হৃদয়ে ভোরের শব্দ: কোলাহলহীন কবিতা

শ্রেষ্ঠ বিপ্লবীরও প্রেমের চুম্বন দরকার হয় লড়াইয়ের জ্বালানি হিসাবে

অনস্বীকার্য যে সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। কিন্তু বাংলা ভাষার অধোগতি যত দ্রুত হচ্ছে তার সাথে পাল্লা দিয়েই যেন কবিযশপ্রার্থী বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক সময় ফেসবুক টাইমলাইনে কবিতার (যেগুলো পৃথিবীর কোন সংজ্ঞা অনুযায়ী কবিতা নয়) প্রাবল্যে বমি পায়। সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে যখন সত্যিকারের কবিতা মাথা তুলে দাঁড়ায়, তখন বুকের ভেতর থেকে যে শব্দ কানে আসে সেটাই ‘হৃদয়ে ভোরের শব্দ’।

অনাড়ম্বর মন ছুঁয়ে যাওয়া প্রচ্ছদ উল্টে প্রথম কবিতাটা পড়তে গিয়েই যখন পাই

আশ্চর্য মুহূর্তরা রোদ্দুরের ধারে শুয়ে
অগ্নিশুদ্ধ প্রতীক্ষায় লীন

তখন সহসা বিশ্বাস হতে চায় না এটা কৌস্তভ দাশগুপ্তের প্রথম কবিতার বই।

বিশ্বাস করতাম না, যদি কৌস্তভ আমার স্কুলবেলার বন্ধু না হত। বিশাল চেহারা অথচ ঈষৎ লাজুক। নিতান্ত ঘনিষ্ঠতা না হলে কৌস্তভের ভাবনার হদিশ পাওয়া মুশকিল। কবিতাগুলো পড়তে পড়তে বুঝতে পারছিলাম গোটা হাইস্কুল জীবন এক ক্লাসে পড়ে, অনেক সময় এক বেঞ্চে বসেও কৌস্তভের প্রাণের মাঝে যে এত সুধা আছে সে খবর পাইনি।

হৃদয়ের শব্দ শুনতে পাওয়ার জন্য যে নৈঃশব্দ্য জরুরী, তা প্রতিনিয়ত খান খান হয়ে যাচ্ছে। এ বইটার সবচেয়ে বড় গুণ হল পড়তে পড়তে চারপাশের সেই কোলাহল ক্রমশ আর কানে পৌঁছায় না। মন চলে যায় এমন এক সময়ে যখন প্রেম অনুভবের বিষয় ছিল, উদযাপনের নয়। এ ধরনের কবিতার বা সাহিত্যের একটা সমালোচনা চিরকাল ছিল, হয়ত থাকবেও। সেটা হল এগুলো সমকাল থেকে বিযুক্ত। এই সমালোচনা কোনদিন আমার মাথায় ঢোকেনি। প্রেমের চেয়ে মহত্তর মানবিক অনুভূতি কিছু আছে বলে জানি না, আর অনুভূতি চিরকালীন। আলাদা করে সমকালীন হওয়ার কোন প্রয়োজন তার আছে বলে মনে হয় না। কৌস্তভ যখন লিখছে

আজ কি তবে শিশির বলে ভুল করেছি তোমার চোখের জল?
আজ কি তবে ভোর ছিল না?… শুধুই ছিল ধূসররঙা শোকের চলাচল?

তখন সে নিঃসন্দেহে সব কালের সব প্রেমিকের জিজ্ঞাসাকেই লিখে ফেলছে, এ কালের প্রেমিকের তো বটেই। আমার অবশ্য আরো একটা কথা মনে হয়।

বার্টোল্ট ব্রেখট বলেছিলেন অন্ধকার সময়েও গান হবে, অন্ধকার সময়টাকে নিয়েই গান হবে। ঠিকই বলেছিলেন, কিন্তু সেটাও শেষ কথা নয়। অন্ধকার সময়েও আলোর গান গাইতে হবে। নইলে অন্ধকারের আগে যে আলো ছিল সে বিশ্বাস হারিয়ে যাবে। গল্প, উপন্যাস, সিনেমার কথা জানি না। কিন্তু অন্ধ মেয়েকে জ্যোৎস্নার ধারণা কবি ছাড়া আর কে দেবেন? তাই দারুণ ধ্বংসের মধ্যে, লড়াইয়ের মধ্যে দাঁড়িয়েও স্রেফ প্রেমের কবিতা লিখেছে বলে কোন কবিকে পলায়নী মানসিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে না। শ্রেষ্ঠ বিপ্লবীরও প্রেমের চুম্বন দরকার হয় লড়াইয়ের জ্বালানি হিসাবে। তেমনি ধ্বংস, রক্তপাত, প্রতিবাদের কবিতার মতই নীচের পংক্তিগুলোর প্রয়োজনও ফুরোবার নয়।

মেদুর বর্ষায় রাঙানো ভরসায়
দুপুর জলে ভেজা অন্তরীপ
সাঁকোটি পার করে এসেছি, ভেসে গেছি,
সোনালুগাছ রাখে একলা টিপ

তাহলে কৌস্তভের প্রথম কবিতার বই কি নিখুঁত, ত্রুটিমুক্ত? এক্ষুণি দু চারজন প্রথিতযশা কবির সাথে তুলনা করে ফেলা উচিৎ ওকে? বন্ধুবান্ধবদের লেখা নিয়ে তেমন আদিখ্যেতা করার একটা চল হয়েছে বটে, তবে আমি সে রাস্তায় যাব না। কারণ যে কোন কবিতালেখককে শেষ পর্যন্ত নিজের লেখার উপর ভর দিয়েই দাঁড়াতে হয়, বন্ধুদের উচ্ছ্বাসের উপর নয়।
খামতির কথা বলতে গেলে বলতেই হয় এই বইয়ের বেশ কিছু কবিতায় বয়ঃসন্ধির ছেলেমানুষী প্রেমের স্মৃতি কাব্যগুণকে ছাপিয়ে গেছে। সেই কবিতাগুলো মননে বা প্রকরণে অন্যগুলোর উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। দু এক জায়গায় সম্ভবত মুদ্রণ প্রমাদও ঘটেছে, ফলে রসভঙ্গ হচ্ছে। তদসত্ত্বেও প্রথম কবিতার বই লোভী করে তুলল। কৌস্তভের কবিতা এরপর কোন দিকে যায়, প্রেমের কোন অদেখা দিক কৌস্তভ এরপর দেখায় — এইসব জানার লোভ।

যে কবিতাটা আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে, সেই তিন নম্বর কবিতাটা সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করার লোভ আর সামলাতে পারছি না। মধুরেণ সমাপয়েৎ।

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি তখন, স্নান সারছে তোদের বাড়ি
থমকে আমার চিলেকোঠায়, দুইখানি চোখ সুদূর পাড়ি
বৃষ্টি এলো, বৃষ্টি এলো! চল ছাদে চল তাড়াতাড়ি
পূবের দিকে বাবার জামা, পশ্চিমে মা দিদির শাড়ি
এইবেলা না তুললে পরে সবটা ভিজে একসা হবে
বৃষ্টিবিকেল, আমার দুচোখ আটকে গেছে কোথায় কবে!
বসতবাড়ির নীল মরসুম, চটজলদি ফুলের টবে
শব্দ কিছু দিই উড়িয়ে, শব্দ কিছু থাক নীরবে

কাঁধের ডানে ছাপা শাড়ির শরীর জুড়ে দমকা হাওয়া
একটা জীবন ছোট্ট ভারী, আমার তোমায় দেখতে পাওয়া
আয় বৃষ্টি যায় বৃষ্টি, জমছে কথা বলতে চাওয়া
ইচ্ছেগুলো স্টীমারঘাটে, ইচ্ছেরা সব নৌকা বাওয়া

নিঝুম রাতের রূপকথারা অসীম নাভি মেঘলা ক্ষত
শূন্য দু’হাত তোমার টানে শ্রাবণধারায় রমণরত
হঠাৎ যেন নেই কেউ নেই, সামনে দাঁড়াও দেবীর মত
দশ দিকে থাক আঁধারজীবন, মাঝখানে প্রেম লজ্জানত
বৃষ্টি এলো, বৃষ্টি এলো! যাচ্ছি ধুয়ে অতর্কিতে
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি তখন… জ্যোৎস্না লুকোয় ১০ এর B তে

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading