শ্রীদেবীত্ব

এই আঁতলামিটা আসলে ঠিক সেটাই করে যেটা এড়াতে চায় সচেতনভাবে — একজন অভিনেত্রীকে শুধু মহিলা হিসাবে বিচার করা। কারণ যে ছবিতে চরিত্র দাবী করেছে, সেখানে সুপ্রিয়া দেবীর কাজই ছিল যৌন আবেদনে দর্শককে ঘায়েল করে দেওয়া। যদি সেটা করতে পেরে থাকেন, তাঁর অভিনয় সার্থক

sridevi-FI

জনপ্রিয় মানেই ভাল নয় — একথা যেমন সত্যি, তেমনি জনপ্রিয় মানেই শিল্প হিসাবে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার দাবী রাখে না — এরকম মনে করাও অকারণ আঁতলামি ছাড়া কিছুই নয়। ফেসবুক যেমন মহা বিরক্তিকর কিছু ছ্যাবলামিকে প্রশ্রয় দেয় তেমন এই ধরণের আঁতলামিকেও ইদানীং বড্ড বাড়িয়ে তুলেছে।
যেমন সুপ্রিয়া দেবী মারা যাওয়ার পর দেখলাম রাম শ্যাম যদু মধু সকলেই চিৎকার করছে “দাদা, আমি বাঁচতে চাই।” এদের অধিকাংশকে বিনা পয়সায় দেখাতে চাইলেও ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখতে চাইবে না, অনেক কষ্টে বসানো গেলেও মাঝপথে উঠে যাবে। কেউ কেউ হয়ত আদৌ দ্যাখেনি ছবিটা। কারণ সংলাপটা “দাদা, আমি বাঁচতে চাই” নয়। অথচ সকলে মিলে এমন করা শুরু করল যেন সুপ্রিয়া দেবী সারাজীবনে ঐ একটিই ছবি করেছেন। আর ঋত্বিক ঘটকের সাথে ঐ কাজটার জন্যেই সকলে চেনে ওঁকে। অধিকাংশ লোকের তো ‘কোমল গান্ধার’ এর অনসূয়াকেও মনে আছে মনে হল না, বাণিজ্যিক ছবিগুলোর কথা ছেড়েই দেওয়া যাক। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে আপামর দর্শক সুপ্রিয়াকে চিনেছে বাণিজ্যিক ছবিতে তাঁর অভিনয়ের জন্যেই। ঋত্বিকও তো সেসব অভিনয় দেখেই তাঁকে নীতা বা অনসূয়ার চরিত্রের জন্যে নির্বাচন করেন। সুপ্রিয়া তো আর গীতা ঘটক নন, যে ছোট থেকেই ঋত্বিক চিনবেন।
আসলে এদেশে অভিনেত্রীরা মারা গেলে আমাদের ঘোরতর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটা মজার ঘটনা ঘটে আমার মনে হয়। অভিনেত্রীকে পর্দায় দেখে কখন কখন তাঁর সৌন্দর্যে/যৌন আবেদনে আমরা মথিত হয়েছি, সেইটে চেপে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা চলে। এই একবিংশ শতাব্দীতে নারীবাদ যেটুকু জায়গা করতে পেরেছে আমাদের সমাজে, সেটা যৌনতা সম্পর্কে আমাদের চিরাচরিত ঢাকঢাক গুড়গুড়ে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কোন সমালোচক কোন সংবাদমাধ্যমে প্রয়াতা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বা আমার মত সাধারণ লোক ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে ভাবছে “সাবধানে লিখি, বাবা। যদি সেক্সিজম হয়ে যায়।” মেরিলিন মনরো বা আনিটা একবার্গ মারা গেলে পাশ্চাত্যের গণমাধ্যম বা সাধারণ মানুষকে কিন্তু এরকম অদ্ভুত আচরণ করতে দেখি না। আসলে আমাদের এখানে অধিকাংশ লোকই সেক্সিজম মানে সেক্স বোঝে তো। ফলে সুপ্রিয়াকে ‘বনপলাশীর পদাবলী’ তে (বিশেষ করে ‘দেখুক পাড়াপড়শিতে’ গানে যখন তিনি উত্তমকুমারের বঁড়শিতে গেঁথে যান) যে প্রবল আবেদনময়ী লেগেছিল, সেটা লেখাটা বড্ড uncool হয়ে পড়ে। ‘মন নিয়ে’ ছবিতে উত্তমকুমারকে নিয়ে টানাটানি করা যমজ বোনেদের চরিত্রগুলোয় সুপ্রিয়ার অভিনয় অনালোচিতই থেকে যায়। এমনকি ‘সিস্টার’ ছবির সেই চরিত্র, যে শত্রুসেনার হাত থেকে স্কুলের মেয়েদের বাঁচাতে নিজের দেহ সমর্পণ করে — সেটার কথাও নাকি খুব একটা কারোর মনে নেই। চারদিকে এত সিনেমাবোদ্ধা গিজগিজ করছে দেখলে নীলকণ্ঠ বোধহয় সেই ঢাকনাহীন বাংলার বোতলটা ছুঁড়ে মারত।
এই আঁতলামিটা আসলে ঠিক সেটাই করে যেটা এড়াতে চায় সচেতনভাবে — একজন অভিনেত্রীকে শুধু মহিলা হিসাবে বিচার করা। কারণ যে ছবিতে চরিত্র দাবী করেছে, সেখানে সুপ্রিয়া দেবীর কাজই ছিল যৌন আবেদনে দর্শককে ঘায়েল করে দেওয়া। যদি সেটা করতে পেরে থাকেন, তাঁর অভিনয় সার্থক। সেই সার্থকতা স্বীকার না করাই তো শিল্পীর পক্ষে অমর্যাদাকর। উত্তমকুমারের বেলায় আমরা শুধু ‘জতুগৃহ’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘বাঘবন্দি খেলা’ নিয়েই আলোচনা করি? ‘সপ্তপদী’ বা ‘শঙখবেলা’ র মত যেসব ছবিতে তাঁকে দেখলেই আজও বহু মেয়ের প্রেম করতে ইচ্ছে করে —- সেগুলোকে বাদ দিয়ে ভাবি? এমনকি সত্যজিৎ রায়ও তো তাঁর সুপুরুষ চেহারার যৌন আবেদনকে ব্যবহার করেছেন। তাতে দোষ কি?
এখন এত কথা বলছি কেন? বলছি এইজন্যে যে শ্রীদেবীকে নিয়ে দেখছি আবার সেই আঁতলামো শুরু হয়ে গেছে। আসলে শ্রীদেবী সম্পর্কে ভারতীয় পুরুষের যে যৌন আবেগ সেটাকে চাপা দেওয়া আরো শক্ত। সুপ্রিয়ার বেলায় আমাদের উদ্ধার করেছেন ঋত্বিক। শ্রীদেবী যে কখনো শ্যাম বেনেগাল বা গোবিন্দ নিহালনির মত পরিচালকের সাথে অভিনয় করেননি! এখন আঁতলামোটা করা যাবে কী করে! ধরা হল দীর্ঘ বিরতির পরে করা শেষদুটো ছবিকে — ইংলিশ ভিংলিশ আর মম। এদুটোই নাকি শ্রীদেবীর অভিনয়ক্ষমতার শীর্ষ বলে শুনতে পাচ্ছি এখন। দুটোর একটাও আমি দেখিনি, তবুও শ্রীদেবীর মৃত্যুতে আমার কারো চেয়ে কম দুঃখ তো হচ্ছে না! তিনি যে শুধু সুন্দরী ছিলেন না জিনাত আমনের মত, অভিনয়টা যথেষ্ট ভাল জানতেন — সেটা ইংলিশ ভিংলিশের আগে বোঝা যায়নি! ‘আখরি রাস্তা’র মত অমিতাভসর্বস্ব ছবিতেও তো যখন পর্দায় আসেন, শ্রীদেবীর দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়। বিদ্যা বালন তো সেদিনের মহিলা, একজন নায়িকা একা একটা বাণিজ্যিক ছবিকে টেনে নিয়ে যেতে পারেন সে তো নেচে গেয়ে মারামারি করে শ্রীদেবী আশির দশকেই দেখিয়ে দিয়েছেন ‘চালবাজ’ এ। ‘চাঁদনী’ ছবিতে শ্রীদেবীর পাশে ঋষি কাপুর আর ওরকম সুপুরুষ বিনোদ খান্নাকেও নেহাত বেচারা লাগেনি কি? অতীতের এক সুন্দরী নায়িকাকে দুটো না বানালে ওয়াটার পিউরিফায়ার বেচা যায় না। শ্রীদেবী কিন্তু বরাবরই তাঁর সৌন্দর্য আর অভিনয়ের এমন কম্বো পেশ করেছেন যে আমাদের কৈশোরে তিনি ফলিডলের বিজ্ঞাপন করলে আমরা তাও কিনে ফেলতাম। তাহলে আজ আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে এসব হালের ছবির নাম কেন? ‘ইংলিশ ভিংলিশ’ হয়ত শ্রীদেবীর ছবি, শ্রীদেবীকে ইংলিশ ভিংলিশের অভিনেত্রী বললে কিন্তু নেহাতই অন্যায় হবে।
বরং সত্যি কথাটা সহজ করে বলা যাক না। আমাদের প্রজন্ম বরাবর বনি কাপুরকে মনে মনে (কখনো প্রকাশ্যেও) গালাগাল দিয়ে এসেছে শ্রীদেবীর স্বামী হওয়ার সৌভাগ্যের জন্যে। বেশ মনে আছে আমার এক অতীব মেধাবী বন্ধু একবার ফুট কেটেছিল “কে বেশি বৌদিবাজ বল তো? রবি ঠাকুর না অনিল কাপুর?” চরম সত্যি কথাটা এই যে আমাদের প্রজন্মের যেসব ছেলে একদমই সুবোধ বালক ছিল, তাদের কৈশোরও স্বপ্নার্দ্র করে রেখেছিলেন শ্রীদেবী, কারণ তিনি ক্যামেরার সামনে অদৃশ্য পুরুষের সঙ্গেও প্রবল প্রেম করতে পারতেন। নীল শাড়িতে সেই শ্রীদেবীকে দেখার পর আমাদের দিন কাটত না, রাত কাটত না।
প্রকাশ্যে আজ যে যা-ই বলুক আর লিখুক, মনে মনে সবাই জানে, সৌরভ গাঙ্গুলি যেমন বলকে বলতে পারতেন “বাপি, বাড়ি যা”, শ্রীদেবীও সানি লিওনকে বলতে পারতেন “সানি, বাড়ি যা।”

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

2 thoughts on “শ্রীদেবীত্ব”

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading