
এ তল্লাটে মানুষ অনেকদিন বাঁচে। কেন যে বাঁচে!
ভাবতে ভাবতে সবুজগ্রাম রিডিং ক্লাব পেরোল রবীন। ক্লাবের দরজায় বসে সিগারেট খাচ্ছিল শ্যামল কংসবণিক আর ঠিক সামনের চায়ের দোকানটা খুলে সবে গঙ্গাজল ছড়াতে শুরু করেছিল দেবু ঘোষ। ঠিক তার আগেই গার্লস স্কুলের সামনে দিয়ে আসার সময়ে নজরে পড়েছে এই বিকেল পাঁচটাতেও রিকশায় গুঁড়ি মেরে ঘুমোচ্ছে শম্ভু। ওর ছেলে যে কদিন আগেই অভিযোগ করল ও আজকাল দিনের বেলাও নেশা করে, সেটা তাহলে সত্যি।
শম্ভুর ছেলেটা রবীনের স্কুলেই পড়ত। মাধ্যমিক পাস করেছিল সেকেন্ড ডিভিশনে। কথা শুনল না। কিছুতেই পড়াশোনাটা চালাল না। অবশ্য বাপের মত নেশাভাং ধরেনি। স্টেশন চত্বরে খেলনার দোকান খুলেছে, রীতিমত পরিশ্রম করে। ফলে দোকানটা দাঁড়িয়ে গেছে। ওর বউটাও মাধ্যমিক পাশ। দোকানের কাজে সাহায্যও করে। শম্ভুর বউ মারা গেছে পাঁচ-ছ বছর হবে। ছেলে যা রোজগার করে তাতে শম্ভুর আর রিকশা না চালালেও চলে। রবীনের মনে হয়েছিল ছেলে হয়ত দ্যাখে না, তাই ও চালিয়ে যাচ্ছে। সে কথা একদিন সরাসরি জিজ্ঞেস করাতে ছেলেটা বলল “আপনি মাস্টারমশাই, আপনার কাছে তো মিথ্যে বলব না। আমার অসুবিধা নেই, কিন্তু আমার বউয়ের একদম ইচ্ছা নয় বাবা আর রিকশা চালায়। ও কতবার করে বলল, আমিও বলেছি। কদিন তো বেরোনো বন্ধ করেছিল। তারপর বলল ‘না, ঘরে বসে কী করব? কতক্ষণ টিভি দেখে কাটে?’ আসলে তা না। বাবার তো নেশা আছে আপনি জানেন। বাড়ি থাকলে তো ওটা হচ্ছে না, না?”
“বয়স তো অনেক হল। দ্যাখ না ছাড়াতে পারিস কিনা?”
“খুব অশান্তি করে স্যার। আমার বউ একবার খাবারে ওষুধ দিয়েছিল। বুঝতে পেরে গিয়ে সে কি গালাগাল! আগে শুধু সন্ধ্যের পরে নেশা করত, আজকাল দিনে দুপুরে ধরেছে। আমি তাও দিনরাত বলছি যে এবার এসব ছাড়ো। দুদিন পরে নাতিপুতি হবে, সে কী শিখবে তোমায় দেখে?”
“ও বাবা! এটা তো ভাল খবর দিলি। বউমা মা হইব? কবে ডেট?”
পাশে দাঁড়ানো বউটা একটু রাঙা হয়। ছেলেটা একগাল হেসে বলে “এই সবে তিন মাস।”
“বাঃ বাঃ, বহুত আচ্ছা” বলতে বলতে রবীন প্রাক্তন ছাত্রটিকে জড়িয়ে ধরে। “কত বড় হয়ে গেলি তোরা! বউয়ের দিকে নজর রাখিস, বাবা। এই কটা দিন খুব সাবধানে রাখতে হয়।”
দোকানদার দেবু ঘোষ লোক ভাল, পার্টির শুভাকাঙ্ক্ষী। অনেকবার অনেককে নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছে কংগ্রেস আমলে। রবীনকেও। রিডিং ক্লাবের সামনেই দোকান, ফলে পুলিসের বিষনজরে পড়া স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এত চালাক চতুর যে দারোগা, কনস্টেবলরা ভাবত ও সি পি এমকে দুচক্ষে দেখতে পারে না। তাই ওর গায়ে হাত পড়েনি। রবীনদের তাতে সুবিধা হয়েছে।
পার্টি সে ঋণ সুদে আসলে মিটিয়েও দিয়েছে। দেবুর ছেলে সবুজগ্রাম কলেজে ক্লাস ফোর স্টাফের চাকরি পেয়েছে; দোকানটা ছিল ঝুপড়ি, হয়েছে পাকা। সে আমলে শুধু চা, বিস্কুট, বিড়ি, সিগারেট পাওয়া যেত। এখন সন্ধ্যের পরে রোল, চাউমিন, মোগলাই, কোল্ড ড্রিঙ্কস। ওর ছেলে কলেজ ছুটির পরে এসে দোকানের দায়িত্ব নিয়ে নেয়, দেবু বাড়ি চলে যায়। ইদানীং অভিযোগ উঠেছে দোকানে নাকি লুকিয়ে চুরিয়ে মদ বিক্রি হচ্ছে। রবীন খোঁজ নিয়ে দেখেছে — কথাটা সত্যি।
জানতে পারা মাত্রই লোকাল কমিটির মিটিঙে তুলেছিল ব্যাপারটা। এল সি এস শ্যামল কংসবণিক স্রেফ উড়িয়ে দিল “ধুর ! এইসব তুমি বিশ্বাস করো?”
“এটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্নই নয়, শ্যামলদা। আমি নিজে খবর নিয়ে দেখেছি। কথাটা ঠিকই। এটা বন্ধ করা দরকার।”
রবীন এতটা কড়াভাবে বলবে শ্যামল ভাবেনি। একটু থতমত খেয়ে বলে “হ্যাঁ, যদি সত্যি হয় তাহলে তো বন্ধ করতেই হবে। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া …”
“প্রমাণ!” বাঘের মত লাফিয়ে ওঠে উদ্দালক। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী, ছাত্রনেতা, সবে পার্টি সদস্যপদ পেয়েছে। এ ধরণের ছেলেরা আজকাল পার্টির ধারে কাছে আসে না চট করে, এলেও কলকাতায় সদস্যপদ নেয়।
“আমরা কি পুলিশ না উকিল? প্রমাণ আবার কী? সারা সবুজগ্রাম জানে ব্যাপারটা। দোকানে গিয়ে ধমকালেই বাপ বাপ বলে ও বোতলগুলো বার করে দেবে। পার্টির জন্যে ওর চাকরি, দোকান সবকিছু। পার্টি চাইলে ওর দোকান বন্ধ করে দেবে। একদিন ওকে ডেকে আপনারা সিনিয়র লোকেরা বলে দিন ‘বাপু, এসব আজ থেকে বন্ধ করো’। কথা শুনলে ভাল, নাহলে গিয়ে দোকান ভেঙে দিয়ে আসব।”
“এটা গুন্ডামি। আমি এল সি এস থাকতে ও সমস্ত অ্যালাউ করব না।”
“আপনি তো অদ্ভুত কথা বলছেন!” রবীন এবার বেশ রেগে যায়। “পাড়ার মধ্যে মদ বিক্রি করছে তাতে আপনার আপত্তি নেই। সেটা বন্ধ করাটা গুন্ডামি?”
“বেআইনি কাজ করছে। সেটা বন্ধ করার জন্যে পুলিশ আছে। আমাদের এত লাফালাফির কী আছে? দেবু পার্টির জন্যে কম করেছে? রবীন তো জানে সব। ওর পেটে লাথি মারলে পার্টির ভাল হবে?”
“না, তা কেন হবে? পাড়ার লোকে দেখছে সি পি এম ঘনিষ্ঠ একটা ছেলে দোকানে লুকিয়ে মদ বেচছে। এতেই পার্টির ভাল হচ্ছে।” উদ্দালক রাগে গরগর করে ওঠে।
“আচ্ছা শ্যামলদা, আপনি তো ঐ পাড়াতেই থাকেন। দুবেলা রিডিং ক্লাবে গিয়ে না বসলে আপনার চলে না। আপনি কী করে এটা সাপোর্ট করছেন বলুন তো? পাড়ার লোকে তো দুদিন বাদে আপনাকেই গাল দেবে।” রবীন বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। তাতে একটা চমকপ্রদ উত্তর আসে।
“শ্যামল কংসবণিককে সবুজগ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়ে গালাগালি দেওয়ার ক্ষমতা কারো নেই।”
উপস্থিত আরো কয়েকজন কমরেডের চাপাচাপিতে সম্রাট শ্যামল কংসবণিক শেষ অব্দি পরের এল সি মিটিঙের এজেন্ডায় ব্যাপারটা রাখতে রাজি হন।
উদ্দালক সাইকেলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বলেছিল “এটা কী হল, রবীনদা? এইসব ব্যাপারেও মিটিং করতে লাগে?”
মনে যা-ই থাকুক, রবীন মুখে বলেছিল “না, আসলে সবার মতামত নিয়ে করতে চাইছে আর কি।”
রাস্তাটায় ল্যাম্পপোস্টগুলো বেশ দূরে দূরে আর কথাটা বলে সোজাসুজি উদ্দালকের দিকে তাকাতেও চাইছিল না রবীন। তাই ওর মুখটা দেখতে পেল না ভাল করে। কিন্তু আড়চোখে দেখেই বুঝল ও ভীষণ অসন্তুষ্ট। স্বাভাবিক। উদ্দালকের বয়সে রবীনেরও এমনটাই হত। তখন অবশ্য, যতদূর মনে পড়ে রবীনের, চোলাই মদের ঠেক ভেঙে দেওয়া গুন্ডামি বলে মনে হত না কোন নেতার। বেশ কয়েকটা তো দল বেঁধে রবীন নিজেই গিয়ে ভেঙে এসেছে।
বাকি রাস্তা উদ্দালক আর কথাই বলেনি। পান্তির মোড় থেকে ওকে বাঁদিকে চলে যেতে হয়, রবীনের বাড়ি সোজা গিয়ে দু তিনটে বাড়ি পরেই। মোড়টায় এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে তাজা ছেলেটা, তারপর তার বর্ষীয়ান কমরেডকে জিজ্ঞেস করে “আচ্ছা রবীনদা, আপনি এটা মানছেন তো যে পল্টুর মদ বিক্রি পার্টির ক্ষতি করছে এবং এটা বন্ধ করা পার্টির দায়িত্ব?”
“একশো বার।”
“যাক, বাবা !” কালো মুখটা একটু উজ্জ্বল হয়। “ছোটবেলা থেকে আপনাকে দেখছি। আপনি, আমার কাকা — এদের দেখেই তো কমিউনিস্ট হলাম। আপনাদের মত হতে চেয়ে। আপনারা যেন বদলে যাবেন না।”
কথাটা শুনে ভীষণ লজ্জা করে রবীনের।
“আমরা কেউ কমিউনিস্ট হইনি রে। হতে এসেছিলাম। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি হয়ে ওঠার। পারিনি। আমার তো সময় বেশি নেই, আর বোধহয় হয়ে উঠল না। দ্যাখ, তোরা হতে পারিস কিনা?”
বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গিয়েছিল রবীনের। ইদানীং এটা হয়। চট করে চোখে জল এসে যায়। আসলে এমনিতে তো আশাবাদী হওয়ার মত বিশেষ কিছু নেই, যখন কোন তরুণ কমরেড এরকম কথা বলে তখনই শুধু মনে হয় সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি, শেষ হয়ে যায় না।
তবে পল্টু ঘোষের শাস্তিবিধান যে হবে না সেটা রবীন সেদিনই বুঝে গিয়েছিল। উদ্দালক নতুন ছেলে তাই ও ভেবেছিল মিটিঙে ইতিবাচক সিদ্ধান্তই হবে। কিন্তু রবীন পার্টি আর ফুলপ্যান্ট ধরেছিল একসঙ্গে। এই ষাট বছর বয়সে কোন্ মিটিঙে কী হতে চলেছে সেটা বুঝতে আর মিটিং অব্দি অপেক্ষা করতে হয় না। শ্যামল ব্যাপারটাকে আলোচনার বিষয় করেছে কোন ব্যবস্থা নিতে চায় না বলেই। লোকাল কমিটির অধিকাংশ সদস্যই ওর ধামাধরা। এল সি এসের কথাই তাদের বেদবাক্য। অতএব শেষ অব্দি এই সিদ্ধান্তই হবে যে “পার্টি পুলিশের কাজ করতে যাবে না।” একথা রবীন আগেই বুঝতে পেরেছিল। পরের শনিবার মিটিঙে ঠিক তাই হল।
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে উদ্দালক বলেছিল “রবীনদা, লোকাল কমিটি যা-ই বলুক, ব্যাপারটা তো অন্যায়। চলুন না পাড়ার লোকের সঙ্গে গিয়ে আমরাই ভেঙে দিয়ে আসি দোকানটা। আপনি লিড করলে অনেক পার্টি মেম্বারই চলে আসবে।”
“সেটা করা যায় কিন্তু তারপরে আর পার্টিতে থাকা যাবে না। আর আমরা পার্টি ছাড়া মানে পার্টিটাকে বাজে লোকেদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। সেটাও কোন কাজের কথা নয়।”
“তাহলে কী করা উচিৎ?”
“ধৈর্য ধরতে হবে। কমরেডদের বোঝাতে হবে। সবকিছু কি এক্ষুণি এক্ষুণি হবে বাবা?”
“তার মানে তদ্দিন পল্টুর চোলাইয়ের ব্যবসা রমরমিয়ে চলবে?”
“অগত্যা। তবে আরেকটা উপায়ও আছে। জানি না কতটা কাজে দেবে।”
পরদিনই অন্য উপায়টা পরখ করে দেখেছিল রবীন। বাজারে দেখা হয়ে যাওয়াতে পল্টুর বাবাকে একপাশে ডেকে বলেছিল “তোমাগো দোকানটা এইবারে ভাইঙা ফ্যালামু ভাবতাছি, দেবুদা।” নিমেষে দেবুর মুখটা চুরি করে দুধ খেয়ে ধরা পড়া পোষা বেড়ালের মত হয়ে গিয়েছিল। মুখটা নামিয়ে নিয়ে সে চুপচাপ শুনে গেল।
“তোমাগো দোকানে মদ বিক্কিরি হয় ক্যান? মদের দোকান করনের লাইগ্যা তোমারে পঞ্চায়েত লোন দিছিল?”
“আমার নাতির নামে দিব্যি কইরা কইতাছি রবীন, আমি হেইডা একদম সমর্থন করি না। আমি পল্টুরে অনেকবার বারণ করছি। কিন্তু হেয়া এখন বড় হইয়া গ্যাছে, আমার কথা শোনে কৈ? একদিন তো এই নিয়া কথা কাটাকাটি কইরা আমার গায়ে হাত তুইলা দিছে।”
কাঁদতে কাঁদতে মাটিতেই বসে পড়ে অশক্ত বৃদ্ধ দেবু ঘোষ।
“অ! এই স্বভাব হইছে? এত বাড় বাড়ছে যে বাপের গায়ে হাত তোলে? তাইলে তো আরোই দোকান ভাইঙা দেয়া দরকার।”
এবার দেবু একেবারে পা জড়িয়ে ধরে রবীনের। “এই সর্বনাশ তুমি কইরো না। দুটি পায়ে পড়ি। আমার বউমা, নাতির মুখ চাইয়া ছাড়ান দ্যাও।”
ব্যাপারটা ঠিক এইখানেই আনতে চাইছিল রবীন। তাই সে বলে “দ্যাখো দেবুদা, দোকানডা তুমি অনেক কষ্ট কইরা করছিলা। তাছাড়া তুমি পার্টির জন্যেও কম করো নাই। তাই এত কইরা কইতাছি। অন্য কেউ হইলে কিছুই কইতাম না, সোজা যাইয়া ভাইঙা দিতাম। তোমারে এক মাস সময় দিলাম। এর মইধ্যে পল্টুরে কও এইসব দুনম্বরী ধান্দা বন্ধ করতে। নাইলে কিন্তু আর তোমার কথা মনে থাকব না।”
পল্টু যে বাপকে ঠ্যাঙায় এটা শোনার পরে এই টোটকা কাজ করবে বলে আর রবীন আশা করেনি। সে এ-ও জানত যে এক মাস পর কোন ব্যবস্থাই নেওয়া যাবে না। তবু এটা করল যাতে অন্তত নিজের কাছে পরিষ্কার থাকা যায়, যাতে নিজেকে বোঝাতে পারে “আমার যতটুকু সাধ্য আমি করেছি।”
তবে নিজেকে ঠকানো বড় শক্ত। “সত্যিই কি আমার ক্ষমতা এইটুকুই?” এই প্রশ্নটা বারবার ফিরে আসছিল, বিশেষত রাতে শোয়ার পর। এপাশ ওপাশ করতে করতে বাঁদিকে কাত হয়ে চোখ খুললেই বাইরের ঘরে আলমারির মাথায় রাখা হীরুদার ছবিটার উপর চোখ পড়ে। ঐ মানুষটা বেঁচে থাকলে এই সংশয়টা তৈরিই হত না। একবার এও মনে হয়েছিল যে উদ্দালকই ঠিক বলেছে। ওটাই করে ফেললে হয়। কিন্তু অল্পবয়সীগুলোর কথা ভেবেই ভাবনাটা বাতিল করতে হয়েছিল। বেআইনি মদের ঘাঁটি ভেঙে দেওয়ার জন্যে রবীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সাহস শ্যামলের হত না। তবে উদ্দালকের মত ছেলেদের পেছনে হয়ত অন্য কোনভাবে লেগে যেত। তাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হত — ওদের টাইট দেওয়া আর রবীনকে দুর্বল করে দেওয়া। ফলে পল্টু ঘোষের দুনম্বরী ব্যবসা টিকে গেল। রবীন শুধু দেবুর হাতের চা খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। রিডিং ক্লাবে গেলে আজকাল চায়ের তেষ্টা পেলেও ও উচ্চবাচ্য করে না। অবশ্য ওখানে যাওয়ার দরকারও চট করে হয় না। রিডিং ক্লাব এখন গসিপ ক্লাব। পার্টি ক্লাস তো আজকাল স্কুলবাড়িগুলোতেই করা হয়, আর আগেকার মত ভাল বক্তা এনে সেমিনার করার উৎসাহ কমরেডদের মধ্যে বিশেষ নেই। বইপত্র আর পড়ে কে যে ওখান থেকে বই নেবে বা বই নিয়ে আলোচনা হবে?
এইসব ভাবতে ভাবতে রবীন কালীতলা পেরিয়ে গেল। পল্টুর বাইকটা চোখে পড়ল। মদ বেচছে, বাপকে ঠ্যাঙাচ্ছে আর দুবেলা কালীবাড়ি যাচ্ছে। “খাসা জীবন”, রবীন আপনমনেই বলে ওঠে। দেবুর কথা ভাবলে খারাপই লাগে। বেচারা বোধহয় মরতে পারলে বেঁচে যায়। কিন্তু দিব্যি বেঁচে আছে, রীতিমত সুস্থ শরীরে। রিকশাওয়ালা শম্ভুও যদি এখন বিদেয় হয় তাতে কারো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। ওর বউ মরেছে অনেকদিন, ছেলে মানুষ হয়ে গেছে, জীবনে ওর আর নতুন কিছু করার নেই, নেশা করে ছেলে-বউকে বিব্রত করা ছাড়া। অথচ ও-ও বেঁচে আছে। এতবছর ধরে মদ-গাঁজা টানার পরেও অসুখবিসুখ তেমন কিছু নেই। শুধু চোখে একটু কম দ্যাখে। সে তো ৬০-৬৫ তে হতেই পারে। গোঁয়ারগোবিন্দ বলে চশমা পরতে চায় না, নয়ত এতেও অসুবিধা হত না।
তবে যে লোকটা এখুনি মরে গেলে তবু কিছুটা সম্মান নিয়ে মরতে পারত সে হল এল সি এস শ্যামল। ভাবতে অবাক লাগে রবীনের যে এই লোকটা কী পরিমাণ আত্মত্যাগ করেছে এক সময়। ভাল সরকারী চাকরি পেয়েছিল বাবার পরিচিতির কারণে। পেতে গেলে কমিউনিস্ট পার্টি করা ছাড়তে হত শুধু। নেয়নি সে চাকরি। রাগে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর আগে অব্দি লুকিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যেত, থাকত শ্বশুরবাড়িতে। সেই লোক এখন উপদল করতে ব্যস্ত। কী করে বড় নেতাদের প্রিয় হয়ে নিজে আরো বড় নেতা হবে সেটাই একমাত্র চিন্তা। বামফ্রন্ট সরকার হওয়ার পরে কাজের কাজ বলতে করেছে শুধু শালার আর ছেলের চাকরির ব্যবস্থা। কংগ্রেস আমলে লোকটা ছিল অকুতোভয়। কম লাঠির বাড়ি খেয়েছে? সবমিলিয়ে জেল খেটেছে বছর তিনেক। আর এখন? মদের ঠেক ভাঙতে ভয় পায়। ভয় পায় নাকি পেয়ারের লোক বলে পল্টুকে আড়াল করছে? যা-ই হোক, ঐ লোককে এভাবে দেখে বড় ঘেন্না হয়। একা রবীনের হয় তা নয়। অনেক সাধারণ লোকও ইদানীং পেছনে গাল দেয় শ্যামলদাকে, বলে “শালা যদ্দিন ফালতু পার্টির নেতা ছিল তদ্দিন ভদ্দরলোক ছিল। ক্ষমতা পেয়েই আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে।” সকলের সবটুকু শ্রদ্ধা হারানোর আগে মারা গেলেই ভাল হয় না? বয়সও তো প্রায় সত্তর হল ওঁর।
নিজের সম্পর্কেও একই কথা মনে হয় রবীনের। না বিপ্লব হল, না গরীব মানুষের জন্য কিছু করা হল, না নিজের আপাদমস্তক কমিউনিস্ট হওয়া হল। এমনকি নিজের ছেলেটাও মনের মত হল না। কী লাভ আর বেঁচে থেকে? শরীরে কোন গ্লানি নেই সত্যি। কিন্তু ৫৮-৫৯ এ কি মরে না কেউ? হঠাৎ হার্ট ফেল করে? এ তল্লাটে অবশ্য এরকম হয় না খুব একটা। এখানে যাদের না বাঁচলেও চলে তারা অনেকদিন বাঁচে। মরে উদ্দালকের মত ছেলেরা, যাদের অনেকদিন বাঁচা দরকার ছিল।
রবীন সাইকেল থেকে নামে।
“কী রে, ম্যাটাডোরকে খবর দেওয়া হয়েছে?” পার্টির ছেলেগুলোকে জিজ্ঞেস করে।
*এই উপন্যাসের সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। কোন সত্যি ঘটনা বা জীবিত/মৃত ব্যক্তির সাথে মিল পাওয়া গেলে তা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। কিছু বাস্তব চরিত্রের নাম এসেছে কেবল সময়কাল বোঝাতে
ভাল লাগলে টাকা পাঠাতে পারেন:
মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে journopratik@okhdfcbank কে
অথবা
নেট ব্যাঙ্কিং বা অন্য উপায়ে নিম্নলিখিত অ্যাকাউন্টে
Pratik Bandyopadhyay
A/c No. 14041140002343
HDFC Bank
Branch: South Calcutta Girls’ College
IFS Code: HDFC0001404
MICR Code: 700240048