ঠিক সাতটা অনুচ্ছেদ। কারণ এই ঘটনা এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য নয়।
১) শরীর, নারী শরীর তো বটেই, অবশ্যই বিদ্রোহের হাতিয়ার হতে পারে। মণিপুরের মায়েরা এক সময় রাষ্ট্রীয় ধর্ষণের প্রতিবাদে উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন। হাতের ব্যানারে লেখা ছিল “INDIAN ARMY RAPE US.” এরকম বিস্ফোরক রাজনৈতিক বক্তব্য নিজের শরীরকে ব্যবহার করে প্রকাশ করা যায়। আবার সাধারণভাবে ধর্ষণ, যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে মহিলারা slut walk ও করে থাকেন। সুতরাং শুধু বুকে বা পিঠে কেন, হাতে পায়ে মাথায় পশ্চাদ্দেশে — যেখানে ইচ্ছা হয় আপনি কিছু লিখে ছবি তুলতেই পারেন। কিন্তু সেটা যদি বিদ্রোহ বলে গ্রাহ্য হতে হয় তাহলে লেখাটার সারবত্তা থাকতে হবে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে খিস্তি বসিয়ে দিলেই বিদ্রোহ হয় না। মণিপুরের মায়েদের মত বা যাঁরা slut walk করেন তাঁদের মত বিদ্রোহী হতে গেলে কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার —- সকলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। তাতে নানাবিধ ক্ষতির ঝুঁকি থাকে। সেজেগুজে একটি জনপ্রিয় উৎসবে যোগ দেওয়ায় কোন ঝুঁকি নেই। ভাইরাল হতে চাওয়া বিদ্রোহ নয়।
২) রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ বা প্যারডি এমন কিছু অভূতপূর্ব ব্যাপার নয় যা রোদ্দুর রায়ের ক্ষণজন্মা প্রতিভার দৌলতে এই সোনার বাংলায় ঘটতে পারল। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই ওসব হয়েছে, স্বয়ং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় করেছেন। বিশিষ্ট সমালোচক জ্যোতি ভটাচার্য দেখিয়েছেন কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর একটা কবিতায় ‘ভারততীর্থ’ কবিতার কিছু পংক্তি নিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন। কিন্তু তাঁরা আনতাবড়ি খিস্তি যোগ করে কাজ সারেননি। “উনি ব্যঙ্গ করেছেন অতএব আমি করলে দোষ নেই” — এটা অশিক্ষিতের যুক্তি। কী করেছেন তা দিয়ে আপনার বিচার হবে, স্রেফ করেছেন বলেই বাহবা দাবী করতে পারেন না কেউ। সে আপনি মেঘ বা রৌদ্র যা-ই হন।
৩) অনেক বুদ্ধিমান লোক ‘শেষের কবিতা’ র বিভিন্ন অংশ উদ্ধৃত করে রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই এই অসভ্যতার ওকালতি করাতে চাইছেন। প্রচুর লাইকও পাচ্ছেন, কারণ উপন্যাস পড়ার সময় আজকাল কারোর নেই। যাঁরা আগ্রহী তাঁরা উপন্যাসটা পড়লে দেখবেন যে অংশগুলো উদ্ধৃত হচ্ছে সেগুলো অমিত রায় এবং সে যে ছদ্মনামে রবিবাবুর বিরোধিতা করত, সেই নিবারণ চক্রবর্তীর বক্তব্য, রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য নয়। আর অমিত চরিত্রটি কী এবং কেন সেটা উপন্যাসের শেষ পাতা অব্দি পৌঁছাতে পারলে বেশ বোঝা যায়। কথাটা যদি গোলমেলে মনে হয় তাহলে গুগল করে দেখে নিন negative capability মানে কী।
৪) সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে এক শ্রেণীর লেখক আছেন যাঁরা মনে করেন চাট্টি খিস্তি লিখলেই নবারুণ ভট্টাচার্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করা হয়। তাঁদের মধ্যে ব্যাপারটার প্রবল সমর্থন দেখতে পাচ্ছি। অবাক হচ্ছি না। যাঁরা কিংবদন্তির রাজহংসের জল বাদ দিয়ে দুধ খাওয়ার মত করে নবারুণের সাহিত্য থেকে তুলে নিয়েছেন কেবল খিস্তিটুকু, তাঁরা এই ধাষ্টামো সমর্থন করবেন না তো করবে কারা?
৫) ভারতের ফ্যাসিবাদীদের একটি প্রিয় খেলা আছে। ইংরেজিতে তার নাম whataboutery, আমি বাংলায় বলি বনলতা সেনগিরি। অর্থাৎ “এতদিন কোথায় ছিলেন?” এই কাণ্ডে দেখছি ফ্যাসিবিরোধীরা প্রবল বনলতা সেনগিরি করছেন। “দিল্লীতে জোর করে রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয় সঙ্গীত গাইয়ে খুন করে ফেলা হল। সেটা অশ্লীল মনে হয়নি?” “বিজেপি রবীন্দ্রনাথের কবিতা বিকৃত করে পোস্টার বানিয়েছে। সেটা অশ্লীল মনে হয়নি?” এ কি অদ্ভুত গা জোয়ারি রে বাবা! যারা রবীন্দ্রভারতীর কাণ্ডটার নিন্দা করছি তারা অনেকেই তো সোচ্চার বিজেপিবিরোধী, দিল্লীর দাঙ্গা নিয়েও সোচ্চার থেকেছি। এই অসভ্যতা বিজেপি করেনি বলেই নিন্দা করা যাবে না? বা বিজেপিও নিন্দা করছে বলেই আমাদের প্রশংসা করা কর্তব্য? এ তো বিজেপির মতই অনর্থক বাইনারি তৈরি করা। তাও আবার বাংলার সংস্কৃতির পায়ুমৈথুন করে — ঠিক যেটা বিজেপি করতে চায়।
৬) বাড়াবাড়ি করা আমাদের জাতীয় স্বভাবে পরিণত হয়েছে। যেমন ক্রিয়ায় তেমনি প্রতিক্রিয়ায়। কিছু ছেলেমেয়ে অসভ্যতা করেছে, তাদের নিন্দা শুনতেই হবে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পারলে কিছু শাস্তিও দিতে পারেন। এদের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করার দরকার কী? এরা কি চুরি ডাকাতি করেছে না খুন জখম করেছে? আর উপাচার্যই বা কিসের নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে পদত্যাগ করতে চাইছিলেন?
৭) গত দশ-বারো বছরে রাস্তাঘাটে খিস্তি দিয়ে কথা বলা যে দ্রুততায় ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, একই দ্রুততায় ভারতীয় পুরুষদের ধর্ষণ করার ইচ্ছাও বেড়েছে। কিছু মেয়ের পিঠ দেখা যেতেই সেই ইচ্ছা বেরিয়ে আসছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার! মেয়েদের পিঠ দেখা গেছে! আবার সে পিঠে কিসব লেখা! এ উত্তেজনা সামলানো যায়? যাদের মেয়েদের হাতের তালু দেখলেও গা শিরশির করে, তারা যে পিঠ দেখে মত্ত হাতীর মত আচরণ করবে তাতে আর আশ্চর্য কী?