যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই

“বাবরি ভাঙার উদ্দেশ্য যদি না-ই থেকে থাকে তাহলে ‘মন্দির ওয়াহি বনায়েঙ্গে’ স্লোগানে ‘ওয়াহি’ বলতে আপনি কোন জায়গাটা বুঝিয়েছিলেন? কল্যাণ সিং এর বাড়ির বৈঠকখানাটা? প্রতীকী করসেবায় শাবল, গাঁইতি, তরোয়াল এসবই বা আসে কোথা থেকে?”

সকালের কাগজে দেখলাম এক বৃদ্ধকে নিয়ে একটা আবেগঘন লেখা বেরিয়েছে। হেডিংটা পড়েই মনে মনে একটা কাঁচা খিস্তি দিলাম। তারপরেই মনে পড়ল ছোটবেলায় একবার বাবার সাথে বাজারে গেছি, বাবা চায়ের দোকানে ঢুকেছে। এক অচেনা বুড়ো, দেখলেই তার জন্যে কষ্ট হবে আপনার, এক কোণে বসে চা খাচ্ছিল। চায়ের গেলাসটা মুখ অব্দি নিয়ে যাওয়াও তার পক্ষে কষ্টকর। বহুকষ্টে মুখের পেশি সঞ্চালন করে একবার বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল। বাবাও হাসল। আমি জিজ্ঞেস করলাম “কে গো? চেনো?”
বাবা বলল “চিনব না? একসময় এ আমাদের কম ঠেঙিয়েছে? নামকরা গুন্ডা ছিল।”
“খুনটুন করেছে নাকি?”
“ঠিক জানি না। করেও থাকতে পারে এক আধটা।”
“এখনো গুন্ডামি করে?”
“না না। এখন তো বয়স হয়ে গেছে, ভদ্রলোক হয়ে গেছে।”
গুন্ডারা বয়স হলে ভদ্রলোকই হয়ে যায় বটে। কারণ উপায় থাকে না, জোয়ান গুন্ডাদের জায়গা ছেড়ে দিতে হয়।
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কোন বৃদ্ধের কথা বলছি? হ্যাঁ, লালকৃষ্ণ আদবানির কথাই বলছি। তিনি নাকি বাবরি ধ্বংসে আজও ব্যথিত। লেখাটা পড়লে দেখবেন সেই চিরাচরিত হিন্দুত্ববাদের যুক্তিগুলো আবার আওড়ানো হয়েছে, নতুন কিছু নেই। আর বাবরি ধ্বংস সম্পর্কে আন্দোলনের এক নম্বর নেতা বলছেন তাঁর নাকি উদ্দেশ্য ছিল শুধু প্রতীকী করসেবা করা, মসজিদ ভাঙা নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে গেছিল।
আদবানির সঙ্গে কথা বলেছেন এক প্রবীণ সাংবাদিক। অদ্ভুত ব্যাপার হল ঝানু সাংবাদিকরাও ২৫ বছর পরেও এইসব ঢপ হজম করছেন। একবারও প্রশ্ন করেননি “বাবরি ভাঙার উদ্দেশ্য যদি না-ই থেকে থাকে তাহলে ‘মন্দির ওয়াহি বনায়েঙ্গে’ স্লোগানে ‘ওয়াহি’ বলতে আপনি কোন জায়গাটা বুঝিয়েছিলেন? কল্যাণ সিং এর বাড়ির বৈঠকখানাটা? প্রতীকী করসেবায় শাবল, গাঁইতি, তরোয়াল এসবই বা আসে কোথা থেকে?”
যাই হোক, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি তার অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে তরতরিয়ে এগিয়েছে গত ২৫ বছরে। লালু গুন্ডা কালের নিয়মে নরেন গুন্ডাকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে ভদ্দরলোক হয়ে গেছে। হিন্দুত্ববাদের ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার এই যাত্রায় সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হল আমাদের ভুলে যাওয়ার প্রবণতা। ভুলে যাবেন না। ভুলে যাবেন না নরেন্দ্র মোদী যদি হিন্দুত্ববাদের বিশ্বকাপজয়ী মহেন্দ্র সিং ধোনি হন, আদবানি তাহলে কঠিন পরিস্থিতিতে বিদেশের মাটিতে ম্যাচ জেতানো সৌরভ গাঙ্গুলি। এখন তিনি নিজেকে অময় খুরাসিয়া হিসাবে প্রমাণ করে হাত ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করলেই তাঁকে সেটা করতে দেওয়া চলবে না কারণ জার্মান ভাষায় একটা প্রবাদ আছে “যারা ইতিহাস বিস্মৃত হয় তারা অভিশপ্ত। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি তারা করবেই।” জার্মানরা আবার এই ব্যাপারটা অন্য অনেকের চেয়ে ভাল জানে। ভুক্তভোগী তো।
যাতে ভুলে না যাই, তাই রইল আনন্দ পট্টবর্ধনের তথ্যচিত্র ‘রাম কে নাম’

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা তিন।

Leave a Reply

%d bloggers like this: