
পূর্বকথা: কলেজে পড়ার সময় এস এফ আই করত বিপ্লব। এ আই ডি এস ও-র সদস্য এবং প্রিয় বন্ধু রঞ্জনের খুনের পর সংগঠন ছেড়ে দেয়। বাবার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার সেই শুরু। আজ হায়দরাবাদে বসে হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় জানতে ইচ্ছা করে, বাবা নিজের পার্টির কাজকর্ম সম্বন্ধে আজকাল কী ভাবছে? সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম নিয়ে কী মতামত বাবার?
হায়দরাবাদে এসে থেকে একটা দিনের জন্যেও ছুটি নেয়নি বিপ্লব। সাপ্তাহিক দুদিন ছুটিতেই চলে যায়। শনিবারটা মোটামুটি খেয়ে আর শুয়েই কাটে, আর রবিবার নুন শোতে যা হোক একটা সিনেমা দেখতে যায়, প্যারাডাইসে বিরিয়ানি খেয়ে সন্ধে সন্ধে বাড়ি ফিরে আসে। আসার পথে একটা পাঁইট নিয়ে আসে, সেটা নিয়ে বসে টিভি দেখতে দেখতে রাত হয়ে যায়। শুয়ে পড়ে। অচিন্ত্যদা থাকতে তাও ওর বাড়ি যাওয়া ছিল, বউদি ছিল, ওদের মেয়েটা ছিল, ফলে মদ খাওয়া ছাড়াও কথাবার্তা হাসিঠাট্টা ছিল। ওরা চলে যাওয়ার পর থেকে সেসবও নেই। ছুটি লাগবে কোন কাজে? আগের বছর একবার মা আর মাসি এসেছিল কয়েক দিনের জন্যে। তখনো দুজনকে নিয়ে ঘোরাঘুরি যা করার সেটা উইক এন্ডেই করেছিল বিপ্লব। বাকি দিনগুলো ফোন থেকে ক্যাব বুক করে দিয়েই সেরেছিল।
ভাল লাগে না আসলে। ছুটি নিয়ে বাড়ি যেতে ইচ্ছা করে না। মানে করেনি এখানে এসে থেকে। টান যা ছিল সে বাবার প্রতি। সে তো অনেক বছর আগেই চুকে গেছে। মাকেও নিশ্চয়ই ভালবাসে বিপ্লব, কিন্তু মার সাথে আর কী নিয়ে কথা বলবে? মা সেই তো কয়েক মিনিট পরেই প্রেম, বিয়ে, পাত্রী দেখা — এসবে চলে যাবে। আর সবুজগ্রামে যাওয়া মানেই তো সেইসব লোকজন, সেইসব রাস্তাঘাট — যাদের বিপ্লব সহ্য করতে পারত না। তাদের দেখলেই আবার নিজের লাঞ্ছনার ইতিহাস, স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস মনে পড়বে। সুতরাং খুব দরকার না পড়লে সবুজগ্রামমুখো না হওয়াই ভাল। তার চেয়ে মায়ের মন খারাপ হলে ও অনলাইনে প্লেনের টিকিট কেটে দেবে, মা-ই আসুক। চাইলে বাবাও আসুক, আপত্তি নেই। তবে ও জানে বাবা নিজে থেকে কখনোই আসতে চাইবে না, ও বললে হয়ত আসতে পারে। কিন্তু ও-ই বা কেন বলতে যাবে?
এই ভাবনা নিয়েই কেটে যাচ্ছিল দিব্যি। আর কাটছে না। কিছুদিন ধরে বাবার প্রতি মনটা ক্রমেই নরম হয়ে আসছে, সেই সঙ্গে সবুজগ্রামের প্রতিও। ক মাস আগেও মনে হত একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট কিনে নিয়ে এখানেই জীবনটা কাটিয়ে দেবে। এখন যেন কেমন অস্থির লাগে। রাস্তাগুলোকে বড় বেশি চওড়া লাগে ইদানীং, রাতের শহরটাকে বড় বেশি জ্বলজ্বলে। চারপাশের মানুষ কি ভীষণ সুখে আছে! এতটা সুখে কি থাকা উচিৎ?
সেদিন অফিস যাওয়ার সময়ে সিগনালে যেই দাঁড়িয়েছে অটোটা, একটা লোক এসে হাত পেতে ভিক্ষা চাইল। এখানে এমনটা প্রায় সব সিগনালেই হয়, নতুন কিছু না। অভ্যেসও হয়ে গেছে অনেকদিন। যার দিতে ইচ্ছে করে সে দেয়, যার ইচ্ছে করে না সে হাত নেড়ে ভাগিয়ে দেয়। কেউই ভিখারির মুখের দিকে তাকিয়েও দ্যাখে না। সেদিন কেন যে তাকাতে গিয়েছিল বিপ্লব? গা-টা গুলিয়ে উঠল।
বেশি বয়স হবে না লোকটার, কারণ বেশিরভাগ চুল কালো। কিন্তু অপুষ্টি বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটা। হাত, পা একেবারে কাঠির মত। শতচ্ছিন্ন পাঞ্জাবী আর ছিঁড়তে ছিঁড়তে প্রায় হাফপ্যান্ট হয়ে যাওয়া একটা পাজামা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অবশ্য মুখটা। ঠোঁটের ঠিক নীচে একটা বিরাট ঘা। পুঁজ, রক্ত গড়াচ্ছে, মাছি বসছে। গোটা মুখটা ফুলে এমন চেহারা যে একটা কথাও বোঝা যায় না। নির্ঘাত ক্যান্সার। হয়ত লোকটার খুব তামাকের নেশা ছিল। চেহারাটা দেখে হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। যতক্ষণে হিপ পকেটের দিকে হাতটা নিয়ে যেতে পারল বিপ্লব, ততক্ষণে সিগনাল সবুজ হয়ে গেছে, অটোওয়ালা হুশ করে এগিয়ে গেছে বেশ কয়েক গজ। সে জানে ভদ্রলোকেরা কেউ ভিখারি পছন্দ করে না, সুতরাং ভিক্ষা দেওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকার কোন দরকার নেই। তারপর থেকে যতগুলো সিগনালে দাঁড়াতে হল, বিপ্লব ভিক্ষা দিল শুধু না, গুনল কতজন ভিক্ষা চাইছে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর কাছে। আশ্চর্য! এত ভিখারি ভারতবর্ষের অগ্রগণ্য এই শহরটায়! ভাবতে ভাবতে অফিসের সামনে পৌঁছে গেল বিপ্লব।
ওঃ! কি বিরাট এ পাড়ার বাড়িগুলো! কি সুন্দর, কি সাজানো বাড়ি আর মানুষগুলো! লিফট থেকে বেরিয়ে নিজের ফ্লোরে ঢুকতেই একটা মিষ্টি গন্ধ পেল বিপ্লব। দামী রুম ফ্রেশনারের গন্ধ। প্রতিদিনই পাওয়া যায় গন্ধটা। ভিখারিটাকে ভাল করে দেখার সময়ে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ এসেছিল নাকে। অফিসের সুগন্ধ সেই গন্ধটা মনে করিয়ে দিল।
লাঞ্চ ব্রেকের সময় বাঙালি সহকর্মী প্রসূনকে বিপ্লব জিজ্ঞেস করল “আচ্ছা, হায়দরাবাদে কত ভিখারি দেখেছিস?”
“না দেখে উপায় আছে, বস? শালা সিগনালে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে এসে ছেঁকে ধরে।”
“আচ্ছা, তুই তো যাদবপুরের ছেলে। কলকাতায় এত ভিখারি আছে?”
“নো ওয়ে। এত নেই। ফুটপাথে অনেক লোক থাকে অবশ্য। তবে এত লোক ভিক্ষে করে খায় না।”
“কেন বল তো? কলকাতায় তো চাকরি বাকরি এখানকার থেকে অনেক কম। অন্ধ্র তো ডেভেলপড স্টেট, তাই না? ওয়েস্ট বেঙ্গলের থেকে অনেক এগিয়ে।”
প্রসূন কোন উত্তর দেওয়ার আগেই স্থানীয় ছেলে শাহনওয়াজ বলে ওঠে “বকোয়াস ডেভেলপড।”
প্রসূন বলে “আরে ইয়ার, অ্যায়সা কিঁউ বোল রহা হ্যায়। হায়দরাবাদ ইজ ইন্ডিয়াজ আই টি হাব। কিতনে লোগ কাম করতে হ্যাঁয় ইয়াহাঁ পে। ফ্রম অল স্টেটস।”
“তো? ইস মে ইয়াহাঁকে লোগোঁ কা কেয়া ফায়দা?”
“কেয়া বাত করতা হ্যায়? ইধার কে লোগ ভি তো কাম করতে হ্যাঁয়। তু তো ইয়হি কা হ্যায়।”
“হাঁ। ইতনে তেলুগু লোগোঁ কো কাম মিলা ইধার কি ম্যায় কভি কলকত্তা গয়া নেহি, ফির ভি বেঙ্গলি সমঝতা হুঁ পুরা কা পুরা।”
“আরে তো ইয়ে নৌকরি করনে কে লিয়ে লিখনা পঢ়না পড়তা হ্যায় না?”
“কিতনে লোগ পঢ় পায়েঙ্গে ইতনা? মেরে আব্বা কা বহুত বড়া বিজনেস হ্যায় ইস লিয়ে প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সে পঢ় লিয়া ম্যায়। কৌন কৌন পঢ়েগা ইতনা? ঔর জিসকো কম্পিউটার নেহি মালুম উয়ো পঢ়া লিখা নহি হ্যায়? উসকা কুছ নেহি হোতা আন্ধ্রা মে। মেরা বড়া ভাই ইংলিশ মে এম এ করকে চুপচাপ বৈঠা থা ঘর মে। আভি এম এস অফিস সিখকে ক্লেরিকাল জব ঢুন্ড রহা হ্যায়।”
প্রসূন কী বলবে ভাবছিল। বিপ্লব বলল “উই আর ওয়েস্টিং টাইম, গাইজ। দোজ বেগারস আর নট এজুকেটেড পিপল। আই ওয়জ আস্কিং অ্যাবাউট দেম।”
“উনকা তো ঔর ভি বুরা হাল হ্যায়। দোজ পিপল আর মোস্টলি ফ্রম আর আর। মতলব রঙ্গা রেড্ডি ডিস্ট্রিক্ট। ক্ষেতিবাড়ি তো চলতা নেহি। দেখতে নহি হো পেপার মে, কিতনে কিসাণ খুদকুশি করতে হ্যাঁয়? কোই সোচতা হি নহি উনকে বারে মে। আদমি ভিখ নহি মাঙ্গেগা তো করেগা কেয়া? হায়দরাবাদ সে জিতনি দূর যাওগে উতনি গরিবি নজর আয়েগি। অ্যায়সে হি হার গয়া চন্দ্রবাবু?”
“বাট রোডজ আর সো গুড হিয়ার। চন্দ্রবাবু ডেভেলপড ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ইউ হ্যাভ টু অ্যাডমিট।” প্রসূন লড়ে যায়।
“নহি কিয়া কৌন বোল রাহা হ্যায়? লেকিন সির্ফ স্টেট ক্যাপিটাল মে কিয়া হ্যায়। বাকি স্টেট যায়ে ভাঁড় মে।”
প্রসূন মুখ বেঁকিয়ে বলে “স্টিল বেটার দ্যান ওয়েস্ট বেঙ্গল। সি পি এম হ্যাজ ডেস্ট্রয়েড দ্য স্টেট ক্যাপিটাল।”
শাহনওয়াজ হেসে বলে “উয়ো তুমহারা স্টেট তুম জানো। লেকিন ইয়াহাঁ পে জো ডেভেলপমেন্ট দিখতা হ্যায় উয়ো চন্দ লোগোঁকে লিয়ে হি হ্যায়। একদিন গাড়ি লে কে হায়দরাবাদ সে বাহার নিকলো না? পতা চল যায়গা।”
“মুঝে জওয়াব নেহি মিলা,” বিপ্লব আবার বলে। “কলকাতা মে ভিখারি অগর কম হ্যায় তো কিঁউ হ্যায়?”
“আরে ভাই কুড়ি টাকায় পেট ভরে খেতে পাওয়া যায় কলকাতায়। কুড়ি টাকা রোজগার করতে আর কী লাগে? ওটুকুর জন্যে কেন ভিক্ষা করতে যাবে কেউ?” প্রসূনই বলে। “যদি না ভিখিরিদের ঐসব র্যাকেটের মেম্বার হয়।”
“সহি বোলতা হ্যায় বন্দা,” শাহনওয়াজ বলে। “সালা কস্ট অফ লিভিং ইতনা হাই হ্যায় ইধার।”
সেদিন সারাদিন ধরে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেছিল বিপ্লব — ডেভেলপমেন্ট মানে তাহলে এটাই? কেউ কেউ ফুলে ফেঁপে উঠবে আর বেশিরভাগ লোক মরুক, বাঁচুক সরকার ফিরেও দেখবে না? বেড়ে উঠতে উঠতে যে অন্যরকম একটা উন্নয়নের কথা শিখেছিল ও! অবশ্য সেসব আর হল কোথায়? বাবার পার্টিও তো সে উন্নয়ন দেখাতে পারল না। “লাঙল যার জমি তার” স্লোগান দিত যারা, তারা তো অপারেশন বর্গার পরেই থেমে গেল, যৌথ খামারের স্বপ্ন সত্যি করার দিকে তো গেলই না। আর শহরের গরীব মানুষেরই বা কী হল? হকার উচ্ছেদ, বস্তি উচ্ছেদ তো বাম সরকারও করেছে। এসব ভাবতে ভাবতে সেদিন রাতে ঠিক করে ঘুমই হয়নি বিপ্লবের। বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে এরকম বেশকিছু বিনিদ্র রাত কেটেছে কলেজে পড়ার সময়, রঞ্জন খুন হওয়ার পর থেকে। তখন আসলে নিজের সঙ্গেও একটা লড়াই চলছিল। এস এফ আই ছেড়ে দেওয়ার পর থেকেই সুকৃতি, অনিকেতদারা এ আই ডি এস ও তে যোগ দিতে বলছিল। বিপ্লব কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল সেটাই ভাল হবে। এ আই ডি এস ও কে এই কলেজে দাঁড় করিয়ে, এস এফ আই কে হারিয়ে দিলে তবে ওদের উচিৎ শিক্ষা হবে। আবার কখনো মনে হচ্ছিল, এরাও যে কাল ক্ষমতা পেলে এস এফ আই এর মতই হয়ে উঠবে না তার গ্যারান্টি কী? মা যে বলে “যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ”, সেটা বোধহয় ভুল নয়। এইসব ভাবতে ভাবতে, শেষ অব্দি, রাজনীতির সংস্রব ত্যাগ করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিপ্লব। এবং জীবনে প্রথমবার, পড়াশোনা ছাড়া মনের আর সব জানলা বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রথম কদিন সুকৃতির মত কয়েকজন ওকে বোঝানোর খুব চেষ্টা করেছিল, ওর মত ছেলেকে রাজনীতিতে দরকার। তারপর হাল ছেড়ে দেয়। সেই থেকে নিজের কেরিয়ার, নিজের সুখ নিয়েই বেশ ছিল এত বছর। রাস্তায় এত ভিখারি কেন? উন্নয়ন মানে কী? কেমন হওয়া উচিৎ? এসব প্রশ্ন কোন পূর্বজন্ম থেকে ভেসে উঠে আজ হঠাৎ ঘুমোতে দিচ্ছে না বিপ্লবকে! শেষ রাতে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল বাবা কি প্রচণ্ড শ্লেষে আবৃত্তি করত “দু কানে চশমা আঁটিয়া ঘুমাইনু রাতে / দিব্যি হতেছে নিদ বেশি।” বিপ্লবের সেই চশমা ভেঙে গেছে। এখন কী করবে সে? অন্ধ না হলে কি উন্মাদ হয়ে যেতে হয় এই দুনিয়ায়?
*এই উপন্যাসের সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। কোন সত্যি ঘটনা বা জীবিত/মৃত ব্যক্তির সাথে মিল পাওয়া গেলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। কিছু বাস্তব চরিত্রের নাম এসেছে কেবল সময়কাল বোঝাতে
ভাল লাগলে টাকা দিতে পারেন Google Pay / Paytm / BHIM বা অন্য UPI অ্যাপের মাধ্যমে journopratik@okhdfcbank কে
অথবা
নেট ব্যাঙ্কিং বা অন্য উপায়ে নিম্নলিখিত অ্যাকাউন্টে
Pratik Bandyopadhyay
A/c No. 14041140002343
HDFC Bank
Branch: South Calcutta Girls’ College
IFS Code: HDFC0001404
MICR Code: 700240048