এক যে ছিল সংসদ

প্রধানমন্ত্রী প্রথম দিন সংসদে ঢোকার সময় সিঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেছিলেন, বলেছিলেন “এটাই তো আমার মন্দির”

সে এক সংসদ ছিল। প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসতেন জহরলাল নেহরু বলে একজন। সাহিত্যিক ই এম ফর্স্টারের ধারণা ছিল, ফরাসী দার্শনিক ভলতেয়ারের যদি পুনর্জন্ম হয় আর তিনি বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে একটা চিঠি লিখবেন ঠিক করেন, তাহলে একমাত্র যে রাষ্ট্রনেতা সেটা পাওয়ার যোগ্য, তিনি নেহরু। আর বিরোধী দলনেতার আসনে বসতেন অসামান্য বাগ্মী এবং পণ্ডিত, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। একটু দূরেই ছিলেন হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনিও কম বড় বক্তা নন। একবার শ্যামাপ্রসাদ বক্তৃতা দিচ্ছেন, নেহরু উঠে বললেন “What nonsense are you talking?” শ্যামাপ্রসাদ জবাব দিলেন “There’s no monopoly of yours in talking nonsense, sir.”
ঘটনাটা শুনেছিলাম হাওড়ার এক সময়কার সিপিএম সাংসদ প্রয়াত সুশান্ত চক্রবর্তীর মুখে। তিনি আরো একটা সংসদীয় বিতর্কের গল্প শুনিয়েছিলেন। সেটা ওরকম মান্ধাতার আমলের ঘটনা নয়, আমাদের সময়ের অনেক কাছাকাছি। কংগ্রেস নেতা এ আর আন্তুলের বিরুদ্ধে সিমেন্ট নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ। তা নিয়ে বিরোধীরা সংসদে জোর চেপে ধরেছেন সরকারকে। বিতর্কে এক মন্ত্রী দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন, তারপর বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং বলতে উঠেছেন। শুরুতেই বললেন “The minister spoke at length, trying to cement his argument. But failed.”
এই গল্পগুলো শুনি ২০০০ সাল নাগাদ। তখন ক্লাস টুয়েলভে পড়ি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তরুণ মাস্টারমশাই বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠিক করলেন আমাদের দিয়ে মক পার্লামেন্ট করাবেন। যেদিন অনুষ্ঠানটা হল সেদিন অতিথি হিসাবে এসে সুশান্তবাবু শুনিয়েছিলেন গল্পগুলো। ওগুলো অবশ্য লোকসভা, রাজ্যসভার অধিবেশনের সরাসরি টিভি সম্প্রচার শুরু হওয়ার আগের ঘটনা। আমি যে প্রজন্মের লোক, তারাই প্রথম টিভিতে ওসব দেখতে পায়। তখনো কিন্তু সংসদের বিতর্কগুলোর একটা ন্যূনতম মান ছিল।
আমরা ট্রেজারি বেঞ্চে অটলবিহারী বাজপেয়ীর কথার চেয়ে লম্বা বিরামযুক্ত বক্তৃতা শুনেছি, সাথে তাঁর স্বরচিত কবিতা। যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনে আছে আস্থাভোটে জয়যুক্ত হওয়ার আগে বলা “কর্তব্য পথ পর / ইয়ে ভি সহি, উয়ো ভি সহি।” আমরা লালকৃষ্ণ আদবানির সংস্কৃতাশ্রয়ী হিন্দি বক্তৃতা শুনেছি, বিরোধী আসন থেকে জলদগম্ভীর সোমনাথ চ্যাটার্জিকে শুনেছি, পূর্ণ সাংমাকে মনে আছে, ভোজপুরী হিন্দি আর টুকরো রসিকতায় গুরু বিষয়কে লঘু করে বলতে পারার ক্ষমতাসম্পন্ন লালুপ্রসাদকেও মনে আছে। আরো পরে সরকারপক্ষের পি চিদম্বরম, কপিল সিবাল আর বিরোধীপক্ষের অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ, সীতারাম ইয়েচুরির বক্তব্যও কান পেতে শোনার মত ছিল। তার চেয়েও বড় কথা ওয়াক আউট, বিলের প্রিন্ট আউট ছেঁড়া, ওয়েলে নেমে স্লোগান দেওয়া — এসব সত্ত্বেও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে বিতর্ক হত। তাতে সব পক্ষের প্রধান নেতারা অংশগ্রহণও করতেন। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা দেবেন না, এটা কল্পনাতীত ছিল।
তারপর আচ্ছে দিন এল। কার জানি না, তবে সংসদীয় গণতন্ত্রের যে নয় তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী প্রথম দিন সংসদে ঢোকার সময় সিঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেছিলেন, বলেছিলেন “এটাই তো আমার মন্দির।” এবং তারপর থেকেই ক্রমশ সংসদের অধিবেশন বসার দিন কমেছে, মন্দিরের প্রধান সেবায়েতের উপস্থিতিও কমেছে। অনেক দেশদ্রোহী বলে উনি সংসদটা এড়িয়ে যান কারণ মেঠো বক্তৃতায় হাত-পা নেড়ে, চোখের জল ফেলে উতরে গেলেও সংসদে জোরালো বক্তৃতা দেওয়া ওঁর কম্ম নয়। তবে আমি একথা বিশ্বাস করি না। এটা নেহাতই কুৎসা। আসলে ভদ্রলোক দিনে মোটে চার ঘন্টা ঘুমোন তো। আমার ধারণা সেই চার ঘন্টা হল দুপুর বারোটা থেকে চারটে। তা ঐ সময়টা কি সংসদে বসে নষ্ট করা যায়? ওটুকু না ঘুমোলে মানুষটা অসুস্থ হয়ে পড়বে না?
কিন্তু দেশদ্রোহীরা তো এসব শুনবে না, তারা উল্টোপাল্টা বলবেই। সেটা বন্ধ করতে সরকার ভাল বুদ্ধি বার করেছেন — কোন বিতর্ক হওয়ারই দরকার নেই সংসদে। এই প্রবণতা শুরু থেকেই অল্প অল্প দেখা যাচ্ছিল। বিমুদ্রাকরণের মত বড় বিষয় নিয়েও বিরোধীরা চেঁচামেচি করার পর সরকার আলোচনায় রাজি হয়েছিল। তাও চেয়েছিল যেন সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়, ভোটাভুটির ব্যাপার না থাকে। এবং যেভাবেই আলোচনা হোক না কেন, প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বক্তব্য রাখবেন না।
এবারে আরেক কাঠি সরেস। একটা লোক দেশের এত টাকা মেরে দিয়ে পালিয়ে গেল যে এখনো ঠিক বোঝা যাচ্ছে না কত টাকা, অথচ সরকারের মনেই হল না এটা নিয়ে সংসদে আলোচনার প্রয়োজন আছে। বিরোধীরা আলোচনার দাবীতে বিস্তর চেঁচামেচি করছেন (বেশ করছেন), এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানাচ্ছেন সরকার সবকিছু নিয়ে আলোচনায় রাজি। কিন্তু একথা বলছেন কবে? না বিনা বিতর্কে অর্থ বিল পাশ হয়ে যাওয়ার পরে। যা যা ছিল তাতে তার মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর বিদেশের টাকায় পুষ্ট হওয়াকে আইনসম্মত করে নেওয়াও আছে। এতবড় কান্ড হয়ে গেল কোন বিতর্ক ছাড়াই। সরকারের যেন কোন দায় নেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে সংসদকে সচল করার। ফ্লোর ম্যানেজমেন্ট কথাটার যেন কোন অস্তিত্বই নেই।
আসলে বিনা বিতর্কে পছন্দের কাজগুলো হয়ে যাক — এটা এদেশে কে না চায়? যে কোন বড় শহরের জনবহুল মোড়ে দাঁড়িয়ে যাদের ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলা বলে মনে হয় তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন। কতজন যে বলবে “গণতন্ত্রের সীমা থাকা উচিৎ”, “মিলিটারি রুল হচ্ছে বেস্ট”!
যাঁরা মনে করেন কথাগুলো ঠিকই, তাঁদের জন্যে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা বলে শেষ করি। ঘটনাটার সাথে আমাদের দেশের কোন ঘটনার মিল আছে কিনা আপনারাই ভেবে দেখুন।
ঘটনাটা ঘটে ২১শে মার্চ, ১৯৩৩ এ। সেদিন নাজি পার্টির নেতা হিটলার পটসডাম গ্যারিসন চার্চের বাইরে তদানীন্তন জার্মান রাষ্ট্রপতি পল ফান হিন্ডেনবার্গকে হাঁটু মুড়ে অভিবাদন জানায় এবং করমর্দন করে। উপলক্ষটা ছিল নব নির্বাচিত রাইখস্ট্যাগের (জার্মান সংসদ আর কি) প্রথম অধিবেশন। যেহেতু হিন্ডেনবার্গ রাষ্ট্রপ্রধান আর দিনটা হল রাইখস্ট্যাগের অধিবেশন শুরুর দিন, তাই অনেকে মনে করেছিল হিটলার জার্মান সংবিধান ইত্যাদির প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করল। এর পরের বারো বছর প্রমাণ করেছে তাদের ভাবনাটা সঠিক ছিল কিনা।

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন।

Leave a Reply

%d bloggers like this: