সাম্প্রদায়িক, অসাম্প্রদায়িক

সে তখন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুসলমান প্রধান এলাকার গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। চাকরিটা নিয়েছিল কলেজের চাকরি পাওয়া পর্যন্ত নমো নমো করে করবে বলে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ওকে এমনভাবে ভালবাসায় বেঁধেছে যে ও পড়েছে দোটানায়। আমাকে ফোন করার কারণ ঐ স্কুলের পরিচালন সমিতির দুর্নীতি। স্কুলের উন্নয়নের জন্য আসা সরকারী টাকা অন্য খাতে খরচা করা হচ্ছে। প্রধানশিক্ষক ভাল মানুষ, পণ্ডিত। কিন্তু ঐ গ্রামেরই বাসিন্দা। ফলে জলে থেকে কুমীরের সাথে বিবাদ করতে ভয় পান। সেই সুযোগে স্কুলের উন্নতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুনেছে আমি সাংবাদিক। তাই ফোন করেছে। যদি কাগজে এই দুর্নীতির খবর ছাপা যায়, দোষীদের শাস্তি হয়

৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২ এবং তারপরের কয়েকদিন এখনো ছবির মত মনে আছে। খুব চেনা কোন কোন মানুষের ভেতরের পশুকে সেই প্রথম দেখতে পেয়েছিলাম। আমার বয়স তখন দশ। বড় হওয়ার গতিটা ঐ বয়সে বাড়তে শুরু করে। বলা যায় ৯২-৯৩ সালের ঐ দিনগুলো সেই গতিটাকে কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
এর প্রায় ছবছর পরে, ২৬শে জুলাই, ১৯৯৮ আমি রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে ভর্তি হই। আবাসিক কলেজ হওয়াতে বাড়ি ছেড়ে নিজ দায়িত্বে থাকার সেই শুরু। তার আগে ধর্মের আমার জীবনে কোন দৈনন্দিন ভূমিকা ছিল না। বাবা নাস্তিক, মা আস্তিক হলেও নিয়মিত পূজার্চনার পাট ছিল না বাড়িতে। রামকৃষ্ণ মিশনের ধর্মীয় পরিবেশ যে আমার বিশেষ ভাল লাগত না তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু দেদার আড্ডা দেওয়ার সুযোগ সে অস্বস্তি ভুলিয়ে দিত। কিছুটা সেইজন্যেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে কলেজের তিনবছরও দিব্যি ওখানে কাটিয়ে দিয়েছি।
ঘটনাচক্রে বিদ্যামন্দিরে আমার পাঁচ বছর বিজেপি নেতৃত্বাধীন প্রথম এনডিএ সরকারের পাঁচ বছরের মধ্যেই পড়ে। সব ব্যাপারেই ধর্মের আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসা তখন শুরু হয়ে গেছে। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও ধর্ম নিয়ে, ধর্মের ঝান্ডাধরা রাজনীতি নিয়ে প্রচণ্ড তর্কবিতর্ক হত। অবশ্য তখন মতান্তর মানেই মনান্তর ছিল না। যা-ই হোক আমার এক সহপাঠী ছিল যে মুসলমানদের দুচক্ষে দেখতে পারত না। সে বাংলাদেশ থেকে তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসা হিন্দু। তাকে আমি এবং আরো কয়েকজন কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারতাম না যে তার মত অভিজ্ঞতা অনেক মুসলমানেরও বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। তার মানে যেমন সব হিন্দু খুনে নয়, তেমনি সব মুসলমানও তার পরিবারের উপর অত্যাচার করা লোকেদের মত নয়। সে কিছুতেই মানত না। সে ঘুরেফিরেই বলত “ওরা ঐরকমই”। ২০০৩ এ কলেজ ছাড়ার পর থেকে আর তার সাথে যোগাযোগ নেই।
২০১০ সালের এক সকাল। নাইট ডিউটি করে এসে আমার তখন মাঝরাত। হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল। আমার পেশায় এরকম হলে প্রথমেই লোকে ভাবে বসের ফোন। চাকরিটা গেছে হয়ত। আমি সেকথা ভেবেই ধড়মড়িয়ে উঠে ফোনটা ধরেছি। দেখি অজানা একটা নম্বর। বসের ফোন নয় যখন তখন কেটে দেব ভেবেছিলাম। তারপর মনে হল মিটিয়ে দেওয়াই ভাল, নইলে আবার করতে পারে। কথা বলতে গিয়ে দেখি এ আমার সেই বন্ধু।
আমার বন্ধু প্রতিবাদ করতে গিয়ে গালাগালি খেয়েছে ছাত্রছাত্রীদের সামনে। আমাদেরই কোন সহপাঠীর থেকে। সে তখন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুসলমান প্রধান এলাকার গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। চাকরিটা নিয়েছিল কলেজের চাকরি পাওয়া পর্যন্ত নমো নমো করে করবে বলে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ওকে এমনভাবে ভালবাসায় বেঁধেছে যে ও পড়েছে দোটানায়। আমাকে ফোন করার কারণ ঐ স্কুলের পরিচালন সমিতির দুর্নীতি। স্কুলের উন্নয়নের জন্য আসা সরকারী টাকা অন্য খাতে খরচা করা হচ্ছে। প্রধানশিক্ষক ভাল মানুষ, পণ্ডিত। কিন্তু ঐ গ্রামেরই বাসিন্দা। ফলে জলে থেকে কুমীরের সাথে বিবাদ করতে ভয় পান। সেই সুযোগে স্কুলের উন্নতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুনেছে আমি সাংবাদিক। তাই ফোন করেছে। যদি কাগজে এই দুর্নীতির খবর ছাপা যায়, দোষীদের শাস্তি হয়।
আমি তাকে বোঝালাম যে বহু গ্রামের স্কুলেই এই জিনিস ঘটে। ফলে বেশ বড় অংকের আর্থিক দুর্নীতি না হলে কাগজ ছাপতে রাজি হবে না। যদি হয়ও, শাস্তি দেওয়া তো কাগজের হাতে নয়। প্রশাসনিক নড়াচড়া না হলে দোষীদের রোষ এসে পড়বে ওরই উপরে। তাতে ওর ভীষণ বিপদ ঘটতে পারে। তাতে সে আমায় বলল “ঠিকই বলেছিস। কো এড স্কুল তো। কখন কি বদনাম দিয়ে দেবে! কিন্তু দুঃখটা কী জানিস তো? এই স্কুলের ছেলেমেয়েরা কি গরীব তুই ভাবতে পারবি না। এত গরীব আমি তুই চোখে দেখিনি। তাদের জন্য স্কুল। কত কষ্ট করে একটু লেখাপড়া করে এরা। অধিকাংশ মুসলমান আর কিছু আদিবাসী। এদের জন্য সরকারের স্কিম আছে। সেই টাকা ছোটলোকগুলো মেরে নিচ্ছে! আমার আর কি? নেট পাশ করে গেছি, বেশি পেছনে লাগলে চলে যাব। কিন্তু এই ছেলেমেয়েগুলোর কী হবে বল তো, প্রতীক?” আমি পরামর্শ দিলাম গোপনে ডি আই প্রমুখের সাথে যোগাযোগ করতে। বন্ধু বারবার বলে গেল ছেলেমেয়েগুলো কত কষ্ট করে, ঐ গ্রামের লোককে কি প্রচণ্ড পরিশ্রম করে বেঁচে থাকতে হয়। গ্রামের সরল সোজা মানুষের উপর মাতব্বররা কিভাবে ছড়ি ঘোরায় সেকথাও বলল। কিন্তু একবারও বলল না “মুসলমান তো। ওরা ঐরকমই।”
বন্ধুটি ধর্মান্ধ — এই ধারণা নিয়েই কলেজ ছেড়েছিলাম। সেদিন ভুল প্রমাণিত হলাম। সেই আনন্দে আমার সেই সকালে আর ঘুম এলো না

Author: Pratik

সাংবাদিক, লেখক। কাজ করেছেন দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ডেকান ক্রনিকল, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য স্টেটসম্যান এবং অধুনালুপ্ত দ্য বেঙ্গল পোস্টে। বর্তমানে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও কাগজে লেখালিখি করেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ছয়।

Leave a Reply

Discover more from amarlikhon

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading