বেঁচে থাক ডিম ভাত

আজকের পৃথিবীতে রাজনৈতিক সমাবেশ সবচেয়ে বড় জায়গা যেখানে আপনাকে আপনার ক্রয় ক্ষমতা অনুযায়ী মাপা হয় না

ডিম্ভাত নিয়ে চলা বিদ্রুপ এবং তার প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে কতকগুলো কথা বলা দরকার যেগুলো মমতার ব্রিগেড সমাবেশ, বামেদের ব্রিগেড সমাবেশ ছাড়িয়েও প্রাসঙ্গিক।
১) যাঁরা কোনোদিন কোনো রংয়ের রাজনৈতিক মিছিলে বা সমাবেশে যাননি এবং যাওয়াটা “down market” বলে মনে করেন তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলি, বহু মানুষের সাথে হাঁটলে অথবা দিগন্তবিস্তৃত মাঠে লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে বসে থাকলে আর কিছু না হোক একটা জিনিস হয় সেটা হল ইগো নিয়ন্ত্রণে আসে। ছশো কোটি মানুষের দুনিয়ায় আপনি কত ক্ষুদ্র, কত অকিঞ্চিৎকর সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। শুধু এই কারণেই নিয়মিত মিছিলে, মিটিঙে যাওয়া যেতে পারে। ল্যাজ মোটা হওয়া আটকানোর এর থেকে ভাল প্রতিষেধক নেই।
২) ব্রিগেডের সমাবেশে আসা লোকেদের উদ্দেশ্য বা কোন লোভ দেখিয়ে তাদের নিয়ে আসা হয়েছে তা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ নতুন কিছু নয়, বরাবর হয়ে আসছে। আমাদের বাল্যকালে, সিপিএম তথা বামফ্রন্ট যখন মধ্যগগনে, তখন একটি সংবাদপত্রের উত্তর সম্পাদকীয় স্তম্ভে দীর্ঘ লেখা বেরিয়েছিল, যাতে প্রশ্ন করা হয়েছিল “যে দেশে ব্রিগেড নেই সে দেশে কি গণতন্ত্র নেই?” পৃথিবীর সব দেশের গণতন্ত্র এক ছাঁচে ঢালা হোক, একই অর্থনীতি সব দেশে চলুক এই নিও লিবারেল বদমাইশি যাদের তত্ত্ব, বলা বাহুল্য তারাই এসব লিখেছিল। বিশ্বায়নের দুই দশকে আমরা, এ দেশের মধ্যবিত্তরা, এই বুলিগুলো মুখস্থ করে ফেলেছি। বহুজাতিক ব্র‍্যান্ডের জুতো আর জিনস পরতে পেরে আহ্লাদিত আমরাই এখন সগর্বে সকলকে বোঝাই গণতন্ত্র মানে হল পাঁচ বছর অন্তর ভোটটি দিয়ে বাকি সময়টা ঘুমিয়ে থাকা। বিরোধিতা মানেই “disruption” অতএব মিটিং, মিছিল, বনধ সবকিছুই কর্মনাশা। যাদের কর্ম নাশ হচ্ছে রোজ তারা ঘুমিয়ে থাকুক, আমাকে আমার কর্ম করতে দিক। এই চিন্তাভাবনা থেকেই ডিম্ভাত ব্যঙ্গ। এবং এই নিষ্ক্রিয়তার চাষবাসেরই ফল মমতা এবং মোদীর একনায়কত্ব, যেখানে প্রতিবাদ করলেন মানেই আপনি যথাক্রমে উন্নয়নবিরোধী এবং অ্যান্টি ন্যাশনাল। নিও লিবারেল অর্থনীতি, রাজনীতি এখন অস্তাচলে। জায়গা নিচ্ছে ট্রাম্প, ব্রেক্সিট, বলসোনারোর দল। অতএব ফ্রান্সে ব্রিগেড নেই, গণতন্ত্র আছে এবং সেখানে ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন চলছে। স্ট্যাচু অফ লিবার্টির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেখানেও ব্রিগেড নেই। কিন্তু একনায়ক হতে চাওয়া রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে প্রায় রোজ আপনারা যাকে “disruption” বলেন তা চলেছে। এমন অবস্থা যে মাঝেমধ্যেই সরকার ঝাঁপ ফেলে দিচ্ছে। আপনি যদি এসব না জানেন বা জেনেও আন্দোলন, সমাবেশ দেখে নাক সিঁটকোন তার মানে একটাই — আপনি backdated বা আপনাদের ভাষায় uncool. অর্থাৎ down market.
৩) লড়াই, আন্দোলন, ইউনিয়ন — এসবকে অপ্রয়োজনীয়, “যাদের কোনো কাজ নেই তারা এসব করে” বলে গালাগাল দিতে হলে ভেবেচিন্তে দেবেন। জেট এয়ারওয়েজের কর্মীদের মত চাকরি থেকে রাতারাতি ছাঁটাই হয়ে গেলে আবার প্রকাশ কারাতের কাছে ছুটবেন না যেন। আরো একটা কথা ভেবে দেখবেন। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে সত্যিই কোনো ব্রিগেড সমাবেশে আসা কয়েক লাখ লোকের কোন কাজ নেই, তাহলে সেটা জাতীয় সমস্যা। সেই সমস্যার সমাধানে আপনি কী করছেন? এই সমস্যার সমাধান দাবিও করেছেন কি কখনো? যদি না করে থাকেন তাহলে এই কর্মহীন লোকগুলোকে বিদ্রূপ করার বা নিন্দা করার অধিকার আপনার জন্মায় কী করে?
৪) “এদের তো কিনে নেওয়া খুব সোজা। এদের তো ডিম ভাত (মতান্তরে, স্থানান্তরে বা দিনান্তরে এক প্যাকেট বিরিয়ানি) খাইয়ে দিলেই চলে আসে”। এটা যদি মানুষের শস্তা হওয়ার প্রমাণ হয় তাহলে তো আপনি তো আরো শস্তা। এদের দূর দূরান্ত থেকে আনতে হলে অন্তত যে আনছে তাকে গাঁটের পয়সা খরচ করে বিরিয়ানি খাওয়াতে হয়। আপনি তো আলো ঝলমলে দোকান দেখলেই সপ্তাহান্তে সপরিবারে মলে চলে যান, যা দরকার নেই তা-ও নিজের পয়সা খরচ করে কেনেন, পাঁচ টাকার পপকর্ন দেড়শো টাকায় কেনেন। অর্থাৎ আপনাকে টুপি পরিয়ে আপনার চেয়ে অনেক বড়লোকেরা আরো বড়লোক হয়, এবং আপনার রুচি পছন্দকে কিনে ফ্যালে একটা সমাবেশ আয়োজনের চেয়ে অনেক কম খরচেই।
৫) উপর্যুক্ত কথাগুলো সবই “দেশটার কিস্যু হবে না” ধরণের, প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণপন্থী, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের প্রতি। এ ছাড়াও দুরকমের বামপন্থী আছেন। একদল তাঁদের অপছন্দের পার্টিকে গাল পাড়তে পারার আনন্দে ভুলেই গেছেন যে এই একই গালাগাল বরাবর তাঁদের পছন্দের পার্টিকে দেওয়া হয়েছে, কদিন পরেই আবার দেওয়া হবে। আরেক দল ঠান্ডা ঘরে বসে মার্কস, লেনিন, মাও মুখস্থ করা ছাড়া বিশেষ কিছুই করছেন না কিন্তু ব্রিগেড ফিগেডকে পাত্তা দেন না। কারণ তাঁরা তো কবেই বলেছেন যে কোনো মানুষই নিজের ইচ্ছায় ভোট দেন না এবং সকলকেই জোর করে ব্রিগেডে নিয়ে আসা হয়। এঁরা একদা ভাল করে বন্দুক চালাতে না শিখেই সশস্ত্র বিপ্লব করতে গিয়েছিলেন। সহযোদ্ধারা মৃত্যুবরণ করলেন, কেউ কেউ সারাজীবনের মত পঙ্গু হয়ে গেলেন, এঁরা কে জানে কী করে আস্ত থেকে গেলেন। এখন হয় খবরের কাগজের স্তম্ভের আড়াল থেকে, নয় ফেসবুক ওয়ালের আড়াল থেকে শ্রেণিশত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এঁদের বোধ করি বেশি পাত্তা দেওয়ার দরকার নেই, কারণ প্রথমোক্তরা কেউ বিমান বসুর মত আশি বছর বয়সে পুলিশের লাঠি খেতে যাবেন না। দ্বিতীয়োক্তরা কবিতা কৃষ্ণনের মত মাঠে ময়দানে রোজ ধর্ষণ, খুনের হুমকি অগ্রাহ্য করে রাজনীতি করবেন না। তবে মুখিয়ে আছি মোদীর মিটিংয়ের দিন এঁরা জোর করে আনা, ডিম ভাত খেতে আসা জনতা সম্বন্ধে কটা কথা বলেন তা দেখার জন্যে।
শেষে একটা কথা বলি। আজকের পৃথিবীতে রাজনৈতিক সমাবেশ (যে কোনো দলের) সবচেয়ে বড় জায়গা যেখানে আপনাকে আপনার ক্রয় ক্ষমতা অনুযায়ী মাপা হয় না।
আমার পকেটে হয়ত দুটো ডেবিট কার্ড, একটা ক্রেডিট কার্ড। সবকটা মিলিয়ে হয়ত আমার কাছে পাঁচশো ক্রেডিট পয়েন্ট আছে। ধরা যাক আমার স্ত্রীর পার্সেও দুটো ডেবিট কার্ড, আছে নশো ক্রেডিট পয়েন্ট। আমার বন্ধু প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, তার মোটে একটা স্যালারি অ্যাকাউন্টের কার্ড। তার সাথে তার বান্ধবী আছেন, যিনি হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছেন, সেভিংস অ্যাকাউন্টে হাজার পাঁচেক টাকা আছে। আমাদের সাথে আমাদের পরিচারিকা আছেন, যাঁকে মাসে তিন হাজার টাকা মাইনে দিই। তাঁর কোনো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই নেই। আমরা যদি কোনো সিনেমা হলে যাই বা মলে ঢুকি, পাঁচ জনের আত্মবিশ্বাস হবে পাঁচ রকমের। কারণ আমাদের ক্ষমতা ওই চত্বরে সমান নয়। কোনো কোনো জায়গায় পরিচারিকাকে হয়ত আমাদের সাথে বসতেই দেওয়া হবে না। কে জানে, হয়ত আমরাই চাইব উনি অন্য টেবিলে বসুন বা বাইরে অপেক্ষা করুন। কিন্তু আমরা যদি কোনো মিছিলে যাই বা ব্রিগেডে যাই, পাঁচজনেই সমান। আমাদের পরিচারিকার মত আমাদেরও ঘাসের উপর চটি পেতেই বসতে হবে। সুতরাং মিছিল বেঁচে থাক, মিটিং বেঁচে থাক, সেখানে যাওয়া মানুষের ক্ষিদে পেলে খাওয়ানোর ব্যবস্থা বেঁচে থাক।
বরং “কেউ যদি বেশি খাও খাওয়ার হিসেব নাও, কেন না অনেক লোক ভাল করে খায় না।”

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

2 thoughts on “বেঁচে থাক ডিম ভাত”

  1. Reblogged this on Beautiful world and commented:
    “লড়াই, আন্দোলন, ইউনিয়ন — এসবকে অপ্রয়োজনীয়, “যাদের কোন কাজ নেই তারা এসব করে” বলে গালাগাল দিতে হলে ভেবেচিন্তে দেবেন। জেট এয়ারওয়েজের কর্মীদের মত চাকরি থেকে রাতারাতি ছাঁটাই হয়ে গেলে আবার প্রকাশ কারাতের কাছে ছুটবেন না যেন। আরো একটা কথা ভেবে দেখবেন। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় যে সত্যিই কোন ব্রিগেড সমাবেশে আসা কয়েক লাখ লোকের কোন কাজ নেই, তাহলে সেটা জাতীয় সমস্যা। সেই সমস্যার সমাধানে আপনি কী করছেন? এই সমস্যার সমাধান দাবীও করেছেন কি কখনো? যদি না করে থাকেন তাহলে এই কর্মহীন লোকগুলোকে বিদ্রূপ করার বা নিন্দা করার অধিকার আপনার জন্মায় কী করে?”

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading