ইংরেজি কাগজের বাঙালি সম্পাদক: আমি বলব, তুমি শুনবে

এইসব কাগজের হিন্দিভাষী সম্পাদকরা ধরে নেন যে পাঠকের মাতৃভাষা হিন্দি নয়, সে-ও হিন্দি বোঝে।

এশিয়ায় অনুষ্ঠিত প্রথম ফুটবল বিশ্বকাপের শুরুতেই অঘটন। আগের বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের তারকাখচিত দলকে ১-০ গোলে হারিয়ে দিল আফ্রিকা থেকে প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলতে আসা সেনেগাল। পরদিন কলকাতার ‘দ্য স্টেটসম্যান’ খবরের কাগজ প্রথম পাতায় সবচেয়ে বড় হরফে শিরোনাম দিল — David 1 Goliath 0. তখন কলেজে পড়ি। ইংরেজি অনার্সের আমরা কজন মুগ্ধ, বলাবলি করছি “কী দারুন হেডিং দিয়েছে!” হোস্টেলের খবরের কাগজের টেবিলে রাখা কাগজটা সকলেই পড়ে। ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত — কোনও অনার্সের ছেলেই বাদ যায় না। স্পষ্ট দেখতে পেলাম সকলেই আমাদের মত মুগ্ধ হয়নি। কয়েকজন পরিষ্কার জিজ্ঞেস করল “এটার মানে কী?”

ঘটনাটা ২০০২ সালের। তখনো ইন্টারনেট আজকের মত সহজলভ্য নয়, সকলেই ফেসবুকে এবং অনেকেই টুইটারে বা ইন্সটাগ্রামে আছে এমন নয়। ফলে সাংস্কৃতিক বিনিময় এত সহজ ছিল না। ইদানিং বাংলা সংবাদমাধ্যমেও কখনো কখনো অসম লড়াই বোঝাতে ডেভিড-গোলিয়াথের কথা লেখা হয়। কারণ এখন সন্দেশখালির ধর্মপ্রাণ হিন্দুরও জানতে বাকি নেই অনুষঙ্গটা, জানার জন্য বাইবেল পড়তে হয়নি। স্প্যানিশ ভাষা না জেনেও যেমন অনেক ফুটবল পাগল বাঙালি রিয়াল মাদ্রিদের দশম চ্যাম্পিয়নস লিগ খেতাবকে ডেসিমা বলেছিল। কিন্তু যখনকার কথা বলছি তখন বাইবেলের কাহিনির সঙ্গে সামান্য পরিচয় না থাকলে স্টেটসম্যানের ঐ শিরোনাম দুর্বোধ্য হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। দেখা গিয়েছিল ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছাড়া, আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে যারা ক্রিশ্চান মিশনারি স্কুলের প্রাক্তনী, নিদেন পক্ষে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করেছে, অথবা পারিবারিকভাবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত, কেবল তারাই ঐ শিরোনামটা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিল। তাই ইংরেজি অনার্সের এক সহপাঠী প্রশ্ন তুলেছিল “খবরের কাগজ কি mass এর জন্য, না class এর জন্য?” তারপর নিজেই উত্তর দিয়েছিল “স্থানীয় ভাষার কাগজ জনতার জন্য, ইংরেজি কাগজ বাছাই করা লোকের জন্য।”

এই যুক্তি সেদিন যতটা অকাট্য মনে হয়েছিল আজ আর ততটা মনে হয় না। কারণ গত ১৮ বছরে দেশের সব রাজ্যেই ইংরেজি জানা লোকের সংখ্যা বেড়েছে, ফলত ইংরেজি কাগজের পাঠকও বেড়েছে। Audit Bureau of Circulations (ABC), অর্থাৎ ভারতে প্রকাশিত পত্রপত্রিকাগুলোর কোনটা কত বিক্রি হয়, পড়া হয় তার হিসাব রাখে যে সংস্থা, তাদের পরিসংখ্যান থেকেই এ কথা প্রমাণিত হয়। তাছাড়া খবরের কাগজের পাঠক টিভি দেখেন না বা মোবাইলে ইন্টারনেট ঘাঁটেন না — এমন মনে করাও অযৌক্তিক। তাই কাগজের পাঠক বুঝবেন না, এমন শব্দ বা চিত্রকল্পের তালিকা ২০০২ এর তুলনায় ছোট হয়ে এসেছে। যেসব শব্দ/শব্দবন্ধ দু দশক আগে ইংরেজি কাগজের পাঠকদের একাংশেরও দুর্বোধ্য মনে হত, তার অনেকগুলোই এখন বাংলা কাগজেও দিব্যি ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বরং দেখা যায় বাংলা প্রতিশব্দ থাকা সত্ত্বেও ইংরেজি শব্দটাই বাংলা কাগজে, পত্রিকায়, টিভি চ্যানেলে ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র’ কথাটার ব্যবহার যেমন দিন দিন কমে যাচ্ছে, বিপুল বিক্রমে ‘আই টি সেক্টর’ বলা এবং লেখা চলছে। ‘Demonetisation’ কথাটার বাংলা প্রতিশব্দ চালু করার জন্যও বাংলা সংবাদমাধ্যম বেশিদিন লড়ল না। কথাটা বাংলা হরফে লিখে দিয়েই কাজ সারা হল। এতে বাংলা ভাষার লাভ হচ্ছে না ক্ষতি হচ্ছে তা ভিন্ন আলোচনার বিষয়, কিন্তু নিঃসন্দেহে ইংরেজি কাগজ সম্পাদনার কাজ অনেক সহজ হচ্ছে। কিন্তু mass আর class এর তফাতটা কি একেবারে ঘুচে গেছে? পনেরো বছর ইংরেজি কাগজে সম্পাদনার কাজ করতে গিয়ে এই প্রশ্নটার উত্তর প্রায় রোজ খুঁজতে হত।অন্য দেশের কথা জানি না, ভারতে এখনো ইংরেজি কাগজ (বা ওয়েবসাইট) পড়তে পারার সঙ্গে শ্রেণির গভীর যোগাযোগ আছে। ইদানিং ব্যাঙের ছাতার মত পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে ওঠা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দৌলতে বেশ কম রোজগারের মানুষও সাধ্যের বাইরে গিয়ে ছেলেমেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছেন, কিন্তু বাড়িতে ইংরেজি কাগজ রাখার সাধ তাঁদের চট করে হয় না। ইংরেজি কাগজের বিক্রি বেড়েছে আসলে উদারীকরণের ফলে গত তিরিশ বছরে তৈরি হওয়া উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির কারণে। এখন যে সব্জি বিক্রেতা তাঁর ছেলেমেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছেন, তিনি তাঁর পরিবারে লেখাপড়ার প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্ম। ফলে ইংরেজি কাগজ পড়ার কথা ভাবতে পারেন না, ছেলেমেয়ের কেন পড়া প্রয়োজন তাও বুঝে উঠতে পারেন না। কিন্তু এখন যিনি বহুজাতিকের কর্মচারী হওয়ায় গাড়ি কিনেছেন, তাঁর বাপ-ঠাকুর্দারা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ছিলেন, তবু বাড়িতে লেখাপড়ার চল ছিল। ফলে তিনি জানেন আরো এগোতে হলে আরো বেশি করে ইংরেজি রপ্ত করতে হবে। তাই ইংরেজি কাগজ পড়া। ইংরেজি কাগজের সাব-এডিটররাও আসেন মূলত এই ধরণের পরিবার থেকে। ফলে কাগজের বিষয় নির্বাচন এবং ভাষা — দুটো ক্ষেত্রেই তার প্রতিফলন হয়। সম্পাদনা করার সময় যে পাঠককে লক্ষ্য বলে ধরা হয়, তিনি উচ্চ মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পাঠক।

এই কারণেই বাংলা কাগজের চেয়ে ইংরেজি কাগজের প্রথম পাতায় শেয়ার বাজারের ওঠানামার খবর বেশি প্রকাশিত হতে দেখা যায়। তেমনি একেবারে অন্য বিষয়ের খবর লিখতে গিয়ে “bulls and bears” অনুষঙ্গ ব্যবহার করা ইংরেজি কাগজে জলভাত। পাঠক আর সম্পাদক, উভয়েই বাংলাভাষী হলেও। এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। হোস্টেলের মত জায়গায় নানা শ্রেণির পাঠক একত্র হওয়ার ফলে ঐ সরল হিসাব সবসময় খাটে না, তাই কোন কোন পাঠককে ছুঁতে পারা যায় না। ইংরেজি কাগজে লেখার ক্ষেত্রে অবশ্য একটা অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া যায় ভারতের সর্বত্রই, কেবল পশ্চিমবঙ্গে নয়। কোন শব্দ বা শব্দবন্ধ বুঝতে না পারলে পাঠক সেটা নিজের অক্ষমতা বলেই ধরে নেন এবং জেনে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কারণ ঐ কাগজটা পড়ার অনেক কারণের একটা হল ইংরেজি ভাষাটা আরো ভাল করে শেখা। আজ থেকে কুড়ি পঁচিশ বছর আগে তো বড়রা সরাসরিই ছোটদের স্টেটসম্যান পড়ে ইংরেজি শিখতে বলতেন। এখন ইংরেজি পড়ার অভ্যাস সার্বিকভাবে বেড়েছে, ‘দ্য টাইমস’ বা ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ও ঘরে বসেই পড়া যাচ্ছে, তাই হয়ত এখন আর কেউ কাগজ পড়ে ইংরেজি শিখতে বলেন না, তবে ইংরেজি কাগজের কৌলীন্য কমেনি। বাংলা কাগজের ভাষা কিন্তু সর্বজনগ্রাহ্য হতেই হবে।
শিরোনামের কথা বলে শুরু করেছিলাম, শিরোনামের কথা দিয়েই শেষ করি।

সর্বভারতীয় বলে পরিচিত যে ইংরেজি কাগজগুলো, সেগুলোর শিরোনামে প্রায়শই হিন্দি শব্দ/শব্দবন্ধ নিয়ে খেলা লক্ষ্য করা যায়, রোমান হরফে পুরোপুরি হিন্দি শিরোনামও দেখা যায়। নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে ২০১০ এর বিহার বিধানসভা নির্বাচনে এন ডি এ জোট জয়ী হওয়ার পর ‘দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ এর শিরোনাম ছিল ‘Rajnitish’। ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ র পাতায় অভিনেত্রী জেসি রনধাওয়া সম্বন্ধে প্রতিবেদনে ‘Jesse jaisi koi nahin’ শিরোনাম ব্যবহৃত হয়েছে। স্পষ্টতই এইসব কাগজের হিন্দিভাষী সম্পাদকরা ধরে নেন যে পাঠকের মাতৃভাষা হিন্দি নয়, সে-ও হিন্দি বোঝে। বাংলা, ওড়িশা বা দক্ষিণ ভারতের পাঠকদের অসুবিধার কথা ভাবা হয় না। অন্যদিকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত যে ইংরেজি কাগজগুলোর ইন্টারনেটের বাইরে সর্বভারতীয় উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য নয়, সেসব কাগজে কিন্তু বাংলা শব্দ/শব্দবন্ধ নিয়ে শিরোনামে এরকম খেলা সচরাচর দেখা যায় না। রোমান হরফে লেখা আদ্যন্ত বাংলা শিরোনাম তো নৈব নৈব চ। ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলি যখন মধ্যগগনে তখনো কি কোথাও শিরোনাম হয়েছে “Sourav fills Brisbane”? কোনও নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের পর কলকাতার কোন ইংরেজি কাগজে ব্যানার হেডিং হবে “Mamatar khamata” — এ কথা এখনো অকল্পনীয়। অথচ এই কাগজগুলোর বেশিরভাগ পাঠক বাঙালি, সম্পাদকমণ্ডলীর বড় অংশও তাই।

এমনটা কেন ঘটে? হিন্দিভাষী সম্পাদকদের চেয়ে বাঙালি সম্পাদকদের ইংরেজির উপর দখল কি বেশি, নাকি বাঙালি সম্পাদকরা নিজেদের মাতৃভাষা সম্পর্কে হীনম্মন্যতায় ভোগেন? সমাজবিজ্ঞানের লোকেরা গবেষণা করে দেখতে পারেন।

তথ্যসূত্র
১। http://archive.indianexpress.com/news/rajnitish/715691/
২। https://timesofindia.indiatimes.com/ahmedabad-times/Jesse-jaisi-koi-nahin/articleshow/757540.cms

https://guruchandali.com/ এ প্রকাশিত

সকল অহঙ্কার হে আমার

“আমাদের সময়ে আমরা এইসব স্টলওয়ার্টদের পেয়েছি আর নিংড়ে নিয়েছি। যতটা পারা যায় শিখে নিতাম। ওঁরাও খুব ভালবেসে শেখাতেন, দরকারে বকাঝকাও করতেন। এখন আর আমি কাকে কী শেখাব? আজকাল তো সবাই সব জানে।”

সেদিন যথাসময়ে অফিসে ঢুকে দেখি, অনেক দেরি করে ফেলেছি। নিউজরুম আলো করে বসে আছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

তখন ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ তে কাজ করি। কলকাতা সংস্করণের অধুনা প্রয়াত রেসিডেন্ট এডিটর সুমিত সেন সৌমিত্রবাবুর স্নেহভাজন ছিলেন বলে শুনেছি। সেই সুবাদেই টাইমসের অফিসে আসা। আসবেন জানতাম না। যখন পৌঁছেছি, তখন তাঁর প্রায় ফেরার সময় হয়ে গেছে। ভাগ্যিস আমার মত আরো অনেকেরই আশ মেটেনি সেদিন। তাই কিছুদিন পরেই আরেকবার তিনি আসবেন বলে কথা হল।

সে দিন আসতে আসতে আরো বছর খানেক কি দেড়েক। আগেরবার এসে শুনেছি গটগট করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেছিলেন। এবার একতলাতেই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ঐ মানুষটিকে আগে কয়েকবার রবীন্দ্র সদন, বিমানবন্দর ইত্যাদি জায়গায় বহুদূর থেকে দেখেছি। দু হাত দূরত্ব থেকে সেদিন দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আড্ডার মেজাজে কথা হল, অনেকে অনেক প্রশ্ন করলেন, আমারও অনেক কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজই বেরোল না। বেরোবে কী করে? কেবল আমার কান তো তাঁর কথা শুনছিল না, আমার প্রতিটি রোমকূপ শুনছিল।

তিনি যা যা বললেন তার মধ্যে অনেক কথা বহুবার বহু জায়গায় বলেছেন বা লিখেছেন। আজকের কাগজগুলোতেও সেসব বিলক্ষণ পাওয়া যাবে। যা আমাকে সবচেয়ে চমৎকৃত করেছিল, সেটা বলি। কারণ সেগুলো আর কোথাও পড়েছি বা শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।

বলছিলেন অগ্রজ শিল্পীদের কথা। শিশির ভাদুড়ি, অহীন্দ্র চৌধুরী থেকে ছবি বিশ্বাসে এসে দীর্ঘক্ষণ বললেন। সত্যি কথা বলতে, নিজের অভিনয় নিয়ে যা বললেন সেগুলো সবই নানাজনের প্রশ্নের উত্তরে। তার চেয়ে অনেক বেশি কথা বললেন ছবি বিশ্বাসের সম্বন্ধে। কেবল ছবি বিশ্বাসের অভিনয় প্রতিভা নয়, বললেন তাঁর অসম্ভব পরিশ্রম করার ক্ষমতা নিয়েও। ছবি বিশ্বাসের জীবনের শেষ দিকে কোন এক ছবিতে দুজনের একটা দীর্ঘ দৃশ্য ছিল।

“লম্বা সিন, আর সংলাপগুলোও খুব লম্বা লম্বা। আমি বারবার ভুল করছি আর শট এন জি হয়ে যাচ্ছে। ছবিদার তখন শরীরটা এমনিই বেশ খারাপ। ঐ সিনটাতে আবার সুট বুট পরা, অথচ তখন অসম্ভব গরম। শট ওকে হচ্ছে না বলে ফ্যান চালানোও যাচ্ছে না। ফলে ওঁর আরো শরীর খারাপ লাগছে, ক্রমশ রেগে যাচ্ছেন। শেষে পরিচালক বললেন ‘আমরা একটু ব্রেক নিই, আপনারা একটু রেস্ট নিয়ে নিন। তারপর আবার চেষ্টা করা যাবে।’ আমি ছবিদার সাথে বসে সারেন্ডার করলাম। বললাম ‘দেখছেন তো পারছি না। দিন না বাবা একটু দেখিয়ে?’ উনি সেই বিখ্যাত গম্ভীর গলায় বললেন ‘বুঝতে পেরেছ তাহলে’? তারপর তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ‘তুমি আমার ডায়লগ বলো, আমি তোমার ডায়লগ বলছি।’ তারপর অতবড় সিন গোটাটা রিহার্সাল করালেন, মুভমেন্টগুলোও শুধরে দিলেন। তারপর নিজের নিজের ডায়লগ বলিয়ে আবার করালেন। শেষে ডিরেক্টরকে ডেকে এনে শট নেওয়ালেন, শট ওকে হল।

আমি অবাক হয়ে গেলাম শরীরের ঐ অবস্থাতেও ওরকম উদ্যম দেখে। তাছাড়া আমার একটা অহঙ্কার ছিল, আমার সংলাপ সবসময় মুখস্থ থাকে। সেই অহঙ্কারটাও চুরমার হয়ে গেল। কারণ দেখলাম ছবিদার শুধু নিজের নয়, আমার ডায়লগও হুবহু মুখস্থ। বরং আমি দু এক জায়গায় ভুল করে ফেলেছিলাম, উনি ধমকালেন ‘কী যে করো তোমরা! ডায়লগ মুখস্থ রাখতে পারো না?”

প্রবাদপ্রতিম অভিনেতার মুখে এই গল্পটা শুনে আশ্চর্য লেগেছিল, কিভাবে আমাদের সামনে নিজের ত্রুটিগুলো অকপটে বললেন! অগ্রজ অভিনেতার কাছ থেকে কত শিখেছেন সেটাও কেমন সবিস্তারে বললেন! অথচ কত সহজ ছিল “আমি এই, আমি তাই, আমি সেই” বলা। সেরকম বলার মত যথেষ্ট কীর্তি তো তাঁর ছিলই। অবশ্য হয়ত আমরা এই প্রজন্মের লোক বলেই আমাদের এত অবাক লাগে। সৌমিত্রবাবু তো বললেনই “আমাদের সময়ে আমরা এইসব স্টলওয়ার্টদের পেয়েছি আর নিংড়ে নিয়েছি। যতটা পারা যায় শিখে নিতাম। ওঁরাও খুব ভালবেসে শেখাতেন, দরকারে বকাঝকাও করতেন। এখন আর আমি কাকে কী শেখাব? আজকাল তো সবাই সব জানে।”

“নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলি করি অপমান” কথাটা আমরা ভুলে গেছি। তাই কলকাতার ফিল্মোৎসবে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিংহ, উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় বা মাধবী মুখোপাধ্যায়ের কাট আউট ঝোলে না। ঝোলে আয়োজক প্রধান মুখ্যমন্ত্রীর ছবি। মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীরা অবশ্য আকাশ থেকে পড়েন না, আমাদের মধ্যে থেকেই উঠে আসেন। আমরা সবাই তো এখন আত্মরতিপ্রবণ। নইলে কোন বিখ্যাত মানুষ মারা গেলে সাংবাদিকরা কেন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখবেন, “অমুক সালে যখন আমি তমুক এক্সক্লুসিভটা করে অমুক প্রোমোশনটা পেয়েছি…”? কেনই বা আসবে মৃত মানুষটি কবে কী কারণে লেখকের প্রশংসা করেছিলেন?

%d bloggers like this: