ভো ভো ভদ্রসন্তান

কী হয় পঞ্চায়েত দিয়ে? যে ভদ্রসন্তান পেটে বোম মারলেও ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের তিনটে স্তর কী কী বলতে পারবে না, সেও জানে পঞ্চায়েতের কোন কাজ নেই। বামফ্রন্ট সরকার এইটে বানিয়েছিল কেবল টাকা মারার জন্যে। কী দরকার এমন ভোটের? তুলে দিলেই হয়। এই যে ক্যানিং লোকালে ভদ্রসন্তানদের বাড়ি রান্না করতে আসা, বাসন মাজতে আসা ছোটলোকগুলো তিন চারদিন কামাই দেয় পঞ্চায়েতে ভোট দেবে বলে —- এর দরকারটা কী রে ভাই? এইসব ছোটলোক গণতন্ত্রের বোঝেটা কী? পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তো করার মধ্যে করেছে এই যে এদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছে। ছোটলোকেরা অনেকে গ্রামের ভদ্রসন্তানদের টপকে প্রধান টধান হয়েছে। তা এ কি আর ভাল ব্যবস্থা রে বাপু?

শেষপর্যন্ত এক মাস্টারমশাইকে মরতে হল ভদ্রসন্তানদের “এসব আগেও হয়েছে” র এলায়িত ঔদাসীন্য থেকে জাগানোর জন্যে। হতভাগ্য প্রিসাইডিং অফিসার রাজকুমার রায় মরিয়া প্রমাণ করিলেন ভদ্রসন্তানগণের চেতনা মরে নাই। তাঁহারা আজিও নির্বাচনী হিংসার জন্যে সরকারকে দায়ী করিয়া গালাগাল করিতে সক্ষম।
মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময়কার হিংসাটা নেহাত বিসদৃশ লাগায় একটু “উঃ আঃ” করতেই হচ্ছিল। তবু “এরা আসলে সিপিএমের মত সংগঠিত না তো, তাই একটু বেশি উগ্র” এসব বলে চালানো হচ্ছিল। মনোনয়ন জমা দেওয়া মিটে যেতেই ভদ্রসন্তানদের ভারী নিশ্চিন্দিভাব এসেছিল। কাগজে বেরিয়েছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এত বেশি আসন শাসক দল কখনো জেতেনি তাই খানিকটা নিন্দেমন্দ না করে উপায় ছিল না। শিক্ষিত লোক হিসাবে সমাজে একটা পরিচিতি আছে তো। এরপর তো নির্বাচন আর নির্বাচনে তো মারামারি, বোমাবাজি, খুন হয়েছে অনেক। অতএব ওতে সরকারের দোষ হয় না। নিন্দে করার দায়িত্বও নেই ভদ্রজনের।
তার চেয়ে বড় কথা যে মরল সে তো হয় এ পার্টির লোক, নয় ও পার্টির লোক। তারা তো আর কারো মা, বাপ, ভাই, বোন, ছেলেপুলে নয়। পার্টি তো করে অশিক্ষিতরা, যাদের শিক্ষিতদের মত স্বার্থপর হয়ে বাঁচার সুযোগ নেই। অতএব তারা মরলে ভদ্রসন্তানের কী-ই বা এসে যায়? ও তাপসী মালিকই বলুন আর দেবু দাস, ঊষা দাসই বলুন, ভদ্রসন্তান হলে কি আর রাজনীতির মধ্যে যেত? চেতন ভগতের কথামত নিজের কেরিয়ার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে জমাটি একখান চাকরি জুটিয়ে সক্কলের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেত। অতএব পরিবর্তনের সরকার ভাল সরকার। যতই লোক মারুক আর গণতন্ত্রের মা-মাসি করুক, ভি আই পি রোডটা কংক্রিটে আর রেলিঙে মুড়ে দিয়েছে, এত আলো লাগিয়েছে যে ছেলেমেয়েরা চুমু খাওয়ার আড়াল পাচ্ছে না, স্কুলমাস্টারগুলো কোন কাজ করত না, তাদের ঘাড়ে কন্যাশ্রী থেকে দিদিশ্রী সব চাপিয়ে দিয়ে খুব টাইট দিয়েছে। আর কী চাই? একেই তো বলে উন্নয়ন। কেন হিংসার প্রতিবাদ করতে যাবে ভদ্রসন্তান? এত উন্নয়নের বদলে নাহয় এক ভাই এক কবিকে দিলই দুটো গাল। কবিকে কে বলেছিল পার্টির লোকের মত কবিতা লিখতে? তিনি যদি ভদ্রসন্তানোচিত কাজ কোনগুলো সেটা ভুলে মেরে দেন, সেটা বুড়ো বয়সের ভীমরতি। তার জন্যে সরকারকে কেন গাল দেবে? সর্বেসর্বা মুখ্যমন্ত্রীকেই বা কেন দোষ দেবে?
তবু নয় ভেবে দেখা যেত যদি ভোটটা লোকসভা কি বিধানসভার হত। কিসের ভোট? না পঞ্চায়েতের। কী হয় পঞ্চায়েত দিয়ে? যে ভদ্রসন্তান পেটে বোম মারলেও ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের তিনটে স্তর কী কী বলতে পারবে না, সেও জানে পঞ্চায়েতের কোন কাজ নেই। বামফ্রন্ট সরকার এইটে বানিয়েছিল কেবল টাকা মারার জন্যে। কী দরকার এমন ভোটের? তুলে দিলেই হয়। এই যে ক্যানিং লোকালে ভদ্রসন্তানদের বাড়ি রান্না করতে আসা, বাসন মাজতে আসা ছোটলোকগুলো তিন চারদিন কামাই দেয় পঞ্চায়েতে ভোট দেবে বলে —- এর দরকারটা কী রে ভাই? এইসব ছোটলোক গণতন্ত্রের বোঝেটা কী? পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তো করার মধ্যে করেছে এই যে এদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছে। ছোটলোকেরা অনেকে গ্রামের ভদ্রসন্তানদের টপকে প্রধান টধান হয়েছে। তা এ কি আর ভাল ব্যবস্থা রে বাপু? যেমন করেছিল পেছন পাকা কমিউনিস্টের দল, এখন ফল ভুগছে।
এ নিয়ে শহর, মফঃস্বল, গ্রাম সব জায়গার ভদ্রসন্তানেরাই একমত ছিলেন দুদিন আগে অব্দি। গোলমাল পাকালেন তাদেরই একজন। প্রিসাইডিং অফিসার হয়েছেন ভাল কথা, “আগেও হয়েছে” মন্ত্র জপে বুথে গিয়ে চোখকান বুঁজে থাকলেই চুকে যেত। কিন্তু এই চরম নীতিহীনতার যুগেও থাকে কিছু কিছু নীতিবাগীশ বোকার হদ্দ। এরা ভাবে ছাত্রদের সামনে অনুকরণীয় চরিত্র হয়ে ওঠাটা শিক্ষকের কাজের মধ্যে পড়ে। এই ভদ্রলোক সম্ভবত ঐ দলে। এই ধরণের লোকের সমস্যা হচ্ছে মেরুদণ্ড বলে জিনিসটা এখনো নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়নি আমাদের মত। ফলে সাহসটা অসম্ভব বেশি। লাঠিসোটা, টাঙ্গি, বন্দুক — যা-ই দেখাও না কেন, এদের ভয় পাওয়ানো মুশকিল। তা শক্ত মেরুদণ্ড তো অধুনা একটি রোগবিশেষ। সে রোগে শেষ অব্দি যা হয় তাই হয়েছে আর কি। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াটি চমকপ্রদ। দৃশ্যত মার খেলেন এস ডি ও, তবে আসলে চড়চাপড়গুলো কার উদ্দেশে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এবং প্রত্যেকটি চড় তিনি অর্জন করেছেন।
মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যু অনেক ছাত্রকে জাগিয়ে তুলেছে দেখে ভাল লাগছে। এই দারুণ দুঃসময়ে আমরা এতই দ্বিধাবিভক্ত যে ডাক্তার মার খেলে শুধু ডাক্তাররা প্রতিবাদ করেন, রাজনৈতিক কর্মী মার খেলে শুধু তার দলের লোকেরাই প্রতিবাদ করে, শিক্ষক মার খেলে শুধু শিক্ষক সমিতি প্রতিবাদ করে, ছাত্ররা মার খেলেও সেটা শুধু তাদের সমস্যা, সাংবাদিক মার খেলে… যাকগে। কথা হচ্ছে এই ব্যাপারটা শাসকও বুঝে ফেলেছে। ফলে প্রতিবাদীদের গায়ে একটা লেবেল সেঁটে দেয়। জানে ঐটে করে দিলেই তারা আর কারো থেকে কোন সহানুভূতি, সমর্থন পাবে না। এবারে যেমন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সরকার লেবেল দিয়েছে “ওরা তো ভোটকর্মী নয়, শিক্ষকও নয়। ওরা এবিটিএ।” কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেমন বলে আর কি “ওরা তো ছাত্র নয়, ওরা বামপন্থী ছাত্র”, “ওরা তো কৃষক নয়, ওরা সিপিএমের কৃষক” বা এদের সব্বাইকে একেবারে থার্ড ব্র‍্যাকেটে পুরে “ওরা এন্টি ন্যাশনাল।” অস্যার্থ কেবল এটা নয় যে ঐ লেবেলের লোকেদের প্রতিবাদের অধিকার নেই। লেবেলটা আসলে চোখ মটকে বাকিদের বলা “এদের সাথে যোগ দিও না।” আমরা ভদ্রসন্তানেরাও এমন সুবোধ বালক যে সরকারী মতটা বুলির মত আউড়ে শুধু নিজে চেপে যাই তা নয়, অন্যকেও বোঝাই।
ভদ্রসন্তানদেরই আবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি কিনা, তাই তেনারা যা মনে করেন সেই মতটাই প্রধান হয়ে ওঠে। ফলে জঘন্যতম কান্ডগুলো করেও সরকারগুলো দিব্য “আগেও হয়েছে” বলে চালিয়ে যাচ্ছে।
— নির্বাচনের জন্যে খুন? আগেও হয়েছে।
— ধর্ষণ? আগেও হয়েছে।
— ঘোড়া কেনাবেচা? আগেও হয়েছে।
— বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পুলিশের অত্যাচার? আগেও হয়েছে।
মোদীর আছে “কংগ্রেস কে সত্তর সাল” আর দিদির “বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বছর”। যদ্দিন উনি আরো সত্তর বছর আর ইনি আরো চৌত্রিশ বছর শাসন না করছেন তদ্দিন চুপটি করে থাকতে হবে। ভদ্রসন্তানরা অবিশ্যি চুপ করে থাকতে ভারী ভালবাসেন। জেগে উঠে একেকজন যা সব সমাধান দিচ্ছেন তাতে মনে হয় এর চেয়ে ঘুমোলেই বুঝি ভাল ছিল। সেদিন ভোট দেব বলে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি (সকাল সকাল গেছিলাম বলে দিতে পেরেছি, ভাইসব। আমায় মেডেল দিও), কর্তব্যরত পুলিশকর্মীর সাথে আমার পেছনের ভদ্রসন্তান দেশ, জাতি, পরিস্থিতি নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা শুরু করলেন এবং দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত করলেন “ভোট অনলাইন করে দেয়া উচিৎ।” আদ্ধেক লোক কী দিয়ে ভাত খাবে তার ঠিক নেই, উনি অনলাইনে ভোট করাচ্ছেন। এবং এতদ্দ্বারা শাসক দলের বদমাইশিকে বেমালুম অস্বীকার করছেন। আসলে সেই যে আগন্তুক ছবিতে ছিল — কূপমণ্ডূক। আজকাল ভদ্রসন্তানেরা স্মার্টফোনমণ্ডূক। নিজের প্রতি ছাড়া আর কারো প্রতি কোন দায়দায়িত্ব নেই। রাজকুমার রায়ের মৃত্যুটা বড় চমকে দিয়েছে, বড় কাছের লোক মনে হচ্ছে। তাই দুদিন একটু রাগারাগি করবেন আর কি। তারপর আবার মুখে লিউকোপ্লাস্ট লাগাবেন। তার উপরে লেখা থাকবে “আগেও হয়েছে”, এবং যেদিন সরকার দয়া করে ভোট দেয়ার সুযোগ দেবে সেদিন সুড়সুড় করে গিয়ে আবার ওদেরই ভোট দেবেন।
অবশ্য সব ভদ্রসন্তানই এমনধারা তা বললে অন্যায় হবে। অনেকে খুব প্রতিবাদী। তেনারা জেগে উঠেই ঠিক করে ফেলেছেন এদের আর ভোট নয়। কারণটি ভারী মজার। “এসব খুনোখুনি মারামারি করছে মুসলমানরা। বিজেপি এলেই এরা সিধে হয়ে যাবে। অতএব বাংলায় বিজেপিকেই চাই।” এদের জিজ্ঞেস করুন “হ্যাঁ দাদা, অনুব্রত মন্ডল কি মুসলমান? জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক কি পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়েন?” এনারা বুদ্ধিমানের মত জবাব দেবেন “আরে এরা তো আর মারামারিটা করছে না। যারা করছে তাদের নামগুলো দেখুন না। বেশিরভাগ মুসলমান। আরাবুলকে ভুলে যাচ্ছেন?” তখন যদি ধরিয়ে দেন যে যারা মার খেয়ে মরছে তাদের মধ্যেও অনেক মুসলমান, অমনি আপনি এন্টি ন্যাশনাল হয়ে যাবেন। আসল কথা সেই যে ব্রিগেডের মাঠে ২০১৪ সালে মোদীজি এসে বলেছিলেন “এখানে মমতা দিদি আছেন খুব ভাল কথা। দিল্লীতে আমায় বসান, আপনাদের দুই হাতে লাড্ডু হয়ে যাবে।” তা সেই লাড্ডু এখন গোগ্রাসে গিলছি আমরা। দু হাতের লাড্ডুতে মন ভরছে না, কোঁচড়েও চাই। তাই আবার নবান্নেও বিজেপিকে দরকার।
খান ভদ্রসন্তানগণ, পেট পুরে খান। পেটপুরে খান আর প্রাণভরে মলত্যাগ করুন। আপনারা তো আর ছোটলোক নন যে মাঠেঘাটে যেতে হবে। মোদীর স্বচ্ছ ভারত আর দিদির নির্মল বাংলার তো আপনারাই ব্র‍্যান্ড এম্বাসেডর।

বিঃ দ্রঃ তৃণমূল কংগ্রেসের কে এক অর্বাচীন এম এল এ কাল দাবী করেছেন তিনি নাকি এমন সন্ত্রাস বাম আমলেও দ্যাখেননি। ওসব গুজবে কান দেবেন না। লাড্ডু খেয়ে যান।

বিশ্বসাথে যোগে

এত ভাল লেগেছে কবিতাটা, বলে “যে করে হোক আমায় একটা জাপানী অনুবাদ যোগাড় করে দাও”

“বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও।”

গানটা ছোট থেকেই শুনছি। কতবার কত রবীন্দ্রজয়ন্তীতে সুরে, বেসুরে; কত লং প্লেয়িং রেকর্ডে, ক্যাসেটে, সিডিতে যে শুনেছি তার হিসাব নেই। বেশিরভাগ রবীন্দ্রসঙ্গীত যেরকম অন্যমনস্কভাবে শোনে সবাই, সেভাবেও শুনেছি আবার মন দিয়েও শুনে দেখেছি। কোন যোগ স্থাপন করতে পারিনি গানটার সাথে। এভাবেই স্কুল, কলেজ পেরিয়ে গেছি। বাবা-মায়ের ঠ্যালা খেয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে অংশগ্রহণ করেছি একটা বয়স পর্যন্ত, তারপর যে বয়সে বাবা-মা আর জোর করতে পারে না সেই বয়স থেকে যতটা পেরেছি পাশ কাটিয়ে গেছি অনুষ্ঠানটাকে।

তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলাম। একদিন আশুতোষ বিল্ডিং এর ঠিক সামনে অর্ধচন্দ্রাকার জায়গাটায় বসে পা দুলিয়ে অমূল্য আড্ডা দিচ্ছি, আমার সহপাঠী বন্ধু এবং তৎকালীন কমরেড (পরে সহকর্মী) সুদীপ্ত এসে জোর করে টেনে নিয়ে গেল। কোথায় যেতে হবে না হবে কিচ্ছু বলল না। যদ্দূর মনে পড়ে ইউনিভার্সিটির গেট দিয়ে বেরিয়েই রেলায় ট্যাক্সি ডেকে আমাকে নিয়ে উঠে পড়ল। কোথায় যাওয়ার তাড়া, কিসের তাড়া কিছুই বুঝলাম না। যেতে যেতে শোনা গেল সেটা।

আমরা দুজনে তখনো বিশ্বজুড়ে যৌথ খামারের স্বপ্নটপ্ন দেখি। তা জাপান থেকে এক কমরেড এসেছেন আমাদের এখানকার নির্বাচন কভার করতে। তাঁকে সাহায্য করতে হবে। ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের রাজ্য কমিটি নাকি সাংবাদিকতা বিভাগের কোন ছাত্রকে চেয়েছে সেই কাজে। আর আমার যোগ্যতা সম্পর্কে অকারণ উচ্চ ধারণা পোষণ করা বন্ধুটি অমনি আমার নাম বলে দিয়েছে। বলে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি অবশ্য। আমাকে পাকড়াও করে পাড়ি দিয়েছে রাজ্য কমিটির অফিসে। শুনেই আমি ট্যাক্সির দরজা খুলে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিলাম আর কি। জাপানীর জ জানি না, সুদীপ্ত আমায় এরকম ফাঁসাচ্ছে! শেষমেশ যে বান্ধবীটির প্রতি অনুরক্ত ছিলাম তার কথা ভেবে টেবে ঝাঁপটা দিলাম না।

জাপানীটি দেখা গেল অতীব ভদ্রলোক এবং সে জাপানী জানা লোক খুঁজছে না, খুঁজছে ইংরিজি এবং বাংলা জানা লোক। তা তার সাথে নির্বাচন কভার করা তো হল। বোধহয় নেহাত খারাপ সাহায্য করিনি। তাই সে পরেও আরেকবার কলকাতায় এসে আমাকেই খুঁজে বার করে কাজকম্ম করেছিল।

এর পরের বছর। ছাত্রজীবন একেবারে শেষ প্রান্তে। ছাত্র ফেডারেশনের সাথে সম্পর্ক ঘুচিয়ে দিয়েছি, এম এ পাশ করে চাকরিবাকরি পাব কিনা তা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছি। এমন সময় খবর হল উগো শাভেজ কলকাতায় আসবেন। শাভেজ মানে ভেনেজুয়েলার সেই নেতা যিনি প্রায় একটা গোটা মহাদেশকে বিশ্বায়নের চাকার তলা থেকে সরিয়ে এনে অন্যরকমভাবে বাঁচার সাহস দিয়েছেন। শাভেজ মানে যিনি ভোটে জিতে এসে সমাজতান্ত্রিক কর্মকান্ড চালানোর ক্ষমতা ধরেন। শাভেজ মানে যিনি প্রায় কাস্ত্রোর মতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে বহুজাতিকদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারেন। সেই শাভেজ আসছেন কলকাতায়। যখন নেলসন ম্যান্ডেলা এসেছিলেন, বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন হাত ধরে। এবারে শোনামাত্র ভাবছি কী করে যাওয়া যায় রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে সেই দিনটায়। ছাত্র ফেডারেশনের সাথে আড়ি করেছি, যৌথ খামারের স্বপ্নের সাথে তো আড়ি করিনি। এত কাছে আসছেন শাভেজ, অন্তত কয়েকশো ফুট দূর থেকে তাঁকে দেখব না!

কোন ব্যবস্থা মাথায় আসার আগেই জাপানী কমরেড জুনিচির ফোন। “আমি কমরেড শাভেজের কলকাতা সফর কভার করতে আসছি। তোমার অন্য কোন কাজ না থাকলে আমাকে একটু সাহায্য করবে?” অন্য কাজ! সব কাজ ফেলে ঐ কাজ করব আমি।

জুনিচির সঙ্গী হওয়ার সুবাদে মঞ্চের একেবারে কাছাকাছি বসার সুযোগ পেয়ে গেলাম। খুব কাছ দিয়ে হেঁটে এসে মঞ্চে উঠলেন শাভেজ। তারপর উদাত্ত গলায় নিজের মাতৃভাষায় বক্তৃতা। স্টেডিয়ামে উপস্থিত বেশিরভাগ লোকের মতই আমিও স্প্যানিশ জানি না। জুনিচিও জানে না। আমার কাজ ছিল ঐ সভার সকলের বক্তৃতার ইংরিজি অনুবাদ লিখে দেওয়া। শাভেজের বক্তৃতা শুনছি আর প্যাডে লিখছি। আসলে তো তাঁর কথা শুনে লিখছি না, লিখছি স্প্যানিশ দূতাবাস আমারই বয়সী যে ছেলেটিকে শাভেজের বক্তৃতা বাংলা করে বলে দেওয়ার জন্যে নিযুক্ত করেছিল তার কথা শুনে। দু এক মিনিটের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেল যে ভাগ্যবানটি স্প্যানিশ যেমনই জানুক, বাংলা মোটেই জানে না। হোঁচট খেতে খেতেও প্রায় মেরে এনেছিল ব্যাপারটা কিন্তু একেবারে গুবলেট হয়ে গেল শাভেজ বক্তৃতার উপসংহারে রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা বলতে শুরু করতেই। লাইনদুয়েক বাংলা করতেই গোটা স্টেডিয়াম বুঝে গেল এটা কোন কবিতা। কিন্তু সেই হতভাগা বোধহয় জম্মে কবিতাটা পড়েনি। তাই সে ভ্যাবাচ্যাকা। আরো লাইনতিনেক চলার পর এমনকি শাভেজও বুঝলেন ঠিক বাংলা হচ্ছে না। ভুরু কুঁচকে থেমে গেলেন। অগত্যা মঞ্চে উপবিষ্ট পশ্চিমবাংলার তখনকার মুখ্যমন্ত্রী (তিনিও নাকি বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর মত কবিতা টবিতা লিখতেন) উঠে এসে সেই বঙ্গ মায়ের স্প্যানিশ সন্তানটিকে সরিয়ে দিয়ে গড়গড় করে বলে দিলেন “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য / উচ্চ যেথা শির…” ইত্যাদি। শাভেজ দেখলাম যারপরনাই খুশি হলেন। দুজনের আলিঙ্গন, স্টেডিয়ামসুদ্ধ লোকের স্লোগান দিয়ে মিটিং শেষ হল।

কথা ছিল বক্তৃতাগুলো আমি পরদিন দুপুরের মধ্যে ইমেল করব জুনিচিকে। তারপর বিকেলে ওর হোটেলে যাব আর কোন সাহায্য লাগলে সেটা করতে। পরদিন হোটেলে পৌঁছতেই ওর প্রথম প্রশ্ন “তুমি এত ভাল কবিতা লিখতে পার?রবীন্দ্রনাথের কবিতাটার কি সুন্দর ইংরিজি করেছ!” লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায় আর কি। ওকে বোঝালাম যে ইংরিজিটা মহাকবি নিজেই করে গেছেন। তাতে ও আরো মুগ্ধ। রবীন্দ্রনাথ নোবেলজয়ী কবি। জাপানেও গেছেন সেকথা ওর জানা। কিন্তু তিনি যে এত ভাল ইংরিজি জানতেন তা ও শোনেনি কখনো। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ হয়ে রইল।

তারপরেই আমাকে ফেলল মহাবিপদে।

“আচ্ছা এই কবিতাটার জাপানী অনুবাদ পাওয়া যাবে?”

বোঝ! আমি ওকে বললাম যে রবীন্দ্রনাথ জাপানী ভাষা জানতেন বলে আমার জানা নেই। ওদের দেশের কোন কবি যদি করে থাকেন অনুবাদ তো থাকতে পারে কিন্তু সে তো ও-ই ভাল জানবে। জুনিচি নাছোড়বান্দা। এত ভাল লেগেছে কবিতাটা, বলে “যে করে হোক আমায় একটা জাপানী অনুবাদ যোগাড় করে দাও।” দিন দুয়েক সময় চেয়ে নিয়ে কেটে পড়লাম।

অকূলপাথারে পড়লে যা করা আমাদের জাতীয় অভ্যেস সেটাই করলাম। বাবার পরামর্শ চাইলাম। বাবাই বাতলে দিলেন। আমার এক মামা বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ছিলেন। সেই মামীকে ধরলাম। নিপ্পন ভবনের অধিকর্তার ইমেল আইডি যোগাড় হল। তাঁকেই জুনিচির ব্যাপারে জানিয়ে লিখলাম অন্তত বঞ্চিত করে যেন বাঁচিয়ে দেন। ভেবেছিলাম উত্তর টুত্তর পাব না। অবাক কান্ড! চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই উত্তর এল “আপনার অনুরোধ পেয়েছি। মিস্টার জুনিচি কোদামাকে আমরা কবিতাটা পাঠাচ্ছি।”

জুনিচির সেদিনই দিল্লীতে নিজের আস্তানায় ফিরে যাওয়ার কথা। আমি জানালাম কী বার্তা এসেছে রবীন্দ্রনাথের নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বেচারা একটু ব্যাজার মুখেই ফেরত গেল। বোধহয় ভেবেছিল মারাদোনার মত ডজ করে দিলাম। আমি আবার নিপ্পন ভবনের অধিকর্তা মারাদোনা কিনা তাই ভাবছিলাম। কে আমি অজ্ঞাতকুলশীল কলকাতার উপকণ্ঠের এক ছাত্র? আমার অনুরোধে কেনই বা এসব করতে যাবেন তিনি? কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বুঝি ক্ষমতা অসীম। পরদিন বিকেলে দিল্লী থেকে ফোন করল জুনিচি। সে ইমেলে কবিতাটা পেয়েছে। এবং পড়ে আপ্লুত। “এমন আশ্চর্য কবিতা আমি আগে পড়িনি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।”

রবীন্দ্রনাথকে বললাম, একমাত্র তুমিই পারো। কোথায় সুদূর লাতিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলা! সেখানকার বিপ্লবী নেতার বুকে তুফান তোলে তোমার কবিতা আর সেই কবিতা নিজের ভাষায় পড়তে চায় এশিয়ার এক প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের সাংবাদিক! আব্দারটা করে তোমার দেশের, তোমার ভাষার এক অকিঞ্চিৎকর তরুণের কাছে আর সে আব্দারটা মেটাতে সমর্থ হয় কারণ একটা বিশ্বভারতী রেখে গেছ তুমি!
সেইদিন গানটা কানের ভিতর দিয়ে মরমে পৌঁছল। ফিরে রবীন্দ্রনাথকেই বললাম “নয়কো বনে, নয় বিজনে, / নয়কো আমার আপন মনে — / সবার যেথায় আপন তুমি, হে প্রিয়, সেথায় আপন আমারও।।”

হোক সংযুক্তি

আপনি বলবেন সবাই যদি নিজেকে একা ভাবে তাহলে সেদিনকার মেট্রোর মত গণপিটুনির মানসিকতা তৈরি হচ্ছে কী করে? মানুষ হিংসা প্রদর্শন করার বেলায় ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে কী করে?

মাত্র আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে ব্যাপারটা দাঁড়িয়ে গেল জোয়ান বনাম বুড়োতে। এরকমই একটা কিছু আশঙ্কা করছিলাম। কেন? সে কথায় পরে আসছি। আগে মেট্রো, বাস, ট্রেনে আমার গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতার কিছুটা বলি। তাতে এই “বুড়ো মানেই বদ” স্টিরিওটাইপটার অন্তঃসারশূন্যতা কিছুটা বোঝা যাবে।
আমার মেয়ের বয়স ছয়। যখন একেবারে কোলের শিশু ছিল, তখন বেশ কয়েকবার মেট্রোয় উঠে ভিড়ের মধ্যে আমার স্ত্রী লেডিস সিটের সামনে দাঁড়িয়েছে। সেখানে বসা জেন ওয়াইয়ের সদস্যারা নিজেদের মোবাইল স্ক্রিনে ব্যস্ত থেকেছে বা হেড ফোনে সুরের জগতে মগ্ন থেকেছে। উঠে দাঁড়িয়ে বা পাশের জনকে সরে বসতে বলে আমার বউকে বসার জায়গা করে দিয়েছেন পাকা বা কাঁচাপাকা চুলের মহিলারা, অনেক সময় পুরুষরা। কেউ বলতেই পারেন যে এ থেকে প্রমাণ হয় না বুড়োবুড়িরা রক্ষণশীল নয়, moral policing করে না। ঠিক। কিন্তু এ থেকে এটা প্রমাণ হয় যে বয়স্কদের মধ্যে রক্ষণশীলতা যদি থেকে থাকে, তরুণদের মধ্যে আছে নিদারুণ হৃদয়হীনতা। সেটাও ঘটনাবিশেষে নিগ্রহ হয়ে উঠতে পারে এবং ওঠেও।
এটাকেও স্টিরিওটাইপ বলবেন তো? একদম ঠিক। এবং স্টিরিওটাইপ মাত্রেই ভুল। বয়স্ক মানুষ মাত্রেই সেদিনের মেট্রোর লোকগুলোর মত নয়, অল্পবয়সী মাত্রেই হৃদয়হীন নয়। তবু আরো দুটো ঘটনা শুনে নিন।
বছর পাঁচেক আগে বাসে করে অফিস যাচ্ছি। আমি শুরুর দিকের স্টপেজ থেকে উঠি বলে বসার জায়গা পেয়েছি কিন্তু কিছু পরেই বাসটায় ঠাসাঠাসি ভিড় হয়ে গেল। লক্ষ্য করলাম প্রায় আমারই বয়সী একটি মেয়ে ঐ ভিড়ের মধ্যে বিশাল একটা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে লোকের অভিশাপ এবং গুঁতো হজম করছে। ব্যাগটা নিতে চাইলাম, দিতে রাজি না হওয়ায় আন্দাজ করলাম মূল্যবান কিছু আছে। তখন আমার আসনটাই ছেড়ে দিলাম, মেয়েটি বসল। এটা বলার মত ঘটনা নয়। বলতে হচ্ছে আমি উঠে দাঁড়াতেই আমার সমবয়স্ক পুরুষ সহযাত্রীর প্রতিক্রিয়াটার জন্যে। বাঁকা হেসে সে আমায় বলল “বা দাদা, মেয়েছেলে বলে বসতে দিলেন? একটুআধটু আমাদেরও তো দিলে পারেন।” প্রথমে ইঙ্গিতটা বুঝিনি। বুঝতে পেরে বললাম “হ্যাঁ মেয়ে বলেই বসতে দিলাম। আপনি মেয়ে হয়ে আসুন, আপনাকেও বসতে দেব।” ছেলেটি এরপর আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু কয়েক মিনিট পরে দেখি ছেলেটি আর মেয়েটি অল্পস্বল্প কথা বলছে। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর বোঝা গেল ওরা সহকর্মী। এই হচ্ছে আমাদের প্রজন্ম, এই তার মহিলা সহকর্মীর প্রতি শ্রদ্ধা, এই আমাদের প্রগতিশীলতা।
দ্বিতীয় ঘটনা মাসখানেক আগের। বলতে লজ্জা হয়, আমার জন্মস্থান, আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা নবগ্রামে স্টেশন রোডের উপর ঘটেছে ঘটনাটা। বাড়ি ফেরার পথে সাইকেল নিতে গেছি ভর সন্ধ্যেবেলা। রাস্তা তখন জমজমাট। দেখি দোকানের সামনে আমার বয়সী একটি ছেলে তার সঙ্গের মহিলাকে কুৎসিত ভাষায় ধমকাচ্ছে। অনেকেই তাকিয়ে আছে, কেউ কিছু বলছে না। মেয়েটি, সম্ভবত ভয়ে, কাকুতিমিনতি করছে বাড়ি যাওয়ার জন্যে। একটু দেখে মনে হল ছেলেটি মত্ত। তাকে ধমকাব ভাবছি, এমন সময়ে ঠাস করে মেয়েটির গালে এক চড় কষিয়ে দিল। দ্বিতীয় চড় কষানোর আগেই তার হাতটা ধরে ফেলেছি এবং ধমকে বলেছি এটা ভদ্রলোকের জায়গা। এখানে এসব চলবে না। ছেলেটি অনেকক্ষণ ধরে টলতে টলতে আমায় ধমকে গেল এই মর্মে যে এটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার, আমি যেন নিজের চরকায় তেল দিই। আমি বলে গেলাম যা করার বাড়ি গিয়ে করতে হবে, এখানে এই ব্যবহার চলবে না। মিনিট পাঁচেক চলেছিল ব্যাপারটা। শেষ অব্দি মেয়েটি আমার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে টেনে হিঁচড়ে ইঞ্চি ছয়েক নড়াতে পারল ছেলেটিকে, আমায় চলে আসতে হল। কারণ আমাদের পাশ দিয়ে যেসব সুবেশী, শিক্ষিত তরুণ তরুণী হেঁটে যাচ্ছিলেন তাঁদের কেউ এগিয়ে এসে আমার সাথে গলা মেলালেন না। বরং ফুটপাথের মাঝবয়সী দোকানদার ভয়ে ভয়ে আমায় একটু সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পাশের মিষ্টির দোকান থেকে এক প্রবীণ তবু এসে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে আমায় বললেন “কী দরকার তোমার! এসব কি আর ভদ্র ঘরের ছেলেমেয়ে? কী করতে কী করে দেবে…”
দৃষ্টান্ত বাড়িয়ে কাজ নেই। আসল কথা হচ্ছে মানুষ বদলে গেছে । আমার মা যখন যুবতী আর আমি মায়ের আঙুল ধরে চলা শিশু, সেই সময় আমাকে নিয়ে ট্রেনে বাসে উঠলে বসার জায়গা পেতে অসুবিধা হত না মনে আছে। তরুণরাই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতেন। আর তাই নিয়ে অন্য তরুণদের অশ্লীল ইঙ্গিত করতেও দেখিনি কখনো। আর আমাদের নবগ্রাম অজ পাড়াগাঁ ছিল তখন। সেখানে প্রকাশ্য রাস্তায় বউকে চড় মারার সাহস কারো ছিল না। অর্থাৎ বুড়োবুড়ি ছুঁড়োছুঁড়ি নির্বিশেষে আমরা পশ্চাৎপদ হয়ে পড়েছি। কেন?
এর এক শব্দে উত্তর বিযুক্তি (alienation)। গত দুই আড়াই দশকে আমাদের শেখানো হয়েছে “শুধু নিজেরটুকু নিয়ে ভাবো।” এর পোশাকি নাম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবাদ (individualism)। জীবনের সবকিছুর কেন্দ্রেই আমি। আমার সুখ, আমার স্বাচ্ছন্দ্য, আমার ক্লেশ, আমার কষ্ট। বাকি দুনিয়া গোল্লায় যাক। এই মতবাদ সম্বল করেই আমাদের প্রজন্ম বড় হয়েছে, আমাদের বাবা-মায়েরা, মানে সেদিন মেট্রোয় ঐ যুগলকে যারা পিটিয়েছে তাদের পান্ডারা যে প্রজন্মের, বড় করেছেন। এই মতবাদই আমাদের সমাজকে, আমাদের রাজনীতিকে আজ নিয়ন্ত্রণ করছে। গোকুলে বেড়েছে সে, তারপর অনুকূল পরিবেশ পেয়ে এখন রাজত্ব করছে।
খেয়াল করে দেখুন — গত আড়াই দশক আপনি কাগজে পত্রে, সিনেমায়, সিরিয়ালে সর্বত্র এটাই জেনেছেন যে নিজের সমস্যা নিজে মিটিয়ে নেওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে ভাল। এবং সেটাই আধুনিক মানুষের ধর্ম। যে কোন রকমের জোটবদ্ধতাই হচ্ছে দুর্বলতার লক্ষণ, সেকেলে মানসিকতার লক্ষণ, অফিস কাছারিতে ফাঁকিবাজির লক্ষণ। এইভাবে আপনাকে ক্রমশ বিযুক্ত করা হয়েছে অন্য মানুষের থেকে। আপনি এখন জানেন আপনি অফিসে একা, ট্রেনে একা, বাসে একা, অনেক ক্ষেত্রে বাড়িতেও একা।
এবার আপনি বলবেন সবাই যদি নিজেকে একা ভাবে তাহলে সেদিনকার মেট্রোর মত গণপিটুনির মানসিকতা তৈরি হচ্ছে কী করে? মানুষ হিংসা প্রদর্শন করার বেলায় ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে কী করে?
ব্যাপারটা খুব সোজা। মানুষ জোট বেঁধেছিল, সমাজবদ্ধ হয়েছিল কারণ শারীরিক, মানসিকভাবে তার একার পক্ষে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা অসম্ভব। সেই ব্যাপারটা আজও বদলায়নি কারণ মানুষ স্বয়ংসম্পূর্ণ জীব নয়। প্রযুক্তির এত উন্নতি সত্ত্বেও একা একজন মানুষ বাঁচতে পারে না, তাকে অন্য মানুষের উপর নির্ভর করতেই হয়, শারীরিক এবং মানসিক প্রয়োজনে। ফলে যতই কেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবাদ শেখাও না, মানুষ বিপদে পড়লে, এমনকি বিপন্ন বোধ করলেই, একজোট হতে চায়।
ঠিক এই কারণেই মানুষ কী কারণে একজোট হচ্ছে সেটা বুঝতে গেলে রাজনীতিটা বোঝা দরকার। সব মানুষই নিজের নিজের রাজনীতি অনুযায়ী একজোট হয়। আর কে কার সাথে জোট বাঁধবে সেটা নিয়ন্ত্রণ করে তার বিযুক্তি। কে কতটা বিযুক্ত সেটাই ঠিক করে সে তার চারপাশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে নিজেকে কোন পক্ষ ভাববে।
রাজনীতি মানে শুধু সিপিএম, তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস নয়। এই পোস্টে যাঁরা লাইক দেবেন তাঁরা মনে করেন ছেলেমেয়েদুটোর প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন প্রকাশ্য জায়গায় প্রেমের অভিব্যক্তির অধিকার সকলের আছে, আবার কেউ মনে করেন ছেলেমেয়েদুটো বাড়াবাড়ি করেছিল কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারো নেই। কেউ হয়ত আরো একটু ভিন্নমত তবে মোটের উপর এঁরা সকলেই মনে করেন ওদের মারা অন্যায় হয়েছে। এই ঘটনায় এই মতটাই তাঁদের রাজনীতি।
আবার যারা ছেলেমেয়েদুটোকে ধরে পেটাল আর যারা এখনো তাদের সমর্থন করে যাচ্ছে, তারা মনে করে একটা মেয়ে একটা ছেলেকে প্রকাশ্যে জড়িয়ে ধরা বা চুমু খাওয়া এদেশের সংস্কৃতিবিরোধী বা মোটের উপর অশ্লীল। মারা হয়েছে বেশ হয়েছে। এটাই তাদের রাজনীতি।
এখন মুশকিল হচ্ছে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যবাদের যুগে আমরা আবার শিখেছি যে সবকিছুর মধ্যে রাজনীতি টেনে আনা উচিৎ নয়। কোন ঘটনার রাজনীতি বুঝতে না চাওয়ার এই যে দীর্ঘদিনের অভ্যাস তৈরি হয়েছে তার ফলে আমরা পক্ষ চিনতে ভুল করি। যেমন যখন চাকরি পাই না, রোজগার হারাই, কষ্টের হকের রোজগারও ফুড়ুৎ করে পকেট থেকে উড়ে যায় তখন বুঝতে পারি না যে আমার শত্রু সেই অর্থনৈতিক নীতি যা উত্তুঙ্গ জিডিপি তৈরি করে অথচ কর্মসংস্থান কমায়। আমি ভাবতে শুরু করি আমার শত্রু তফসিলি জাতি উপজাতির লোকেরা, অথবা বিশেষ একটা ধর্মের লোকেরা। কখনো বা ভাবি মেয়েরা এত বেশি লেখাপড়া শিখছে বলেই যত গন্ডগোল, চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যেও ভিড় বেড়ে যাচ্ছে। আমার বিযুক্তি আমাকে ভেতরে ভেতরে আক্রমণাত্মক করে তোলে আর আমি ঐ কাল্পনিক শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে হিসহিস করতে থাকি। আমার সামাজিক, অর্থনৈতিক, যৌন অবস্থান যা-ই হোক আমার চোখে আমিই হয়ে উঠি সবচেয়ে প্রতারিত, বঞ্চিত মানুষটা। অথচ যেহেতু আমি জানি যে আমি একা সেহেতু আমি সদা ভীত।
সুতরাং আমার সামনেই একটা মেয়ের কাপড় ধরে কেউ টানলে আমি না দেখার ভান করি কারণ ঐ মেয়েটা আমার কে? ওর চেয়ে আমি কি কম আক্রান্ত? ওর হয়ে বলতে গিয়ে কেন নিজেকে আরো বিপদে ফেলব? চোখের সামনে কেউ দুর্ঘটনায় মরে গেলেও আমি চোখ বন্ধ করে থাকি কারণ যে মরেছে সে আমার কেউ হয় না। আমার এমনিতেই হাজারটা সঙ্কট। আমার সঙ্কটের চেয়ে অন্য একটা মানুষের মৃত্যুও বড় সঙ্কট হতে পারে না।
তবে আমার চারপাশের সঙ্গে আমার যে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব — সেটা কিন্তু মিথ্যে নয়। আমার উপর যে নানাবিধ অন্যায় চাপ তৈরি হচ্ছে সেটা কিন্তু আমার কল্পনা নয়। যদি মিথ্যে হত তাহলে মেট্রোয় ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ানোর জন্যে মার খেতে হত না। ফলত আমি যে কোন এক পক্ষে আর আমার যে বিপক্ষ আছে তাও সত্যি। আমি নিজের পক্ষের লোক খুঁজছি। একজোট হতে পারলেই আর আমার ভয়ের কারণ থাকে না। তখন গুছিয়ে ঠ্যাঙাতে পারি শত্রুপক্ষকে। কিন্তু আমি কোন পক্ষে আর কোন পক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই সেটা বুঝব কী করে? চোখের সামনে যাকে বা যাদের দেখছি তারা তো আমারই মত কয়েকজন ব্যক্তি মাত্র, তার বেশিকিছু নয় — এরকমটাই ভাবতে শিখেছি আমি। অতএব আমি সিদ্ধান্ত করলাম যে আমার বয়সী ছেলেমেয়েদের যে বুড়োরা ধরে মারল, তারা শুধুই বুড়ো। কোন বিশেষ মতামতের, মানে রাজনীতির, প্রতিভূ নয়। অর্থাৎ এই লড়াইটায় আমার পক্ষ হল আমার মত তরুণরা আর বিপক্ষ হল বয়স্ক লোকেরা। সেদিন দলে ভারী ছিলাম না তাই মার খেয়েছি। সোশাল মিডিয়ায় আমার পক্ষের অনেককে পেয়ে গেছি অতএব মার ফিরিয়ে দিই যত বয়স্ক লোক আছে সকলকে গালাগালি দিয়ে।
যারা সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে আক্রমণ করেছিল তারাও একইরকম বিযুক্তির শিকার ছিল, যতক্ষণ না সংস্কৃতির শত্রু নামক কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধে তারা এক হতে পেরেছে। শুধু এদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই এখন এরকম কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধেই মানুষ বিযুক্তি কাটিয়ে এক হতে পারছে, আসল শত্রুরা বহাল তবিয়তে আছে। কলকাতার মেট্রো কোন বিচ্ছিন্ন জায়গা নয়।
তাই বলছি, হোক আলিঙ্গন। বয়স্কদের বিরুদ্ধে তরুণদের আলিঙ্গন নয়, রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীলদের আলিঙ্গন। বিযুক্তি কাটুক, মোবাইলের বাইরে এসে সত্যিকারের দুনিয়ায় সংযুক্তি হোক।
পক্ষ নেওয়ার আগে পক্ষ চিনুন।

%d bloggers like this: