সাচ্চা মুসলমান

কোন বন্ধুর সাথে আড্ডা মারার সময়ে, কোন স্যারের ক্লাস করার সময়ে, কোন ক্রিকেটারের নৈপুণ্যে মুগ্ধ হওয়ার সময়ে আমি সতর্ক হয়ে তাঁদের মুসলমানত্ব খেয়াল করিনি কারণ তাঁরা আমার হিন্দুত্ব সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন না। সরস্বতীপুজোর দিন আমি আর আমার বন্ধু মন দিয়ে খিচুড়ি আর ঘ্যাঁট সাঁটাচ্ছিলাম। ও মুসলমান হয়ে এই প্রসাদ খেয়ে ইসলামবিরোধী কাজ করছে কিনা এই গুরুতর সমস্যাটা নিয়ে আমাদের ভেবে দেখার সময় হয়নি

মহম্মদ শামির বউ কেন হিজাব ব্যবহার করেন না? মীর কেন সপরিবারে বড়দিন পালন করেন এবং অন্যদের শুভেচ্ছা জানান? এসব তো সাচ্চা মুসলমানের কাজ নয়।
এইসব কথাবার্তা শুনে যা বুঝছি, বহু মুসলমান বন্ধুর সাথে মেশা সত্ত্বেও, বহু মুসলমান মাস্টারমশাইয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও, বহু মুসলমান অভিনেত্রীর প্রেমে পড়া সত্ত্বেও, বহু মুসলমান ক্রিকেটারের খেলা দেখা এবং প্রতিবেদন লেখায় যুক্ত থাকা সত্ত্বেও, মুসলমান কবিদের কবিতা পড়ে পাগল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এখন অব্দি একজনও সাচ্চা মুসলমানকে আমি চিনি না। অবশ্য আমার দিক থেকে একটা বড় ভুল হয়েছে। কোন বন্ধুর সাথে আড্ডা মারার সময়ে, কোন স্যারের ক্লাস করার সময়ে, কোন ক্রিকেটারের নৈপুণ্যে মুগ্ধ হওয়ার সময়ে আমি সতর্ক হয়ে তাঁদের মুসলমানত্ব খেয়াল করিনি কারণ তাঁরা আমার হিন্দুত্ব সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন না। সরস্বতীপুজোর দিন আমি আর আমার বন্ধু মন দিয়ে খিচুড়ি আর ঘ্যাঁট সাঁটাচ্ছিলাম। ও মুসলমান হয়ে এই প্রসাদ খেয়ে ইসলামবিরোধী কাজ করছে কিনা এই গুরুতর সমস্যাটা নিয়ে আমাদের ভেবে দেখার সময় হয়নি।
ম্যাকবেথ পড়ানোর সময়ে আমাদের মাস্টারমশাই শেক্সপিয়ারেই বুঁদ ছিলেন, আমার গায়ে পৈতে আছে কিনা সে ভাবনা ওঁর মাথায় আসেনি। আমিও ওঁর কন্ঠে উচ্চাকাঙ্ক্ষায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলা একজন মানুষকেই খুঁজছিলাম। তিনি দিনে পাঁচবার নমাজ পড়েন কিনা এ প্রশ্নটা আমার মনে জাগেনি।
কি অদ্ভুতই না হত যদি ওয়াহিদা রহমান বোরখায় ঢেকে রাখতেন ঐ রহস্যময় সৌন্দর্য! কোন গীতিকারের মনেই আসত না পূর্ণিমার চাঁদের সংগে তাঁর তুলনা চলে। একবার ভাবুন, মহম্মদ রফি গানটা গাইতে গিয়ে যদি বলে উঠতেন “বলি হচ্ছেটা কী? ওয়াহিদার তো পর্দার নীচে থাকা উচিৎ। তার বদলে এসব কী ধ্যাষ্টামো? এই যে ভাই শাকিল, বলি তোমার কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই? নিজে মুসলমান হয়ে আরেকজন মুসলমান মহিলাকে নিয়ে এইসব গান লিখেছ? বলি নবীকে কী জবাব দেবে ভেবেছ?”
কান্ডটা সত্যিই ঘটলে আমি অন্তত কিছুটা দরিদ্র হয়ে থাকতাম। আমার বউ যখন রেগে যায় তখন তাকে মানানোর জন্যে যে যে গান বেসুরো গলায় গাই তা থেকে একটা কম পড়ে যেত। তা এই রফি সাহেব, ওয়াহিদা আর গীতিকার শাকিল বাদাউনি দেখছি সাচ্চা মুসলমান নন। নির্দেশক মহম্মদ সাদিক তো কাফের টাফের হবেন বোধহয়।
মধ্য কলকাতার এক বারে ভাল চিলি পর্ক পাওয়া যায়। আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে ঐ অপূর্ব জিনিসটি যিনি প্রথমবার খাইয়েছিলেন তাঁকেও দেখছি সাচ্চা মুসলমান বলা চলে না, যদিও ইসলাম ধর্ম নিয়ে তাঁর অনেক পড়াশোনা।
যা-ই হোক আমার জীবনে এরকম মেকি মুসলমানদের যা অবদান তাতে এদের সাচ্চাই নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না। গন্ডগোল পাকালেন আরেক মুসলমান। কাজী নজরুল নামের এই ভদ্রলোক বেশকিছু রসোত্তীর্ণ শ্যামাসংগীত লিখে বসে আছেন। অতএব এনাকেও ঐ মেকিদের দলেই ধরেছিলাম। তারপর দেখি ও বাবা! “ক্ষমা কর হজরত” বলে একখানা কবিতাও লিখেছেন। সে কবিতাটা পড়লে কেমন যেন যারা শামি আর মীরের পেছনে লেগেছে তাদেরকেই মেকি মুসলমান বলে মনে হচ্ছে যে! কি বিপদ!
তারপর ভাবলাম, যাকগে! এসব ওদের ধর্মের ব্যাপার। হিন্দুরা কিন্তু এরকম গোলমেলে নয়। হিন্দুরা ভীষণ উদার। এই যে সবাই মিলে চার হাত পা তুলে সান্টাক্লসের টুপি মাথায় দিয়ে বড়দিন পালন করছে, এতে একজনও কিছু বলেছে? বলেনি তো। এই ভেবে একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে গিয়ে বিষম টিষম খেয়ে একাক্কার।
আসলে ফোনে ফেসবুকটা খোলা ছিল। এক বন্ধুর ওয়ালে দেখলাম কোন অভিনেত্রী নাকি টিভি সিরিয়ালে পার্বতী সাজে। সে বেড়াতে গিয়ে কেন বিকিনি পরেছে তাই নিয়ে বহু হিন্দু গোঁসা করেছে। তারপর দেখি সঈফ-করিনা কেন ছেলের নাম তৈমুর রেখেছে তা নিয়ে অনেক হিন্দুর অনেক বক্তব্য। কয়েকটি বরাহনন্দন আবার ঐ দুধের শিশুর ক্যান্সার কামনা করেছে। তারপরে আরো দেখলাম ইরফান পাঠানের ছেলে হওয়ায় কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছে “ভাই, ছেলের নাম কিন্তু দাউদ বা ইয়াকুব রেখো না।”
গর্বে বুকটা ফুলে উঠল, চোখে জল এসে গেল। বুঝলাম সব ধর্মের ইতরদের শ্রেষ্ঠ মিলনতীর্থ আমাদের এই ভারতবর্ষ। সম্যক বুঝলাম রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, নেহরু, আম্বেদকর, মৌলানা আজাদ — সব্বাই ভুল। সবার উপরে ডি এল রায় সত্য তাহার উপরে নাই। “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।”

যারা ইতিহাস বিস্মৃত হয়

যদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা আলাদা করে বলেন তাহলে বলি ভারতবর্ষে ঐ অপরাধে কঠোর শাস্তি কারোরই হয় না। উল্টে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোক হলে নায়ক হয়ে যাওয়া যায়, মন্ত্রীও হওয়া যায়। বলুন তো বাল ঠাকরে শিয়া না সুন্নি? বাবু বজরংগি কি মুসলমান? মায়া কোদনানি? জগদীশ টাইটলার? সজ্জন কুমার? লালকৃষ্ণ আদবানি? উমা ভারতী?

আমি হিন্দু। কিন্তু আমি আজহারের ব্যাটিং দারুণ ভালবাসতাম। ও ফিক্সিং করেছে শুনে ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলাম। মহম্মদ রফি আমার খুব ভাল লাগে, অনেকসময় কিশোরের চেয়েও বেশি। বিরিয়ানি আমার সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য। আমার অনেক মুসলমান বন্ধু আছে। অতএব প্রমাণিত হল যে আমি সাম্প্রদায়িক নই। সুতরাং আমি একথা বলতেই পারি যে আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকে সব রাজনৈতিক দলই সংখ্যালঘু তোষণ করে এসেছে। সবেতেই ওদের বেশি সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে, ওদের দোষগুলো সব ঢেকে রাখা হয়। এখনো ওরা যা ইচ্ছে মারদাঙ্গা করে, তাতে দোষ হয় না। মিডিয়া পর্যন্ত ওদের দোষ চেপে দেয়।

উপর্যুক্ত কথাগুলো যদি আপনার মনের কথা হয় তাহলে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি মোটেই অসাম্প্রদায়িক নন। বরং আপনি যুক্তি বা তথ্যের ধার না ধারা একজন মানুষ যিনি আবেগ দিয়ে সবকিছু বিচার করেন। আর্থসামাজিক মানদন্ডগুলোর প্রায় সবকটাতে মুসলমান সম্প্রদায় দেশের সবথেকে পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়। সরকারী চাকরিতেও। আমি বলছি না। ভারতের একমাত্র প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ পার্টির মন্ত্রী সংসদে বলেছেন। এই দেখুন https://www.google.co.in/…/muslim-working-proportion…/lite/…

এই যখন ঘটনা তখন সংখ্যালঘু তোষণটা হল কখন আর তার সুবিধাটা পেল কে?
এই যে বলছেন ওরা মারদাঙ্গা করলে কোন দোষ হয় না সেই নিয়েও বলা যাক তাহলে। ২০০১ এর জনগণনা অনুযায়ী আমাদের জনসংখ্যার ১৩% মুসলমান অথচ ঐসময়ে বিভিন্ন জেলে বন্দী ছিল যারা তাদের ২২% মুসলমান। নিজেই পড়ে দেখুন http://m.timesofindia.com/…/Muslim…/articleshow/45253329.cms

যদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা আলাদা করে বলেন তাহলে বলি ভারতবর্ষে ঐ অপরাধে কঠোর শাস্তি কারোরই হয় না। উল্টে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের লোক হলে নায়ক হয়ে যাওয়া যায়, মন্ত্রীও হওয়া যায়। বলুন তো বাল ঠাকরে শিয়া না সুন্নি? বাবু বজরংগি কি মুসলমান? মায়া কোদনানি? জগদীশ টাইটলার? সজ্জন কুমার? লালকৃষ্ণ আদবানি? উমা ভারতী?

এবার আসুন মিডিয়ার কথায়। প্রথমত মিডিয়া কোন একটি সংস্থা নয়। প্রত্যেক মিডিয়া হাউসের নিজস্ব মতামত, কার্যপদ্ধতি, স্বার্থ আছে। সকলেই সেই অনুযায়ী খবর পরিবেশন করে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে সেটাকেই বোঝায়। ফলে খবরের সত্যতা যাচাই না করে যা ইচ্ছে লিখে, দেখিয়ে বাজার গরম করে এমন কাগজ এবং চ্যানেল যেমন আছে তেমনি দায়িত্বশীল গণমাধ্যমও আছে। ভারতীয় সাংবাদিকতার যে অবনমন হয়েছে তা নিয়ে আজ কোন ঢাকঢাক গুড়গুড় নেই। তবু এখনো প্রায় সব কাগজ বা টিভি চ্যানেলই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ক্ষেত্রে কয়েকটা নিয়ম মেনে চলে। যেমন কোন সম্প্রদায়ের লোক কোন সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ করেছে তা উল্লেখ না করা, কাদের বেশি ক্ষয়ক্ষতি, কাদের কম এসব আলোচনা না করা, সর্বোপরি ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি না হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ পরিস্থিতি যতক্ষণ না প্রশাসনের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে ততক্ষণ তেমনভাবে রিপোর্টই না করা। কারণ দেখা গেছে তাতে উত্তেজনা নতুন নতুন এলাকায় ছড়ায় এবং দাঙ্গাবাজদের কাজ সহজ হয়। আজকাল অবশ্য অনেকেই মনে করছেন সোশাল মিডিয়ার এই যুগে এই পদ্ধতি অচল। এতে বরং যা নয় তাই গুজব ছড়ানোর ফাঁকা ময়দান তৈরি হয়। এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। কিন্তু মনে রাখবেন মিডিয়া দেখাচ্ছে না মানে কিন্তু শুধু সংখ্যালঘু নয়, সংখ্যাগুরুদের কুকর্মগুলোও চাপা পড়ে থাকছে। আপনি হোয়াটস্যাপে যে ভিডিওটা দেখে লাফাচ্ছেন সেটাই একমাত্র সত্য নয়।
এত কথা বলছি মানে যে আমি আপনাকে দাঙ্গাবাজ বলছি তা নয়। এমন হতেই পারে যে আপনি যা বলছেন সরল বিশ্বাস থেকেই বলছেন। মানে আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে কথাগুলো সাম্প্রদায়িক নয়। আমি আপনার সেই বিশ্বাসটাকেই প্রশ্ন করছি। ভেবে দেখুন তো আপনি সেই জার্মানদের মত হয়ে যাচ্ছেন না তো যারা নাজিদের এই প্রোপাগান্ডায় বিশ্বাস করেছিল যে ইহুদীরাই জার্মানির সমস্ত দুর্দশার কারণ? তারপর কী হয়েছিল সেটা ইতিহাস। রক্তাক্ত, লজ্জাকর ইতিহাস। সে ইতিহাস ভুলে যাচ্ছেন না তো? জার্মান ভাষায় একটা প্রবাদ আছে “যারা ইতিহাস বিস্মৃত হয়, তারা অভিশপ্ত। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি তারা করবেই।”

সাম্প্রদায়িক, অসাম্প্রদায়িক

সে তখন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুসলমান প্রধান এলাকার গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। চাকরিটা নিয়েছিল কলেজের চাকরি পাওয়া পর্যন্ত নমো নমো করে করবে বলে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ওকে এমনভাবে ভালবাসায় বেঁধেছে যে ও পড়েছে দোটানায়। আমাকে ফোন করার কারণ ঐ স্কুলের পরিচালন সমিতির দুর্নীতি। স্কুলের উন্নয়নের জন্য আসা সরকারী টাকা অন্য খাতে খরচা করা হচ্ছে। প্রধানশিক্ষক ভাল মানুষ, পণ্ডিত। কিন্তু ঐ গ্রামেরই বাসিন্দা। ফলে জলে থেকে কুমীরের সাথে বিবাদ করতে ভয় পান। সেই সুযোগে স্কুলের উন্নতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুনেছে আমি সাংবাদিক। তাই ফোন করেছে। যদি কাগজে এই দুর্নীতির খবর ছাপা যায়, দোষীদের শাস্তি হয়

৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২ এবং তারপরের কয়েকদিন এখনো ছবির মত মনে আছে। খুব চেনা কোন কোন মানুষের ভেতরের পশুকে সেই প্রথম দেখতে পেয়েছিলাম। আমার বয়স তখন দশ। বড় হওয়ার গতিটা ঐ বয়সে বাড়তে শুরু করে। বলা যায় ৯২-৯৩ সালের ঐ দিনগুলো সেই গতিটাকে কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
এর প্রায় ছবছর পরে, ২৬শে জুলাই, ১৯৯৮ আমি রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরে ভর্তি হই। আবাসিক কলেজ হওয়াতে বাড়ি ছেড়ে নিজ দায়িত্বে থাকার সেই শুরু। তার আগে ধর্মের আমার জীবনে কোন দৈনন্দিন ভূমিকা ছিল না। বাবা নাস্তিক, মা আস্তিক হলেও নিয়মিত পূজার্চনার পাট ছিল না বাড়িতে। রামকৃষ্ণ মিশনের ধর্মীয় পরিবেশ যে আমার বিশেষ ভাল লাগত না তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু দেদার আড্ডা দেওয়ার সুযোগ সে অস্বস্তি ভুলিয়ে দিত। কিছুটা সেইজন্যেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে কলেজের তিনবছরও দিব্যি ওখানে কাটিয়ে দিয়েছি।
ঘটনাচক্রে বিদ্যামন্দিরে আমার পাঁচ বছর বিজেপি নেতৃত্বাধীন প্রথম এনডিএ সরকারের পাঁচ বছরের মধ্যেই পড়ে। সব ব্যাপারেই ধর্মের আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসা তখন শুরু হয়ে গেছে। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও ধর্ম নিয়ে, ধর্মের ঝান্ডাধরা রাজনীতি নিয়ে প্রচণ্ড তর্কবিতর্ক হত। অবশ্য তখন মতান্তর মানেই মনান্তর ছিল না। যা-ই হোক আমার এক সহপাঠী ছিল যে মুসলমানদের দুচক্ষে দেখতে পারত না। সে বাংলাদেশ থেকে তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসা হিন্দু। তাকে আমি এবং আরো কয়েকজন কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারতাম না যে তার মত অভিজ্ঞতা অনেক মুসলমানেরও বিভিন্ন সময়ে হয়েছে। তার মানে যেমন সব হিন্দু খুনে নয়, তেমনি সব মুসলমানও তার পরিবারের উপর অত্যাচার করা লোকেদের মত নয়। সে কিছুতেই মানত না। সে ঘুরেফিরেই বলত “ওরা ঐরকমই”। ২০০৩ এ কলেজ ছাড়ার পর থেকে আর তার সাথে যোগাযোগ নেই।
২০১০ সালের এক সকাল। নাইট ডিউটি করে এসে আমার তখন মাঝরাত। হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল। আমার পেশায় এরকম হলে প্রথমেই লোকে ভাবে বসের ফোন। চাকরিটা গেছে হয়ত। আমি সেকথা ভেবেই ধড়মড়িয়ে উঠে ফোনটা ধরেছি। দেখি অজানা একটা নম্বর। বসের ফোন নয় যখন তখন কেটে দেব ভেবেছিলাম। তারপর মনে হল মিটিয়ে দেওয়াই ভাল, নইলে আবার করতে পারে। কথা বলতে গিয়ে দেখি এ আমার সেই বন্ধু।
আমার বন্ধু প্রতিবাদ করতে গিয়ে গালাগালি খেয়েছে ছাত্রছাত্রীদের সামনে। আমাদেরই কোন সহপাঠীর থেকে। সে তখন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুসলমান প্রধান এলাকার গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। চাকরিটা নিয়েছিল কলেজের চাকরি পাওয়া পর্যন্ত নমো নমো করে করবে বলে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা ওকে এমনভাবে ভালবাসায় বেঁধেছে যে ও পড়েছে দোটানায়। আমাকে ফোন করার কারণ ঐ স্কুলের পরিচালন সমিতির দুর্নীতি। স্কুলের উন্নয়নের জন্য আসা সরকারী টাকা অন্য খাতে খরচা করা হচ্ছে। প্রধানশিক্ষক ভাল মানুষ, পণ্ডিত। কিন্তু ঐ গ্রামেরই বাসিন্দা। ফলে জলে থেকে কুমীরের সাথে বিবাদ করতে ভয় পান। সেই সুযোগে স্কুলের উন্নতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুনেছে আমি সাংবাদিক। তাই ফোন করেছে। যদি কাগজে এই দুর্নীতির খবর ছাপা যায়, দোষীদের শাস্তি হয়।
আমি তাকে বোঝালাম যে বহু গ্রামের স্কুলেই এই জিনিস ঘটে। ফলে বেশ বড় অংকের আর্থিক দুর্নীতি না হলে কাগজ ছাপতে রাজি হবে না। যদি হয়ও, শাস্তি দেওয়া তো কাগজের হাতে নয়। প্রশাসনিক নড়াচড়া না হলে দোষীদের রোষ এসে পড়বে ওরই উপরে। তাতে ওর ভীষণ বিপদ ঘটতে পারে। তাতে সে আমায় বলল “ঠিকই বলেছিস। কো এড স্কুল তো। কখন কি বদনাম দিয়ে দেবে! কিন্তু দুঃখটা কী জানিস তো? এই স্কুলের ছেলেমেয়েরা কি গরীব তুই ভাবতে পারবি না। এত গরীব আমি তুই চোখে দেখিনি। তাদের জন্য স্কুল। কত কষ্ট করে একটু লেখাপড়া করে এরা। অধিকাংশ মুসলমান আর কিছু আদিবাসী। এদের জন্য সরকারের স্কিম আছে। সেই টাকা ছোটলোকগুলো মেরে নিচ্ছে! আমার আর কি? নেট পাশ করে গেছি, বেশি পেছনে লাগলে চলে যাব। কিন্তু এই ছেলেমেয়েগুলোর কী হবে বল তো, প্রতীক?” আমি পরামর্শ দিলাম গোপনে ডি আই প্রমুখের সাথে যোগাযোগ করতে। বন্ধু বারবার বলে গেল ছেলেমেয়েগুলো কত কষ্ট করে, ঐ গ্রামের লোককে কি প্রচণ্ড পরিশ্রম করে বেঁচে থাকতে হয়। গ্রামের সরল সোজা মানুষের উপর মাতব্বররা কিভাবে ছড়ি ঘোরায় সেকথাও বলল। কিন্তু একবারও বলল না “মুসলমান তো। ওরা ঐরকমই।”
বন্ধুটি ধর্মান্ধ — এই ধারণা নিয়েই কলেজ ছেড়েছিলাম। সেদিন ভুল প্রমাণিত হলাম। সেই আনন্দে আমার সেই সকালে আর ঘুম এলো না

%d bloggers like this: