লেখাপড়া করে যে-ই

ইসলামপুর নিয়ে পক্ষ নিতেই হবে কারণ ইসলামপুর প্রথম ঘটনা নয়, বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়

মোদ্দাকথা পড়াশোনা হোক সেটা সরকার চায় না। কেন্দ্রীয় সরকারও চায় না, রাজ্য সরকারও চায় না।
যাঁরা ছাত্রদের রাজনীতি করার অধিকারের বিরুদ্ধে তাঁদের মধ্যে দুরকম মত আছে। এক দল মনে করেন ছাত্রদের শুধু বইয়ে মুখ গুঁজে থাকা উচিৎ, আর কিছু করা তাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক। আরেক দল মানুষের মতে রাজনীতি করতে পারে, কিন্তু সে রাজনীতির দাবীদাওয়া হওয়া উচিৎ একান্ত ছাত্রদের। ক্যাম্পাসের বাইরের কোন ঘটনার অভিঘাত সেখানে থাকা চলবে না। এই মতগুলোর ভাল মন্দের মধ্যে যাচ্ছি না। কিন্তু দুরকম মতের লোকেরাই নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে এ রাজ্যের এবং এ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কত কয়েক বছর ধরে যা চলছে তা সরাসরি ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ায় প্রভাব ফ্যালে। সুতরাং সেগুলোকে ভুলে বই মুখে গুঁজে বসে থেকে তাদের বিশেষ লাভ নেই। কারণ পড়ার পরিবেশ এবং উদ্দেশ্যই নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে।
স্কুলে বাংলার শিক্ষক নেই। সে জায়গা পূরণ করা দীর্ঘদিনের দাবী। অথচ এসে হাজির হলেন উর্দু আর সংস্কৃতের শিক্ষকরা। ছাত্রদের মধ্যে অসন্তোষ, হতেই পারে কিছু বাইরের লোকও তাদের অসন্তোষে ঘৃতাহুতি করেছে। একটা এলাকার স্কুল কলেজের সাথে সেই এলাকার সমস্ত মানুষেরই স্বার্থ জড়িত আছে, বিশেষত সরকারপোষিত স্কুলগুলোর সাথে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তরা এখন ছেলেমেয়েকে অমুক ইন্টারন্যাশনাল, তমুক পাবলিক স্কুলে পাঠাতে পারেন। গরীব, নিম্নবিত্ত ছেলেমেয়েদের জন্যে এখনো যে সরকারী স্কুলই ভরসা। ফলে বহিরাগত আপনি বলবেন কাকে? তাছাড়া কোন রাজনীতিবিদ এসে দিদিমণিকে জগ ছুঁড়ে মারলে যখন বহিরাগতর প্রশ্ন ওঠে না, তখন এ বেলাতেই বা সে প্রশ্ন কেন উঠবে?
ইসলামপুর নিয়ে পক্ষ নিতেই হবে কারণ ইসলামপুর প্রথম ঘটনা নয়, বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়। দীর্ঘ তিন চার দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গে যে চাকরিটা যোগ্যতা থাকলেই পাওয়া যায় বলে লোকে জানত সেটা হল স্কুল শিক্ষকের চাকরি। সেখানেও দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ঢুকে পড়ায় বামফ্রন্ট সরকারের আমলে নেট বা স্লেট পরীক্ষার আদলে স্কুল সার্ভিস পরীক্ষা চালু হয়। বর্তমান সরকার আসার পরে সেই পরীক্ষা নিয়মিত হয় না, হলেও কে পাশ করল আর কে চাকরি পেল তা ভগবান আর সরকার ছাড়া কাক পক্ষীতেও টের পায় না। বেসরকারী ক্ষেত্রে কাজ করা লোকেরা বিশ্বায়নের যুগে কর্মক্ষেত্রে আন্দোলন করার অধিকার হারিয়েছে, সরকারী কর্মচারীদের সে অধিকার বজায় আছে বলে জানা ছিল। কিন্তু শিক্ষকদের অধিকারের এমনই চেহারা যে এক সহকর্মীর ভোট করাতে গিয়ে রহস্যমৃত্যুর তদন্ত চাইলেও হাজতবাস করতে হয়, মার খেতে হয়। স্কুল চত্বরেও বিভিন্ন শ্রী সামলাতে সামলাতে লেখাপড়ার বিশ্রী অবস্থা মেনে নিতে হচ্ছে মাস্টারমশাই-দিদিমণিদের।
এদিকে কলেজগুলো চলছে একগাদা আংশিক সময়ের অধ্যাপকদের দিয়ে। তরুণ মেধাবীরা প্রায় ঠিকে ঝিতে পর্যবসিত। তারা এবং প্রবীণরা সর্বদাই আতঙ্কে আছেন, কখন ছাত্র সংসদ বা অন্য কারো কোপদৃষ্টি পড়ে। মারধোর না খেয়ে সসম্মানে বাড়ি ফিরতেই পারলেই যথেষ্ট, পড়ানোয় আর মন দেবেন কখন?
উল্টোদিকে কলেজ ভর্তি হতে গেলে কয়েক হাজার বা লক্ষ টাকা তোলা দিতে হবে ছাত্র সংসদকে। অথচ ছাত্র সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে বহু কলেজে। আন্দোলনের দাবী ন্যায্য, অন্যায্য যা-ই হোক, যাদবপুর থেকে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বত্র সরকার এবং প্রধানদের সমাধান হল “পুলিশ ডাকো আর ঠ্যাঙাও।” এও মোটামুটি স্বতঃসিদ্ধ যে ছাত্রদের কোন দাবী থাকতে নেই। অতএব হোস্টেলে থাকার জায়গা আদায় করতে হলেও তাদের হয় মেডিকাল কলেজের মত অনশন করতে হবে, নয় প্রেসিডেন্সির মত কলেজের গেটে তালা ঝুলিয়ে বলতে হবে “হোস্টেল দাও তবে তালা খুলব।” সুবিধামত সরকার কোথাও বলবে “এটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার” আর কোথাও “সরকারের টাকায় চলবে, সরকারের কথা শুনবে না?” ওদিকে মালদার স্বীকৃতিবিহীন কলেজটার ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন এখনো চলছে, কলকাতার বুকে। ওদের জন্যে কেউ কোন সমাধান খুঁজছেন কিনা কে জানে?
আপনি যদি শিক্ষিত যুবক/যুবতী বা তাদের বাবা-মা হন, আপনি ভাবতেই পারেন “এ রাজ্যটা একেবারে গেছে। ওকে বাইরে পাঠিয়ে দেব।” কিন্তু তাতেও নিস্তার নেই। সমস্ত সরকারী বা বেসরকারী সমীক্ষায় দেশের যে বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় প্রথম সারিতে (যদি প্রথম না হয়) থাকে, সেই জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারী পার্টির ছাত্র সংগঠন মারদাঙ্গা করেও সংসদ দখল করতে পারেনি। সেই রাগে দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলে দিয়েছেন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে “ভারতবিরোধী শক্তি” কাজ করছে। অর্থাৎ দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী, গবেষকদের ভারত সরকার শত্রু হিসাবে দেগে দিল। তার কয়েকদিন আগেই দিল্লীর জাকির হুসেন কলেজেও সংসদ নির্বাচনের দিন তাণ্ডব চলেছে।
গত পাঁচ বছরে ভারত সরকারের নিশানায় জেএনইউ ছাড়াও এসেছে হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় প্রভৃতি। ক্যান্টিনে এটা কেন, ওটা কেন নয়? অমুক জায়গায় তমুকের ছবি ঝুলছে কেন? আবোল তাবোল ছুতোয় পড়াশোনা নষ্ট করে দেওয়ার প্রবল প্রচেষ্টা চলছে, চলবে।
কোথায় কেমন লেখাপড়া হচ্ছে তা নিয়ে সরকার বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়। তারা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঢাউস জাতীয় পতাকা টাঙাতে ব্যস্ত, সাঁজোয়া গাড়ি রাখতে চায়। অবশ্য শুধু চায় বললে এই সরকারের সক্রিয়তাকে নেহাতই অসম্মান করা হয়। খোদ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC) সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন ২৯শে সেপ্টেম্বর তারিখটা সার্জিকাল স্ট্রাইক দিবস হিসাবে পালন করতে হবে। সেদিন এন সি সি প্যারেড করতে হবে, ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে সেনাবাহিনীর প্রশংসাসূচক ডিজিটাল বা সত্যিকারের কার্ড বানাতে হবে, দিল্লীতে এবং সব রাজ্যের রাজধানীতে এই উপলক্ষে যে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের সেখানে যেতে উৎসাহ দিতে হবে ইত্যাদি। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় ততটা পড়াশোনার জায়গা নয় যতটা দেশপ্রেমের প্রদর্শনীর জায়গা।
অবশ্য এর জন্যে মঞ্জুরি কমিশনের উপর রাগ না করাই ভাল। সে বেচারা নিজেই তো আর দুদিন পর থাকবে না। পরিকল্পনা কমিশন গিয়ে নীতি আয়োগ এসেছে, যার প্রয়োগ সম্বন্ধে রচনা লিখতে দিলে চেয়ারম্যান নিজেও মাথা চুলকোবেন। আগামী দিনে মঞ্জুরি কমিশন গিয়ে কোন এক জো হুজুরি কমিশন আসবে নিশ্চয়ই। অবশ্য ওসবের দরকারই বা কী? এখনো তৈরি না হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে যখন সরকার স্বয়ং সেন্টার অফ এক্সেলেন্স তকমা দিয়ে দিচ্ছেন তখন আর ন্যাক, ইউজিসি এসব রেখে আয়করদাতার পয়সা নষ্ট করা কেন?
এসবেও অবশ্য অনেকেরই আপত্তি নেই। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে পুষ্পক বিমানের মডেল নিয়ে তো আলোচনা হয়েই গেছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে আধুনিক বিদ্যাগুলো সব ফালতু। ওগুলো শেখার কোন দরকারই নেই। অতএব উঠে যাক না স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তবে খারাপ লাগে আমার সেইসব বোকা বন্ধুদের জন্যে, যারা গত এক দশক উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন গবেষণাগারে কাজ করে, এ দেশের চেয়ে অনেক উন্নত জীবনযাত্রায় থেকেও ভুলতে পারেনি যে তার লেখাপড়ার খরচ অনেকদিন পর্যন্ত ভাগ করে নিয়েছে এ দেশের রিকশাওয়ালা, পানওয়ালা, লোকের বাড়িতে বাসন মাজে যারা তারা। সেই বোকাগুলো দেশে ফিরে এসে দেশকে কিছু ফিরিয়ে দিতে চাইছে আর কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না তাদের যোগ্যতা কেন দেশে ফিরে আসার জন্যে যথেষ্ট হচ্ছে না। ভাবি তাদের মনে করিয়ে দেব “লেখাপড়া করে যে-ই/অনাহারে মরে সে-ই।/জানার কোন শেষ নাই/জানার চেষ্টা বৃথা তাই।/বিদ্যালাভে লোকসান/নাই অর্থ নাই মান”।
সরকার কেন খাল কেটে উদয়ন পণ্ডিত আনতে যাবে?

দিলীপবাবুর দান: জীবনানন্দ দাশ

তোমরা যে মোটা মোটা মানে বইগুলো পড়, ও দিয়ে যেন খবরদার জীবনানন্দকে পাকড়াও করতে যেয়ো না

jd

মাস্টারমশাই, দিদিমণিদের কাছ থেকে ঠিক কী পাই আমরা? শিক্ষা বললে বোধহয় উত্তরটা দায়সারা হয়। কারণ শিক্ষা শুধু তাঁরাই দেন না। বাবা-মা দেন, আত্মীয়রা দেন, বন্ধুবান্ধবও নিজের অজান্তেই ভাল মন্দ নানারকম শিক্ষা দেয়। কিন্তু সেই সব শিক্ষাই যে আমাদের মনে থাকে এমন নয়। অথচ কোন মাস্টারমশাইয়ের কাছে শেখা কোন কোন জিনিস আমরা সারা জীবন ভুলতে পারি না। সত্যি কথা বলতে, দীর্ঘ কর্মজীবনের সব ছাত্রছাত্রীকে কোন মাস্টারমশাই বা দিদিমণিরই মনে থাকে না। অথচ এমন মানুষ পাওয়া বিরল যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁদের ক্লাস করতে হয়েছে তাঁদের কাউকে একেবারে ভুলে গেছে। এই বৈপরীত্যের কারণ শুধু সংখ্যাতাত্ত্বিক বলে মেনে নেওয়া যায় না। কারণ শিশু শ্রেণী থেকে শুরু করে লেখাপড়া শেষ করা অব্দি কম শিক্ষক, শিক্ষিকার ক্লাস করে না একজন মানুষ। অথচ অনেক বৃদ্ধকেও দেখেছি স্কুলের মাস্টারমশাইদের দিব্যি মনে রেখেছেন। আসলে সম্ভবত আমরা শিক্ষক শিক্ষিকাদের থেকে এমন অনেক জিজ্ঞাসা পাই যা সারা জীবনের পাথেয় হয়ে থাকে। তার কিছু ক্লাসঘরেই, কিছু হয়ত ক্লাসঘরের বাইরে। প্রমথ চৌধুরীর কথা যদি বিশ্বাস করতে হয়, তাহলে “সুশিক্ষিত লোক মাত্রেই স্বশিক্ষিত।” অতএব শিখতে হয় নিজেকেই, কেউ শেখাতে পারে না। কিন্তু কী শিখব, কেন শিখব, কোনটা শিখলে আমার ভাল লাগবে — প্রিয় মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা বোধহয় সেটাই ধরিয়ে দেন। কেউ খুব ভাল পারেন কাজটা, কেউ আবার তত ভাল পারেন না। যাঁরা ভাল পারেন তাঁরাই বোধহয় বেশি করে মনে থেকে যান। আজ সকালের কাগজে জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে পাতা জোড়া লেখা পড়তে পড়তে যেমন আমার মনে পড়ছিল সেই মাস্টারমশাইয়ের কথা, যিনি জীবনানন্দে নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে আমাদের পাঠ্য ছিল এই কবিতাটা:

তোমার বুকের থেকে একদিন চ’লে যাবে তোমার সন্তান
বাংলার বুক ছেড়ে চ’লে যাবে, যে ইঙ্গিতে নক্ষত্রও ঝরে,
আকাশের নীলাভ নরম বুক ছেড়ে দিয়ে হিমের ভিতরে
ডুবে যায়, — কুয়াশায় ঝ’রে পড়ে দিকে দিকে রূপশালী ধান
একদিন; — হয়তো বা নিমপেঁচা অন্ধকারে গা’বে তার গান,
আমারে কুড়ায়ে নেবে অন্ধকারে মেঠো ইঁদুরের মতো মরণের ঘরে —
হৃদয়ে ক্ষুদের গন্ধ লেগে আছে আকাঙ্ক্ষার — তবুও তো
চোখের উপরে
নীল মৃত্যু উজাগর — বাঁকা চাঁদ, শূন্য মাঠ, শিশিরের ঘ্রাণ —

কখন মরণ আসে কেবা জানে — কালীদহে কখন যে ঝড়
কমলের নাল ভাঙে — ছিঁড়ে ফেলে গাংচিল শালিখের প্রাণ
জানি নাকো;— তবু যেন মরি আমি এই মাঠ-ঘাটের ভিতর,
কৃষ্ণা যমুনার নয় — যেন এই গাঙুড়ের ঢেউয়ের আঘ্রাণ
লেগে থাকে চোখেমুখে — রূপসী বাংলা যেন বুকের উপর
জেগে থাকে; তারি নীচে শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর।

আমাদের কবিতাটা পড়িয়েছিলেন দিলীপবাবু। তিনি গম্ভীর মানুষ। তাঁকে কখনো হা হা করে হাসতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তাঁর হাসি স্মিত, তিনি রাগে ফেটে পড়তেন না, ফুটতেন। সর্বদা ধুতি পাঞ্জাবী পরতেন। ফুল পাঞ্জাবীর হাতা কনুইয়ের উপর পর্যন্ত গোটানো থাকত। চোখে থাকত সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা, চুল উলটে আঁচড়ানো। দূরদর্শনের সাদাকালো আমলে তোলা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের যে ভিডিও এখনো মাঝেসাঝে দেখানো হয়, অনেকটা সেইরকম চেহারা। স্যার অবশ্য অতটা ছিপছিপে ছিলেন না। একটা হাত মুড়ে বুকের কাছে ধরা পাঠ্য বই আর ডাস্টার, অন্য হাতে চক নিয়ে দিলীপবাবু ক্লাসে আসতেন।

জীবনানন্দের কবিতাটা যত দিন ধরে আমাদের পড়িয়েছিলেন, তত দিন ধরে সম্ভবত অন্য কোন লেখা পড়াননি। প্রথম দিনই বললেন “এবার তোমরা যে কবিতাটা পড়তে যাচ্ছ, এর তুল্য কিছু আগে কখনো পড়নি।”

বেয়াড়া প্রশ্ন করার মত ছাত্র কোনকালে কম ছিল না। একজন জিজ্ঞেস করল “স্যার, ট্রামের তলায় কোন মানুষ কী করে চাপা পড়ে?”

আমরা তটস্থ। ভেবেছি রাশভারী দিলীপবাবু ভয়ানক রেগে যাবেন। কিন্তু তিনি স্মিত হেসে বললেন “কোন মানুষ কী করে চাপা পড়ে জানি না বাবা। তবে ইনি জীবনানন্দ দাশ, যে কোন মানুষ নন। এঁকে কোন ছকে ধরা যায় না। তোমরা যে মোটা মোটা মানে বইগুলো পড়, ও দিয়ে যেন খবরদার জীবনানন্দকে পাকড়াও করতে যেয়ো না। কবিতাটা বারবার পড়। এমনিতে আমাদের যা অভ্যেস আর কি। মানে বই পড়ব, বইটা পড়ব না। সেটা এঁর ক্ষেত্রে করেছ কি মরেছ।”

কবিতাটা পড়াতে পড়াতে মাঝে মাঝে আমাদের মুখগুলো দেখতেন। কোন মুখে একটু আগ্রহের উদ্ভাস, কোন মুখ একেবারে অনাগ্রহী, কোন মুখ দুর্বোধ্যতায় হাবুডুবু — এসবই খেয়াল করতেন বোধ করি। পড়াতে পড়াতে একদিন “কৃষ্ণা যমুনার নয় — যেন এই গাঙুড়ের ঢেউয়ের আঘ্রাণ” পংক্তিতে পৌঁছেছেন। একজন প্রশ্ন করল “স্যার, ঢেউয়ের আবার গন্ধ হয় নাকি?”

“পুকুর বা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কোন গন্ধ পাওনি কখনো?”

ছেলেটি মাথা নেড়ে না বলায় দিলীপবাবু বড় অসহায়ের মত হাসলেন। তারপর বললেন “সত্যি। এ বড় অন্যায়। যাঁরা পাঠ্য ঠিক করেছেন তাঁদের বোধহয় এতখানি দাবী করা উচিৎ হয়নি তোমাদের কাছে। ক্লাসরুমে বসে কী করেই বা ঢেউয়ের গন্ধ বুঝবে তোমরা? তাছাড়া এত কিছু অনুভব করতে বলাও কি উচিৎ? অনুভব না করেই যখন পরীক্ষায় নম্বর পাওয়া যায়। তবে বাবা কবিতা তো পাঠকের একটু বেশি মনোযোগ দাবী করে। কবি তো আমার মত স্কুল মাস্টার নন যে তোমাকে বুঝিয়ে দেওয়া তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়বে। পাঠ্য হওয়ার জন্যে তো কবিতাটা লেখেননি কবি। দ্যাখো না একটু চেষ্টা করে, যদি ঢেউয়ের গন্ধটন্ধ পাও?”

আমাদের তখন দুর্বিনীত হওয়ার বয়স। আমি আর আমার এক বন্ধু তখন মনে করি আমাদের আশ্চর্য কাব্যপ্রতিভা আছে। আমরা দুজনেই তখন পাঠ্য কবিতার অক্ষম অনুকরণ দিয়ে কবিতার খাতা ভরিয়ে ফেলছি। অতএব যেদিন কবিতাটা পড়ানো শেষ হল এবং দিলীপবাবু বললেন কারো কোন প্রশ্ন থাকলে করতে, সেদিন আমার বন্ধুটি জিজ্ঞেস করল “স্যার, ভবিষ্যতে কোন কবি যদি জীবনানন্দের মত লিখতে পারে?”

দিলীপবাবু মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বললেন “সে হবার নয়। ইনি যে পথে হেঁটেছেন সে পথে বাংলা কবিতার ইতিহাসে আগেও কেউ হাঁটেননি, পরেও কেউ হাঁটেননি। যে হাঁটবে তার পরিণতি হবে জীবনানন্দের মতই। কত লোকে কত কথা বলেছে। কেউ বলেছে নৈরাশ্যবাদী কবি, কেউ বলেছে নির্জনতার কবি। এঁর মত হওয়া যায় না। আর হতে যাবেই বা কেন? নিজের মত হও।”

ক্লাসের শেষদিকে এসে বললেন “কবিতাটা তো পড়ালাম। কিন্তু বলে দিই, দেখা গেছে বোর্ডের পরীক্ষকরা জীবনানন্দের কবিতার প্রশ্নের উত্তরে নম্বর দেয়ার ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে। অতএব যারা বেশি নম্বর পেতে চায় তারা জীবনানন্দকে ছোঁয় না। তোমরাও নির্ঘাত তাই করবে। তবে কেবল নম্বর পাওয়ার জন্যে কবিতা পড়া খুবই দুর্ভাগ্যের। জীবনানন্দ তোমাদের নম্বর পাইয়ে দিতে পারবেন না। তবে যদি একটু ভাল লাগিয়ে নিতে পার, তাহলে এমন অনেক কিছু পেতে পার যা আমারও জানা নেই।”

আরও পড়ুন শ্রদ্ধেয়

যেন রহস্যোপন্যাস। শেষে সাংঘাতিক কিছু আছে সেই আভাসটুকু দিলেন কিন্তু কী আছে বললেন না। ঐ খোঁচাটুকুই আমায় বাধ্য করল রূপসী বাংলা বইটার খোঁজ করতে। পরে আরো অন্যান্য। আজও যখন জীবনানন্দ পড়তে গিয়ে কোন পংক্তিতে আটকে যাই, দুর্বোধ্য মনে হয়, স্যারের কথাগুলো মনে করি। “কবি তো আমার মত স্কুল মাস্টার নন যে তোমাকে বুঝিয়ে দেওয়া তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়বে। পাঠ্য হওয়ার জন্যে তো কবিতাটা লেখেননি কবি। দ্যাখো না একটু চেষ্টা করে, যদি ঢেউয়ের গন্ধটন্ধ পাও।”

দিলীপবাবু আমায় জীবনানন্দ দিয়েছেন। তাঁর ক্লাসে আজও বসে আছি।

হে অভ্রান্ত চুল

ওয়েন্ডি ডোনিগার হিন্দুশাস্ত্র নিয়ে লিখতে পারবেন না কারণ তিনি বিধর্মী এবং বিদেশী। অড্রে ট্রাশকের গবেষণাও আমরা জানতে চাই না একই কারণে। সুতরাং শামিম আহমেদই বা শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে লেখেন কোন সাহসে? কি ভাগ্যি ম্যাক্স মুলার সাহেব এ যুগে জন্মাননি!

প্রায় দেড় দশক হল খবরের কাগজে কাজ করছি। নয় নয় করে গোটা পাঁচেক কাগজে কাজ করা হয়ে গেল। এই কাগজগুলোর কোন কোনটার আবার এক বা একাধিক যমজ কাগজ আছে অন্য ভাষার। এছাড়াও অনেক কাগজ আছে যেগুলো পড়ি কিন্তু কখনো কাজ করিনি। এতগুলো কাগজ মিলিয়ে আজ অব্দি একটি কাগজও পাইনি যাতে কখনো কোন ভুল বেরোয় না। সমস্ত ভুলই অনভিপ্রেত এবং পরিহার্য। তবুও অনিবার্য। তার কারণ খবরের কাগজে লেখে এবং সম্পাদনা করে মানুষ। সাংবাদিকরা মানুষ, তাঁরা ভুল করেন। আবার সম্মানীয় অতিথি লেখক লেখিকারাও অনেক সময় ভুল করেন কারণ তাঁরাও মানুষ। সাংবাদিকতায় শিক্ষানবিশির দিনগুলোতে যাঁর কাছে হাতে কলমে কাজ শিখেছি, ভুল করলে তিনি প্রবল বকাঝকা করতেন সঙ্গত কারণেই। তবে পরে একটা কথা বলতেন, সেটা খুব দামী কথা। “কাজ করলেই ভুল হবে। একমাত্র যে কোন কাজ করে না, তারই ভুল হয় না।”

এই কথাটা কখনো ভুলতে পারি না বলেই অনুজ সাংবাদিকরা বা সংবাদজগতের বাইরের কেউ কোন সংবাদমাধ্যমের প্রমাদ নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় বা তার বাইরে রগড় করতে চাইলে প্রশ্রয় দিই না। আমারও তো কাজ করতে গিয়ে ভুল হয়। ক্রিকেট মাঠে যেমন বলা হয় “যে ক্যাচ ফেলেছে তাকে ধমকিও না। পরের ক্যাচটা তোমার হাত থেকে পড়তে পারে।”

গত রবিবার বহুল প্রচারিত একটা কাগজে প্রকাশিত শামিম আহমেদের একটা লেখা নিয়ে যারা বাজার গরম করে চলেছে তাদের কান্ড দেখে এই কথাগুলো বলতেই হল। তবে এটুকু বলে ছেড়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তার কারণ লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে যা চলছে সেটা শুধু একটা লেখার একটা ভুলভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা নয়, লেখাটার উৎকর্ষ বা উৎকর্ষের অভাব নিয়ে মতপ্রকাশ নয়, লেখকের মেধা নিয়ে ব্যঙ্গ (লেখক সম্বন্ধে কিছু না জেনেই), তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি, তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সরাসরি বা ঠারেঠোরে বলা “ও আর কী জানবে”। শুধু তাই নয়, এও বলার চেষ্টা হয়েছে যে জন্মাষ্টমীর দিন এই লেখা আসলে হিন্দুদের পূজ্য শ্রীকৃষ্ণকে কালিমালিপ্ত করার প্রচেষ্টা।

এগুলোকে এক কথায় বলে অসভ্যতা। এক দল লোক দেখলাম লিখছে সংশ্লিষ্ট কাগজের উচিৎ ছিল কোন সংস্কৃত পন্ডিতকে দিয়ে লেখাটা পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া। স্পষ্টতই এখানে scholar অর্থে পন্ডিত বলা হচ্ছে না। কারণ যে লিখেছে সে জানে না শামিমবাবু সংস্কৃত জানেন কি জানেন না। শুধু লেখকের নাম থেকেই সে ধরে নিয়েছে এমন হতেই পারে না যে লোকটি সংস্কৃত জানে। ইসলাম ধর্মাবলম্বী একজন হিন্দুদের পুরাণ আর কী জানবে?

এই জাতীয় সর্বজ্ঞ সমালোচকদের জ্ঞাতার্থে বলা যাক যে শামিমবাবু ইতিমধ্যেই মহাভারত নিয়ে পাঁচটি বইয়ের রচয়িতা। রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের দর্শন বিভাগের এই অধ্যাপকের অধীনে ছজন মহাভারত নিয়ে এম ফিল স্তরের গবেষণা করেছে, আরো চারজন পি এইচ ডি ডিগ্রির জন্য গবেষণারত। পুরনো খবরের কাগজ (বা ইন্টারনেট) ঘাঁটলে এও জানা যাবে যে রামকৃষ্ণ মিশনের ইতিহাসে শামিমবাবু প্রথম ইসলাম ধর্মাবলম্বী অধ্যাপক যিনি স্নাতক স্তরে বেদান্ত দর্শন পড়িয়েছেন। এই সবই তিনি করে ফেললেন এতগুলো বছরে, সংস্কৃত না জেনেই — এতটা ভাবার মূর্খামি আশা করি সমালোচকরা করবেন না।

আরেক ধরণের সমালোচক দেখলাম সোজাসুজি লিখেই দিয়েছেন যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জন্মাষ্টমির দিনে বা অন্যান্য হিন্দু উৎসবের দিনগুলোতে হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে কুৎসা রটানো হয় শস্তা পাবলিসিটি পাওয়ার জন্যে। শামিমবাবুর লেখাটা বারবার পড়েও অবশ্য কৃষ্ণের বিরুদ্ধে কুৎসা কোন জায়গাটায় করা হয়েছে বুঝে উঠতে পারলাম না। আসলে দোষ বোধহয় ব্যাসদেবেরই। তিনি মহাকাব্য লিখেছেন মনপ্রাণ দিয়ে। তাঁর কাব্যের চরিত্রেরা ভগবান হলেও দোষেগুণে মেশামিশি। সেইজন্যেই কয়েক হাজার বছর পরেও কাব্যটা সজীব। ব্যাসদেব তো আর জানতেন না এখনকার বিরাট হিন্দুদের নীতিবোধ চীনের পাঁচিলের মত উঁচু হবে, যা শ্রীকৃষ্ণের পক্ষেও অলঙ্ঘ্য হবে, সে যতই তিনি মূককে বাচাল এবং পঙ্গুকে গিরি লঙ্ঘন করার শক্তি দিন না কেন।

লেখার যে যে তথ্য নিয়ে সমালোচকদের আপত্তি সেগুলো নিয়ে আর আমি বাক্য ব্যয় করব না। লেখকের নিজের বক্তব্যই নীচে দেওয়া রইল। যা দুঃখের তা হল লেখার চেয়েও লেখকের পরিচয় আমাদের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে আজকাল। ওয়েন্ডি ডোনিগার হিন্দুশাস্ত্র নিয়ে লিখতে পারবেন না কারণ তিনি বিধর্মী এবং বিদেশী। অড্রে ট্রাশকের গবেষণাও আমরা জানতে চাই না একই কারণে। সুতরাং শামিম আহমেদই বা শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে লেখেন কোন সাহসে? কি ভাগ্যি ম্যাক্স মুলার সাহেব এ যুগে জন্মাননি! আর মাইকেল মধুসূদন! তিনি তো এ যুগে নির্ঘাত গণপিটুনিতে মারা যেতেন। তাঁর জীবন নিয়ে উৎপল দত্তের মঞ্চসফল নাটক ছিল ‘দাঁড়াও পথিকবর’। তখন আমার জন্ম হয়নি। পরে ঐ নাটকের উপর ভিত্তি করে তৈরি ছায়াছবিতে দেখেছিলাম একটি দৃশ্যে সুদূর গ্রামদেশ থেকে এক বৈষ্ণব কলকাতায় এসেছে শুধু ব্রজাঙ্গনা কাব্যের রচয়িতাকে দেখবে বলে। সুট বুট পরা মাইকেলকে দেখে তো সে তাজ্জব। সে বলে “তুমি নিশ্চয়ই শাপভ্রষ্ট, বাবা। এ কাব্য যে লিখেছে সে আসলে পরম বৈষ্ণব।” ঐ বৈষ্ণব ভদ্রলোকের সহিষ্ণুতা আমরা হারিয়েছি। তাই এখন অভ্রান্ত চুলেদের রাজত্ব। সেই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “টিকি মুণ্ডে চড়ি উঠি কহে ডগা নাড়ি, হাত-পা প্রত্যেক কাজে ভুল করে ভারি। হাত-পা কহিল হাসি, হে অভ্রান্ত চুল, কাজ করি আমরা যে, তাই করি ভুল।“

অভ্রান্ত চুলেদের বলি, এককভাবে বা দলবদ্ধ ট্রোলিং করে শামিমবাবুকে চুপ করানো যাবে না। কারণ তিনি একা নন, আমরা তাঁর সঙ্গে আছি এবং যতদিন আছি ততদিন তাঁকে একা হতেও দেব না।

বিঃ দ্রঃ যা দিনকাল তাতে প্রশ্ন উঠবেই যে আমি শামিম আহমেদ সম্পর্কে এত জানছি কী করে বা তাঁর হয়ে ওকালতি করছি কেন? উত্তরটা সোজাসুজি দিয়ে রাখি। প্রথমত, কার কী নিয়ে লেখা উচিৎ তা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার গণতন্ত্রে একমাত্র লেখকের নিজের। কোন ভুল সে অধিকার কেড়ে নেওয়ার সপক্ষে কোন যুক্তি নয়। সেই অধিকারের সপক্ষে দরকার হলে এক হাজার বার ওকালতি করব। দ্বিতীয়ত, শামিমবাবুর সাথে দু দশক আগে ক্লাসঘরে আমার আলাপ হয়। এতদিনে ক্লাসঘর ছাড়িয়ে আমাদের অসমবয়সী বন্ধুত্ব এতটাই অগ্রসর যে তিনি আমার পরিবারভুক্ত, আমি তাঁর পরিবারের লোক। আমার পরিবারের দিকে তেড়ে এলে আমি তো চুপ করে বসে থাকব না।

shamim1shamim2

%d bloggers like this: