ক্রিকেটার তুমি কার?

এই দল আর ভারতের কৃষকদের হয়ে খেলে না। প্রবল অর্থনৈতিক মন্দায় গত এক বছরে যারা চাকরি খুইয়েছে, এ দল তাদেরও নয়।

১৯৯৯-এর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে কলকাতার আশেপাশে এ বারের মত হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ছিল না। চেন্নাইতে অবশ্য বছরের কোন সময়েই ঠান্ডা বলে কিছু থাকে কিনা তা বিতর্কের বিষয়। সেখানকার চিপকে চলছিল ভারত বনাম পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচ। ৩০শে জানুয়ারি, অর্থাৎ ম্যাচের তৃতীয় দিন, বিকেলে যখন খেলা শেষ হল তখন চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য ২৭১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ভারতের দুই ওপেনার আউট, ক্রিজে রাহুল দ্রাবিড়। এবং আমাদের নয়নের মণি শচীন তেণ্ডুলকার। “জেতালে ও-ই জেতাবে” — সকলের এমনটাই ধারণা। ওয়াসিম আক্রাম, ওয়াকার ইউনিস, সাকলেন মুস্তাককে সামলে আর কে জেতাতে পারে? রাহুল বড়জোর ম্যাচ বাঁচাতে পারেন। আজহার পারেন না, এমনকি সৌরভ পারেন বলেও আমরা কেউ ভাবছিলাম না। পরদিন দেখা গিয়েছিল, আমরা ভুল ভাবছিলাম না।

আমরা মানে রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের ছাত্ররা। বেলুড় মঠের ঠিক পাশেই আমাদের আবাসিক কলেজ; স্বামী বিবেকানন্দের নাকি স্বপ্ন ছিল এই কলেজ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আমাদের স্বভাব চরিত্র মোটেই অপাপবিদ্ধ ব্রহ্মচারীসুলভ ছিল না। আমরা বিলক্ষণ ক্লাস পালাতাম, স্টাডি আওয়ারে পাঁচিল টপকাতাম নানা কারণে। ক্রিকেট দেখা তার মধ্যে অবশ্যই একটা। ৩১শে জানুয়ারি ম্যাচের ফয়সালা হবে। সেদিন অবশ্য ক্লাস পালাবার দরকার ছিল না। কারণ দিনটা রবিবার। আমরা এক দঙ্গল সেদিন সকালেই হোস্টেল থেকে পলাতক। বেলুড় বাজারের আশেপাশে একগাদা ক্লাব। কোনটা সদ্যনির্মিত তৃণমূল কংগ্রেস প্রভাবিত, কোনটার বাইরে ঝোলে কাস্তে হাতুড়ি আঁকা লাল পতাকা। কোনটা অমুক গ্রামরক্ষী বাহিনী, কোনটা তমুক সংঘ। আমাদের মত হোস্টেল পালানো ক্রীড়ামোদীদের জন্য সকলেরই অবারিত দ্বার। কারণ পার্টি যার যার, ক্রিকেট সবার। ভারতীয় ক্রিকেটাররাও সবার।

সেদিন সকাল থেকে আবার বেলুড়ের সর্বত্র প্রবল বিদ্যুৎ বিভ্রাট। বামপন্থী আমি, আমার এক বিজেপি সমর্থক বন্ধু আর মোটের উপর অরাজনৈতিক জনা দুয়েক — এই চারজন টিভির খোঁজে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে চলেছি। এই এখানে বসে শচীনের স্কোয়ার কাট দেখে মুগ্ধ হচ্ছি, পরক্ষণেই দৌড়তে হচ্ছে অন্য কোথাও, কারণ কারেন্ট চলে গেছে। শুধু আমরা চারজন নয়, একযোগে দৌড়ে বেড়াচ্ছে আমাদের কলেজের বিভিন্ন ব্যাচের জনা পঞ্চাশেক। কেউ এ ক্লাবে অন্ধ ভি কে রামস্বামীর দুবার ড্রপ পড়া বলে সৌরভকে আউট দেওয়া দেখেছে, কেউ ও ক্লাবে দেখে বুঝেছে আজহারের এল বি ডব্লিউ সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না।

এইভাবে সারা দুপুর অক্লান্ত দৌড়াদৌড়ি করে আমরা শচীন আর নয়ন মোঙ্গিয়ার জুটিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছি। ধর্মসঙ্কট উপস্থিত হল শচীন নব্বইয়ের ঘরে ঢুকে পড়ার পর। দেখা গেল গোটা এলাকা একসাথে বিদ্যুৎহীন। আমরা আক্ষরিক অর্থে পথে বসে পড়েছি। তারপর কোন একজন সিনিয়র ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল, ঐ মোড়ে কংগ্রেসের পার্টি অফিসে টিভি চলছে। সে রাস্তা থেকে দেখেছে। কিন্তু ওরা কি যাকে তাকে ঢুকতে দেবে? দল বেঁধে দৌড়নো হল ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অফিসের দিকে। একজন বুক ঠুকে দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কাকু, একটু খেলা দেখা যাবে? মাথা দোলানোর অপেক্ষা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সদলবলে কংগ্রেস ত্যাগ করার পর অতগুলো ছেলে একত্রে সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের কোন কংগ্রেস অফিসে ঢোকেনি। কিন্তু আমি আর আমার বিজেপি বন্ধু ইতস্তত করছি। তখনো বামেদের সমর্থনে কেন্দ্রে ইউ পি এ সরকার হয়নি, বরং কয়েক বছর আগেই সিপিএমের তাত্ত্বিক নেতারা কংগ্রেসের সমর্থনে সরকারে যাবেন না জেদ করে জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া আটকে দিয়েছেন। সেই কংগ্রেস অফিসে ঢুকব? আমার বিজেপি বন্ধু আবার দাবি করে সে আসলে গুজরাটি, মাত্র কয়েক পুরুষ আগেই তার পূর্বপুরুষ গুজরাট থেকে বাংলায় এসেছিলেন। সবচেয়ে বিখ্যাত গুজরাটি মহাত্মা থেকে সোনিয়া পর্যন্ত সব গান্ধীকেই সে ঘৃণা করে। তাদের ছবিওলা পার্টি অফিসে সে ঢোকে কী করে? শেষ পর্যন্ত দুজনেই অবশ্য বুক ঠুকে ঢুকে পড়লাম। শচীন জিতে গেলেন, পতাকাগুলো হেরে গেল। কারণ ওগুলো বিভিন্ন দলের পতাকা, শচীনের হাতে যে ভারতের পতাকা।

ম্যাচটা অবশ্য শচীন জেতাতে পারেননি। শেষের দিকে পিঠের ব্যথায় কাবু হয়ে চটজলদি খেলা শেষ করার চেষ্টায় বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উইকেট দিয়ে আসেন। তাঁর চারজন টিমমেট মিলে বাকি এক মুঠো রান করে উঠতে পারেননি। সেই হারের ধাক্কা এত প্রবল ছিল যে আমরা অনেকেই সেদিন সন্ধ্যায় পড়াশোনা করতে পারিনি। কেউ কেউ রাতে খেতেও যায়নি ডাইনিং হলে। এই বিষাদ কেন? কারণ ভারতীয় ক্রিকেট দল সবার হয়ে খেলে। শচীন যখন ব্যাট করতেন, আমাদের সবার হয়ে ব্যাট করতেন। বিরাট কোহলি, অজিঙ্ক রাহানে, চেতেশ্বর পুজারা, ঋষভ পন্থ — সকলেই সব ভারতীয়ের প্রতিনিধি। এমনটাই আমরা জানতাম। এবার বোধহয় মেনে নিতে হবে, ভুল জানতাম। ওঁরা আসলে বি সি সি আই নামে এক প্রাইভেট কোম্পানির কর্মচারী। সে কোম্পানির মালিকানা এখন বিজেপি নেতা তথা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সুপুত্র জয় শাহের হাতে। অতএব ক্রিকেটাররা এবং ক্রিকেট এখন কেবল বিজেপি আর তার সমর্থকদের। তা নাহলে ব্যতিক্রমহীনভাবে সকলে কৃষক আন্দোলন নিয়ে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে টুইট করতে যাবেন কেন? শুভমান গিল বাদে সকলেই তো এতদিন চুপ করে ছিলেন। এমনিতে তো এঁরা দেশের কোন ব্যাপারে মুখ খোলেন না, স্বর্গের দেবতাদের মত থাকেন। হঠাৎ এই বেলা একযোগে মর্ত্যে অবতরণের দরকার পড়ল কেন?

তথ্যের খাতিরে স্বীকার করতেই হয় যে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড ২০০৪ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে বলেছিল, ভারতীয় ক্রিকেট দল হল “the official team of BCCI, not the official team of India”. কিন্তু তারপর আরব সাগর দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্ট রীতিমত কমিশন বসিয়ে বোর্ড ভেঙে দিয়ে অ্যাড হক কমিটি দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট চালিয়েছেন বেশ কিছুদিন। তারপর নতুন বোর্ড গঠন হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে অভূতপূর্ব বদল হয়েছে। রাজনীতিবিদদের ক্রিকেট প্রশাসনে অংশগ্রহণ চিরকাল ছিল। মাধবরাও সিন্ধিয়া, এন কে পি সালভে, শরদ পাওয়ারের মত কংগ্রেস নেতারা বোর্ডের সর্বোচ্চ পদেও থেকেছেন। তা বলে স্টেডিয়ামের বাইরে অরুণ জেটলির মত তাঁদের বিশাল মূর্তি বসানো হয়নি। ক্রিকেটারদের দিয়ে সরকারের প্রচার চালানো হয়নি। এখন নোটবন্দি হতে না হতেই বিরাট কোহলি পণ্ডিতের মত বলে দেন স্বাধীন ভারতে এটাই সবচেয়ে বিপ্লবী পদক্ষেপ। পুলওয়ামা বিস্ফোরণ, যার তদন্তে সরকার আদৌ মাথা ঘামাল না, সেই বিস্ফোরণে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ভারতীয় দল খেলতে নামে আর্মি ক্যামোফ্লাজ ক্যাপ পরে। যদি তারপর ভারতীয় ক্রিকেটাররা বা অধিনায়ক বিরাট সরকারকে প্রশ্ন করতেন পুলওয়ামার শহীদদের মৃত্যুর জন্য কারা দায়ী তার তদন্ত হল না কেন? ধৃত দাবিন্দর সিং কেন জামিন পেল? তাহলে তবু ঐ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনকে বিশ্বাস করা যেত। যেহেতু তা করা হয়নি, সেহেতু ভারতীয় ক্রিকেট দলকে সরকারী মুখপাত্র ছাড়া কিছু ভাবা শক্ত।

এই দল আর ভারতের কৃষকদের হয়ে খেলে না। প্রবল অর্থনৈতিক মন্দায় গত এক বছরে যারা চাকরি খুইয়েছে, এ দল তাদেরও নয়। কারণ তাদের সম্বন্ধে ক্রিকেটাররা টুইট করেন না। হঠাৎ লকডাউনে কাজ হারিয়ে যে প্রবাসী শ্রমিকরা কয়েকশো মাইল পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন, অনাহারে অর্ধাহারে বেঁচেছেন বা মারা গেছেন, তাঁদের নিয়ে টুইট করার সময়ও বাবুদের হয় না। যতই মহম্মদ সিরাজ বাবার মৃত্যু ভুলে থেকে প্রাণপণ বোলিং করে বিদেশের মাঠে জয়ের রাস্তা দেখান, এই দল নিজেকে ভারতের প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধি মনে করে কিনা তা-ও সন্দেহজনক। কারণ অস্ট্রেলিয়ায় নিজেদের ক্রিকেটাররা বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্যের স্বীকার হওয়ার আগে পর্যন্ত এরা #BlackLivesMatter আন্দোলনের প্রতি কোন সমর্থন জানায়নি। জর্জ ফ্লয়েড কাণ্ডের পর শুরু হওয়া ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে খেলোয়াড়রা এক হাঁটু মুড়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত মাথার উপরে তুলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, কিন্তু আই পি এল শুরু হয়েছিল ওসব ছাড়াই। ১৯ সেপ্টেম্বর আরম্ভ হওয়া প্রতিযোগিতায় ২৬ অক্টোবর হার্দিক পান্ডিয়া প্রথম ওভাবে প্রতিবাদ করেন, তাও একক প্রয়াসে। অথচ ভারত সরকারের যে কোন সিদ্ধান্ত সমর্থন করতে এই ক্রিকেটাররাই এক পায়ে খাড়া। সুতরাং এই ভারতীয় ক্রিকেট দলকে সেই ১৯৯৯-এর মত আমি আর আমার বিজেপি সমর্থক বন্ধু — দুজনেই নিজের দল বলে দাবি করতে পারি না বোধহয়। আমার মত লোকেরা এখন সেই বন্ধুর চোখে তো বটেই, ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের চোখেও দেশদ্রোহী।

আরো দুঃখের কথা, সেদিন যে ক্রিকেটারদের সাফল্যকে নিজেদের সাফল্য বলে আমরা মনে করতাম, যাঁদের ব্যর্থতায় আমরা কান্নায় ভেঙে পড়তাম, তাঁরাও আর আমাদের সকলের নন। বিরাট নাহয় বি সি সি আই-এর চাকুরে, শচীন তো তা নন। অনিল কুম্বলেও নন। তবু তাঁরা বাকি পৃথিবীর নিন্দার হাত থেকে সরকারকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন। সে কি এঁরা আম্বানিদের বেতনভুক কর্মচারী বলে? এই দুজনের বিতর্ক এড়িয়ে চলা কিন্তু জগদ্বিখ্যাত। শচীন তো বিতর্ক থেকে এতটাই দূরে থাকতে পছন্দ করতেন যে ম্যাচ ফিক্সিং কাণ্ডে অপরাধীদের শাস্তি হয়ে যাওয়ার পরেও বলেছিলেন তিনি নাকি ঐ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না, কিছুই দ্যাখেননি। হঠাৎ মধ্যবয়সে এসে বিতর্কের ভয় উধাও! আর আমাদের প্রথম যৌবনের বিপ্লবী অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির কথা যত কম বলা যায় তত ভাল। তিনি এখন শালগ্রাম শিলা। পদ ধরে রাখতে নিজের মেয়েকেও সোশাল মিডিয়া পোস্ট ডিলিট করতে বাধ্য করেন। অসুস্থ শরীরেও গতকাল শচীন, কুম্বলের টুইট রিটুইট করেছেন, কর্তব্যে অবহেলা নেই।

এতদিন জানতাম দুঃসময়ে বন্ধু চেনা যায়। দেখা গেল দুঃসময়ে আইকনও চেনা যায়।

https://nagorik.net/ এ প্রকাশিত। ছবি ইন্টারনেট থেকে।