অখন্ড বাংলা

যদি আলাদাই হবেন তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় এপারের বাঙালি কেন অধীর হয়ে থাকত দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় খবর শোনার জন্যে? কেন এপারের আমরা বড় হলাম শামসুরের নানির ‘বিষাদসিন্ধু’ পাঠ শুনতে শুনতে? যে কাজ লর্ড কার্জন করে উঠতে পারলেন না, কাঁটাতারও সেভাবে পেরে উঠল না, কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেকাজ করতে চাইছেন?

“মোরা এক সে দেশের খাই গো হাওয়া
এক সে দেশের জল”

“আল্লা মেঘ দে পানি দে
ছায়া দে রে তুই”

“বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার বায়ু বাংলার ফল
পুণ্য হউক পুণ্য হউক
হে ভগবান”

উপরের পংক্তিগুলো বাংলা ভাষার সম্পদ। “জল” বললেও বাংলা, “পানি” বললেও। যে অন্যকিছু ভাবে সে হয় বাংলাকে, বাঙালিকে চেনে না অথবা বদমাইশ। অসদুদ্দেশ্য আছে, তাই বোকা সাজছে। গত কয়েকশো বছর ধরে যে বাঙালি “জল” বলে আর যে বাঙালি “পানি” বলে তারা পাশাপাশি বাস করছে। কখনো শোনা যায়নি একদল অন্য দলকে বলেছে “তোমায় আমি যা বলছি তা-ই বলতে হবে। নইলে তুমি বাঙালি নও।” বস্তুত কোন বাঙালি হিন্দু হলেই যে “জল” বলবে আর মুসলমান হলেই “পানি”, এই ধারণাগুলোও অতিসরলীকৃত। উপরের পংক্তিগুলোতেই দেখা যাচ্ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বী নজরুল ব্রাক্ষ্ম রবীন্দ্রনাথের মতই “জল” লিখেছেন। ইচ্ছা হয়েছে বলে লিখেছেন, পানি লিখলেও মহাভারত অশুদ্ধ হত না। আব্বাসউদ্দিনের গলায় যখন ক্ষরাক্লিষ্ট গ্রাম্য মানুষের বৃষ্টির প্রার্থনা শুনি, “আল্লা” বলছেন বলে তা বিদেশী মনে হয় কি কখনো? বাংলার ভালোর জন্যে নিজের ভগবানের কাছে রবীন্দ্রনাথের উদাত্ত প্রার্থনা সুচিত্রা মিত্রের গলায় কি বিজাতীয় মনে হয় কোন মুসলমান শ্রোতার?
পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখন এইরকম কিম্ভূত কিমাকার চিন্তাই করছেন। রামধনু শব্দটা শুনে যে বাঙালির বৃষ্টিদিনের অপরূপ দৃশ্য মনে না পড়ে দাশরথির কথা মনে পড়ে সে যে সুকুমারের দাশরথির চেয়েও বড় পাগল এটা আলাদা করে বুঝিয়ে দেওয়ার দরকার নেই বোধহয়। হেসে উড়িয়ে দেওয়া যেত, যদি এই বিষ পাঠ্যবইয়ে ঢোকানোর চেষ্টা না হত।
বাংলা ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিল তারা অনেকেই হয়ত মা-কে আম্মি বলে ডাকত, বাবাকে আব্বা বা আব্বু। আবার বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা অনেকে মা-কে মা বলেই ডাকতেন। কী তফাত? শামসুর রহমান বাঙালি আর নির্মলেন্দু গুণ হিন্দু বাঙালি? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাঙালি আর সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ মুসলমান বাঙালি? বাঙালি দুরকমের হয় — হিন্দু আর মুসলমান — শিশুদের একথা শিখিয়ে দেওয়া, এ তো নোংরামি! বাঙালি একরকমই — বাঙালি। কেউ ফুল বেলপাতা দিয়ে বিগ্রহের পূজা করেন, কেউ শুধু পশ্চিমদিকে মুখ করে জানু পেতে বসে নিজের ঈশ্বরের আরাধনা করেন। এ তো তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তা বলে তাঁরা আলাদা!
যদি আলাদাই হবেন তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় এপারের বাঙালি কেন অধীর হয়ে থাকত দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায় খবর শোনার জন্যে? কেন এপারের আমরা বড় হলাম শামসুরের নানির ‘বিষাদসিন্ধু’ পাঠ শুনতে শুনতে? যে কাজ লর্ড কার্জন করে উঠতে পারলেন না, কাঁটাতারও সেভাবে পেরে উঠল না, কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেকাজ করতে চাইছেন?
সরকারের কীর্তিকলাপ বেশ কিছুদিন ধরেই ভরসার বদলে সন্দেহের উদ্রেক করছে। পশ্চিমবঙ্গের অনেক হতাশাজনক নেইয়ের পাশে দীর্ঘকাল একটা গর্ব করার মত নেই ছিল — সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নেই। বাম আমলের সবকিছুর সঙ্গে সঙ্গে এটাকেও বাতিল করবেন নাকি? সাম্প্রদায়িক গোলমাল আটকানোয় সরকারের গড়িমসি কিছুদিন ধরেই প্রকট হয়ে উঠছে। পুলিশ যেন হিন্দি সিনেমার পুলিশ হয়ে উঠেছে, পৌঁছয় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে। সেই প্রেক্ষাপটে রামধনুর রং বদল আরো বিপজ্জনক। এ যে একেবারে বুকের ভেতর দেওয়াল তোলার চেষ্টা, ছোট থেকেই আমরা-ওরা তৈরি করে দেওয়ার চেষ্টা।
বাঙালির এই বিপদে কোথায় কবি সুবোধ সরকার? তিনি তো মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ। তিনি প্রতিবাদ করবেন না? বলবেন না এটা অন্যায়, এটা বিপজ্জনক? নইলে কবি হিসাবে, সমাজের বিবেক হিসাবে কী করে মানব ভদ্রলোককে? কোথায় বা শিক্ষাবিদ সুনন্দ সান্যাল? তিনি তো শিক্ষার রাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ঝরঝরে হয়ে যাওয়া নিয়ে বরাবর সোচ্চার ছিলেন। প্রাথমিকে ইংরিজি না পড়তে পেরে যাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়েছে উনি বলতেন, তাদের ছেলেমেয়েরা একে অপরকে ধর্মের ভিত্তিতে চিনতে শিখুক — এই কি উনি চান? কোথায় কবীর সুমন যিনি বলেন মমতাদেবীর নামে মন্দির হবে? এই কি দেবীসুলভ কাজ?

পুনশ্চ: যাদের সাথে রাজনৈতিক লড়াইয়ে জেতার জন্যে মাননীয়া এই বিভাজন উস্কে দিচ্ছেন সেই সঙ্ঘ পরিবার এ খেলায় বিশ্বকাপের দাবিদার; মুখ্যমন্ত্রী তো সবে সন্তোষ ট্রফি খেলতে নেমেছেন। এখন মোহন ভ্যাগাবন্ড আসছে, এরপরে এ রাজ্যে ভোগী আদিত্যনাথ, শুঁড়ির সাক্ষী মহারাজও আসবে। এসে বঙ্গ ক্যালিফেট ইত্যাদি আষাঢ়ে গপ্প বলবে। সেই ঢপগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করার দায়িত্ব এতদ্বারা মুখ্যমন্ত্রীই নিয়ে নিয়েছেন। পারেন মাইরি! টিপু সুলতান মসজিদের একজন ইমাম আছেন তাই-ই জানতাম না ভাল করে। এখন দেখছি মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া ভাতায় বেশি খেয়ে তেনার এমন বদহজম হয়েছে যে নিজেকে দন্ডমুন্ডের কর্তা ভেবে বসেছেন।

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading