ফালন করছেন, এদিকে ওষুধের জন্য বাংলাদেশের কোম্পানিগুলোর কাছে হাত পাততে হচ্ছে। ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছেন। মোদী সরকারের কাছে বাংলাদেশ থেকে এই ওষুধ আমদানি করার অনুমতিও চেয়েছেন।
অনুমতি পাবেন কিনা কে জানে? মোদীর অনুমতি দেওয়ার সময় হবে কি? উনি তো গোড়াতেই বলেছিলেন উনি প্রধানমন্ত্রী নন, প্রধান সেবক। ফলে ওঁর অনেক কাজ। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে নাকি অতিমারীর জরুরি পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে ফোন করে শুনেছেন তিনি পশ্চিমবঙ্গে ভোটের প্রচারে ব্যস্ত, ফিরলে উত্তর পাবেন। ইতিমধ্যে কত মানুষ আর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরবেন না, সে খবরে প্রধানমন্ত্রীর দরকার নেই। এমন নয় যে তিনি এই প্রথম অযোগ্যতার বা নৃশংসতার পরিচয় দিচ্ছেন। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ই তিনি নিজের জাত চিনিয়েছেন। সেসব জেনেশুনে বিষ পান তো আমরাই করেছি। এখন বিষের জ্বালায় এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না বললে চলবে কেন?
পৃথিবীর সব দেশে কোভিডের প্রকোপে লকডাউন হয়েছে, কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষকে কয়েক শো মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করতে হয়নি, পথে ক্ষিদে তেষ্টায় মরতে হয়নি। এ দেশে হয়েছে। যখন তারা মরেছে, তখন আমরাই তো অসন্তোষ প্রকাশ করেছি, লকডাউন সত্ত্বেও এরা হাঁটছে কেন? অবৈজ্ঞানিক হলেও পোকামাকড় জ্ঞানে মানুষগুলোকে পথে বসিয়ে গায়ে স্প্রে করে স্যানিটাইজ করা হয়েছে। ওতেই নাকি কোভিড ছড়ানো বন্ধ হবে। তাতেই বা আমাদের কজনের আপত্তি হয়েছে? বিদেশ থেকে আসা বড়লোকেরা বেমালুম পরিচিতি বা টাকার জোরে কোয়ারান্টিনের বালাই না রেখে দেশের ভিতর সেঁধিয়ে গেছে আর আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছি বাড়ির কাজের লোক, ক্যাটারিং-এর কাজ করা লোক, রিকশাওয়ালা, পথের ভিখারি আর প্রবাসী শ্রমিকরাই ভাইরাস ছড়াচ্ছে। লেখাপড়া শিখে অবিজ্ঞানের চাষ করেছে যারা, অমুক পাঁপড় খেলে করোনা হয় না, তমুক আসন করলে করোনা হয় না, মাথায় গোমূত্র ছেটালে করোনা হয় না — এসব বিশ্বাস করেছে যারা, তারা কোন দেশের লোক?
কত না কালক্ষেপ করেছি গোটা পৃথিবীর দখল নেওয়ার জন্য ভাইরাসটা চীন গবেষণাগারে বানিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে কিনা সেই আলোচনায়। অথচ চীন যে কয়েক মাসের মধ্যে একগাদা নতুন হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছিল সেদিকে নজর দিইনি। না দেশ, না রাজ্য — কোন সরকারকে প্রশ্ন করিনি আমাদের একটাও নতুন হাসপাতাল হল না কেন? মুখ্যমন্ত্রী রাস্তায় নেমে গোল কেটেছেন কাকে কোথায় দাঁড়াতে হবে, আমরা হাততালি দিয়ে বলিনি “ওঃ, কি দারুণ লিডার! সামনে দাঁড়িয়ে লড়ছেন।” করোনাকে বালিশ করে শুয়ে পড়তে বলেছেন, আমরা বলেছি “বিজ্ঞানীরাও তো তা-ই বলছেন। এ ভাইরাস তো অনেকদিন থাকবে।” এখন কোথায় গেল কোলবালিশ আর কোথায় গেল প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান, যা সবদিক থেকে পাশ্চাত্যের চেয়ে উন্নত? কোনটাই পারল না তো বাঁচাতে? এতদিন পরে গণেশের প্লাস্টিক সার্জারির প্রাচীন কৌশলে বিশ্বাসী প্রধানমন্ত্রীর সরকার বলছে একশোটা হাসপাতালে নতুন অক্সিজেন প্ল্যান্ট বানানো হবে পিএম কেয়ারস ফান্ডের টাকায়।[২]
দেড়শো কোটি মানুষের দেশের মোটে একশোটা হাসপাতালে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করার টাকার খোঁজ এত দিনে পাওয়া গেল। এদিকে দুর্গাপুজোর টাকা জোগানো রাজ্য সরকার এখনো কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের চিকিৎসা বাবদ শ্রীরামপুর শ্রমজীবী হাসপাতালের প্রাপ্য আট কোটি টাকা দেয়নি।[৩]
আহা, নিজ রাজনৈতিক এজেন্ডার স্বার্থে আমরা কত কূট তর্কই না করেছি! কেউ পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা খারাপ বললে বলেছি “গুজরাটের অবস্থা কি ভাল? মধ্যপ্রদেশের অবস্থা কি ভাল?” যেন ঐ রাজ্যগুলোর চেয়ে কম লোক মরলেই এ রাজ্যের সরকারকে মেডেল দিতে হবে, এ রাজ্যের মানুষের জীবনের দাম নির্ভর করে ঐ রাজ্যগুলোর মানুষের জীবনের উপর। সারা দেশে কয়েকটা হাতে গোনা সংবাদমাধ্যম সাহস করে খবর করেছে যে কেন্দ্রীয় সরকার এবং অনেকগুলো রাজ্য সরকার রোগীর সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা লুকোচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে অকর্মণ্য সরকারগুলো দারুণ তৎপরতায় গর্জে উঠেছে, মামলা মোকদ্দমার হুমকি দেওয়া হয়েছে। কোন পার্টির সরকার তা দেখে আমরা ঠিক করেছি খবরগুলো বিশ্বাস করব কিনা। যদি কেউ কখনো বলে ফেলে কেরালা করোনা ভাল সামলাচ্ছে, অমনি আমরা তক্কে তক্কে থেকেছি কেরালায় কেস বাড়ে কিনা, মৃত্যু বাড়ে কিনা। বাড়লেই সে কি উল্লাস! “বাঃ বাঃ! কেরালায় লোক মরেছে। হল তো? কেরালা মডেল?” এই শকুনবৃত্তি যে দেশের মানুষ করে, সে দেশই তো মৃত্যু উপত্যকা। এখন আমার দেশ না বলে এড়িয়ে গেলে হবে?
যখন সরকার বলেছিল করোনা তেমন চিন্তার ব্যাপার নয়, তখন আয়োজিত তবলিগী জামাতের মর্কজকে দেশের করোনা ছড়ানোর জন্য দায়ী করে কত না চেঁচিয়েছি। হিন্দু এলাকায় মুসলমান ফলওয়ালা, সব্জিওয়ালাকে ঢুকতে দিইনি কারণ নিশ্চিত খবর ছিল, কোভিড-১৯ ওদের বাধ্য ছেলে। ওদের শরীরে থেকে অসুস্থ করছে না, কিন্তু ওদের কথায় হিন্দুদের দেহে ঢুকে পড়ছে। এখন লক্ষ লক্ষ লোক কুম্ভমেলায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করলেও চিন্তা নেই, কারোর করোনা হবে না। এ কথা বলছে কোন দেশের মন্ত্রীসান্ত্রীরা?[৪]
তাদের মন্ত্রী বানিয়েছে কারা? টিমবাকটুর লোকেরা?
নেতা মন্ত্রীরা নাহয় সাধারণ মানুষের জীবনের তোয়াক্কা করেন না, ভোটের জন্য লালায়িত — তাই সমাবেশ করেই চলেছেন। সে সমাবেশ বন্ধ করার দাবি তুলছে না যে সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী — তারা কিসের জন্য লালায়িত? কোন দেশের লোক তারা?
এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ, কারণ কেবল মানুষ মরছে না। কয়েক কোটি জীবন্ত মানুষের বিবেক মরে গেছে, মরে যাচ্ছে প্রতিদিন। করোনায় এখনো দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও, যে অতিমারীতে মৃত্যু হয় বিবেকের, তাতে ভারত ইতিমধ্যেই পৃথিবীতে প্রথম স্থানে।
বামপন্থীরা কি কেবল বুলিতেই আটকে থাকবেন? বরাবর তো তাঁদের শক্তি ছিল দ্রুত প্রতিক্রিয়ায় পথে নেমে আন্দোলন।
“এই নির্বাচন গুলি দিয়ে নয়, বুলি দিয়ে হওয়া উচিৎ”, বললেন সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম। মনে পড়ে গেল সুকুমার রায়ের ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ নাটকে রাম বিভীষণকে খোঁড়াতে দেখে বলছেন “যত তেজ বুঝি তোমার মুখেই।” জাম্বুবান পাশ থেকে টোন কাটছে “আজ্ঞে হ্যাঁ, মুখেন মারিতং জগৎ”। আসলে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস এবং সিপিএম দলের ইতিহাস সম্বন্ধে ন্যূনতম, লোকের মুখে শোনা ধারণা থাকলেও বিশ্বাস করা শক্ত হবে যে গণতন্ত্রের চরম সঙ্কটের মুহূর্তে একজন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা লড়াই আন্দোলনের কথা বলছেন না, রাজ্য অচল করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন না। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এক কবি একদা লিখেছিলেন “রাস্তাই একমাত্র রাস্তা”, আর সেলিম বললেন বাকযুদ্ধই একমাত্র রাস্তা!
রাষ্ট্রের বন্দুকের গুলিতে চারজন মানুষের প্রাণ চলে যাওয়ার পর অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। দোষীদের শাস্তি হয়নি, হবেও না। কারণ নির্বাচনকালীন প্রশাসন অজস্র অস্বস্তিকর প্রশ্ন না শোনার ভান করে আত্মরক্ষার স্বার্থে জওয়ানরা গুলি চালিয়েছিল বলে রায় দিয়ে ফেলেছে। ব্যবস্থা নেওয়া বলতে নির্বাচন কমিশন ৭২ ঘন্টা রাজনৈতিক নেতাদের ঐ এলাকায় ঢুকতে বারণ করেছে আর বাকি চার দফা নির্বাচনের প্রচার এক দিন করে কমিয়ে দিয়েছে। স্পষ্টতই, যে চারজনের প্রাণ গিয়েছে, সেই মনিরুজ্জামান, ছামিউল, হামিদুল আর নুর সম্বন্ধে নির্বাচন কমিশনের মনোভাব — পরের ছেলে পরমানন্দ। কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপির নেতা দিলীপ ঘোষ বলেই দিয়েছেন দরকার পড়লে আরো শীতলকুচি হতে পারে। ফলত নির্বাচন কমিশন স্বয়ংশাসিত সংস্থা — এ কথা এখন কলেজের ছাত্রদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরীক্ষার উত্তর মাত্র। এমতাবস্থায় লক্ষ্মী ছেলের সংসদীয় রাজনীতি যে ভোটারদের সমর্থন আদায় করা আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্কটের মোকাবিলা করা — দুটোর কোনটার জন্যেই যথেষ্ট নয়, তা বিজেপি বিরোধী যে কোন রাজনৈতিক নেতার বুঝতে পারা উচিৎ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিলক্ষণ বুঝেছেন। তাই ঘটনার দিনই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পদত্যাগ দাবি করেছেন, শীতলকুচিতে তাঁর যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মৃতদের পরিবার পরিজনের সাথে ভিডিও কলে কথা বলেছেন, প্রতিবাদ মিছিলে হেঁটেছেন। আর বামপন্থীরা ইতিমধ্যে কী করলেন?
তাঁরাও প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। জেলায় জেলায় প্রতিবাদ হবে। যেমন প্রতিবাদ দলীয় বৃত্তের বাইরে থাকা কোন কোন সংগঠনও করছে। শীতলকুচির ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পরেই সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন, সেখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর আচরণের নিন্দা ছিল। বলেছিলেন যে দলের লোকই মারা গিয়ে থাক, নিন্দার ভাষা নেই। সঙ্গে ছিল এই বক্তব্য, যে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করার প্রস্তাব দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সাধারণ মানুষকে প্ররোচিত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী কেন ঘেরাও করার কথা বলেছিলেন, তার আগের ঘটনাবলী কী, সেসব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার সময় সম্ভবত সিপিএম নেতৃত্ব পাননি।
কোন সন্দেহ নেই তৃতীয় দফা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে যে মোটের উপর শান্তিপূর্ণ ভোটদান হয়েছে, বহু জায়গায় মানুষ দশ বছর পর নিজের ভোট নিজে দিতে পেরেছেন, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের আতঙ্ক কেটেছে, তাতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বড় ভূমিকা রয়েছে। যাঁরা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বাদ দিয়ে ভোট করানো হোক দাবি তুলছেন এখন, তাঁদের চোখে হঠাৎ রাজ্য পুলিস ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে গেছে। রাজ্যের বহু মানুষ তাঁদের সাথে একমত হবেন না। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনীও চুপচাপ ভোটারদের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছে তা নয়। রাজ্যের একাধিক জায়গা থেকে তাদের আচার আচরণ নিয়ে মানুষ প্রথম দফা থেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন। কেউ বলছিলেন তারা বিজেপিকে ভোট দেওয়ার জন্য প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে, কেউ বলছিলেন তারাই উত্তেজনার সৃষ্টি করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে আরো গুরুতর কিছু অভিযোগ উঠেছে, ভোটের ডিউটি করে এসে প্রিসাইডিং অফিসাররা সেসব সোশাল মিডিয়ায় লিখেছেন। কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক অভিযোগ উঠেছিল হুগলী জেলা থেকে। সেখানে ৫ই এপ্রিল রাতে একটি দশম শ্রেণির ছাত্রীকে স্কুলবাড়িতে টেনে নিয়ে গিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীর এক জওয়ান শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। সেই জওয়ানকে পুলিস গ্রেপ্তার করেনি। [১]
এই বাহিনীকে যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘেরাও করার কথা বলে থাকেন, তার নিন্দা করা যেতে পারে বড় জোর এই মর্মে, যে এতে উত্তেজনা ছাড়বে, ভোটের মরসুমে তা কাম্য নয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে মানুষের মৃত্যুর পর মমতার ঐ উক্তিকেও উস্কানিমূলক আখ্যা দিয়ে সমানভাবে দায়ী করলে মনে হয়, মৃতেরা বা স্থানীয় মানুষ সত্যি সত্যিই জওয়ানদের আক্রমণ করেছিলেন, তাই তারা গুলি চালিয়েছে। অথচ তেমন কোন ভিডিও ফুটেজ বা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দুদিন পেরিয়ে গেলেও পাওয়া যায়নি। সাত তাড়াতাড়ি পুলিসের বক্তব্য বিশ্বাস করে ঐ বিবৃতি সুজনবাবু দিলেন কেন? ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ কাগজের আজকের সংস্করণ পড়লে সুজনবাবু আরো ধন্দে পড়বেন। কারণ মঈনুদ্দিন চিস্তির প্রতিবেদন বলছে, যে মৃণাল হক অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বলে নাকি জওয়ানরা তাকে সাহায্য করতে যায় এবং গুজব রটে তাকে মারধর করা হয়েছে, তা থেকে অশান্তি শুরু হয়, সেই মৃণাল হকের বাবা-মা বলছেন সে বাজারে গিয়েছিল, তাকে জওয়ানরা অকারণে মারধর করে। সত্য যা-ই হোক, নির্বাচন কমিশনে জমা পড়া রিপোর্টের সাথে এই বয়ান যে মিলছে না। [২] সংযুক্ত মোর্চার নেতৃবৃন্দের চোখেও এইসব অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। আজ কলকাতায় নির্বাচন আধিকারিকের সাথে দেখা করে বেরিয়ে তাঁরা যে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন তাতে তা-ই বোঝা গেল। তাহলে অন্য নেতার মুখ্যমন্ত্রীকে দায়ী করার অত তাড়া ছিল কেন, সে প্রশ্ন রয়ে গেল। [৩]
তবু তো সুজনবাবুর বিবৃতিতে ঘটনার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নিন্দার ভাগ বেশি ছিল। যত সময় গড়িয়েছে, বাম নেতা কর্মীদের ভাষ্যে নিক্তিতে মেপে বিজেপি আর তৃণমূলকে সমান দায়ী করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছে সেলিমবাবুর সাংবাদিক সম্মেলন। শেষকালে তিনি অমিত শাহ আর মমতা — দুজনেরই পদত্যাগ দাবি করে বসলেন। অমিত শাহ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তাঁরই অঙ্গুলিহেলনে এই ঘটনা ঘটেছে — এমন অভিযোগ অনেকেই করছেন। ফলে সেলিম তাঁর পদত্যাগ দাবি করতেই পারেন। কিন্তু কেবল কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করতে বলেছেন বলে মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে, এ যুক্তি হাস্যকর। অবশ্য সেলিমের পক্ষ সমর্থনে বলা যেতে পারে যে তিনি ঐ দুজনের পদত্যাগ করা উচিৎ বলেই সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করে দেন, ফলে মমতার কেন পদত্যাগ করা উচিৎ তার যুক্তি ব্যাখ্যা করার সময় পাওয়া যায়নি। মনে কী দ্বিধা রেখে তিনি চলে গেলেন!
কোন যুক্তি যদি থেকেও থাকে, তা দুর্বোধ্য। কেউ বুঝেছেন বলে মনে হয় না। সাধারণ ভোটারের কাছে বরং এ কথাই প্রতিভাত হল, যে মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্যই যে এই গুলি চালনা, বিজেপি-বিরোধী ভোটারদের বার্তা দেওয়ার জন্যই যে এই নৃশংসতা — বামপন্থীরা তা বুঝলেন না বা বুঝতে চাইলেন না। আমরা তৃতীয় পক্ষ, আমাদের অন্য দুই পক্ষকেই আক্রমণ করতে হবে — এই রাজনৈতিক হীনমন্যতা তাঁদের বিজেপি-বিরোধী ভোটারদের নিজেদের দিকে টেনে আনার প্রয়োজন ভুলিয়ে দিল। বরং এই ভারসাম্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা কেবল সংখ্যালঘু নয়, সবরকম বিজেপি-বিরোধী মানুষ, যাঁরা তৃণমূলের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে মোর্চাকে ভোট দেবেন ভাবছিলেন, তাঁদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দিল। অন্য দিকে এই নির্বাচন পর্বে সম্ভবত প্রথমবার, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শক্তিশালী মনে হল। কারণটা আর কিছুই নয়। বিরোধিতাই তাঁর শক্তি, প্রশাসন চালানো নয়। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী হিসাবে তাঁকে আগাগোড়াই রক্ষণ সামলাতে হচ্ছিল। শীতলকুচির ঘটনা তাঁকে আবার বিরোধী নেত্রীর মত আক্রমণে যাওয়ার সুযোগ এনে দিল।
এ তো গেল বুলি নিয়ে কথাবার্তা। কিন্তু বামপন্থীরা কি কেবল বুলিতেই আটকে থাকবেন? বরাবর তো তাঁদের শক্তি ছিল দ্রুত প্রতিক্রিয়ায় পথে নেমে আন্দোলন। এ বারের নির্বাচনে যে তাঁরা প্রবলভাবে আলোচনার মধ্যে চলে এলেন, তা-ও তো ছাত্র-যুবদের নবান্ন অভিযানের পর। এবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ চাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা দ্বিতীয় তো হলেনই, উপরন্তু সকালবেলায় শীতলকুচিতে গুলি চলার পরে সারাদিনে কোথাও নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষকদের বা বিজেপি নেতাদের ঘেরাও করার মত কোন ঘটনা ঘটল না। শুধু বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি করা হল, ঘটনার দুদিন পরে নির্বাচন আধিকারিকের সাথে দেখা করে মোর্চার আপত্তিগুলো জানানো হল কেবল। এই ঈষদুষ্ণ ব্যবহার কি মৃতেরা তৃণমূলের লোক বলে? তাহলে এ-ও তো হীনমন্যতা।
প্রথম দুটো বেঞ্চের মধ্যে মারামারি হচ্ছে, আমি শেষ বেঞ্চের ছেলে, আমার কী আসে যায়? এই মানসিকতা নিয়ে কি বিরোধী রাজনীতি হয়? সমর্থন বাড়ানো যায়? সময় বলবে। তবে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সিপিএম বলে একটা পার্টি ছিল, যারা কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধী খুন হওয়ার পর তাঁর নিজের পার্টি বনধ ডাকার আগেই বনধ ডেকে দিয়েছিল। যুক্তি ছিল, ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন হত্যা করা আসলে ভারতের গণতন্ত্রকে হত্যার চেষ্টা। তারই প্রতিবাদে বনধ। জানি না ভোট দানের সময় অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করতে আসা বাহিনীর গুলিতে সাধারণ ভোটারের হত্যা গণতন্ত্রকে হত্যা করার চেষ্টা কিনা, সে দিনের নেতারা থাকলে তৎক্ষণাৎ পরদিন বাংলা বনধ ডাকতেন কিনা। কোন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিরোধী আসনে থাকা দল, যদি প্রমাণ করতে চায় তার কাছে মানুষের জীবনের দাম আছে, তাহলে শুধু বুলিতে কি কাজ হয়? জাম্বুবানের ভাষায় “ঢাল নেই তলোয়ার নেই খামচা মারেঙ্গা”?
আমরা যাকে লেখিকা তসলিমার সত্যবাদিতা বলে ভেবেছি, তা কি আসলে শুধুমাত্র তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জারিত মুসলমান বিদ্বেষ?
এই উপমহাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কথা হবে, নারী স্বাধীনতা নিয়ে কথা হবে, আর তসলিমা নাসরিনের নাম আসবে না — এমনটা প্রায় হয় না। ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন এসে পড়লেও একবার না একবার তাঁর নাম ওঠেই। এ বারেও দিন দুয়েক আগে একটা বাংলা খবরের চ্যানেলে দেখলাম বিজেপির মুখপাত্র যুগপৎ তৃণমূল এবং সিপিএমকে আঘাত করতে তসলিমা অস্ত্র ব্যবহার করলেন। অনস্বীকার্য যে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ থেকে তসলিমার বিতাড়ন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বামপন্থীদের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। গোটা কতক গুন্ডার তাণ্ডবে সন্ত্রস্ত হয়ে বামফ্রন্ট সরকার তাঁকে কলকাতা ছেড়ে যেতে বাধ্য করল — এ দৃশ্য কেবল বামপন্থী নয়, কোন উদারচেতা মানুষেরই পছন্দের দৃশ্য নয়। বিশেষত যখন একই সরকার অতীতে পাকিস্তানের ক্রিকেট দলকে শিবসেনা মুম্বাইতে খেলতে দেবে না শুনে সাদরে ডেকে এনেছে। দীপা মেহতাকে হিন্দুত্ববাদীরা বারাণসীতে ‘ওয়াটার’ ছবির শুটিং করতে দেবে না শুনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য স্বয়ং পশ্চিমবঙ্গে আহ্বান করেছেন। তৃণমূল রাজত্বে এক দিকে তসলিমাকে ফিরিয়ে না আনা, অন্য দিকে গজল শিল্পী গুলাম আলিকে অন্য জায়গায় গাইতে দেওয়া হচ্ছে না বলে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে গাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির দ্বিচারিতা নির্দেশ করে। কিন্তু এসব জানা কথার পুনরালোচনা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আলোচ্য তসলিমার বিদ্রোহী, উদার ভাবমূর্তি।
সাহিত্যিক জীবনের শুরু থেকেই তসলিমা পশ্চিমবঙ্গের আদর পেয়েছেন। সম্ভবত নিজের দেশের চেয়েও বেশি সমাদৃত হয়েছেন সীমান্তের এ পারে। অবশ্য তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখাগুলো থেকে জানা যায় পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি জগতের অনেকেই তাঁর প্রতি ঈর্ষায় ভুগতেন, সকলেই তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন না। কিন্তু ঈর্ষা তো যে কোন গুণী মানুষের জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তসলিমার বই যে পশ্চিমবঙ্গের পাঠক একসময় গোগ্রাসে গিলেছেন তা তো আর মিথ্যে নয়। লোকাল ট্রেনে ‘লজ্জা’-র কপিরাইটকে কাঁচকলা দেখানো শস্তা সংস্করণ বিক্রি হতে দেখার অভিজ্ঞতা সে যুগে অনেকেরই হয়েছে। গ্রামীণ লাইব্রেরিতেও একসময় ‘নির্বাচিত কলাম’ ফেরত আসতে না আসতে অন্য কোন পাঠক নিয়ে নিতেন। তাছাড়া এ রাজ্যের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশ যে তসলিমার দুঃসময়ে তাঁর পাশে থেকেছেন তা নেহাত অকৃতজ্ঞ না হয়ে উঠলে তিনি কোনদিন অস্বীকার করবেন না। নিজেই তো লিখেছেন, শিবনারায়ণ রায়ের মত মানুষ নাকি বলেছিলেন বাংলাদেশ তসলিমার বাড়ি হলে পশ্চিমবঙ্গ তার মাসির বাড়ি। মায়ের কাছে থাকতে না পারলে মাসিই তো আগলাবে। এই সমাদরের কারণ কী? কারণটা সহজ।
তিনি এমন একজন সাহিত্যিক, যিনি নিজের লেখার জন্য সামাজিকভাবে কোণঠাসা হয়েছেন, খুন এবং ধর্ষণের হুমকি পেয়েছেন, নিজের দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। যে কোন রুচিশীল স্বাভাবিক মানুষেরই এমন মানুষের প্রতি সহানুভূতি এবং সমর্থন থাকে, অন্তত গত শতাব্দীতে থাকত। ধর্মীয় মৌলবাদীদের বিপক্ষে যাঁরা দাঁড়ান, তাঁদের প্রতিও গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ (অন্তত সাংবিধানিকভাবে) দেশের মানুষের সহমর্মিতা থাকাই স্বাভাবিক। শুধু পশ্চিমবঙ্গ কেন? পাশ্চাত্যেও তসলিমা একই কারণে আশ্রয় পেয়েছেন। কিন্তু মুশকিল হল, ভারতে হিন্দু মৌলবাদের উত্থান হওয়ার পর থেকেই তসলিমার উদারপন্থার সততা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে। ২০১৪ থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, তসলিমা ইসলামিয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে যত সোচ্চার, হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে তার ছিটেফোঁটাও নন। উপরন্তু, প্রকৃত দক্ষিণপন্থীদের মতই তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য যতটা না ধর্মীয় মৌলবাদ, তার চেয়ে বেশি ধর্মাচরণকারী মানুষজন।
গত বছর কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নতুন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ করল এবং দেশজুড়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের সাথে সাথে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিষ্টান — সকলেই প্রতিবাদে পথে নেমে এলেন। কারণ এই আইন স্পষ্টতই সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের বিপরীত এবং মুসলমানদের অনাগরিক করে দেওয়ার প্রথম ধাপ। উদারচেতা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বীর সৈনিক, নারীবাদী আইকন তসলিমা কিন্তু বিপুল সংখ্যক মহিলার অংশগ্রহণে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়াননি। বরং ১৭ জানুয়ারি ২০২০ কেরালা সাহিত্য উৎসবে তিনি আইনটার প্রশংসা করেন, শুধু যোগ করেন তাঁর মত নাস্তিক বা উদারচেতা মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের জন্য এই আইনে বিশেষ ব্যবস্থা থাকা উচিৎ [১]। বিজেপি রাজত্বে পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী তারেক ফতের মতই তসলিমাও হিন্দুত্ববাদের কাজের মানুষ, কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন বোঝা যায়।
তবু তাঁর লেখালিখির ভক্ত কম নেই পশ্চিমবঙ্গে। তসলিমার বিভিন্ন সোশাল মিডিয়া পোস্ট নিয়ে প্রায়শই দু দল বাঙালির মধ্যে তর্ক বেধে যায়। এক পক্ষে ইসলাম ধর্মের ধ্বজাধারীরা থাকেন, অন্য পক্ষে তাঁদের মৌলবাদী বলা মানুষজন থাকেন — ব্যাপারটা ঠিক এরকম নয়। এক পক্ষে এমন হিন্দু এবং মুসলমান থাকেন, যাঁরা মনে করেন তসলিমা ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। অন্য পক্ষে থাকেন সেই হিন্দু এবং মুসলমানরা, যাঁরা মনে করেন তসলিমা অন্যায় কথাবার্তা লিখেছেন। স্বভাবতই দুই ধর্মের মৌলবাদীরাও এই কথোপকথনে ঢুকে পড়ে, কুকথার আদান প্রদান হয়, শেষ অব্দি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয় না। কিন্তু গত পরশু তসলিমা যে টুইট করেছেন, সেটাকে কিছুতেই ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে টুইট বলে চালিয়ে দেওয়ার উপায় নেই।
তসলিমা লিখেছেন ইংল্যান্ডের ক্রিকেটার মঈন আলি ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত না থাকলে সিরিয়ায় গিয়ে ইসলামিয় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আইসিসে যোগ দিতেন। স্পষ্টতই এখানে তসলিমা ইসলামিয় গোঁড়ামিকে আক্রমণ করছেন না। তাঁর লক্ষ্য মঈন আলি মানুষটাই, কারণ তিনি যে মুসলমান তা প্রচ্ছন্ন নয়। তাঁর লম্বা দাড়ি ধার্মিক মুসলমান হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে। তসলিমার তাতেই আপত্তি এবং এই নিষ্ঠুর রসিকতায় তিনি ধার্মিক মুসলমান মাত্রেই সন্ত্রাসবাদী — এই বার্তাই দিতে চাইছেন। অতীতে ভারতীয় মুসলমানদের সম্বন্ধে এ জাতীয় মন্তব্য করে তিনি পার পেয়ে গেছেন, কারণ বর্তমান ভারতের বহু মানুষ তাঁর সমর্থনে উঠে দাঁড়ায়। বিপদে পড়লেন ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারকে নিয়ে টানাটানি করে। মুহূর্তের মধ্যে ইংল্যান্ড দলের জোফ্রা আর্চার, স্যাম বিলিংস, বেন ডাকেট প্রমুখ তসলিমার নিন্দা করে টুইট করেন।
This is the problem with this app. People being able to say stuff like this. Disgusting. Things need to change, please report this account! https://t.co/uveSFqbna0
তাঁদের ভক্তরাও যোগ দেন। লেখিকা আর যা-ই হোন, বোকা নন। তিনি নিজের দেশ ছাড়া অন্য কোন দেশের সংখ্যাগুরুকে চট করে চটান না। তাই পরবর্তী টুইটেই দাবি করেন মঈন সম্বন্ধে টুইটটা ছিল “sarcasm”। লোকে সব বুঝেও তাঁকে আক্রমণ করছে, কারণ তিনি মুসলমান সমাজকে ধর্মনিরপেক্ষ করে তোলার চেষ্টা করেন এবং তিনি ইসলামিয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে:
Haters know very well that my Moeen Ali tweet was sarcastic. But they made that an issue to humiliate me because I try to secularize Muslim society & I oppose Islamic fanaticism. One of the greatest tragedies of humankind is pro-women leftists support anti-women Islamists.
খ্রিষ্টানরা তাঁকে আক্রমণ করছে তিনি ইসলামিয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন বলে — এই বাণীতে চিড়ে ভেজার কথা নয়, ভেজেওনি। অগত্যা তিনি টুইটটা মুছে দেন। অবশ্য দুঃখপ্রকাশ করেননি। উপরন্তু প্রথম টুইটের সমালোচনায় লিবারেশন নেত্রী কবিতা কৃষ্ণণ তাঁকে “garden variety bigot” বলায় দাবি করেছেন কবিতা তাঁর বিরুদ্ধে “ফতোয়া” দিচ্ছেন। এই শব্দের ব্যবহার থেকেই পরিষ্কার তসলিমার বিরুদ্ধে কথা বলা যে কোন মানুষই তাঁর কাছে ইসলামিয় মৌলবাদী। প্রথমে অন্যকে অকারণে আক্রমণ করা, তারপর প্রতিবাদের সম্মুখীন হলে নিজেকেই আক্রান্ত বলে দাবি করা এক চিরায়ত দক্ষিণপন্থী কায়দা। তসলিমা সেটা চমৎকার রপ্ত করেছেন দেখা যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হল, এই যে এতগুলো বছর ধরে আমরা, আমাদের শিল্পী সাহিত্যিকরা তাঁকে মাথায় করে রেখেছি তাঁর লেখনীর জন্য, সেটা কি স্রেফ বোকামি? আমরা যাকে লেখিকা তসলিমার সত্যবাদিতা বলে ভেবেছি, তা কি আসলে শুধুমাত্র তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জারিত মুসলমান বিদ্বেষ? আমরা, ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা, নেহাত বাংলাদেশের হিন্দুদের নির্যাতনের কথা পড়তে ভাল লাগছিল, মুসলমান সমাজে মেয়েদের কোন স্বাধীনতা নেই –- এই স্টিরিওটাইপে তসলিমার লেখা চমৎকার খাপ খাচ্ছিল বলেই কি এতকাল তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছি? কখনো সখনো অন্য ধর্মের গোঁড়ামি নিয়েও তিনি লিখেছেন সত্যি। কিন্তু যে ধারাবাহিকতায় এবং তীব্রতায় তিনি ইসলাম ধর্মকে আক্রমণ করেন, একইভাবে হিন্দু ধর্মকে আক্রমণ করলেও আমাদের এই উদারতা বজায় থাকত তো?
তসলিমা কি সত্যিই হিন্দুত্বের ট্রোজান ঘোড়া, যাকে আমরা চিনতে পারিনি? নাকি এই মুহূর্তে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার করে নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য তিনি তীব্র মুসলমান বিদ্বেষ প্রদর্শনের রাস্তা নিয়েছেন? আপনাকে, আমাকে, সবাইকেই তো শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচাবার জন্য আপোষ করতেই হয়। তসলিমাই বা ব্যতিক্রম হবেন কী করে? তিনি বিখ্যাত হলেও শেষপর্যন্ত একজন নিরস্ত্র, ক্ষমতাহীন মানুষই তো।
এই যুক্তিতে ক্রিকেটে যাকে benefit of doubt বলে, তসলিমা সেটা পেতে পারেন। কিন্তু তাহলে মেনে নিতে হবে তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিক নন, নারীস্বাধীনতার লড়াকু আইকন নন। কারণ সেই স্তরের মানুষের পিঠ বাঁচানোর অধিকার থাকে না। মেয়েদের জন্য লড়ছি, সংখ্যালঘুদের জন্য লড়ছি, অথচ সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হতে পারব না, একথা বললে চলে না। দুই বাংলার যেসব মানুষ, বিশেষ করে মহিলা, তসলিমাকে উচ্চাসন দিয়েছিলেন; মঈনের কাছে না হলেও তাঁদের কাছে তসলিমাকে একদিন কৈফিয়ত দিতেই হবে।