কাশ্মীরের ভ্যালেন্টাইন

কাশ্মীরে কি আর্চি’স গ্যালারি আছে? সেখানে লাল টুকটুকে হৃদপিণ্ড কিনতে পাওয়া যায়?

প্রমাণ নেই, তবে সাক্ষী আছে। আমি কাশ্মীর গিয়েছি। তখন ডিজিটাল ক্যামেরার যুগ নয়। বাবা-মা কার থেকে যেন চেয়ে চিন্তে ক্যামেরাও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু জম্মু থেকে বাসে চাপার পর খেয়াল হয় ফিল্ম কিনে নিয়ে যাওয়া হয়নি। দাম্পত্যের তারুণ্যে যেরকম ভুল হয়ে থাকে আর কি। তখন ভ্যালেন্টাইন্স ডে না থাকলেও প্রেম তো ছিলই।

গল্পটা শোনার পর থেকে কাশ্মীর বললে প্রথমেই প্রেম মনে হয়। তারপর সাদা কালো টিভিতে ‘কাশ্মীর কি কলি’ দেখলাম। বঙ্গললনা শর্মিলার লালিমা সে টিভিতে বিশেষ ধরা পড়েনি। তবু কাশ্মীর মানেই রোম্যান্স, কাশ্মীর মানেই প্রেম — এ একেবারে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল। ইংরেজি সাহিত্য পড়তে ঢুকেছি। যে মাস্টারমশাই জর্জ বার্নার্ড শ পড়াবেন তিনি অ্যান্টি রোম্যান্টিক নাটক পড়াবেন বলে ক্লাসে জিজ্ঞেস করলেন রোম্যান্টিক বললেই কী মনে আসে? সশব্দ চরণেই প্রেম এসে পড়ল। তখন জিজ্ঞেস করলেন রোম্যান্টিক ফিল্ম বলতে কার কোনটা মনে পড়ে? ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’ এর মাঝখানে আমি বলে ফেললাম ‘কাশ্মীর কি কলি’। মাস্টারমশাই চোখ কপালে তুলে পরিষ্কার বাংলায় বললেন “এ তো ঠাকুরদাদার আমলের ছবি, বাবা। তুমি কি সেই যুগের লোক নাকি?” সেই গঞ্জনাও আমাকে দাবায়ে রাখতে পারেনি। তার আগে এবং পরেও যার প্রতিই মনটা দ্রব হয়েছে তাকেই বলার চেষ্টা করেছি “বরসোঁ সে খিজা কা মৌসম থা, উইরান বড়ি দুনিয়া থি মেরি।” বেশিরভাগ যে শুনতে পায়নি বা পেলেও আশা ভোঁসলের মত জবাব দিতে রাজি হয়নি সে কথা আলাদা।

ইতিমধ্যে আবার ‘রোজা’ এসে পড়েছে। তার পোস্টারে পর্যন্ত গোলাপ ফুল। তামিল দম্পতির “ইয়ে হসিঁ ওয়াদিয়াঁ ইয়ে খুলা আসমাঁ” তে দুষ্টু মিষ্টি মধুচন্দ্রিমার আত্মার উপর ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের নরকের দুঃস্বপ্ন। উফ! কি রোম্যান্টিক! এক শর্মিলায় রক্ষে নেই, মধু দোসর।
ঐ যে বলে বয়স বাড়া ভাল নয়? ঠিকই বলে। কাশ্মীর নিয়ে মাখো মাখো রোম্যান্স ভেঙে গেল বয়স বাড়তেই। সে-ও অবশ্য নারীঘটিত ব্যাপার। অরুন্ধতী রায়। কে যে ওঁকে কুনান পোশপোরা ইত্যাদি যাচ্ছেতাই ব্যাপার নিয়ে লিখতে বলে! তবু চলে যেত বলিউডে মগ্ন থাকলে, সব মাটি করলেন বিশাল ভরদ্বাজ। উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট পড়ে যদি কেউ কাশ্মীরের কথা ভাবে, তাকে ঠেকানো শক্ত। কি যে বিপদ করেছেন ভরদ্বাজ বামুন আর বাশারাত পীর মিলে! এখন কাশ্মীর বললেই, প্রেম বললেই শর্মিলা নয়, মধুও নয়, শ্রদ্ধা কাপুরের কবর মনে পড়ে।

তা ভাবছিলাম কাশ্মীরে কি আর্চি’স গ্যালারি আছে? সেখানে লাল টুকটুকে হৃদপিণ্ড কিনতে পাওয়া যায়? ছ মাস আগের স্টকে ঝুল পড়ে যায়নি? পোকায় কাটেনি? আচ্ছা ওখানকার ছেলেমেয়েরা হোয়াটস্যাপে প্রেম করছে আবার? কাদের যেন হোয়াটস্যাপ অ্যাকাউন্ট নিজে নিজে বন্ধ হয়ে গেছে শুনেছিলাম?

ও হ্যাঁ, ‘শিকারা’ নামে একটা ছবি বেরিয়েছে। সেটাও প্রেমের ছবি। না বললে লোকে বলবে “কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কথা তো বললেন না?” কী করে বোঝাই প্রেম আর উদ্বাস্তু একসাথে বললে আমার প্রথমেই সুপ্রিয়া দেবীর কথা মনে পড়ে!
আচ্ছা গত ছ মাসে কতজন কাশ্মীরি পণ্ডিত কাশ্মীরে ফেরত গেছে কেউ বলতে পারবেন? যারা গেছে তারা কি ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করছে? রবাবে বলিউডি গান দারুণ জমে কিন্তু। ধরুন আপনি একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত মহিলা, ঝিলামের ধারে বসে চোখ বন্ধ করে শুনছেন একটি সুপুরুষ কাশ্মীরি ছেলে বাজাচ্ছে “এক থা গুল ঔর এক থি বুলবুল।”

আহা! চটছেন কেন? লাভ জিহাদে উস্কানি দিচ্ছি না। ও গানটায় শশী কাপুর আর নন্দা ছিলেন। দুজনের কেউই মুসলমান নন। শশীর দাদা শাম্মিও মুসলমান নন, শর্মিলা তো খোদ ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। অতএব ওসব ছবি দেখলে আজও দোষ নেই।

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

One thought on “কাশ্মীরের ভ্যালেন্টাইন”

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading