
পূর্বকথা: মালিনী বিপ্লবকে বলে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু বিপ্লব রাজি নয়। আজকের পশ্চিমবঙ্গে সে ফিরতে চায় না।
জোনাকি আজ মহা ব্যস্ত।
বহুকাল এত উৎসাহ নিয়ে ভোরবেলা থেকে ওকে রান্নাবান্নায় নামতে দ্যাখেনি রবীন। দুদিন ধরেই আচার আচরণ কেমন অন্যরকম লাগছে। সাধারণত আকাচা জামাকাপড় বাথরুমের বাইরে একটা গামলায় ডাঁই হয়ে পড়ে থাকে; কাচা জামাকাপড়গুলোও ইস্তিরি হয়ে, ভাঁজ হয়ে আলনায়, আলমারিতে ওঠার অপেক্ষায় রবীন আর জোনাকির খাটের এক কোণে পড়ে থাকে দিন দুয়েক, যতক্ষণ না রবীন খেয়াল করে ইস্তিরির দোকানে দিয়ে আসে। আজ ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রবীন গামলাটাকে দেখতে পায়নি, আকাচা জামাকাপড়গুলোও উধাও।
ঝুল ঝাড়তে ইদানীং একটু অসুবিধা হয় রবীনের। কাশি শুরু হয়, থামতেই চায় না। তাই কয়েক মাস ধরে নিয়মিত ঝাড়া হচ্ছে না। কাল বিকেলবেলা রবীনকে অবাক করে জোনাকি নিজেই বাড়ির সমস্ত ঝুল ঝেড়ে ফেলেছে। সন্ধ্যায় হেঁটে এসে দেখা গেল, বইয়ের তাকগুলো ঝাড়াঝাড়ি চলছে, এবং তাতে সাহায্য করার জন্যে রত্নাকেও ডেকে আনা হয়েছে এটা ওর কাজের সময় না হওয়া সত্ত্বেও। রবীন বাড়ি ঢোকার পর রত্নাকে নিয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে জোনাকি বেরিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার সময়ে বলে গিয়েছিল “আমি একতলাটা পরিষ্কার করে দিয়েছি। তুমি উপরটা করে দিও।” রবীন মাথা নেড়ে টিভিটা অন করল দেখে ভুরু কুঁচকে বলেছিল “আজই কোরো। কাল আর সময় পাওয়া যাবে না।” কেন এই আয়োজন, কে আসছে — সেসব প্রশ্ন করার সুযোগও দেয়নি। রবীন উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে দোতলায় গিয়ে বিপ্লবের পড়ার টেবিলের ঢাকাটা কেচে মেলে দিয়েছিল, বিছানার চাদরটাও বদলে দিয়েছিল।
কাল যখন বাজার করে ওরা ফিরল, তখনই টের পাওয়া গিয়েছিল দু রকমের মাছ আর খাসির মাংস এসেছে। অতিথির আগমন সম্পর্কে তখনই নিশ্চিত হয়েছিল রবীন। রাতে খেতে বসে জিজ্ঞেস করেছিল “কে আসছে কালকে? তোমার ভাই বোনেরা কেউ?”
রবীন ভেবেছিল জোনাকি হয়ত বিরক্ত হবে। তা তো হলই না, বরং ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এনে বলেছিল “না না, বছরের এই সময় কে আসবে? অফিস কাছারি নেই? বিপ্লবের এক বন্ধু আসবে কালকে।”
“বন্ধু! কোথাকার বন্ধু? গত দশ বছরে তো ওর কোন বন্ধু আসেনি এ বাড়িতে!”
“এ ওর অফিসের বন্ধু।”
“ও, তাই বলো। কোলিগ।”
“আহা, কোলিগ কি বন্ধু হতে পারে না নাকি?”
“নিশ্চয়ই পারে। আমার কোলিগরা তো বরাবরই বন্ধুর কাজ করেছে। কিন্তু এদের তো সময়টা আলাদা। তোমার ছেলেই তো বলত ওদের ফিল্ডে সবাই নাকি সবার কম্পিটিটর, বন্ধুত্ব করতে কেউ অফিস যায় না।”
“তোমার কি মনে কোন ভাল কথা আসে না?” জোনাকি এতক্ষণে রেগে যায়। “বিপ্লব যখন বলেছে বন্ধু, তখন বন্ধু বলে ভাবতে অসুবিধা কোথায়?”
“ও আচ্ছা। বিপ্লব বন্ধু বলেছে। আমি তো সেটা জানতাম না…”
“বলার সুযোগটা দিলে কখন? একটার পর একটা প্রশ্নই করে চলেছ।”
তখন রবীনের ঝগড়া করার একটুও ইচ্ছে ছিল না। তাই সে আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শেষ করে দোতলায় শুতে চলে গিয়েছিল।
সকাল থেকে নাকে নানারকম সুগন্ধ আসছে। রবীন একবার রান্নাঘরের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল “এক কাপ চা পাব কি? নাকি বাবলুর দোকানে যাব?”
“রত্না, ইন্ডাকশনে চা করে দে দাদাকে,” জোনাকি আদেশ করল।
কিছু পরে রত্না যখন চা করে নিয়ে খাওয়াতে এল, রবীন ওকেই জিজ্ঞেস করল “কে আইতাছে রে? এত রান্নাবান্না কার জইন্য?”
“ভাইয়ের বন্ধু।”
“আরে সে তো তোর কাকিমাই আমারে কইছে। তরে কেন জিগাইলাম বোঝস না? ভিতরের খবরটা দে।”
রত্না ফিক করে হাসে, তারপর উঁকি মেরে দেখে নেয় জোনাকির সহসা রান্নাঘর থেকে এদিকে আসার সম্ভাবনা আছে কিনা। তারপর গলা নামিয়ে বলে “কাকু, মনে হয় ভায়ের গালফ্রেন্ড।”
“কস কী? ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড হইছে নাকি? কাকিমা নিজে কইছে?”
“না কাকু, কাকিমায় কয় নাই। আমি বুইঝ্যা গেছি।”
“কী কইরা বুঝলি?”
“কাকিমা তো কিছুই কইতাছিল না। আমিই বন্ধু শুইন্যা জিগাইলাম ‘পোলা না মাইয়া’। তহন কইল ‘মাইয়া’।
“ধুর। এই দ্যাশে আইসা এত বচ্ছর হইল, তুই এহনো মডার্ন হইতে পারলি না, রত্না। মাইয়া বন্ধু হইলেই গার্লফ্রেন্ড হয় না। আগে হইত।”
“আরে না, কাকু। তুমি বিশ্বাস করো, আমি ঠিকই বুঝছি।”
“তুই তো প্রমাণ দিতে পারতাছস না।”
“আছে প্রমাণ। সেই কলকাতা থিকা এইটুক একখান জিনিস দেবার লগে আইতাছে। ভাইরে নিশ্চয় খুব ভালবাসে। নইলে কেউ অ্যাদ্দূর আসে? তুমিই কও।”
“অ। কী জন্য আইতাছে তাও তুই জাইন্যা ফেলছস?”
“হ্যাঁ গো। কাকিমার লগে ভাই নাকি একখান বিদেশী সেন্ট কিনছিল, গেল বার যহন আইছিল তহন ভুইল্যা গেছিল বোধহয়। তাই এই মাইয়াডার হাত দিয়া পাঠাইছে।”
“কুরিয়ার না কইরা এর হাত দিয়া পাঠাইছে? তাইলে হয়ত তুই… আইচ্ছা কোথা থিকা আইতাছে কইলি? কলকাতা?”
“হ। কাকিমায় তো তাই কইল। তাছাড়া দ্যাখতাছ না কাকিমা কিরম ধুমধাম করতাছে? নিশ্চয় পোলায় মায়েরে কিছু কইছে।”
সব মিলিয়ে রত্নার যুক্তি যে অকাট্য, রবীন তা অস্বীকার করতে পারে না। ও চা খাওয়া শেষ করে কাপ ডিশ নিয়ে চলে যায়, রবীন ধন্দে পড়ে যায়। ছেলে মা-কে তার ভালবাসার কথা বলেছে জেনে আনন্দও হয়, আবার একটু আঘাতও লাগে। ছেলে যে শেষ অব্দি কেরিয়ারের বাইরেও জীবন আছে বলে ভাবছে এটা জেনে ভাল লাগছে। আর কষ্ট হচ্ছে, যে ছেলে কথাটা প্রথমে বাবাকে বলল না। অথচ বয়ঃসন্ধিতে বিপ্লবের যত ব্যক্তিগত উথাল পাথাল সে সব তো ও বাবাকেই বলত প্রথমে। মায়ের সাথে তো এই সখ্য ছিল না। বরং বাপ ব্যাটা মিলে অনেক কথাই লুকিয়ে রাখত জোনাকির থেকে। সেই যে একটা মেয়ে ছিল ইতিহাস স্যারের ব্যাচে, যে টুকটুকে ফরসা আর যার বাঁ হাতের পাতায় একটা বড় আঁচিল। তাকে নিয়ে কবিতা লিখে তো মাকে নয়, বাবাকেই দেখাত বিপ্লব। বন্ধুদের সাথে ঝগড়া, মনোমালিন্য, টিউশন বাদ দিয়ে বন্ধুর বাড়িতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে যাওয়া — সবই তো বাবার সাথে ষড় করেই বিপ্লব করত ছোটবেলা থেকে। আজ যখন জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটা নিল, তা থেকেই বাদ দিয়ে দিল? নাঃ। এ নিয়ে মন খারাপ না করাই ভাল। এসব স্বার্থপর মনখারাপের সময় নয় এটা। বাবা তো আর কারো চিরকাল থাকে না। ছেলে জীবনসঙ্গিনী খুঁজে নিয়েছে এটাই বড় কথা। এতে নিরানন্দ হওয়ার আছেটা কী? জোনাকির প্রতিক্রিয়াটাই তো ঠিক। হবু বৌমা প্রথমবার আসছে বাড়িতে, বাড়িটা ঝকঝকে তকতকে রাখাই তো দরকার। ভালমন্দ খাওয়ানোও উচিৎ।
ভাবতে ভাবতে মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠল। ভাবল দাড়িটা কামিয়ে আসা দরকার। কলকাতার মেয়ে, যদি এসে দ্যাখে একটা সাতপুরনো লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে রবীন বসে আছে, কী ধারণা হবে এ বাড়ির লোকেদের সম্পর্কে? দাড়িটা কামিয়ে এসে চট করে স্নানটা করে নিয়ে একটা ভাল পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে থাকতে হবে। গায়ে চাদরটা বেশ করে জড়িয়ে নিয়ে রবীন রান্নাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আবার। জোনাকি মুখ তুলে বলে “আবার কী?”
রবীন স্নিগ্ধ হেসে বলে “শোনো না।”
“এখন আমার সময় নেই। কী বলবে বলো না।”
“আহা, শোনোই না,” বলেই জোনাকিকে হ্যাঁচকা টানে রান্নাঘরের বাইরে টেনে আনে রবীন।
“কী হচ্ছে কি বুড়ো বয়সে? রত্না রয়েছে…”
“আরে তা এত করে ডাকছি, রোজ রোজ কি আর ডাকি?” রবীন বলতে বলতেই টের পায় নিজের গলাটা প্রায় বিয়ের পরের সময়কার মত শোনাল। অবশ্য তখন স্বর এতটা কাঁপত না।
রত্না খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে “কাকিমা, কী কপাল কইরা জন্মাইছিলা! আমার আর আমার বরের কাকুর আদ্দেক বয়স। এখনই য্যান আমারে চেনেই না।”
রবীন সেসবে কান না দিয়ে জোনাকিকে টেনে আনে ঘরে। তারপর কোমরটা জড়িয়ে ধরে বলে “একটু পয়সা দাও। দাড়িটা কামিয়ে আসি। তোমার ছেলের বউ আসছে শুনলাম। শ্বশুরমশাইকে একটু ফিটফাট তো থাকতে হবে।”
“কে বলেছে? কে বলল এই কথা? নিশ্চয়ই রত্না? তোমার আমাকে জিজ্ঞেস করে শান্তি হয়নি, আবার ওকে জিজ্ঞেস করতে গেছ?”
“তাতে কী হয়েছে? রত্না তো আমাদের নিজেদের লোক। তুমি কিছু বললে না দেখে…”
“ও। এখন থেকে আমার বাড়ির ব্যাপারে তুমি আমায় জিজ্ঞেস না করে রত্নার থেকেই সব খবর নিও তাহলে? কে আসছে, কে যাচ্ছে, কী রান্না হচ্ছে, কজন খাবে? সবই তাহলে এবার থেকে রত্নাই ঠিক করুক।”
“আহা, তুমি অত রেগে যাচ্ছ কেন? আমার তো শুনে আনন্দ হচ্ছে, রত্নাও তো আনন্দ করেই বলল। ও বিপ্লবকে সেই ছোট থেকে দেখছে… ওর তো নিজের ভাইয়ের মতই…”
“তা তো বটেই। বিপ্লব সবার নিজের, আমার ছাড়া। আমি নিজের ইচ্ছা মত কিছু করতে পারব না। সারা রাজ্যের লোককে কৈফিয়ত দিয়ে বেড়াতে হবে।”
“কি আশ্চর্য!”
রান্নাঘর থেকে আহত রত্না জোনাকির কথার প্রতিবাদ করতে শুরু করল। রবীন জানে আগামী কয়েক ঘন্টা বাড়িতে কাক চিল বসবে না। তাই সে দাড়ি কামানোর সংকল্প ত্যাগ করে এমনিই বেরিয়ে পড়ল। হরিমতীর ঝিলের ধারে এসে বসল। শীতের মিঠে রোদে চাদর গায়ে ওখানে বসলে মন্দ লাগে না। পকেট হাতড়ে একটা বিড়ি আর লাইটারটা খুঁজে পাওয়া গেল। দুটো টান দিতেই — কাশি। কাশির দমক থামলে রবীন ভেবে দেখল দাড়ি না কামিয়ে ভালই হয়েছে। বোঝাই তো যাচ্ছে ছেলে, ছেলের মা — কেউই চায় না ব্যাপারটার মধ্যে রবীনকে জড়াতে। হয়ত বিপ্লবই মাকে বলে দিয়েছে “বাবার সাথে বেশি আলাপ টালাপ করানোর দরকার নেই।” সত্যিই তো। রবীন গাঁয়ের স্কুল মাস্টার বৈ তো নয়। সবুজগ্রামের অলিগলি দিয়ে এখন যতই অটো দৌড়াক, যতই লোকের ঘরে ঘরে ফ্রিজ, কালার টিভি, ওয়াশিং মেশিন থাক, বছর কুড়ি আগেও যে এখানে সন্ধের পর শিয়াল ডাকত সে কথা তো আর মিথ্যে নয়। আর রবীনরা এত বছর ধরে চেষ্টা করেও তো সবুজগ্রামকে পঞ্চায়েত থেকে মিউনিসিপ্যালিটি করে তুলতে পারল না। কলকাতার আল্ট্রা মডার্ন একটা মেয়ে আসছে এত দূরে, তার সাথে গাঁইয়া স্কুল মাস্টারের কথাবার্তা যত কম হয় তত ভাল। জোনাকি নিজে কলকাতার মেয়ে, ও বরং সামলাতে পারবে। ছেলে সেটা ঠিকই বুঝেছে। মেয়েটার যদি রবীনকে দেখে শুনে মনে হয় “এর ছেলে আর কত আধুনিক হবে?” তাহলে বিপদ। সম্পর্কটা যদি আর না এগোয়? নাঃ। দরকারের চেয়ে বেশি কথাবার্তা বলা যাবে না। কোনরকমে খাওয়ার সময়টুকু। তারপরই রবীন সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাবে কোথাও, কোন একটা মিটিঙের নাম করে।
“ও রবীনদা, ও রবীনদা।” পার্টি অফিসের পাশ দিয়ে হেঁটে বাড়ির রাস্তায় ঢুকতে গিয়ে ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। মুদির দোকান থেকে সত্য ডাকছে।
“এই যে ইনি আপনার বাড়ি খুঁজছেন।” কাছে যেতে সামনে দাঁড়ানো একটা অল্পবয়সী মেয়েকে দেখায় সত্য।
“ওঃ, আপনিই বিপ্লবের বাবা? আমি ওর বন্ধু মালিনী।”
বলেই মেয়েটা একটা প্রণাম করে। বিপ্লব আটকানোর সুযোগ পায় না।
“চলুন, কাকু। ভালই হল আপনাকে পেয়ে গেলাম। এদিকটায় আমি আসিনি কখনো। বিপ্লব ম্যাপ এঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আমার একটু লেফট রাইট গুলিয়ে যায়। তাই হেজিটেট করছিলাম।”
রবীন ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কী বলা উচিৎ না উচিৎ। মেয়েটাই বলে যেতে থাকে হাঁটতে হাঁটতে।
“আপনি এত স্মোক করেন কেন? আমি অটো থেকে নেমেছি আপনার সামনেই। দেখলাম মনের সুখে বিড়ি খাচ্ছেন। চিনলে তক্ষুণি বকা দিতাম। বেলা বারোটা বাজতে চলল। এখন তো স্নান, খাওয়া করার সময়। বয়স হচ্ছে। এত অনিয়ম করবেন না। জীবনের অনেকটাই তো অনিয়মে কেটেছে আপনার। এখন তো একটু শরীরের দিকে নজর দিন।”
রবীনের ভারী অবাক লাগে। বাচ্চা মেয়েটা এমনভাবে কথা বলছে যেন বহুদিন চেনে। আর শেষ কথাটা সবচেয়ে অদ্ভুত।
“আমার জীবন অনিয়মে কেটেছে তুমি জানলে কী করে, মা?”
“এটা না জানার কী আছে? আপনি জেল খেটেছেন, পুলিসের তাড়ায় পালিয়ে বেড়িয়েছেন, তখন কি আর টাইমে খাওয়া টাইমে শোয়ার উপায় ছিল?”
“তুমি দেখছি আমার সম্বন্ধে অনেক খোঁজখবর নিয়ে এসেছ,” রবীন না হেসে পারে না।
“এই তো। এটা তো আপনাদের বাড়ি।”
রবীন আবার অবাক হয়।
“কী করে জানলে?”
“বিপ্লব বলে। আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে একটা বিশাল মাঠ আর সামনে একটা আম গাছ, একটা নারকেল গাছ। আম গাছটা মা পুঁতেছিল, নারকেল গাছটা বাবা।”
রবীনের আজকাল চেঁচাতে বেশ কষ্টই হয়। কিন্তু বেল বাজানোর কথাটা ভুলে গিয়ে জোনাকির নাম ধরে ডেকেই ফেলল। ডাকতে গিয়ে গলাটা ভেঙে গেল। মেয়েটা, যেন স্নেহে, কাঁধে হাত রেখে বলল “কাকু, আমি বেলটা বাজিয়ে নিচ্ছি।”
জোনাকি দৌড়ে এল।
“ইশ! আমার রান্নাবান্না শেষ হয়নি, এই জামাকাপড়ের অবস্থা, তার মধ্যেই তুমি এসে পড়লে?”
মেয়েটা জুতো ছেড়ে জোনাকিকে প্রণাম করে বলল “এ রাম! আপনি ওরকম ফর্ম্যালিটি করবেন না, কাকিমা। আমার মা কি বাড়িতে সারাক্ষণ সেজেগুজে থাকে নাকি? আর আমায় তুই করে ডাকবেন। কাকু, আপনিও কিন্তু তুমি বলবেন না।”
কোথায় বাড়ি, বাড়িতে কে কে আছেন, বাবা কী করেন, মা চাকরি করেন কিনা — জোনাকি কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব প্রশ্ন সেরে ফেলল। মেয়েটাও ভারী সরল বলে মনে হল রবীনের। প্রত্যেকটা প্রশ্নেরই বিস্তারিত উত্তর দিল। রবীন তফাতে বসে শুনল আর কেবলই মনে হতে লাগল, এতখানি আনন্দ নিয়ে বহু যুগ এ বাড়িতে কেউ আসেনি। ওকে দেখে, ওর কথা শুনে আনন্দ না পাওয়াই শক্ত। ও যেন অন্ধকারে একটুখানি আলো নিয়ে এসেছে, চলে গেলেই আবার সব আঁধারে ঢেকে যাবে।
জোনাকি “রান্নাটা নামিয়ে আসি” বলে ছুটে গেল। রবীন এতক্ষণে ফুরসত পেয়ে জিজ্ঞেস করল “তোমার বাবা তাহলে রাজনীতি করেন?”
“বাবা, মা দুজনেই। তবে মা হোলটাইমার নয়। স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডে আছে।”
“কিছু মনে কোরো না, একটা কথা জিজ্ঞেস করি… কোন পার্টি?”
“আপনার পার্টি।”
“ও, তাই?”
“হ্যাঁ। বাবা তো সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে পার্টি করছে। মার সাথে তো পার্টি করতে গিয়েই আলাপ।”
রবীন ভারী খুশি হয়ে ওঠে। মেয়েটা উঠে এসে ওর পাশের চেয়ারে বসে।
“কাকু, আপনার তো সেই নাইন্টিন সিক্সটি নাইনে মেম্বারশিপ, না?”
“বা রে! তুমি এটাও জানো?”
“আবার তুমি? তুই বলুন। বলুন তুই।”
“তুমি আপনি আজ্ঞে করলে আমার সঙ্কোচ কী করে কাটবে?”
“আচ্ছা আমিও কাকু, তুমিই বলব। এবার তুই বলো।”
“আচ্ছা বল, আমি ঊনসত্তরে পার্টি মেম্বারশিপ পেয়েছি কী করে জানলি?”
“বিপ্লব বলেছে। তখন পার্টি করা খুব শক্ত ছিল, না কাকু?”
“পার্টি করা সব সময়েই শক্ত রে, মা। তখন ক্ষমতা ছিল না, নানারকম বিপদ ছিল। পেছনে পুলিশ, গুন্ডা, খুনেরা লেগে থাকত। জীবনের ঝুঁকি ছিল। তারপর সাতাত্তরে পার্টি ক্ষমতায় এল, তখন বিপদগুলো বদলে গেল।”
“লাইক?”
“তখন সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে গেল প্রলোভন। মানুষকে একটা অন্যরকম সরকার দেয়ার লড়াই ছিল আমাদের। সেটা করতে গেলে নানারকম বিপদ হয়। ক্ষমতা নিজেও একটা বিপদ, বুঝলি না? ক্ষমতায় যা নেশা হয়, মদ, গাঁজা, হেরোইনে হয় না।”
“সেসব বিপদ কাটিয়ে তোমরা তো অনেক ভাল ভাল কাজ করেছ।”
“করেছি? হ্যাঁ, কিছু ভাল কাজ তো করেছি বটেই। যথেষ্ট করেছি কিনা কে জানে? আমরা নিজেরা তো আর বিচার করতে পারি না, বিচার করবে মানুষ। আর ইতিহাস।”
“তোমার সাথে দেখা করার আমার খুব ইচ্ছে ছিল, কাকু। সেই জন্যেই বিপ্লব কাকিমার জিনিসটা দিতে আসতে বলল আর আমি রাজি হয়ে গেলাম।”
“আমার সাথে?” বছর পনেরো পরে এমন কথা শুনল রবীন। নিজের কানকেই বিশ্বাস হল না। “কেন রে?”
“তোমার মত লোক যে আমি দেখিনি। আজকাল আর দেখাও যায় না।”
“আমিও তো তোর মতন মেয়ে দেখিনি রে,” রবীন মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে। “কিন্তু আমি এমন কী করলাম রে, মা?”
“বিপ্লব তোমার কথা এত বলে দিন রাত। আমার মনে হয় আমি তোমাকে অনেকদিন থেকে চিনি।”
“আমার কথা বলে?” বিপ্লব আনন্দ গিলে ফেলে। “কী বলে?”
“কত্ত গল্প। সেই যে একবার একটা লোক তোমাকে শার্ট প্যান্টের পিস ঘুষ দিতে এসছিল… তখন তুমি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। লোকটাকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলে… তারপর সেই ব্রড ডে লাইটে রাস্তার মধ্যে কে একটা মস্তান খুন হয়েছিল… কেউ ভয়ে পুলিশে খবর দিচ্ছিল না। তুমি গিয়ে দাঁড়ালে, পুলিশের কাছে লোক পাঠালে। পুলিশ আসা অব্দি তুমি ওখানেই দাঁড়িয়েছিলে, লোকজন সব দূর থেকে সিনেমার শুটিং দেখার মত দেখছিল… তারপর তোমার স্কুলেরও অনেক গল্প আছে।”
“বাপ রে। তোকে তো আমার পুঙ্খানুপুঙ্খ বলে দিয়েছে দেখছি।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। এই ঘরে একটা ছবি আছে না?” মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে সবকটা দেয়াল দেখতে থাকে। “ওগুলো তো তোমার বাবা-মা মনে হচ্ছে। তাহলে সেই ছবিটা কোথায়?”
“কোনটা রে?”
“ঐ যে… তোমার পলিটিক্সের গুরু যে ভদ্রলোক? হীরেন্দ্রনাথ কী যেন?”
“ওহো! হীরুদার ছবিটা। ওটা অনেক পুরনো ছবি তো… নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই স্টুডিওতে দিয়েছি। ওরা নাকি কিসব ডিজিটাল কি করে দেবে, তাতে আর নষ্ট হবে না বলল।”
“হ্যাঁ, ওনার কথাও বলে বিপ্লব।”
“হীরুদার কথা! ও তো হীরুদাকে বোধহয় একবারই দেখেছে! একবার পার্টি সম্মেলনে এখানে এসেছিলেন, জোনাকি আর বিপ্লবকে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম। তার কথা কী বলে ও?”
“বোধহয় তোমার কাছে শোনা কথাগুলোই বলে খুব বাহাদুরি নেয়।”
“হাঃ হাঃ হাঃ। তাই হবে।”
“আচ্ছা কাকু, তুমি এখনো যাত্রা করো?”
“না রে। সে অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি। আসলে গলার জোর না থাকলে যাত্রা করা যায় না তো। আমার গলার অবস্থা তো দেখলি। জোরে ডাকতে গিয়ে ভেঙে গেল।”
“হ্যাঁ, আর এই অবস্থাতেও তুমি স্মোক করেই যাচ্ছ। ভেরি ব্যাড।”
“আরে আমার অসুখটা তো অনেক দিনের। নিউরোলজিক্যাল প্রবলেম। তার সাথে স্মোক করার কী সম্পর্ক?”
“যে কোন রোগই স্মোক করলে বেড়ে যায়। আমি যখন নেক্সট টাইম আসব, যেন দেখি তুমি ছেড়ে দিয়েছ।”
“আর কি পারব রে, এই বয়সে?”
“ঠিক পারবে। এমন কিছু বয়স হয়নি তোমার। তুমি তো লাস্ট মানথ রিটায়ার করেছ। সো জাস্ট সিক্সটি।”
“ও, ষাটটা কোন বয়স নয়?”
“নট অ্যাট অল। আমার দাদু এইট্টি সিক্স। এখনো মিছিলে হাঁটে। মর্নিং ওয়াক করে আমাদের বাড়ি থেকে হেদুয়া অব্দি যায়, আবার আসে। দাদুও কিন্তু চেন স্মোকার ছিল। আমি হওয়ার পরে সিগারেট খেলে মা কোলে দিত না বলে ছেড়ে দিয়েছিল। তাই জন্যে এখনো এত ফিট।”
“বল, বল, তুইই বল। আমরা বললে তো শোনে না,” জোনাকি এসে বলে। ও থাকতে মেয়েটা অন্য কারো সাথে কথা বলতে পারবে না। রবীন আবার কাগজটা নিয়ে বসে।
চোখ থাকে কাগজের দিকে কিন্তু মনটা চলে যায় হায়দরাবাদে, ছেলের কাছে। মিথ্যে ভয় পাচ্ছিল রবীন। বিপ্লব মোটেই মনের মানুষের কাছ থেকে বাবাকে লুকিয়ে রাখতে চায়নি। বরং যতটা সম্ভব ভাগ করে নিয়েছে। বাবাকে নিয়ে ছেলের গর্ব না থাক, লজ্জা নেই তাহলে। বেশ নিশ্চিন্ত লাগে, তন্দ্রা আসে।
তন্দ্রা কাটে মেয়েটার ডাকে। হেসে খুন হচ্ছে ও।
“কাকু, তুমি এরকম বসে বসে ঘুমাও কী করে? আমাকে একটু শিখিয়ে দাও না। অফিসে বেশ বসে বসে ঘুমিয়ে পড়ব, বস টেরও পাবে না।”
“বয়স হলে এরকমই হয় রে। তুই যখন বুড়ি থুড়থুড়ি হবি, তখন তোরও হবে।”
“আচ্ছা এখন খেতে চলো। আমার হেব্বি ক্ষিদে পেয়ে গেছে। কাকিমা যে মিষ্টিগুলো দিয়েছিল সব হজম হয়ে গেছে। তোমাদের জলে কিছু একটা আছে মনে হয়।”
রবীন খেয়াল করে দেখল এই মেয়েটার কম খাওয়ার বাতিক নেই। জোনাকি যা যা রান্না করেছিল, সবই চেটেপুটে খেল। শেষে আবার বলল “কাকিমা, পরের বার এসে না ডিমের ডালনা খাব। বিপ্লব খুব বলে তোমার ডিমের ডালনার কথা। হাফ করে কাটা আলু দিয়ে নাকি করো?”
খাওয়ার পরে ওকে বিপ্লবের ঘর দেখাতে নিয়ে যায় রবীন।
“আচ্ছা কাকু, এই ঘরটাতেই কি লোডশেডিং হয়ে গেলে তুমি শুয়ে শুয়ে গান করতে আর বিপ্লব তোমার বুকের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে থাকত?”
“ইশ! ছেলেটা আবার এসবও বলেছে তোকে? এ কি একটা বলার কথা?”
“বলো না, বলো না।”
“না রে, এটা সেই ঘর নয়। সেটা একতলার বড় ঘরটা। বিপ্লবের ছোটবেলায় এই ঘরটা ছিলই না। ওর মাধ্যমিকের আগে হাউজ বিল্ডিং লোন নিয়ে এ ঘরটা করিয়েছিলাম।”
“হুম। তোমার আজ গলাটা ভাঙা তাই ছেড়ে দিচ্ছি। পরের দিন এসে গান শুনব।”
“ধুর। আমি কি গান গাইতে পারি নাকি? বিপ্লব তখন ছোট ছিল, তাই ওর ভাল লাগত।”
“বললেই হল? তুমি যথেষ্ট ভাল গাইতে পারো। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’ শুনতে শুনতে তোমার ছেলে এখনো কাঁদে। বলে বাবার গাওয়া মনে পড়ে যায়।”
“সে কতকাল আগের কথা। তখন আমার গলাটা… কাঁপলেও… মোটামুটি ঠিক ছিল। এখন তো মাঝে মধ্যেই ভেঙে যায়। এমনিতেও এত কাঁপে…”
“সে দেখা যাবে। এ বারে তো সময় পাচ্ছি না। পরের বার এসে তোমার সব ডাক্তারের পেপারস নিয়ে বসব। গুছিয়ে একটা মেল করব ভেলোরে। এখন অনেক কাটিং এজ রিসার্চ হচ্ছে। দেখব ওরা কী বলে?”
“তুই পরের বার এসে আর কী কী করবি, মা? এত লোভ লাগিয়ে দিস না। এরপর তো পথ চেয়ে বসে থাকব। মেয়েটা কবে আসবে, কখন আসবে?”
বকবকে মেয়েটা রবীনের হাত ধরে চুপটি করে বসে কয়েক সেকেন্ড। চোখের দিকে তাকিয়ে বলে “আসব তো। অনেকবার আসব।” রবীন ভাবে এই বুঝি চোখে জল এসে গিয়ে একটা কেলেঙ্কারি হল। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বিপ্লবের বইয়ের তাকটার কাছে গিয়ে বলে “দাঁড়া, তোকে একটা জিনিস দেখাই।”
বিপ্লবের কবিতার খাতাগুলো পেড়ে আনে। পাতা উল্টে মেয়েটার চোখ চড়কগাছ।
“বিপ্লব কবিতা লিখত?”
“দেখেছিস? তোকে এত কথা বলেছে আর এটা বলেনি। এক সময় ছেলেটা একেবারে অন্যরকম ছিল রে। সে বিপ্লব যে কোথায় গেল… খুব ছোটবেলা থেকেই এত তফাত ছিল আর পাঁচজনের সাথে… জানিস, যেদিন বাবরি মসজিদ ভেঙে দিল… ওর সামনে পরীক্ষা… সন্ধেবেলা একটা মিটিং সেরে বাড়ি ঢুকেছি, দেখি ছেলে হাঁ করে টিভির সামনে বসে আছে, আর জোনাকি চেঁচাচ্ছে। চেঁচানোরই কথা। আমি বললাম ‘কী রে? পড়াশোনা নেই? টিভি দেখছিস?’ বলল ‘বাবা, নরসিমা রাও বক্তৃতা দিচ্ছে দ্যাখো। সর্বনাশ হয়ে গেল, এখন ভাল ভাল কথা বলছে। যে কথার কোন মানে নেই।’ আমি বললাম ‘তা বলে তুই পড়তে বসবি না?’ বলে ‘বসব। এক্ষুণি পড়তে বসে লাভ হবে না, বাবা। আমার মন বসছে না। একটু আগে অমুক জেঠু এসে বলে গেল আমাদের স্কুলের ওখানে নাকি দাঙ্গা লেগেছে। আমাদের ক্লাসের অনেকগুলো ছেলে ওখানে থাকে যে।’”
রবীনের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে মেয়েটা ওর হাত দুটো ধরল। বলল “কাকু, বিশ্বাস করো, তোমার ছেলে এখনো অন্যরকম।”
“হ্যাঁ, ছেলে তো আমার ভালই,” রবীন সম্বিত ফিরে পেয়ে বলে। “তুই এক কাজ কর তো, মা। ঐ যে খাতাটায় অনেকগুলো পাতা খালি, ওটা নিয়ে যা। একবার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দেখিস তো ওকে দিয়ে আবার লেখাতে পারিস কিনা?”
সন্ধে নামল, যাবার সময় হল। আরেকটু হলেই যে জন্যে আসা সেটাই ভুলে যাওয়া হচ্ছিল। ছেলের কেনা বিদেশী পারফিউমের শিশি হাতে পেয়ে ভীষণ আহ্লাদ হলেও জোনাকি নিজের কাজটা ভোলেনি। রবীনের এসব মাথায় আসে না, দেখে খুশিই হল যে জোনাকি মেয়েটার জন্যে একটা সালোয়ার কামিজের পিস কিনে রেখেছিল। তবু, রবীনের ইচ্ছে হল আলাদা করে কিছু দেয়। কী দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞেস করে নিল “মা, তুই বাংলা বই পড়িস তো?” উত্তর পেয়ে নামিয়ে আনল বিপ্লবের নিজের হাতে কেনা ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’। বন্ধু খুন হওয়ার পর ছেলে রাগে নিজের তাক থেকে যে বইগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল তার মধ্যে ছিল এটা। “তোর পড়া?”
“না গো। আমি শুধু সেই গানটা জানি।” মেয়ে গাইতে শুরু করে “ভেদি অনশন মৃত্যু তুষার তুফান / প্রতি নগর হতে গ্রামাঞ্চল। / কমরেড লেনিনের আহবান / চলে মুক্তি সেনাদল।”
গান শেষ হতে রবীন আর থাকতে পারে না, জড়িয়ে ধরে। “খুব ভাল, খুব ভাল। ভাল হও, মা গো। বড় হও।” কলম হাতে নিয়ে লিখে দিতে গিয়ে খেয়াল হয় “তোর নামটা যেন কী?”
“সে কি গো! সারাদিন এত গল্প করলে, নামটাই খেয়াল করোনি?” জোনাকি ভারী অবাক হয়।
“আমার নাম তো মালিনী।”
রবীন বহু কষ্টে বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতটাকে ঠেসে ধরে কাঁপা অক্ষরে লিখতে বাধ্য করে
স্নেহের মালিনীকে
— রবীনকাকু
২৫শে জানুয়ারী ২০১০ ।।
মালিনী চলে যাওয়ার পর বহুক্ষণ ওর বলে যাওয়া কথাগুলো নিজের মনে ফিরে ফিরে শোনে রবীন৷ কখনো দ্যাখেনি, ফোনেও কথা বলেনি যে মেয়ে, সে শুধু বিপ্লবের কথায় কি অকারণ শ্রদ্ধা করে তাকে! ছেলেটা এত কাছে আছে, অথচ দেখতেই পায়নি রবীন। এমন হতভাগা বাপ রে তোর, বিপ্লব?
“জোনাকি। শুলে নাকি?”
“না, জেগেই আছি। বলো।”
“বিপ্লবকে একটু ফোনে ধরো তো।”
“এখন? এই সময় তো অফিসে থাকে।”
“করো না। বলো বাবা কথা বলবে। দু মিনিট।”
“তুমি! তুমি ফোন করছ বিপ্লবকে? তোমার হল কী? মালিনী তো ম্যাজিক জানে দেখছি।”
“পরে পেছনে লেগো,” রবীন মৃদু হেসে বলে। “আগে ফোনটা করো।”
রিং হতেই জোনাকি রবীনের হাতে রিসিভারটা দেয়।
“হ্যালো।”
“হ্যালো। তুই কি এখন ব্যস্ত?”
“কে! বাবা!”
“হ্যাঁ রে। একটু কথা বলতাম। যদি ব্যস্ত থাকিস…”
“না না, ব্যস্ত না। বলো।”
“আজ তোর মানসী এসেছিল।”
“মানসী? ও, মালিনী।”
“তোর তো মানসীই। সে এসেছিল।” ওপাশ থেকে উত্তর আসে না। রবীন কান পেতে থাকে। লম্বা নীরবতার পর একটা অপ্রস্তুত হাসির শব্দ আসে মনে হয়। আবার মনে হয় হয়ত হাসি নয়, হয়ত চেপে রাখা কান্না। ছেলে ডাকে “বাবা।” রবীন অতি কষ্টে বলে “বল বাবা।”
*এই উপন্যাসের সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। কোন সত্যি ঘটনা বা জীবিত/মৃত ব্যক্তির সাথে মিল পাওয়া গেলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। কিছু বাস্তব চরিত্রের নাম এসেছে কেবল সময়কাল বোঝাতে
ভাল লাগলে টাকা দিতে পারেন Google Pay / Paytm / BHIM বা অন্য UPI অ্যাপের মাধ্যমে journopratik@okhdfcbank কে
অথবা
নেট ব্যাঙ্কিং বা অন্য উপায়ে নিম্নলিখিত অ্যাকাউন্টে
Pratik Bandyopadhyay
A/c No. 14041140002343
HDFC Bank
Branch: South Calcutta Girls’ College
IFS Code: HDFC0001404
MICR Code: 700240048