মেধামেধ যজ্ঞ

মানুষের পেট যেহেতু ভিসুভিয়াস নয়, সেহেতু পঁচিশ দিন কেটে যাওয়ায় জঠরাগ্নিও বোধহয় নিভে গেছে

আজ কলকাতায় মহোৎসব ছিল। এ বছরের আই পি এল এর প্রথম খেলা। রাজভবনের উল্টোদিকে বাস থেকে নেমে যখন বাঁয়ে ঘুরে হাঁটছি, তখন উলটোদিক থেকে জনস্রোত ধেয়ে আসছে। নানারকম মুখ। রংচঙে, ঝকঝকে, হাত ধরাধরি করে প্রেমিক প্রেমিকা, বাবার হাত ধরে ছেলে, নাইট রাইডার্সের জার্সি পরিহিত বন্ধুদল। সকলেরই মুখ দেখে বোঝা যায় ফুরফুরে মেজাজ, ভর্তি পেট। কারো কারো হাতে ঠান্ডা পানীয়ের বোতল। এঁদের সকলের কাছে মহোৎসবের আহ্বান এসেছে। কিছু কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে। স্বর্গের বাগানের টিকিট কেটেছেন এঁরা কড়কড়ে নোট খরচ করে। কেনই বা মেজাজ ফুরফুরে থাকবে না?

এঁদের পেরিয়ে ধর্মতলার বাস ডিপোর মধ্যে দিয়ে হাঁটছি, নাকে আসছে ফুটপাথে রাঁধা বিরিয়ানি, ডিমের কারি, মাছের ঝোল, শস্তার চাউমিন, মোগলাই পরোটা, এগ রোল, পেয়ারা, শসার গন্ধ। ধর্মতলার এই আনন্দযজ্ঞে দিনমজুর থেকে শুরু করে আমার মত এ সি ট্যাক্সি চাপতে সক্ষম মানুষ পর্যন্ত সবার নিমন্ত্রণ।

আর এইসব রূপ রস গন্ধের অনতিদূরেই বসে আছেন, বা মাথা ঘুরছে, গা বমি ভাব আসছে বলে শুয়ে আছেন — আমার মেয়ের হবু মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা। একদিন দুদিন নয়, পঁচিশ দিন ধরে কিছু না খেয়ে। এমনও হতে পারে যে আগামী দিনে হয়ত এটাই নিয়ম হয়ে যাবে। এক বৃদ্ধকে দেখলাম একটি অসুস্থ মেয়ের পাশে বসে আছেন। সম্ভবত মেয়েটির বাবা। বলা যায় না, হয়ত আমার মেয়েকেও এরকম অনশনে বসতে হবে লেখাপড়া শিখে আর আমি তখন ঐ বৃদ্ধের জায়গায় গিয়ে বসব।

এই লড়াকু ছেলেমেয়েগুলোর প্রতি আমার অক্ষম, নীরব সমর্থন জানাতে কয়েক মিনিটের জন্যে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম পথপার্শ্বে, যেখানে এরা ত্রিপলের নীচে রাস্তায় বসে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কাটাচ্ছে। বিশ্বাস করুন, জায়গাটায় কোন গ্ল্যামার নেই, কোন বিপ্লব বিপ্লব গন্ধ নেই। কয়েকশো পরীক্ষায় পাশ তরুণ তরুণীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া বিশেষ কোন শব্দও নেই। সোশাল মিডিয়ায় অনেকেই ঠারেঠোরে যা বলতে চাইছেন বা সরকারপক্ষ হয়ত যে আশঙ্কায় এই আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করছেন, তেমন কোন রাজনৈতিক আগুনও জায়গাটায় জ্বলছে না। মানুষের পেট যেহেতু ভিসুভিয়াস নয়, সেহেতু পঁচিশ দিন কেটে যাওয়ায় জঠরাগ্নিও বোধহয় নিভে গেছে।

আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন, মামারা, জ্যাঠারাও এই পেশায় ছিলেন, স্ত্রীও শিক্ষিকা। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি যাঁদের জন্যে, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষক। শুনেছি একসময় শিক্ষকদের সংসার চালানো দুর্বিষহ ছিল, লোকে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইত না শিক্ষক পাত্রের সাথে। কিন্তু তখনো শিক্ষকদের এমন অসম্মান করেনি বোধহয় কোন সরকার। বিধানচন্দ্রের সরকার আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর গুলি চালিয়েছিল, সেকথা বাদ দিলে।

বেশ মনে আছে, বামফ্রন্ট আমলে একসময় স্কুলে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠত প্রায়ই। ম্যানেজিং কমিটির ভূমিকা নিয়ে প্রার্থীদের অসন্তোষ থাকত। যোগ্য প্রার্থী ভাল ইন্টারভিউ দিয়ে বেরিয়েও চাকরি পেতেন না। আমারই এক পরিচিত বহুদূর থেকে এক জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে স্টেশন থেকে স্কুলে যাওয়ার রিকশায় উঠেই চালকের মুখ থেকে শুনেছিলেন “আপনার চাকরি হবে না। সেক্রেটারির লোক আছে। তাকেই নেবে।”
সম্ভবত কতকটা সেই কারণেই কলেজের জন্যে যেমন নেট বা স্লেট পরীক্ষা, সেই আদলে এস এস সি পরীক্ষা চালু করা হয়েছিল। তার সুফল আমাদের প্রজন্মের বহু শিক্ষিত ছেলেমেয়ে পেয়েছেন। আমাদের বাবা-মায়েরা জানতেন, পশ্চিমবঙ্গে আর কোন চাকরি না হোক, এস এস সি টা পাশ করতে পারলে স্কুলের চাকরি হবেই। কিন্তু তা বললে তো চলবে না। আগের সরকারের কোন ভাল কাজকেও যে পরের সরকার রেয়াত করবে, এমন দাবী এ দেশে আর করা চলে না। পরিবর্তন আর উন্নয়নের জোয়ারে পুরাতন যাক ভেসে যাক। অতএব যে পরীক্ষা প্রতি বছর হওয়ার কথা, সে পরীক্ষা প্রায় প্রতি বিশ্বকাপে হচ্ছে। সে পরীক্ষার ফলাফলে আবার এত বেশি মেধাবী ছেলেমেয়ের নাম উঠে আসছে যে মেধা তালিকা প্রকাশ করাই যাচ্ছে না। তবু এই শ দুয়েক ছেলেমেয়ে চৈত্রের গরমে রাস্তায় বসে আছে সরকারের শুভবুদ্ধি উদয়ের আশায়। অহো, কি দুঃসহ স্পর্ধা!

কয়েকদিন আগেই ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ ছবিটা দেখছিলাম। নাজি অধিকৃত পোল্যান্ডের ক্রাকাউতে বন্দী শিবিরে দরকারী আর অদরকারী লোকেদের তালিকা বানানো হচ্ছে। একজন করে বন্দী এসে দাঁড়াচ্ছে আর নাজি কেরানি তার পেশা জিজ্ঞেস করছে। দরকারী বুঝলে পরিচয়পত্রে একরকম ছাপ, অদরকারী বুঝলে অন্যরকম। একজন বললেন “আমি ইতিহাস আর সাহিত্য পড়াই।” পত্রপাঠ অপ্রয়োজনীয় হওয়ার ছাপ পড়ে গেল। অসহায় শিক্ষক বিস্ফারিত নেত্রে বললেন “I teach history and literature. Since when it’s not essential?”

দেখে শিউরে উঠলাম। সাহিত্য, ইতিহাস — এসব পড়া যে দরকারী নয় তা তো আমরা ছোট থেকে শুনে আসছি। আর এই শেষ যৌবনে এসে দেখতে পাচ্ছি ওগুলো যাঁরা পড়ান তাঁরাও অদরকারী বলে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছেন। এই তো সেদিন এক প্রথিতযশা সাংবাদিক (অধুনা বিচারাধীন বন্দী হিসাবে শ্রীঘরে থাকায় যশে কিঞ্চিৎ টান পড়েছে অবশ্য) সদর্পে ফেসবুকে লিখে দিলেন তুলনামূলক সাহিত্যের মত ফালতু বিষয় তুলে দেওয়া উচিৎ। এসব পড়ে কোন লাভ নেই। লিখলেন শুধু নয়, কয়েকশো লাইকও পেলেন। আর এস এস সি পাশ করা ছেলেমেয়েদের আন্দোলন শুরু হতেই সোশাল মিডিয়ায় অদ্ভুতুড়ে তত্ত্ব জন্মাচ্ছে — যারা বিজ্ঞান পড়ে তারা নাকি বেশিরভাগই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে রাজ্যের বাইরে চলে যায়। পড়ে থাকে মেধাহীন বাংলা, ইংরিজি, ইতিহাসের ছেলেমেয়েরা। তাদের এস এস সি ছাড়া গতি নেই, তাই তারাই নাকি যোগ্যতা না থাকলেও চাকরি দাবী করে রাস্তা জুড়ে বসে আছে।

যারা এসব বলছে তারা বোধহয় জানে না গোটা দেশে কত হাজার ইঞ্জিনিয়ার বেকার, কত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আসন পূরণ হচ্ছে না কারণ লোকে বুঝে গেছে ওখানেও চাকরি নেই। নির্ঘাত তারা এও জানে না যে ঐ “not essential” এর তালিকায় বিজ্ঞানের শিক্ষক, গবেষকরাও ঢুকে পড়েছেন।

গত মাসের ঘটনা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারপোষিত বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ গবেষকদের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, শোন বাপু, এখন টাকাকড়ি নেই। অর্ধেক মাইনে দিচ্ছি, তাই নিয়ে চুপচাপ থাকো। পরে দেবখন বাকিটা। এদিকে খবরের কাগজ খুলে দেখুন। সরকারী বিজ্ঞাপনের কমতি নেই। যত অভাব মাস্টারমশাই, দিদিমণি, গবেষকদের মাইনে দেওয়ার বেলায়। এ রাজ্যেও যেমন শিক্ষকদের ডি এ, ইনক্রিমেন্ট দেওয়ার বেলায় শোনা যায় কোষাগার ফাঁকা। অথচ কার্নিভালের টাকা কম পড়ে না, থানা থেকে ডেকে ডেকে দুর্গাপুজোর টাকা দেওয়ার সময়েও টানাটানি হয় না।

আসলে ঐ যে “not essential”, ঐটেই হচ্ছে আসল কথা। যারা শেখায় তাদের যত অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া যাবে তত মানুষের শেখার আগ্রহ কমে যাবে, মগজ ধোলাই না করলেও সবাই বুঝে যাবে “বিদ্যা লাভে লোকসান, নাই অর্থ নাই মান।” তবে না হীরকের রাজা ভগবান হবে?

আর ভগবান হতে সাহায্য করি আমরা, যারা ফেসবুক ভরে আছি। আমরা ভাবছি এসব ধরনা, অনশন তো করছে বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীরা, যারা বাংলা মাধ্যমের স্কুলে চাকরি করতে চায়। এতে আমাদের কী? আমার ছেলেমেয়েকে তো ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে পড়াব, সে বড় হয়ে চাকরি করলে ওরকম স্কুলেই করবে। তো আমার ভারী বয়ে গেছে। কিন্তু এত নিশ্চিন্ত না থেকে একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন দেখি, আপনি কয়েক লাখ টাকা খরচ করে যে স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করেছেন সেই স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা কত টাকা মাইনে পান? এ ছুতো সে ছুতোয় যে বিপুল পরিমাণ টাকা স্কুল কর্তৃপক্ষ আপনার থেকে নিচ্ছেন প্রতিনিয়ত, তার কত শতাংশ শিক্ষক, অশিক্ষক কর্মীদের বেতনে খরচ হচ্ছে? চিত্রটা কিন্তু ভাল নয়।

আসলে শিক্ষা এখন ব্যবসায় পরিণত। কিসের ব্যবসা? কাঁচামাল সরবরাহের ব্যবসা। কাদের কাঁচামাল। কর্পোরেটের। আপনার ছেলেমেয়ে অঙ্ক করে মজা পাচ্ছে কিনা, তার মধ্যে ভবিষ্যতের গণিতবিদ তৈরি হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কেউ নিচ্ছে না। কারো সন্তান স্টিফেন হকিংয়ের মত মহাবিশ্বের রহস্য উদঘাটনে জীবন ব্যয় করুক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা চাইছে না। কারণ ওরকম ছাত্রছাত্রীকে মানবসম্পদ হিসাবে কোন কোম্পানি কিনবে না। আর যে শিক্ষা লাভের কড়ি উৎপাদনে কাজে লাগে না, তা “not essential.” একই কারণে সাহিত্য তথা তুলনামূলক সাহিত্যও ফালতু। কোন শিক্ষক বা শিক্ষিকার প্রণোদনায় (অনুপ্রেরণায় নয় কিছুতেই) যদি এক ঘর ছাত্রছাত্রী শিহরিত হয়ে আবিষ্কার করে জীবনানন্দের কোন পংক্তি আজকের প্যালেস্তাইনের কোন কবির প্রায় অনুবাদ বলে মনে হচ্ছে, তাতে আম্বানি বা জ্যাক মায়ের কী লাভ? উল্টে বিপদ। কারণ “এরা যত বেশি শেখে, তত বেশি জানে, তত কম মানে।”

অতএব, এক দিকে ব্যাঙের ছাতার মত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে ওঠে, যেখানকার দেয় বেতন মহার্ঘ। অন্যদিকে জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন সাধারণ পড়ুয়ার নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এ রাজ্যে কম বেশি যা-ই নম্বর পাও, কলেজে ভর্তি হতে হাজার হাজার টাকা উৎকোচ দিতে হয়। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি না পেয়ে খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকতে হয়, অথচ শিক্ষকের অভাবে স্কুল চলে না, ছাত্রসংখ্যা কমে যায়, স্কুল উঠে যায়।
দেখে শুনে আমি আপনি কী করব? বাবা-মা হিসাবে যেটুকু করতে পারি। অর্থাৎ সামর্থ্য আছে বলে বেসরকারী স্কুলে সরিয়ে নেব, বহুজাতিকের জন্যে মানবসম্পদ তৈরি করব। আর যে বাবা-মায়ের সামর্থ্য নেই, তাঁদের ছেলেমেয়ের আর লেখাপড়া শেখা হবে না, সে মানবসম্পদ হয়ে উঠতে পারবে না। আমরা “essential”, ওরা “not essential”। বিশ্বাস করুন, এখানে মেধার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির কোন ভূমিকা নেই।

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading