হে অভ্রান্ত চুল

ওয়েন্ডি ডোনিগার হিন্দুশাস্ত্র নিয়ে লিখতে পারবেন না কারণ তিনি বিধর্মী এবং বিদেশী। অড্রে ট্রাশকের গবেষণাও আমরা জানতে চাই না একই কারণে। সুতরাং শামিম আহমেদই বা শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে লেখেন কোন সাহসে? কি ভাগ্যি ম্যাক্স মুলার সাহেব এ যুগে জন্মাননি!

প্রায় দেড় দশক হল খবরের কাগজে কাজ করছি। নয় নয় করে গোটা পাঁচেক কাগজে কাজ করা হয়ে গেল। এই কাগজগুলোর কোন কোনটার আবার এক বা একাধিক যমজ কাগজ আছে অন্য ভাষার। এছাড়াও অনেক কাগজ আছে যেগুলো পড়ি কিন্তু কখনো কাজ করিনি। এতগুলো কাগজ মিলিয়ে আজ অব্দি একটি কাগজও পাইনি যাতে কখনো কোন ভুল বেরোয় না। সমস্ত ভুলই অনভিপ্রেত এবং পরিহার্য। তবুও অনিবার্য। তার কারণ খবরের কাগজে লেখে এবং সম্পাদনা করে মানুষ। সাংবাদিকরা মানুষ, তাঁরা ভুল করেন। আবার সম্মানীয় অতিথি লেখক লেখিকারাও অনেক সময় ভুল করেন কারণ তাঁরাও মানুষ। সাংবাদিকতায় শিক্ষানবিশির দিনগুলোতে যাঁর কাছে হাতে কলমে কাজ শিখেছি, ভুল করলে তিনি প্রবল বকাঝকা করতেন সঙ্গত কারণেই। তবে পরে একটা কথা বলতেন, সেটা খুব দামী কথা। “কাজ করলেই ভুল হবে। একমাত্র যে কোন কাজ করে না, তারই ভুল হয় না।”

এই কথাটা কখনো ভুলতে পারি না বলেই অনুজ সাংবাদিকরা বা সংবাদজগতের বাইরের কেউ কোন সংবাদমাধ্যমের প্রমাদ নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় বা তার বাইরে রগড় করতে চাইলে প্রশ্রয় দিই না। আমারও তো কাজ করতে গিয়ে ভুল হয়। ক্রিকেট মাঠে যেমন বলা হয় “যে ক্যাচ ফেলেছে তাকে ধমকিও না। পরের ক্যাচটা তোমার হাত থেকে পড়তে পারে।”

গত রবিবার বহুল প্রচারিত একটা কাগজে প্রকাশিত শামিম আহমেদের একটা লেখা নিয়ে যারা বাজার গরম করে চলেছে তাদের কান্ড দেখে এই কথাগুলো বলতেই হল। তবে এটুকু বলে ছেড়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তার কারণ লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে যা চলছে সেটা শুধু একটা লেখার একটা ভুলভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা নয়, লেখাটার উৎকর্ষ বা উৎকর্ষের অভাব নিয়ে মতপ্রকাশ নয়, লেখকের মেধা নিয়ে ব্যঙ্গ (লেখক সম্বন্ধে কিছু না জেনেই), তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি, তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সরাসরি বা ঠারেঠোরে বলা “ও আর কী জানবে”। শুধু তাই নয়, এও বলার চেষ্টা হয়েছে যে জন্মাষ্টমীর দিন এই লেখা আসলে হিন্দুদের পূজ্য শ্রীকৃষ্ণকে কালিমালিপ্ত করার প্রচেষ্টা।

এগুলোকে এক কথায় বলে অসভ্যতা। এক দল লোক দেখলাম লিখছে সংশ্লিষ্ট কাগজের উচিৎ ছিল কোন সংস্কৃত পন্ডিতকে দিয়ে লেখাটা পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া। স্পষ্টতই এখানে scholar অর্থে পন্ডিত বলা হচ্ছে না। কারণ যে লিখেছে সে জানে না শামিমবাবু সংস্কৃত জানেন কি জানেন না। শুধু লেখকের নাম থেকেই সে ধরে নিয়েছে এমন হতেই পারে না যে লোকটি সংস্কৃত জানে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী একজন হিন্দুদের পুরাণ আর কী জানবে?

এই জাতীয় সর্বজ্ঞ সমালোচকদের জ্ঞাতার্থে বলা যাক যে শামিমবাবু ইতিমধ্যেই মহাভারত নিয়ে পাঁচটি বইয়ের রচয়িতা। রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের দর্শন বিভাগের এই অধ্যাপকের অধীনে ছজন মহাভারত নিয়ে এম ফিল স্তরের গবেষণা করেছে, আরো চারজন পি এইচ ডি ডিগ্রির জন্য গবেষণারত। পুরনো খবরের কাগজ (বা ইন্টারনেট) ঘাঁটলে এও জানা যাবে যে রামকৃষ্ণ মিশনের ইতিহাসে শামিমবাবু প্রথম ইসলাম ধর্মাবলম্বী অধ্যাপক যিনি স্নাতক স্তরে বেদান্ত দর্শন পড়িয়েছেন। এই সবই তিনি করে ফেললেন এতগুলো বছরে, সংস্কৃত না জেনেই — এতটা ভাবার মূর্খামি আশা করি সমালোচকরা করবেন না।

আরেক ধরণের সমালোচক দেখলাম সোজাসুজি লিখেই দিয়েছেন যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জন্মাষ্টমির দিনে বা অন্যান্য হিন্দু উৎসবের দিনগুলোতে হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে কুৎসা রটানো হয় শস্তা পাবলিসিটি পাওয়ার জন্যে। শামিমবাবুর লেখাটা বারবার পড়েও অবশ্য কৃষ্ণের বিরুদ্ধে কুৎসা কোন জায়গাটায় করা হয়েছে বুঝে উঠতে পারলাম না। আসলে দোষ বোধহয় ব্যাসদেবেরই। তিনি মহাকাব্য লিখেছেন মনপ্রাণ দিয়ে। তাঁর কাব্যের চরিত্রেরা ভগবান হলেও দোষেগুণে মেশামিশি। সেইজন্যেই কয়েক হাজার বছর পরেও কাব্যটা সজীব। ব্যাসদেব তো আর জানতেন না এখনকার বিরাট হিন্দুদের নীতিবোধ চীনের পাঁচিলের মত উঁচু হবে, যা শ্রীকৃষ্ণের পক্ষেও অলঙ্ঘ্য হবে, সে যতই তিনি মূককে বাচাল এবং পঙ্গুকে গিরি লঙ্ঘন করার শক্তি দিন না কেন।

লেখার যে যে তথ্য নিয়ে সমালোচকদের আপত্তি সেগুলো নিয়ে আর আমি বাক্য ব্যয় করব না। লেখকের নিজের বক্তব্যই নীচে দেওয়া রইল। যা দুঃখের তা হল লেখার চেয়েও লেখকের পরিচয় আমাদের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে আজকাল। ওয়েন্ডি ডোনিগার হিন্দুশাস্ত্র নিয়ে লিখতে পারবেন না কারণ তিনি বিধর্মী এবং বিদেশী। অড্রে ট্রাশকের গবেষণাও আমরা জানতে চাই না একই কারণে। সুতরাং শামিম আহমেদই বা শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে লেখেন কোন সাহসে? কি ভাগ্যি ম্যাক্স মুলার সাহেব এ যুগে জন্মাননি! আর মাইকেল মধুসূদন! তিনি তো এ যুগে নির্ঘাত গণপিটুনিতে মারা যেতেন। তাঁর জীবন নিয়ে উৎপল দত্তের মঞ্চসফল নাটক ছিল ‘দাঁড়াও পথিকবর’। তখন আমার জন্ম হয়নি। পরে ঐ নাটকের উপর ভিত্তি করে তৈরি ছায়াছবিতে দেখেছিলাম একটি দৃশ্যে সুদূর গ্রামদেশ থেকে এক বৈষ্ণব কলকাতায় এসেছে শুধু ব্রজাঙ্গনা কাব্যের রচয়িতাকে দেখবে বলে। সুট বুট পরা মাইকেলকে দেখে তো সে তাজ্জব। সে বলে “তুমি নিশ্চয়ই শাপভ্রষ্ট, বাবা। এ কাব্য যে লিখেছে সে আসলে পরম বৈষ্ণব।” ঐ বৈষ্ণব ভদ্রলোকের সহিষ্ণুতা আমরা হারিয়েছি। তাই এখন অভ্রান্ত চুলেদের রাজত্ব। সেই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “টিকি মুণ্ডে চড়ি উঠি কহে ডগা নাড়ি, হাত-পা প্রত্যেক কাজে ভুল করে ভারি। হাত-পা কহিল হাসি, হে অভ্রান্ত চুল, কাজ করি আমরা যে, তাই করি ভুল।“

অভ্রান্ত চুলেদের বলি, এককভাবে বা দলবদ্ধ ট্রোলিং করে শামিমবাবুকে চুপ করানো যাবে না। কারণ তিনি একা নন, আমরা তাঁর সঙ্গে আছি এবং যতদিন আছি ততদিন তাঁকে একা হতেও দেব না।

বিঃ দ্রঃ যা দিনকাল তাতে প্রশ্ন উঠবেই যে আমি শামিম আহমেদ সম্পর্কে এত জানছি কী করে বা তাঁর হয়ে ওকালতি করছি কেন? উত্তরটা সোজাসুজি দিয়ে রাখি। প্রথমত, কার কী নিয়ে লেখা উচিৎ তা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার গণতন্ত্রে একমাত্র লেখকের নিজের। কোন ভুল সে অধিকার কেড়ে নেওয়ার সপক্ষে কোন যুক্তি নয়। সেই অধিকারের সপক্ষে দরকার হলে এক হাজার বার ওকালতি করব। দ্বিতীয়ত, শামিমবাবুর সাথে দু দশক আগে ক্লাসঘরে আমার আলাপ হয়। এতদিনে ক্লাসঘর ছাড়িয়ে আমাদের অসমবয়সী বন্ধুত্ব এতটাই অগ্রসর যে তিনি আমার পরিবারভুক্ত, আমি তাঁর পরিবারের লোক। আমার পরিবারের দিকে তেড়ে এলে আমি তো চুপ করে বসে থাকব না।

shamim1shamim2