
পূর্বকথা: বাড়িতে ফোন করে বিপ্লব জানতে পারে নির্বাচনী প্রচারে বেরিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে বাবা। জেনে উদ্বিগ্ন হয়। বাবা অবশ্য সে উদ্বেগকে পাত্তা দেয় না। বেশ কড়া ভাষাতেই জানিয়ে দেয়, বাবার শরীর নিয়ে বা সবুজগ্রামের আর পাঁচজনকে নিয়ে তার ভাবার দরকার নেই।
এ বারের ভোটে খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে। প্রচারে বেরিয়ে এই অনুভূতিটা রবীনের শেষবার হয়েছিল সেই বাহাত্তরের নির্বাচনে। না, তাও নয়। সেবার মনে হয়েছিল ফলাফল কী হবে সেটা বড় কথা নয়, কংগ্রেস ভোটটা ঠিক করে হতে দেবে তো? এবার তা নয়। এবারের অনুভূতিটা রবীন নিজেকেও ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারছে না। আসলে এবার মানুষ যেন কেমন চুপচাপ। কিছুতেই যেন কিছু এসে যায় না। শেষ কবে এত নির্লিপ্ত লেগেছিল ভোটারদের? রবীন অনেক চেষ্টা করেও কিছুতেই মনে করতে পারল না।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে হারব জেনেই অনেকগুলো নির্বাচনের প্রচারে নামতে হয়েছে। তখনো কিন্তু সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মানুষের চোখে শ্রদ্ধা দেখতে পেয়েছে সে। কমিটেড কংগ্রেস ভোটারদের বাড়িতেও চা খাওয়ার প্রস্তাব পাওয়া গেছে, গরীব দিনমজুরও জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে সামান্য কটা টাকা চাঁদা দিয়েছে। সবুজগ্রাম, ক্ষেত্রগ্রাম, বড়িহাটার প্রত্যেকটা গলি, চণ্ডীমণ্ডপ, পুকুর, ডোবা, ঝোপঝাড় রবীন চেনে তার বাড়ির প্রত্যেক কোণের মত। প্রচারে বেরোলেই আগ্রহী মানুষের এগিয়ে এসে কথা বলা, মৃদু অভাব অভিযোগ, কারো শুধু হেসে হাতটা তোলা — এসব বড় ভাল লাগে রবীনের। আর লম্বা মিছিলে একজন স্লোগান তুললে যেই অন্যরা গলা মেলায়, অমনি আজও সেই জোয়ান বয়সের মত গা শিরশির করে ওঠে। নিজেকে হঠাৎই সর্বশক্তিমান মনে হয়। মানুষের এমন কষ্ট নেই যা একদিন দূর হবে না, এমন মানুষ নেই যাকে সাহায্য করা যাবে না — এমন বোধ হয়। ইদানীং তার সঙ্গে চোখ দুটোও ছলছল করে ওঠে৷ পাঁচ-ছ বছর হল কাঁপার অসুখটা বেড়ে যাওয়ায় স্লোগান দেওয়ার সময় গলাটা আর অত উপরে ওঠে না। সকলের মধ্যে নিজের গলাটা অনেক সময় আলাদা করে শুনতে পায় না রবীন। তবু, এই যে রাস্তায় অনেকের সাথে এক লক্ষ্যে হাঁটা, একসাথে গলা মেলানো — এসবে আশ্চর্য শক্তি পাওয়া যায় আজও। নির্বাচনী প্রচারে বেরিয়ে প্রতিবারই রবীনের মনে হয় মানুষ গাইছে, আর ও সেই সুর শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু এবার যেন কেমন বেসুরো ঠেকছে। বহুদিনের চেনা লোকগুলোর থেকেও কোন বেতার তরঙ্গ রবীনের কাছে এসে পৌঁছচ্ছে না। বা হয়ত পৌঁছচ্ছে, রবীন ধরতে পারছে না।
এই নিয়ে বড় দুশ্চিন্তায় কাটছিল। রাতে ঘুম হচ্ছিল না ঠিকঠাক, কেবলই পাগল মহারাজের কথাগুলো মনে পড়ছিল। সেই ৯৬-৯৭ সালের কথা। সে বছর পার্টি সদস্যরা অনেকেই অসন্তুষ্ট জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেওয়া হল না বলে। জ্যোতিবাবু নিজেও বললেন সিদ্ধান্তটা ঐতিহাসিক ভুল। সেই সময়ে এক বিকেলের আড্ডায় মহারাজ বলেছিলেন “মাস্টারমশাই, যতক্ষণ মানুষ পাশে আছে ততক্ষণ ভুল সিদ্ধান্তও আপনার পার্টির গায়ে লাগবে না। যখন মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবে, তখন আবার ঠিক সিদ্ধান্তেও শাস্তি পেতে হবে।” ইউ পি এ সরকারের থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তটা কি সেরকমই একটা হয়ে দাঁড়াবে শেষ অব্দি? রবীনের কেবলই মনে হচ্ছে মানুষের মন বদলে গেছে। কেন মনে হচ্ছে?
বড়িহাটার বিরাট ফুটবল মাঠে সেই ষাটের দশক থেকে পার্টি বিরাট বিরাট জনসভা করেছে। জ্যোতিবাবু এসেছেন অনেকবার। প্রমোদ দাশগুপ্ত, বিনয় চৌধুরী, হরেকৃষ্ণ কোঙার, শৈলেন দাশগুপ্ত, বিমান বসু — কেউ বাদ যাননি। সেই মাঠে জনসভা হল। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন প্রধান বক্তা। যথারীতি মাঠ কানায় কানায় ভরে গেল। কিন্তু দর্শকাসনে বসে রবীনের মনে হল মাঠ জুড়ে মাত্র কয়েকজন মানুষ। বেশিরভাগ যেন কিছু শুনছে না, শুনতে চাইছেও না। টিউশন পালিয়ে কজন ছেলে এসেছে মিটিং শুনতে? রবীন বারবার বোঝার চেষ্টা করল। রাতের রান্নাবান্না দুপুরেই সেরে রেখে কতজন গৃহবধূ এসেছে? কতজন পার্টি সদস্য সপরিবারে এল? মাঠের আশপাশের সম্ভ্রান্ত বাড়ির ছাদগুলো থেকে উঁকি মারছে কি কেউ, অন্তত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে একবার চাক্ষুষ করার লোভে? রবীন হতাশ হল।
পরদিন হরিমতীর ঝিলের ধারে বসে বিড়ি ধরিয়ে আশঙ্কাটার কথা ফাল্গুনী আর শিবুকে বলল রবীন। আজকাল তো এসব কথা যে কোন কমরেডকে বলা যায় না। তাছাড়া এই দু তিনজন ছাড়া আর কোন কমরেডই বা বলরাম আর এল সি এস শ্যামলের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীনের সাথে আড্ডা মারতে আসে?
“না, এবার বিরোদীরা আগের চেয়ে ভাল ফল তো করবেই। মমতা যে মানুষের মধ্যে ছাপ ফেলেচে সে তো ঠিকই,” শিবু বলে।
“আমরাই তো দিনে দিনে বড় নেত্রী বানালাম ওকে। আমরাই ওর মাথা ফাটালাম, আমরাই এক গাদা ভুল করলাম। কি তাই না, রবীনদা?” ফাল্গুনী জিজ্ঞেস করে।
“সেটা আছে, তবে ও-ও ঠিক জায়গায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তো। ভিখারি পাসোয়ান বল, সিঙ্গুর বল, নন্দীগ্রাম বল। ও ঠিক গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তো,” চিন্তিত রবীন বলে। “কিন্তু সেটা বড় কথা না। আসলে কে কত বড় নেতা, নেত্রী হবে সেটা ঠিক করে সাধারণ মানুষ। তাদেরই আমরা চটিয়ে ফেলেছি বলে আমার ধারণা।”
“মানুষ চটেচে। তার সুফল মমতা পাবে ঠিকই। গোটা দশেক সিট এবার জিতবে ওরা। তার মধ্যে আমাদেরটাও থাকতে পারে। তার বেশি না,” শিবু বেশ জোরের সঙ্গে বলে। রবীন চুপ করে থাকে।
“ও মা!” ফাল্গুনী অবাক হয়। “তুমি কি বলছ তার চেয়েও বেশি পাবে?”
“ঠিক বুঝতে পারছি না রে। যা যা মনে হচ্ছে সবটার পেছনেই যে কোন যুক্তি দিতে পারব তা না। কিন্তু যা হবে মনে হচ্ছে… তা যেন সত্যি না হয়।”
“আপনি তো ভয় পাইয়ে দিচ্চেন, রবীনদা,” শিবু হেসে বলে। “এতটা খারাপ ভাবচেন কেন? হ্যাঁ, এবারের ভোট শক্ত ভোট। কিন্তু শক্ত ভোট তো আপনি অনেক করেচেন। চুরাশি সালের ভোট ভাবুন। ইন্দিরা খুন হল বলে ওরা কি সমর্থন পেল! তাও পশ্চিমবাংলায় আমাদের থেকে বেশি তো পেল না। এবার তৃণমূলও নয় ১২-১৪ টাই পাবে।”
“রবীনদা অবশ্য সেই সিঙ্গুরের সময় থেকে বলছে মানুষের ধৈর্য শেষ,” ফাল্গুনী বিড়বিড় করে। “তার মধ্যে প্রকাশ কারাত আবার এরকম একটা কাণ্ড করতে গেল… লোকে কিন্তু ভালভাবে নেয়নি।”
“রেখে দে তোর প্রকাশ কারাত,” রবীন একটু রেগেই যায়। “এখানে বত্রিশ বছর আমাদের সরকার চলছে, লোকে কারাত কী করল তাই দেখে ভোট দেবে?”
শেষ অব্দি রবীন ওদের খুলে বলতে পারল না তার ঠিক কী মনে হচ্ছে। আসলে ওদের কথা শুনে নিজেরও মনে হল, হয়ত অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে ও। অকারণে। হয়ত তার জন্যে শরীরটাও কিছুটা দায়ী। কদিন ধরে সেই বুকের ভেতর অস্বস্তিটা বেশ ঘনঘন হচ্ছে। বিড়ি খেলেও যাচ্ছে না। তার উপর মিছিলে বেরিয়ে মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে গিয়ে এক বিশ্রী কাণ্ড হল। তাই হয়ত একটু বেশি নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা মনে আসছে। এসব মন থেকে ঝেড়ে ফেলাই ভাল। জোনাকি বোধহয় ঠিকই বলে। বয়স হচ্ছে সেটা মেনে নিয়ে অনিয়ম করা কমানো উচিৎ। তাহলে শরীর, মন দুটোই ভাল থাকবে।
প্রচারের শেষ দিনেও কিন্তু মনের মধ্যে খুঁতখুঁতুনি থেকেই গেল। সন্ধের পর পার্টি অফিসে একটা মিটিং শেষ করে রবীন বাড়ি ফিরতে গিয়ে বুঝল, হাত পা আর চলছে না। আসলে সেই অসুস্থতার পরেও পরিশ্রমটা তো আর কমানো যায়নি, ভোটের মরসুমে সেটা সম্ভবও না। অনভ্যাস থেকেই হয়ত এত ক্লান্তি। আগের মত তো সারা বছর পরিশ্রমটা করা হয় না। করলে তো ক্ষমতাবানদের গোঁসা হবে। ভাববে রবীন ঘোষাল বুড়ো বয়সে আবার নেতা হওয়ার চেষ্টা করছে। একমাত্র এই ভোটের সময়টাতেই বাবুদের আপত্তি থাকে না। কে জানে, হয়ত তখন বাবুদের মনে হয় এই বুড়োটার এখনো দাম আছে? মরা হাতিও তো লাখ টাকা হয়।
বাড়ি ঢুকতেই লোডশেডিং। আজকাল এই সময়ে লোডশেডিং হয় না সাধারণত। রবীন ভেবেছিল গা ধুয়ে একটা ঘুম দেবে, তাতে যদি শরীরটা ঠিক হয়। তার উপায় রইল না। গা ধুয়ে এসে অবশ্য অনেকটা ভাল লাগল। মুড়ি চা খেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রবীন দেখল ঘরের ভেতর ভীষণ গরম থাকলেও, বাইরে চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে। না বলবে ধরে নিয়েই জোনাকিকে বলল “মাদুরটা কোথায় গো? চলো না একটু মাঠে গিয়ে বসি। ঘরে যা গরম।” কে জানে সূর্য সেদিন কোন দিকে অস্ত গিয়েছিল? জোনাকি “তুমি যাও” না বলে বলল “চলো।”
উল্টো দিকের মাঠে মাদুর পেতে বসল দুজনে। কতদিন পরে? রবীন ভেবে দেখল অন্তত কুড়ি বছর পরে তারা দুজন মুখোমুখি বসেছে। শুধু দুজনে। কৃষ্ণ পক্ষ চলছে, তার উপর সারা পাড়ায় লোডশেডিং, তাই মুখ দেখা যাচ্ছে না। ভালই হল। দুজনে দুজনকে দেখে মুগ্ধ হওয়ার দিন কবে চলে গেছে। এখন একান্তে মুখোমুখি হলে হয়ত হাজারটা অভিযোগ মনে পড়বে দুজনেরই। এই আড়ালটুকুর সুযোগে রবীন একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলল।
“একটা গান করো না, জোনাকি?”
“ধুত! দেখছ না মাঠে আরো লোক রয়েছে?”
“তাতে কী?”
“গান ফান আমার আর আসে না। তোমার হেঁসেল ঠেলতে ঠেলতে আমার সব গেছে।”
রবীন আর ঘাঁটাল না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর নিজেরই গাওয়ার ইচ্ছে হল। গলার অবস্থা, আশপাশে ছড়িয়ে থাকা প্রতিবেশীদের উপস্থিতি সত্ত্বেও রবীন না গেয়ে থাকতে পারল না। “আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে।” গলাটা খুব কাঁপলেও নেহাত খারাপ লাগছিল না নিজের কানে। কিন্তু “তার ছিঁড়ে গেছে কবে” তে গিয়ে একেবারে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। রবীন প্রাণপণে হেসে উঠে বলল “ধুস শালা। গলাটা অ্যাক্কেরে গেছে গিয়া।” ঠিক তক্ষুণি বাড়ির সামনে একটা রিকশা এসে থামল। অন্ধকারে জোনাকি আর রবীনের বোঝার কোন উপায় ছিল না কে এল। রিকশাওয়ালা ভাড়া নেওয়ার সময় “দে না তোর যা ইচ্ছে” বলছে দেখে রবীন ভুরু কুঁচকে ভাবছিল কে হতে পারে। হঠাৎ জোনাকি লাফিয়ে উঠল “ও মা! তুই?” তারপর কদিন আগে একটা বিয়ের প্যান্ডেল হয়েছিল বলে মাঠে যে গর্তগুলো হয়ে আছে সেগুলোর কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে থপথপিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দিল। রবীনের বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। ছেলেটা খবর না দিয়ে এমন হঠাৎ চলে এল! শরীর খারাপ? নাকি অফিসে কোন গোলমাল? চাকরিটা আছে তো? রবীনও তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। মাদুর গোটাতে গোটাতে শুনতে পেল ছেলে মাকে জিজ্ঞেস করছে “বাবা এখনো ফেরেনি? প্রচার তো পাঁচটায় শেষ হয়ে গেছে।”
ভাল লাগলে টাকা দিতে পারেন Google Pay / Paytm / BHIM বা অন্য UPI অ্যাপের মাধ্যমে journopratik@okhdfcbank কে
অথবা
নেট ব্যাঙ্কিং বা অন্য উপায়ে নিম্নলিখিত অ্যাকাউন্টে
Pratik Bandyopadhyay
A/c No. 14041140002343
HDFC Bank
Branch: South Calcutta Girls’ College
IFS Code: HDFC0001404
MICR Code: 700240048